ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ দুপুর বেলার অক্ত,
বৃষ্টি নামে বৃষ্টি কোথায়? বরকতেরই রক্ত।
(একুশের কবিতা : আল মাহমুদ)

বরকত কে? বরকত হচ্ছেন আমাদের জাতীয় প্রেরণার উৎস। আমরা যে বাংলাদেশ নামের দেশে বাস করি এ মাটি যার রক্তে ভাষার প্রশ্নে প্রথমবার ভিজে উঠেছিল বরকত ছিলেন তিনি। বরকতের জন্ম কিন্তু বাংলাদেশে নয়, অনেক অনেক দূরে। ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায়। ভারত পাকিস্তান ভাগ হলে বরকত চাইলেন তার স্বপ্নের দেশ পাকিস্তানে যেতে। কিন্তু মা রাজি হলেন না। রাজি না হলে কী হবে?
উচ্চ মাধ্যমিকের পর ঠিকই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে গেলেন বরকত। অগত্যা মাকে ছেড়ে পাড়ি জমালেন ঢাকায়। একা, শহীদ বরকত সম্ভবত ভাষা আন্দোলনে একমাত্র শহীদ যার নাগরিকত্ব পাকিস্তানের ছিলো না। স্বপ্নের দেশ পাকিস্তানে এসেছিলেন আটচল্লিশে। বাহান্নর টগবগে যুবক বরকত ‘বাংলা চাই’ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। যে পাকিস্তানকে ভালোবেসে তিনি ভারত ছেড়েছিলেন, সে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নির্মম বুলেটে তার জীবন যাবে ভাবতেও পারেননি। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে বরকত একহাতে কয়েকটা পোস্টার আরেক হাতে গাম নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছিলেন। কেন এমন তাড়াহুড়ো- জানতে চাইলে বরকতের জবাব ছিলো, এই কয়টা পোস্টার, এই বেলা লাগিয়ে নিই কাজে লাগবে। কে জানতো? এই বরকত একটু পরেই শহীদ হয়ে যাবেন? কে জানতো বরকতের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে যাবে বাংলা ভাষা। বরকতের শাহাদাতের ঘটনা বলার আগে প্রেক্ষাপট একটু বলে নিই।
‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়।’
(আব্দুল লতিফ)
আমরা যে ভাষায় লিখি, এই ভাষা কেড়ে নিতে চাইছিলো উর্দুভাষী শাসকগোষ্ঠী। তারা মনে করতো উর্দু যেহেতু ভারতীয় ইসলামী সংস্কৃতিতে বড় অবদান রেখেছে সুতরাং পুরো পাকিস্তান তো বটেই, সমগ্র মুসলিম জাতির ভাষা হবে উর্দু। তাদের এই হঠকারী ভাবনা বাঙালি মুসলমান মেনে নিলো না। তাদের এই অজুহাত ছিলো ঠুনকো। খোদ বর্তমান পাকিস্তানেই পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতু, ব্রাহুই ইত্যাদি ভাষার মানুষেরা তাদের ভাষাকে যৌথ রাষ্ট্রভাষার দাবি জানাচ্ছে। বলা চলে এখনো পাস্তিানের সকল মানুষের ভাষা উর্দু হয়ে ওঠেনি। সেখানে সাতচল্লিশের পর পুরো বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা এক ধরনের বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। প্রথমে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ডাকটিকিট-মুদ্রা সব কিছু উর্দুতে লিখে উর্দুর আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা চালায়। শাসকরা ঘোষণা দেয় উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই কথার মাধ্যমে তারা মূলত সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে। বাঙালিকে নৃতাত্ত্বিক ক্ষুদ্রগোষ্ঠী বানানোর পাঁয়তারা করে। ফলে ফুঁসে ওঠে বাঙালিরা। এরই মধ্যে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নাজিমুদ্দিন বাঙালিদের বুকের ওপর ঢাকায় বসে ঘোষণা দেন- ‘একমাত্র উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হবে পাকিস্তানের?’ না না শব্দে কেঁপে ওঠে সমাবেশস্থল। সাতচল্লিশে যে মানুষগুলো নিজেদের মা-বাবা-ভাই-বোনকে হারিয়েছে পাকিস্তান নামের প্রিয় ভূমির জন্য, সে মানুষগুলোর ভাষাকে তুচ্ছ বলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চায় পাকিস্তানি শাসকরা। আগুনের লেলিহান শিখায় দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে বাঙালি।
ক্ষোভে ফেটে পড়ে জনতা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে যে মানপত্র দেয়া হয় তাতে স্পষ্ট করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা বানানোর দাবি জানানো হয়। মানপত্র পাঠ করেন তৎকালীন ডাকসুর জিএস গোলাম আযম।
তিনি তাতে বলেন, We have accepted Urdu as our Lingua Franca but we also feel very strongly that Bengali, by virtue of its being the official language of the premier province and also the language of the 62% of the population of the state, should be given its rightful place as one of the state languages together with Urdu.
