রাস্তার দুই পাশে চোখ মেলে তাকালে চোখে পড়ে হরেক রঙের ক্ষুদ্র জীব। কীট-পতঙ্গ। রাস্তার পাশে ফড়িং প্রজাপতি ভ্রমরসহ অনেক প্রজাতির কীট-পতঙ্গের ওড়াউড়ি মানুষের মনকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আলোড়িত করে। এক ভালো লাগার অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে।
ফড়িং লাল, সবুজ, হলুদ, কমলাসহ অনেক মিশ্র রঙের হয়ে থাকে। রং ও সৌন্দর্যে অতুলনীয় বৈচিত্র্যময় ফড়িং আমাদের মনকে করে আকৃষ্ট। অতীতে ফড়িংকে এক সময় শয়তানের সুঁই হিসেবে ডাকা হতো এবং ফড়িং দুষ্ট, অবাধ্য শিশুদের মুখ সেলাই করে দেবে বলে এই ভয় দেখানো হতো। তবে পতঙ্গটির ব্যাপারে বিজ্ঞানভিত্তিক ও মজার অনেক তথ্য রয়েছে, যা আমাদের অনেকেরই অজানা।
ফড়িং নামের ছোট পতঙ্গটির রয়েছে অতি প্রাচীন ইতিহাস। পৃথিবীর বুকে ডাইনোসরদের পদচারণার অনেক আগে থেকেই আকাশে উড়ে বেড়িয়েছে ফড়িংরা।
প্রায় ৩০০ মিলিয়নের বেশি বছর ধরে পৃথিবীতে ফড়িংদের বসবাস। সময়ের সাথে পরিবেশের পরিবর্তনে, বিবর্তনের ধারায় এক সময়ের সুবিশাল পতঙ্গ ফড়িং আজকে পরিণত হয়েছে ছোট পতঙ্গে। কার্বনিফেরাস যুগে ফিরে গেলে দেখা যাবে, ফড়িংদের পূর্বপুরুষেরা ছিল পতঙ্গদের মধ্যে সবচেয়ে বড় পতঙ্গ।
এই যুগে পাওয়া যেত পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পতঙ্গগুলো। সুপ্রাচীন গ্রিফেনফ্লাই হলো পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পতঙ্গ, যাদের বিবেচনা করা হয় ফড়িংয়ের পূর্বপুরুষ হিসেবে। বড় দু’টি চোখের সুবাদে ফড়িংয়ের দৃষ্টিশক্তি অসাধারণ। এদের দর্শনশক্তি প্রায় ৩৬০ ডিগ্রি এবং মানুষের চেয়ে অধিক সংখ্যক রঙ দেখতে পারে ফড়িংরা।
একটি ফড়িংয়ের চোখে প্রায় ৩০,০০০ এর মতো লেন্স বা ওমাটিডিয়া রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে এরা অর্জন করেছে অসাধারণ দর্শনক্ষমতা। একটি ফড়িং তার মস্তিষ্কের প্রায় ৮০ ভাগ ব্যবহার করে দৃষ্টিলব্ধ তথ্য বিশ্লেষণে, ফলে অন্যান্য পোকার চলাচল সহজেই নির্ণয় করতে পারে এরা। তাছাড়া, ওড়ার সময়ে অন্য পতঙ্গ বা কোনো কিছুর সাথে সংঘর্ষের হাত থেকেও রক্ষা পেতে ও খাবার শিকার করতে তাদের এই দৃষ্টিশক্তি দারুণ কাজে দেয়।
সাধারণত পুকুর, লেক বা জলাশয়ের ধারেই ফড়িংয়ের আনাগোনা বেশি দেখা যায়। কারণ নারী ফড়িংগুলো পানির ওপরে, জলজ উদ্ভিদ বা শৈবালের ওপর ডিম দেয়। এখানেই ডিম ফুটে বের হয় ফড়িংয়ের বাচ্চা বা নিম্ফ। ফড়িং সামনেও যেমন উড়তে পারে, তেমনি পেছনের দিকেও উড়তে সক্ষম। সম্পূর্ণ গতিতে বা ধীরে, ঠিক সোজা ওপরে বা নিচের দিকে ওড়ার দারুণ সক্ষমতা রয়েছে এদের। তা ছাড়া, সামনে-পেছনে না এগিয়ে বাতাসে এমনি ভেসে থাকার দারুণ দক্ষতার ফড়িংয়ের রয়েছে চারটি পাখা। প্রতিটি পাখা স্বাধীনভাবে চালনা করতে পারে এই পতঙ্গগুলো এবং একটি অক্ষ বরাবর সামনে-পেছনে ঘোরাতেও পারে এগুলো।
