রাজধানীর ব্যস্ত স্টেশন। কত হাজার মানুষ যে এখানে ভিড় বাড়ায়, তার ইয়ত্তা নেই। ছোট-বড়-মাঝারি থেকে শুরু করে নানা বয়সের মানুষের আনাগোনা স্টেশনকে যেনো চিরযৌবনা করে রেখেছে। কত রঙের-ঢঙের আর কত কিসিমের মানুষের দেখা মেলে এখানে তা শুধুই এখানকার বাস্তুহারা স্টেশনকে নিজেদের মনে করা ভবঘুরেরাই জানে।
এখানে রাত-দিন সমান। এ রাত-দিনের সময়ের অঙ্কটা মনে রাখে রেলওয়ের লোকজন আর শশব্যস্ত যাত্রীরাই। অন্যরা যারা আছে তারা হলো টোকাই, ভিখারি, আধা-পুরো পাগল, মুচি, দিনমজুর, কিছু ছিঁচকে চোর, বাদামওয়ালা আর পানি বিক্রেতা। তাদের কাছে দিন-রাত তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। তারা শুধু জানে, সময়ে সময়ে ট্রেন আসবে। ঘাড় ঘুরিয়ে বড় দেয়াল ঘড়ি দেখতে জানে না, দেখতে জানলেও পড়তে পারে না। তারা শুধু জানে মাইল-কিলো পেরিয়ে ট্রেন আসবে।  স্টেশনমাস্টারের তীব্র হুইসেল-ট্রেনের ঝকাঝক শব্দই বলে দেয়, ট্রেন আসছে…।
এ স্টেশনের পুঁচকে টোকাইদের ছোট দল আছে একটা। যাদের বেশির ভাগের জন্মই এ স্টেশনের বস্তিতে। কারো বা জন্ম এখানে না হলেও তারা জানে না তাদের পরিচয় কী! সেই দলের সবার চেয়ে অপেক্ষাকৃত বড় যে, তার নাম আপন। সবার চেয়ে বুদ্ধিমানও সে। তাই সবাই তাকে মেনে চলে। এই নানা বয়সের স্টেশনের বেপরোয়া ছেলেগুলো যদিও কাউকে পরোয়া করে না; কারো বিধিনিষেধ মানার সময় নেই ওদের। তবুও তারা আপনকে ভয় পায়। তার সাথে অনেক বড় বড় মানুষের পরিচয় আছে বলে শোনা যায়। আপনের চেয়ে একটু ছোটটা হলো হৃদয়। তারপর রানা, আদর, আকাশ, আজিজ আরো অনেকে। এদের সবাই স্টেশনের চেনা-জানা মুখ।
প্রতিদিনের ন্যায় ট্রেন চলে যাওয়ার পর কে কত আয় করলো তা নিয়ে মিটিং বসে। আজকেও তার বিপরীত না। সবাই যার যার কামাই সামনে রাখতে শুরু করলো নির্দ্বিধায়। কারণ আপনের এ নতুন উদ্যোগেই তারা নিজেদের টাকা খরচ করে প্রয়োজন মতো। ওখান থেকেই কেউ কেউ ঘরে দেয়। এ টাকার কিছু জমা রাখে আপনের কাছে। স্টেশনের মাদকসেবী-ছিঁচকে চোররাও তাদের ওপর নজর রাখে, তাই নিরাপদে রাখা।
দলবেঁধে কোথাও ভালো খাবার খাওয়া আর ঘুরতে যাওয়া যায় জমানো এই টাকায়। তবে বাড়তি টাকা নষ্ট নয়। শুরুতেই সবাই গাঁইগুঁই করলেও এখন তারা মানিয়ে নিয়েছে। জানে এতেই মঙ্গল।
এর মাঝে আপনের হুঙ্কার, ‘কার কত অইছে তাড়াতাড়ি ক।’ বলেই নিজের টাকা ভাঁজ করতে লাগলো।
রাতুল মুখ ভার করে বলে উঠলো, ‘আইজকা দিন ভালা না, মোডে তিরিশটা ট্যাহা পাইছি।’ তার বলে শেষ করার দেরি, এরই মধ্যে সবাই বিভিন্ন ভঙ্গিতে হেসে উঠলো।