Otherwise we in East Pakistan shall always be under a permanent handicap and disadvantage. Thus alone we shall have full scope of development and forge closer offinity with our brethren of the other part and march forward hand in hand.

‘আমরা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণ করতে পারি, কিন্তু বাংলার ব্যাপারে আমাদের শক্তিশালী অবস্থান জানাচ্ছি। যেহেতু শতকরা ৬২ ভাগ পাকিস্তানি বাংলায় কথা বলে, সেহেতু উর্দুর সাথে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া উচিত। তাহলেই আমরা একসাথে হাতে হাত মিলিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো।’ (২৭ নভেম্বর ১৯৪৮, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজি মানপত্রের ভাষা সংক্রান্ত অংশের ভাষান্তর। -লেখক।)
এরপর লিয়াকত আলী খান সুকৌশলে তার ভাষণে ভাষা সংক্রান্ত বক্তব্য এড়িয়ে যান। ধীরে ধীরে সময় গড়িয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে বাহান্নর সেই-দিন।
আমরা আবার বরকতের শাহাদাতের ঘটনায় ফিরে আসি। যেদিন ঢাকা হয়ে উঠেছিল রক্তিম। আল মাহমুদের ভাষায়-
‘হাজার যুগের সূর্যতাপে জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে!’
আমরা লেখার প্রথমেই একটা দৃশ্যপট দিয়ে শুরু করেছিলাম। বরকত পোস্টার নিয়ে ছোটাছুটি করছিলেন আর বলছিলেন আর কয়টা পোস্টার আছে, লাগিয়ে নিই। মধুদার ক্যান্টিনের সামনে মোহাম্মদ সুলতানের সাথে এ-ই ছিল তার শেষ কথা। তারপর এলো বিভীষিকাময় দুপুর। চলো আমরা সেই দুপুরে ফিরে যাই।
আগের দিনই ছাত্র-জনতা ডাক দেয় বিক্ষোভের, পূর্বনির্ধারিত বিক্ষোভের স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙে ফেললে শুরু হয় এলোপাথাড়ি গুলি। প্রত্যক্ষদর্শী বলছেন, ‘বরকতকে দেখলাম হাওয়াই শার্ট আর চপ্পল পায়ে এগিয়ে আসছেন। এর মধ্যেই হঠাৎ গুলি। ঢলে পড়লেন বরকত, আমরা দৌড়ে গেলাম। বরকত পানি পানি বলে চিৎকার দিলেন। পানি কোথায় পাই, টিয়ার শেলের ঝাঁঝ থেকে বাঁচতে যে কাপড় ভিজিয়ে ব্যবহার করলাম সে কাপড় তার মুখে গুঁজে দিলাম।
(অজ্ঞাত প্রত্যক্ষদর্শী)
তারপরের ঘটনা আমরা বর্ণনা না করে চিত্রকর মুর্তজা বশীরের মুখ থেকে শুনি-
‘মেডিক্যালের দক্ষিণ দিকে যে প্রাচীর, ওখানে একটা চলন্ত জটলা। আমি দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখলাম শ্যামলা বর্ণ একটু লম্বা মুখে বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঘাম, পেটের নিচ দিয়ে কল খুলে দিলে যেমন পানি পড়ে তেমন রক্ত। কাটা মুরগির মতো চিৎকার করছে- ‘পানি পানি’। আমিসহ আরো কয়েকজন ধরেছি, আমি শারীরিক দিক দিয়ে একটু খাটো, আমার মাথা তার মুখের কাছে। হাতে রুমাল দিলো টিয়ার গ্যাস থেকে বাঁচার জন্য। তার জিভ নাড়া দেখে তার মুখে নিংড়ে দিলাম। তিনি বললেন, আমার বাড়িতে খবর দিবেন। আমার নাম আবুল বরকত। বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন। পল্টন লাইনে। তারপর তাকে ধরে আমরা এমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলাম …।’