প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৩০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে ফড়িং। গবেষণায় দেখা গেছে, অসাধারণ দৃষ্টিশক্তি ও উড়তে পারার দক্ষতার দরুন শিকার ধরতে ও আগের জায়গায় ফিরে আসতে একটি ফড়িংয়ের মাত্র ১-১.৫ সেকেন্ড সময় লাগে।
বিভিন্ন প্রজাতির ফড়িং তার এলাকায় অন্য ফড়িংয়ের প্রবেশ একেবারেই পছন্দ করে না। কোনো ফড়িং এই অনধিকার চর্চা করলে, তার বিরুদ্ধে ঐ এলাকার পুরুষ ফড়িং একরকম যুদ্ধ ঘোষণা করে। স্কিমার, ক্লাবটেইলস এবং পেটটেইলস ফড়িং ডিম পাড়ার জন্য পুকুরের আশপাশের জায়গা বেছে নেয়। এই সময় অন্য কোনো ফড়িং যদি এই অঞ্চলে প্রবেশ করে, তাহলে দায়িত্বে থাকা পুরুষ ফড়িং তাকে তাড়া করে ভাগিয়ে দিবে।
অন্যান্য কিছু প্রজাতি যদিও নিজের সুনির্দিষ্ট অঞ্চল নিয়ে মাথা ঘামায় না, তবুও ওড়ার পথে অন্য পুরুষ ফড়িং পথ মাড়িয়ে গেলে, তাদের প্রতি আগ্রাসী আচরণ করে থাকে। তা ছাড়া, কিছু পুরুষ ফড়িং অবশ্য পছন্দের মেয়ে ফড়িংয়ের জন্য প্রতিপক্ষের সাথে সহিংস আচরণ প্রদর্শন করে।
অন্য অনেক প্রাণীর মতো, কিছু ফড়িং প্রয়োজনের তাগিদে বা আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে নিজেদের সাধারণ বাসস্থান ছেড়ে পাড়ি জমায় অনুকূল পরিবেশে।
কিছু প্রজাতি দলবেঁধে, আবার কিছু প্রজাতি একাকী শুরু করে এই যাত্রা। উত্তর আমেরিকার গ্রিন ডার্নার্সনামের ফড়িং শীতকালে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ পরিবেশের দিকে চলে যায় এবং বসন্তকালে আবার ফিরে আসে নিজের চিরচেনা ভূবনে।
বংশ বৃদ্ধির জন্য গ্লোব স্কিমার ফড়িং খুঁজে বেড়ায় অস্থায়ী জলাধার, তাই প্রজননের জন্য এরা অনুসরণ করে বৃষ্টিস্নাত এলাকা। এমনকি ভারত ও আফ্রিকার মধ্যবর্তী রেকর্ড ১১,০০০ মাইল দূরত্ব ভ্রমণের রেকর্ড রয়েছে এই গ্লোব স্কিমারদের।
শরীর উষ্ণ রাখতে পাখা দ্রুত চালনা করে তাপ উৎপন্ন করে ফড়িং। বসে থেকে অলস সময় কাটাতে পছন্দ করা ফড়িং অবশ্য শরীর উষ্ণ রাখতে ব্যবহার করে সূর্যের আলো। পর্যাপ্ত আলো পেতে যথাযথ অবস্থান নিতে এদের জুড়ি নেই।
অতিরিক্ত গরমের সময় কিছু ফড়িং আবার তাদের পাখা ব্যবহার করে অত্যধিক সূর্যের আলো প্রতিফলিত করতে এবং যেখানে সূর্যের আলো কম সেখানে সাধারণত অবস্থান নেয়। পরিবেশবান্ধব ছোট জীব ফড়িং ও এর বাচ্চা জলাশয়ের পোকামাকড় ও মশার লার্ভা খেয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের পরিবেশকে ভালো রাখতে সহায়তা করে।
ফড়িং একাধারে বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষতিকর মশা দমন, ফসলের ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনেও ভূমিকা রাখে। জনশ্রুতি রয়েছে, যে এলাকায় যত বেশি ফড়িং সে এলাকার পরিবেশও তত ভালো। উপকারের কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন দেশে ফড়িং সংরক্ষণ করা হয়। সৌন্দর্যের কারণে জাপানি শিল্পকলায় ফড়িং জনপ্রিয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

Share.

মন্তব্য করুন