বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। মায়ের কোলে আদরে যত্নে বড় হতে হতে তাঁর মুখে শুনে শুনে আমরা এই ভাষা শিখেছি। মনের ভাব প্রকাশ করতে মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তু নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করে থাকে।
এই বিশাল দুনিয়ার মানুষও বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকের পরিসংখ্যান অনুসারে, এই পৃথিবীতে ৬ হাজার ৯ শ’ ৯টি ভাষা আছে। এই হিসাব অবশ্য ২০০৯ সালে করা তাদের জরিপ অনুসারে। সে যাই হোক, আজকের আলোচনার বিষয় আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। যত হাজার ভাষাই পৃথিবীতে থাকুক না কেন আমরা বাংলা ভাষা না জানলে সেই সব ভাষা শিখতে পারবো না। বুঝতে পারবো না। তাই সবার আগে নিজের মাতৃভাষা বাংলাকে জানতে হবে। তারপর জীবনের নানান প্রয়োজনে আমরা ইংরেজি, আরবি, হিন্দি এমনকি বাণিজ্যিক কারণে অনেকে চীনের জটিল ও কঠিন ভাষায়ও শিখেছে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আমাদের জন্য আল্লাহর দেয়া অন্যতম সেরা উপহার। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনের সূরা আর রহমানে বলেছেন, ‘মেহেরবান আল্লাহ কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তাকে ভাষা শিখিয়েছেন।’ তিনি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন ভাষা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আমাদের দিয়েছেন বাংলা ভাষা। শুধু আমরা বাংলাদেশিরাই নই সারা দুনিয়ার ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। এদের মধ্যে ২৬ কোটিরও বেশি বাংলা ভাষাভাষীর বসবাস বাংলাদেশ ও ভারতে। বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী বাকি ৪ কোটিরও বেশি মানুষ ছড়িয়ে আছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। পাকিস্তানের করাচিতে প্রায় ২১ লাখ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। করাচি সিটি করপোরেশনের অন্যতম দাফতরিক ভাষাও বাংলা। যুক্তরাজ্যে স্বীকৃত পঞ্চম অভিবাসী ভাষা বাংলা। সেখানে প্রায় ৮ লাখ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলেন। মধ্যপ্রাচ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রেও আছেন প্রচুর পরিমাণ বাঙালি অভিবাসী। এশিয়া, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকাসহ সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে আছে বাংলা ভাষায় কথা বলা বাঙালি। সিয়েরালিওনেরও অন্যতম দাফতরিক ভাষা বাংলা।
বাংলাপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, উদ্ভবের সময় থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাকে তিনটি ঐতিহাসিক পর্যায়ে ভাগ করে দেখা হয়: প্রাচীন বাংলা (৯০০/১০০০-১৩৫০), মধ্যবাংলা (১৩৫০-১৮০০) এবং আধুনিক বাংলা (১৮০০-এর পরবর্তী)। প্রাচীন বাংলার লিখিত নিদর্শনের মধ্যে চর্যাগীতিকাগুলো  সর্বপ্রধান, যদিও এগুলোর ওপর অন্যান্য পূর্বমাগধীয় ভাষার দাবি তুচ্ছ করার মতো নয়। বিভিন্ন পর্বে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত (তৎসম), আরবি-ফারসি, ইংরেজি শব্দের বেশ প্রবেশ ঘটেছে।
বাংলা শুধু আমাদের মাতৃভাষাই নয়, রাষ্ট্রভাষাও। এই ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন এ দেশের দামাল ছেলে রফিক, সালাম, শফিউল, বরকত, জব্বার, মো. অলিউল্লাহ, আবদুল আউয়ালসহ আরো অনেক ভাষা শহীদ। সেই সময় এই বাংলাদেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। আমাদের দেশ থেকে ১২শ’ মাইল দূরের আজকের পাকিস্তানের নাম ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। শাসন ক্ষমতা মূলত ছিল তাদেরই হাতে। তাদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের সেই ইতিহাস বড় হয়ে তোমরা জানতে পারবে। অনেক ত্যাগ আর সংগ্রামের পর তৎকালীন পাকিস্তান গণপরিষদ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিয়ে একটি বিল পাস করে। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন অব্যাহত ছিল। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অনুমোদনের মাধ্যমে এই আন্দোলন তার লক্ষ্য অর্জন করে। জাতীয় পরিষদে বিষয়টি নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়। এরপর ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সদস্য ফরিদপুরের আদেলউদ্দিন আহমদের দেয়া সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলার আছে একটি সমৃদ্ধ অতীত। এই ভাষায় রচিত হয়েছে অনেক মহত্ত্ব সাহিত্য। বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার বিদ্রোহী সুর ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর অন্তরে কাঁপন ধরিয়েছে। গান জাগিয়েছে মানুষের মনে ভালোবাসার পরশ। তারা ছাড়াও আরও হাজার হাজার কবি সাহিত্যিকের লেখা লাখ লাখ গল্পকথা, উপন্যাস গান, কবিতার পঙ্ক্তিমালা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
মাতৃভাষাকে ভালোবাসতে হবে নিজেকে বিকশিত করার স্বার্থেই। কারণ মাতৃভাষার জ্ঞান ছাড়া পৃথিবীর বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার থেকে জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব নয়। আমাদের মাতৃভাষা একটি সমৃদ্ধ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা। যে কোন শব্দ উচ্চারণ ও লেখা বাংলা বর্ণমালা দিয়ে সম্ভব।

Share.

মন্তব্য করুন