মুর্তজা বশীরের কথায় আমরা বরকতের একদম শেষ মুহূর্তের কথাগুলো কেমন জীবন্ত হয়ে উঠছে, যেন এক্ষুনি শুনতে পাচ্ছি।
জরুরি বিভাগের তৎকালীন ডাক্তার মুহাম্মদ মাহফুজ হোসেন বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি দুপুরে গুলিবিদ্ধ তিনজনকে হাসপাতালে গ্রহণ করি। কপালে গুলিবিদ্ধ রফিককে দেখেই মৃত ঘোষণা করা হয়। আর ঊরুতে গুলিবিদ্ধ বরকত মারা যান রাতে। আমার চোখের সামনে।’
বরকতের সাথে সেদিন শহীদ হয়েছেন আরো অনেকে। সালাম-বরকত রফিক ছাড়াও একটি শিশুকেও হত্যা করা হয়েছে সেদিন। জনসমাবেশের ওপর গাড়ি তুলে দিতেও দ্বিধা করেনি তারা। গাড়ির চাপায় মারা পড়ে অহিউল্লাহ নামে ৯ বছরের শিশু।
পরেরদিন সামরিক জান্তা খুন করে শফিউরকে আর জব্বারকে। বলা চলে বাহান্নর ফেব্রুয়ারিতে বাংলার দাবিতে যে স্ফুলিঙ্গ উঠেছিল তা থামাতে উন্মত্ত হয়ে ওঠে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। তাদের এ উন্মত্ততা দেশভাগে বড় ভূমিকা রেখেছে। নিঃশেষে দেশের মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোয় নেমে আসে ছাত্র-জনতা-শ্রমিক। শুরু হয় অগ্নিগর্ভ আন্দোলন। আন্দোলনের লেলিহানে পুড়তে থাকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর তাসের মসনদ।
তোমরা যারা ছোট তারা এই আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিতে পারো। বরকত জব্বারদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারো। আগামীর দিন তো তোমাদেরই… তোমরা যখন ২০১৮তে নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করেছিলে তখন দেশ মেরামতের দাবি তুলেছিলে। দেশ মেরামত তো সেদিন হবে যেদিন এ দেশের বুকে আর ছাত্রদের বুকের ওপর গুলি চলবে না। তোমরা সেদিন পর্যন্ত থেমো না যতদিন বরকতদের রক্তে রাজপথ ভিজে পিচ্ছিল হয়ে থাকে। তোমাদের হাতে উড্ডীন হবে নতুন কোনো অভ্যুত্থানের পতাকা।
এ দেশ ভাঙতে ভাঙতে গড়েছে। এ দেশ শহীদদের চেতনার ওপর দাঁড়িয়েছে ভিসুভিয়াসের অগ্নির মতো। একুশে ফেব্রুয়ারির পর পর দু’টি শহীদ মিনার গড়া হয়। বুলডোজার দিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তা গুঁড়িয়ে দেয়। কিন্তু এ দেশের মানুষের বুকের ভেতর যে স্মৃতির মিনার গড়ে ওঠে তা কি কখনো ভাঙতে পেরেছে শাসকগোষ্ঠী?
তোমরা যারা নবম-দশম একাদশে পড়ছো, তারা নিশ্চয়ই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রেইনকোট গল্পটি পাঠ্যবইয়ে পড়েছ। দেখবে সেখানে শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনার কথা পাবে। সেখানে পাবে একুশ কিভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের রোডম্যাপ এঁকে দিয়েছিলো- তাও। একুশ মানে মাথা নত না করা, দেখো এই যে শহীদ দিবসে কতো মানুষ খালি পায় এগিয়ে যাচ্ছেন পিল পিল করে শহীদ মিনারের পথে।
কবি আল মাহমুদ এই মিছিলকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,
‘প্রভাতফেরি, প্রভাতফেরি আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, আমি জন্মেছি এই বঙ্গে।’
এসো, শুধু ফেব্রুয়ারি মাস জুড়েই নয়, সারা বছর বাংলা ভাষার প্রতি নিজেদের শ্রদ্ধা ভালোবাসা জিইয়ে রাখি।

Share.

মন্তব্য করুন