‘গতকাইল তো হগলের চাইতে বেশি কামাইছিলা, আইজকা তো মোডে পরথম ট্রেন আইছে। বেবাক দিন সামনে পইড়া আছে ; ধৈর্য ধর।’ বলেই ঝাড়ি দিলো আপন।
আকাশের টাকা গুনতে সময় লাগে। পাশে বসা আপন তার টাকা গুনে দেখল সত্তর টাকা হয়েছে। সে সবাইকে বলে উঠলো, ‘দেহি, হগলে জোরে হাততালি দে।’ বলার সাথে সাথে একসাথে অনেকগুলো হাত বেজে উঠলো।
‘গতকাইল তুই কানছিলি কম ট্যাহা দেইখ্যা, ঘরেও নাকি ট্যাহা দেস নাই; আইজকা তো এক্কেরে ফাটাই দিসস!’ আপনের গলায় বাহবা পেয়ে আকাশের চোখ চিকচিক করে ওঠে, বোঝা গেলো সাথে লজ্জাও পেল বটে।
দেখতে দেখতে সবার টাকা গোনা শেষ, কমবেশি সবার কামাই ভালো। আপন দেখল পাশে এককোণে হৃদয় টাকা গুনছে কিন্তু হিসাব মেলাতে গণ্ডগোল লাগাচ্ছে।
তাকে পাশে ডেকে আপন বললো, ‘আবার পরথম থেইক্যা গুন।’
গুনার সময় সে গুনলো, ‘এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ-ছয়-সাত-আট-দশ…..’ বোঝা গেলো সে আর পারছে না।
রানা ঠাট্টা করে বলে উঠলো, ‘এত্ত দামড়া হইসোস, টাকা গুনবার পারো না! ছিঃ ছিঃ ছিঃ।’ সবাই একচোট হেসে নিলো।
হৃদয় রেগে গিয়ে বললো, ‘গুনবার পারি। তয় আইজ মুনে অয় ট্যাহা বেশি, তাই ভুল করতাছি।’
আবার সবাই ঠাট্টা করা শুরু করলো। সবাইকে থামিয়ে আপন গুনে বললো, ‘হ, হাছা কথা। হে আইজ হগলের চাইতে বেশি কামাইছে, একশো ট্যাহা!’
সবাই হাঁ করে হৃদয়ের দিকে তাকালো। হৃদয় সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভুললো না। সবাইকে দেখিয়ে কলার উঁচু করে ঝেড়ে নিলো।
হঠাৎ কোথা থেকে সবার মাঝে দুই টাকার ছেঁড়া নোট এসে পড়লো। সে দিকটায় তাকাতেই দেখলো; ছোট্ট রূপা হাত ঝাড়ছে। আর হাত নেড়ে আধো আধো বুলিতে কিছু বলছে, যার অর্থ শুধু সে-ই জানে। ওকে টাকা দিতে দেখেই সবাই হেসে খুন। তাকে কোলে নেয়ার জন্য যেনো সবার মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে গেলো।
ছোট্ট রূপা, দেখতে পরীর মতো। এই স্টেশনের সবারই খুব প্রিয়। দেখলেই কোলে নিতে মন চায়। সেও সবার দেখাদেখি এর ওর কাছে হাত পেতে টাকা চায়। যাই পায় সবার মাঝে ভাগ করে দেয়।
দূর থেকে ভেসে আসা ট্রেনের হুইসেল শোনা গেলো, এ সময় টোকাইদেরই বেশি ব্যস্ততা দেখা যায়। চলন্ত ট্রেনে লাফ দিয়েই ব্যাগ বোঝাইয়ের কাজ জোগাড় করে। যাত্রীরাও যে যার মতো তাদের দেয়। রানা-রাতুল সবার চেয়ে খাটো বলে ট্রেন থামলে ওদের ওঠা হয়। এ নিয়ে তাদের ক্ষোভের শেষ নেই। যাত্রীদের খাবারের উচ্ছিষ্ট আর চা-বিস্কুটেই যেনো তাদের দিব্যি চলে। সকাল-বিকেল বলে কোনো কথা নেই। তাদের জেগে থাকলেই দিন, ঘুমুলেই রাত। দিনের সময় গড়িয়ে দুপুর, দুপুর হতে রাত। মাঝে মাঝে পাশের নর্দমার খালি জায়গায় তারা খেলে।

২.
