ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। আমাদের দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাসের মাঝে এটি একটি। তবে অন্য একটি কারণে ভাষার মাসটি ঐতিহ্যপ্রিয় বাঙালির কাছে হয়ে উঠেছে অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। তা হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা। ফেব্রুয়ারিতে যেমনি ভাষা শহীদদের স্মরণে বাংলাভাষাকে আপন করে নেয়ার চেষ্টা চলে নানা আয়োজনে, ঠিক তেমনিভাবে নিজের ভাষায় লেখা বইয়ের কদরও যেনো বহুগুণ বেড়ে যায় আমাদের কাছে।
ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত মায়ের ভাষাকে বরণ করে নেয়ার যে ঐতিহ্যবাহী আয়োজন বাঙালি করেছে তার যৌক্তিকতা বিশেষণের অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পরের বছর হতেই মূলত ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজন করেন সরদার জয়েনউদ্দিন। আজকের আধুনিক অমর একুশে গ্রন্থমেলার অন্যতম রূপকার হিসেবে তাঁর নিকট বাঙালি কৃতজ্ঞ থাকবে আজীবন। বাংলা একাডেমির পরিচালক থাকাকালীন সময়ে তিনি এটি শুরু করেন। তবে ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা যখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হন, তখন তিনি বাংলা একাডেমিতে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে মেলাটি আয়োজন করেন।
স্বাধীনতার পর থেকে মূলত এ বইমেলার আনুষ্ঠানিক চল শুরু হলেও নানা সময়ে ঘাত-প্রতিঘাতে থেমে গিয়েছিল বইমেলার ধারাবাহিকতা। তবে সাহিত্য পিপাসু বাঙালির আকাশচুম্বি চাহিদা ও গ্রহণযোগ্যতাই এই মেলাকে জারি রাখার পেছনের নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে। মানুষের জানার আগ্রহ ও নিজেকে প্রকাশ করার ইচ্ছা সেই সৃষ্টির শুরু হতেই। নিজের কথাগুলোকে তথা ভাবনার সম্ভারসমূহকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে বইয়ের চেয়ে ভালো মাধ্যম আর বুঝি নেই। তাই নানান লোকের নানান মতের মতোই, নানান আদর্শের মানুষের যেমন কমতি নেই, তেমনি তাদের ধারণাগুলোকে ছড়িয়ে দেয়ার মনোভাবেরও কমতি নেই। এ হতেই হয়তো উৎপত্তি বইয়ের। অন্যকে জানার ও বোঝার ক্ষেত্রেও তা আলাদা নয়। এই জানা ও বোঝার বাধাহীন সীমানা পাড়ি দিতেই হয়তো বইমেলার উদ্ভব, যা হরেক রকম চিন্তা ভাবনার সাথে সহজেই পরিচিত হবার উৎকৃষ্টতম পথটি করে দেয়। আগে পাঠ্যসূচির বাইরে গিয়ে অন্যকিছু পড়াটাকে নির্বোধপনা, সময় নষ্ট করা ও বখে যাওয়া বালকের স্বভাব হিসেবে ধরা হতো।