স্টেশনে যারা থাকে তাদের কম-বেশি অনেকের কেউ নেই, নেই আত্মীয় স্বজন। তাই তারা সবাই একসাথে থাকে। তারাই নিজেদের আপন। রাতুল, আকাশ ও আপন সে রকমই। দিনে একসাথে চলাফেরা করে। শীতের রাতে পাতলা কাঁথায় জড়িয়ে আঁটাআঁটি করে থাকা। একে অপরকে জড়িয়ে থাকাই এখানকার অভ্যাস।
এ স্টেশন কখনো নীরব থাকে না, সরবতাই এটির ধর্ম। হরেক রকম সে শব্দের কোলাহল। পাশেই ছোট্ট বাচ্চা কাঁদছে থেকে থেকে। হঠাৎ হঠাৎ মদ খেয়ে মাতালদের হেঁড়ে গলার চেঁচামেচি। অন্যদিকে পাগলের প্রলাপ শুনতে শুনতেই যেনো রাত যৌবন হারায়। কোনো বসতি থেকে আহাজারির শব্দ। ক্ষুধা, যন্ত্রণা আর দুঃখে জর্জরিত জীবনে একমাত্র কোলাহল যেন এই স্টেশন।
ভোর রাতে ট্রেন এলো, তবু কোনো ছোকরাই দৌড়ে গেল না। ব্যাগ বোঝাইয়ের পাল্লা দেয়া নাই। কোথায় যেন একটা নিঃসঙ্গতা ঘিরে আছে স্টেশনটাকে। সারাদিন ছুটোছুটি, হৈ-হুল্লোড় করতে করতে সবাই ক্লান্ত।
আপন, রাতুল ও আকাশ চোখ পিটপিট করে তাদেরই বয়সী দু’টো ছেলে আর একটা রূপার বয়সী মেয়েকে দেখলো বাবা-মার সাথে। ছোট মেয়েটা আধো আধো বুলিতে কিছু একটা বলতেই সবাই হেসে উঠলো।
আপন উঠে বসে পড়লো। বললো, ‘দেখলি, ওই যে আমগো মত পোলাপান, তাগো জীবনে কোনো দুঃখ-কষ্ট নাই। দিন-দুপুরে খাওনের চিন্তা নাই। রাতে থাকনের জায়গা লইয়্যা টানাটানি নাই। খালি সুখ আর সুখ। তাগো চোখে কি কুনোদিন কান্না আহে?’
রাতুল ও আকাশ উঠে বসেছিল আগেই। রাতুল বললো, ‘হেরাও কান্দে। নতুন নতুন খেলনা-জামা না পাইলে কান্দে।’ আকাশের চোখে মুখে দীর্ঘশ্বাস…।
‘আপন ভাই, তাগোর মতো কি আমরা পারুম না কুনো দিন; তয়, আমার কুনো কিছু দরকার নাই। মা-বাপের লগে দেখা অইলেই অইবো খালি। বলমু অ-মা, অ-বাপ আপনারা শুধু আমার কাছেই থাইকেন।’ আকাশের চাপা স্বরে বলা কথাগুলো আপনের বুক চিড়ে দেয়, বুকফেটে
কান্না আসে। কারণ আপনের ইচ্ছাগুলোই যে আকাশের মতোই।

৩.
সপ্তাহখানেক পর একদিন সবাই হাসপাতালের একটি বেডের চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবারই মন খারাপ। আপন দূরের চেয়ারে বসে আছে; ভাবছে, ‘রূপাকে বাঁচানো যাবে তো?’
হাসপাতালের অন্যান্য রোগীরা উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। এত ময়লা-ছেঁড়া জামাকাপড় পরা টোকাইগুলোর কী কাজ এখানে? জানা গেল, স্টেশনের বস্তির একটি বাচ্চার ভয়ানক ডেঙ্গু। তাই সবাই ছুটে এসেছে দেখতে, সেই সকাল থেকে বিকাল এখানে বসেই আছে। দিনকয়েক আগেও তো রূপার সাথে মেতে থাকতো সব ছোকরারাই। হঠাৎ একদিন দুপুরে শুনতে পেলো তার জ্বর। তার টানা এক সপ্তাহ গেলো জ্বর কমে না। ডাক্তার বললো, ‘ডেঙ্গু’!
সেই থেকে তাকে হাসপাতালে রাখা হয়েছে। চিকিৎসা চলছে, সাথে অনেক টাকার ঔষুধ ও নানা খরচ হয়েছে। এগুলো চালাতেই ভ্যানচালক বাবার অবস্থা বেহাল।
ছোট্ট রূপা মিটিমিটি হাসছে, একে ওকে ধরার চেষ্টা করছে। ডাক্তার বলেছে আরো সপ্তাহখানেক রাখলেই সে সুস্থ হবে, সেটা শুনে যেনো সবার বুক থেকে পাথর নেমে গেলো। তবে এখন সমস্যা একটাই, তাকে এ সপ্তাহখানেক রাখার খরচ আর সাথে ভালো-মন্দ খাবার দরকার। রূপার মা নার্সকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেডাম, কত ট্যাহা লাগতে পারে আর?’
নার্স আন্দাজ করে বললো, ‘এইতো হাজার তিনেক হলেই মোটামুটি সব হয়ে যাবে।’ শুনেই রূপার বাবার চক্ষু চড়কগাছ।
‘এত ট্যাহা কই পামু মেডাম, আমরা গরিব মানুষ; থাহি বস্তিতে। দেহেন না কিছু কমানো যায় কি না?’ রূপার বাবার চোখে মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো।
নার্স তাদের এ অবস্থা দেখে বললেন, ‘আপনারা আপাতত হাজার দুয়েক টাকা হাতে রাখেন, বাকিটা কমানোর ব্যবস্থা করে দেয়ার চেষ্টা করবো।’
রূপার বাবা-মার চোখে পানি, মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটিয়ে অব্যক্ত ধন্যবাদ প্রকাশ করলেন।
টাকা জোগাড়ে পোহাতে হলো নানা সমস্যা। আগের খরচগুলোও এর-ওর কাছ থেকে ধার-দেনা করেই চিকিৎসা চলেছিলো। নতুন করে তাই কেউই টাকা ধার দিতে রাজি হলো না, এ যেনো আরেক সমস্যা!
সবার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ, বলা চলে এক নির্ঘুম রাতই কাটালো আপন। সারারাত ভেবেছে এত টাকা কোথা থেকে দিবে। কী করে জোগাড় করা যাবে। তার আচমকা একটি বুদ্ধি খেলে গেলো। তবুও সংশয় যে, ‘সবাই রাজি হবে তো?’
প্রতিদিনকার মতো সকাল শুরু হলো স্টেশনে। বেলা ১১টা। স্টেশনের সবারই আপনের সাথে মিটিংয়ে বসার কথা। আস্তে আস্তে সবাই এসে টাকা গুনছিলো সকালের কামাইয়ের। আপন হালকা নড়াচড়া করে বসলো এবং গম্ভীর স্বরে বললো, ‘শোন সবাই।’
সবাই আপনের কড়কড়ে গলা শুনে তাকালো তার দিকে, ‘আমার আইজকা মনে অইলো রূপারে চাইলে আমরা হগলে মিল্লা ভালা কইরা তুলবার পারি।’
চঞ্চল নাজমা কথা শেষ হবার আগেই বলে উঠলো, ‘ক্যামনে, আমাগো কি অত ট্যাহা আছে নি?’
আপনের কথায় অভয়ের সুর, ‘আমগো পেরায় ছয় সাতদিনের ট্যাহা জইমা আছে। এগুলা দিয়া কিছু করবার পারি আমরা। দেহি কত ট্যাহা অইছে। তোরা কি বলিস?’
সবার মধ্য থেকে আজিজ বলে উঠলো, ‘হ, আমরা হগলে রাজি আছি।’
স্টেশনের সবচে ঘাড়ত্যাড়া ছোকরা হারুন। সে সবার বিপরীতে গিয়ে বললো, ‘তোগো ট্যাহা থাকলে তোরা দে, আমি দিমু না। নিজেরা খাইয়া বাঁচনের ঠিক নাই, আইছে দরদ দেহাইতে!’
রাহুল তার দিকে তেড়ে উঠলো এক প্রকার। বললো, ‘রূপা আমগো বইনের মতন। হেরে বাঁচানের লাইগ্যা সব করমু হগলে, সব।’ রাহুলের কথার জোর সাড়া পাওয়া গেলো। এতে অনেকে হারুনকে নানা কথা শোনালো। আপন সবাইকে চুপ করিয়ে হারুনকে বোঝালে সে তার নিজের ভুল বুঝতে পারলো, পরে খুশি মনেই নিজের টাকা দিলো।
আপন নিশ্চিন্ত মনে সবাইকে বললো, ‘এইবার আমরা হগলে মিলা ট্যাহা গুনমু, আয় কাছে সব।’
আপন তার পুরনো ব্যাগ থেকে ছোটো টাকার ব্যাগ থেকে সবাইকে টাকা গুনতে দিলো।
সবাই সোৎসাহে টাকা গুনছিলো, এ যেন এক অন্যরকম আনন্দ। যতই টাকার পরিমাণ বাড়ছিলো সবার উত্তেজনাও সাথে পাল্লা দিতে লাগলো। একসময় টাকার মোট পরিমাণ বললো আপন নিজেই, ‘আমগো মোড দুই হাজার পাঁচশত ট্যাহা অইছে!’ সবার সে কী আনন্দ! নিজেদের মধ্যে পাল্লা চলছিলো এ বলে যে, ওখানে কার কত বেশি টাকা ছিলো তা নিয়ে!’