তবে দিন পাল্টেছে। সবাই-ই তো যেনো জ্ঞানের সাগরে ডুব দিয়ে অজানাকে জানার তাড়না বয়ে বেড়ায়। এখন বইমেলার গ্রাহক শুধুমাত্র বড়রা কিংবা পণ্ডিতরা নয়, এখনকার বইমেলার গ্রাহক হলো আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা হতে শুরু করে নানা স্তরের মানুষ। এ উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে প্রতিযোগিতার ন্যায়। যেনো জ্ঞানকে ধারণ করার এক অপ্রতিরোধ্য উপায় এই পড়া। বইমেলার নতুন মলাটের বইয়ের প্রতি মানুষের টান প্রবল, সে হোক ছোটো কিংবা বড়। বছর ঘুরে নতুন বছর আসে ফেব্রুয়ারি। সাথে আসে বইমেলা। চাপা উত্তেজনা কাজ করে সকল শ্রেণীর পাঠকের হৃদয়ে। নতুন মলাটের ঘ্রাণ, সাথে পরিচিত -অপরিচিত, জনপ্রিয়-অজনপ্রিয় লেখকের বই আলোড়ন তোলে পাঠকের প্রাণে। সব বয়সের সব শ্রেণীর ভিন্ন পছন্দের পাঠকের রুচির সাথে মিলিয়ে কেনা হয় বই। গল্প-উপন্যাস, কবিতা-নাটিকা থেকে শুরু করে অনুবাদ গ্রন্থ, কমিক্স এবং বিদেশি সাহিত্যসহ নানাবিধ বইয়ের বিশাল পসরা দেখা যায় বইমেলায়। শুরুতে বাংলা একাডেমি চত্বরে গুটিকয়েক দোকান আর প্রকাশনা নিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে তা ছাড়িয়ে গেছে কয়েকশত গুণে।
নতুন প্রজন্মের কাছে বইমেলার গুরুত্ব যেনো পছন্দের খেলনার মতোই। প্রচ্ছদসজ্জা ও নানা চিত্রসহ বই দেখলেই তাদেরও মনে ধরে সহজেই। যেনো ছড়া-কবিতা ও কমিক্সের সব বই নিয়ে যাবে এমন ভাব। বইমেলার অনেকাংশ জুড়ে থাকে শিশু-কিশোরদের নিয়ে আয়োজন। এ আয়োজন সহজেই তাদের মন কাড়তে সক্ষম হয়। মেলার প্রথম প্রহরেই মা-বাবার সাথে আসা শুরু করে শিশু কিশোর হতে উঠতি বয়সের তরুণরা। তাদের কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে ওঠে একুশের গ্রন্থমেলার প্রাঙ্গণ। শুক্রবার সহ ছুটির দিনগুলোতে শিশু-কিশোরদের উপস্থিতি যেনো চোখে পড়ার মতো। আলাদা এক ভুবন। দোকানের চারপাশে ঘুরঘুর করা, এটা সেটা নিতে চাওয়ার বায়না ধরা। যে অঙ্গণ জুড়ে শুধু শিশু-কিশোরদের জন্য তা হলো সিসিমপুর মঞ্চ।
মানসিক বিকাশ ও সর্বক্ষেত্রে অংশগ্রহণের যে তীব্রতা অনুভব করে শিশু-কিশোররা তা হয়তো এ বই পড়ার মাধ্যমেই হয়। নানা বিষয়ে জানার কৌতূহল আর হরেক রকমের বিষয় শেখার যে প্রবল আগ্রহ তা পূর্ণতা পায় এ বইমেলার মাধ্যমেই। শিশু-কিশোরদের মেধা ও মনন বিকাশে প্রয়োজন বই পড়ার চর্চা করা, যা বইমেলার প্রভাবে প্রবল গতি পায়।
একটি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জানার জন্য বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। বইমেলাতে ধারণ করা হয় বিখ্যাত সব লেখকদের শিশু-কিশোর বই; তলস্তয় হতে শুরু করে সুকুমার রায়ের, যা শিশু-কিশোর মনে বুনো উদ্দিপনা সৃষ্টি করে। তাছাড়াও আছে, ভ্রমণকাহিনী, গোয়েন্দাকাহিনী, সায়ন্স ফিকশন ইত্যাদি। বড়দের মতো শিশু কিশোদের উত্তেজনা কখনোই চাপা থাকে না। তাদের ছুটোছুটি বই নিয়ে, কানাকানি আর পড়ার আগ্রহ ছড়িয়ে পড়ে পুরো বইমেলা জুড়েই। এ আনন্দ ও অকৃত্রিম টানের একটা নিজস্ব ভুবন আছে। যে ভুবন হয়ে থাকে শুধু বই আর বইয়ের। তাদের শুদ্ধতম প্রতিভার বিকাশের মাধ্যমেই দেশ ও জাতি পাবে এক নতুন ধারা। যে ধারা বহন করবে ন্যায় আর সত্যের পতাকা। প্রাণের ভাষাকে ধারণ করে প্রাণের বইমেলা যে নতুন দিনের আগমনী বার্তা নিয়ে আসবে এখন তা শুধু সময়ের ব্যাপার।

Share.

মন্তব্য করুন