আপনের প্রথমে মনে হয়েছিলো সবাই হয়তো ব্যাপারটায় রাজি হবে না, তবে বাস্তবে হলো সম্পূর্ণ বিপরীত। সবার এ নিঃস্বার্থ মানসিকতা আপনকে আকুল করে তোলে। হঠাৎ কেমন যেনো বদলে গেলো এ ছেলেমেয়েগুলো। এইতো কিছুদিন আগেও সামান্য কিছুর জন্য হলেও নিজেরা নিজেরা হাতাহাতি-মারামারি করতো। আপনের কাছে প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিচার আসতো। আবার মাঝে সাঝে এ ঝগড়া ছড়িয়ে পড়তো বস্তিতেও। কিন্তু রূপার এ অসুস্থতা যেনো সবাইকে বদলে দিলো। সবাই এক মনে লড়ছে, সবাই চায় রূপা যেনো ফিরে আসুক তাদের মাঝে।
সবার জমানো টাকা রূপার জন্য দিতে চাইলে রূপার বাবা শুরুতে আমতা আমতা করলেও শেষে নিতে রাজি হয়, আর বলে, ‘তোগো এ ঋণ কেমনে শোধ করুম আমি?’
আপনের মুখে কথা নেই। সে জানে, সব ঋণ শোধ হয় না। সে চুপিসারে আড়ালে চলে যায়। ঐ যে ট্রেন আসছে…!
সপ্তাহ খানেক পরই রূপা ফিরো এলো স্টেশনে। যেনো আনন্দের বন্যা নেমে এলো হুট করে। রূপা আধো আধো বুলিতে সবাইকে থেমে থেমে, ‘আ-ব-বা, আ-ম-মা’ বলে ডাকছে। স্টেশনে সেদিন এক বিরাট হল্লা হলো।
সেদিন দাওয়াত ছিলো রূপাদের বস্তিতে সব ছেলেমেয়েদের দুপুরের খাবারের। যে যার সাধ-সাধ্যমতো তার জন্য নতুন নতুন জিনিস এনেছে।
কেউ খেলনা, কেউ বা চকোলেট-চুড়ি ইত্যাদি।
বেশ কিছুদিন আগের ছোট্ট ঘটনার কারণে আপনের সাথে রূপার মায়ের মনোমালিন্য চলছিলো। কিছু কড়া ভাষায় বকাঝকাও করেছিলো তাকে। আপনকে একপাশে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে তিনি বললেন, ‘কিরে কথা কইবি না?’
‘কইতাছিই তো।’ আপনের কণ্ঠে অনুরাগের সুর।
‘রাগ কইরা থাকবি এহনো মার লগে?’
রূপার মার মুখে এ কথা শুনেই যেন বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো তার। চোখ থেকে মুহূর্তেই টপাটপ পানি বেয়ে পড়লো তার। দৌড়ে গিয়ে রূপার মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
‘কান্দিস না বাপ, তোরা হগলেই আমার পোলা-মাইয়া। আমার কত পোলাপান।’
তিনিও কেঁদে বুক ভাসালেন। রাতুল-আকাশ পাশে দাঁড়িয়ে দেখে তাদেরও বুকে জড়িয়ে নিলেন মাতৃ-মমতায়। রাতুল-আকাশও ভাবতে শুরু করলো তাদের কোনো দুঃখ নেই। তারা এখানকার সবাই ভাই-বোন।
রাত বাড়ছে। দূরের কাছের অস্পষ্ট নিয়ন আলোগুলো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে লাগলো। উজ্জ্বল হয়ে আলো ছড়িয়ে যাওয়া চাঁদটাকে যেনো আজ বেশ মায়াবী লাগছিলো।
রাতুল আপন-আকাশকে চাঁদটা দেখিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘এইডা কি ঈদের চান নি রে?’
আপন তৃপ্তির সুরে বললো, ‘হ, আইজকা আমাগো লাইগা ঈদ, আর এইডা ঈদের চাঁদ!’

Share.

মন্তব্য করুন