পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক সময় এসেছে যখন এক সাথে অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যখন কোনো কারণে প্রকৃতিতে বড় আকারে বিভিন্ন প্রজাতি প্রাণীর বিলুপ্তির ঘটনা ঘটে, তখন তাকে গণবিলুপ্তি বলে। গবেষণা বলছে, পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত প্রজাতির প্রাণীর বিচরণ হয়েছে তার ৯৯ ভাগই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই বিলুপ্তির প্রায় পুরোটাই হয়েছে বিভিনড়ব গণবিলুপ্তির সময়ে।
পৃথিবীতে প্রাণিকুলের বয়স প্রায় ৩৫০ কোটি বছর। এই কোটি কোটি বছরে ৫টি ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ বা গণবিলুপ্তি সম্পনড়ব হয়। তার মধ্যে সবচে কুখ্যাতটি ঘটে ২৫ কোটি বছর আগে যেটিকে বলা হয় পারমিয়ানমাস এক্সটিংশন বা ‘দ্য গ্রেট ডাইয়িং’।
পারমিয়ানমাস এক্সটিংশন বা ব্যাপক বিলুপ্তির ফলে প্রায় ৯৫ ভাগ জলজ এবং ৭০ ভাগ স্থলজ প্রজাতি পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে প্রায় ১০ লক্ষ বছর লাগে প্রাণিজগতের এই হত্যাযজ্ঞের ধাক্কা থেকে আবার উঠে দাঁড়াতে।
পারমিয়ানমাস এক্সটিংশনের কারণ তর্কসাপেক্ষ। ভূবিজ্ঞানী এবং জীবাশ্মবিদদের মধ্যে দু’টি ধারণা প্রচলিত। প্রমটি হচ্ছে, বিশাল আকৃতির উল্কার পতন। এই মতবাদের যুক্তি হচ্ছে ৬.৫ কোটি বছর আগের ক্রাটেসিআস এক্সটিংশন যা কিনা ডাইনোসর যুগের বিলুপ্তির কারণ। পারমিয়ানমাস এক্সটিংশনের দ্বিতীয় এবং অধিক গ্রহণযোগ্য মতবাদ হচ্ছে সাইবেরিয়ান ট্র্যাপসের ধারাবাহিক ভলকানিক অগড়বুৎপাত বা ফ্লুইড ব্যাসল্ট। সাইবেরিয়ান ট্র্যাপসের ফ্লুইড ব্যাসল্ট একটি চেইন ইভেন্টের জন্ম দেয় যার ফলাফল হচ্ছে পারমিয়ানমাস এক্সটিংশন। বর্তমান রাশিয়ার অন্তর্গত সাইবেরিয়ান ট্র্যাপসের ফ্লুইড ব্যাসল্ট বা লাভা উদগিরণের সময়কাল ছিল প্রায় ১০ লক্ষ বছর।
যার ফলে উত্তর আমেরিকা মহাদেশের সমান এলাকা লাভায় ঢেকে যায় এবং অবিশ্বাস্য পরিমাণ ছাই আর কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। এক্সটিংশনের প্রথম ধাপ শুরু হয় কার্বন ডাই অক্সাইড দ্বারা যা কিনা স্থলে হত্যাযজ্ঞ চালায়।
বিংশ শতাব্দীর বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড পরিমাণ থেকে ২০ গুণ অধিক কার্বন ডাই অক্সাইড শুরু করে গ্লোবাল ওয়ার্মিং যা স্থলের সম্পূর্ণ ইকোসিস্টেম ধ্বংস করে দেয়। যার পরিণামে তিন ভাগের এক ভাগ স্থলজ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়।
এক্সটিংশনের পরের ধাপ ছিল আরও সঙ্কটপূর্ণ যা শুরু হয় পারমিয়ান মহাসাগরে। কালপ্রিট আবার কার্বন ডাই অক্সাইড কিন্তু এবার এক দোসর এর সহায়তায়।
কার্বনডাই অক্সাইড হচ্ছে অন্যতম গ্রিন হাউজ গ্যাস যা পরিবেশে তাপমাত্রা ধরে রাখে। এর ফলে তৎকালীন পৃথিবীর স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বৃদ্ধি ঘটে। এতে পারমিয়ান সাগরের তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পায় এবং সাগরে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমতে থাকে যা ছিল জলে এক্সটিংশন বা বিলুপ্তিরত প্রথম ধাপ।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘাটতি ৯৫ ভাগ জলজ প্রাণী নিধন করার কথা নয়। দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘাটতি আরও একটি চেইন ইভেন্টের জন্ম দেয় যার ফলাফল এক্সটিংশনের দ্বিতীয় ধাপ বা কিলিং পিরিয়ড।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলে অক্সিজেনের ঘাটতি সাগর তলায় জন্ম দেয় গোলাপি সালফার ব্যাকটেরিয়ার। সালফার ব্যাকটেরিয়ার উপজাত ছিল পচা ডিমের গন্ধ বিশিষ্ট কালপ্রিট হাইড্রোজেন সালফাইড। এই হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাসই ছিল পানিতে হত্যাযজ্ঞের মূল হোতা।
৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ অক্সিজেন নির্ভরশীল প্রজাতির মৃত্যু ঘটে হাইড্রোজেন সালফাইডের বিষক্রিয়ায়। দ্বিতীয় ধাপে বিলোপসাধন পর্ব সম্পন্ন হয়।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কাছে মাত্র ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব এত বিশাল হওয়া অস্বাভাবিক ছিল। এবং প্রাপ্ত ফসিলে আরেকটি গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর আলামত ছিল যা ছিল আরও ভয়াবহ। দ্বিতীয় গ্লোবাল ওয়ার্মিং পৃথিবীর স্বাভাবিক তাপমাত্রা আরও ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বৃদ্ধি ঘটায়। অপরাধীর ছোট লিস্টে যুক্ত হয় আরও একটি গ্রিন হাউজ গ্যাস যা কিনা কার্বন ডাই অক্সাইড থেকেও মারাত্মক; মিথেন গ্যাস।
পারমিয়ান মহাসাগরের গভীরে ছিল হিমায়িত মিথেন বা হাইড্রেটেড মিথেনের বিশাল ভাণ্ডার। প্রম ধাপের ৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সাগর তলার এই হিমায়িত মিথেন গলতে শুরু করে এবং পানির চেয় হালকা এই গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে যা ছিল দ্বিতীয় ধাপের ৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির মূল কারণ।
ফলস্বরূপ পারমিয়ান সাগর আরও উষ্ণ হয়ে ওঠে। উষ্ণ সাগর আরও মিথেন হাইড্রেটের গলন ত্বরান্বিত করে এবং আগের প্রক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডলে তা ছড়িয়ে পড়ে। এবং শুরু হয় এক্সটিংশনের তৃতীয় এবং সর্বশেষ ধাপ, যা স্থলের ৭০ ভাগ প্রজাতির অবলুপ্তি ঘটায়।
কিন্তু এই ধ্বংসযজ্ঞের সময়কাল নিয়ে আছে মতভেদ। কারও মতে পারমিয়ান মাস এক্সটিংশনের সময়কাল ছিল ২ শত হাজার বছর। এবং কারও মতে ধ্বংসযজ্ঞ ছিল আরও দ্রুত ৪৮ থেকে ৬০ হাজার বছর।
পারমিয়ান মাস এক্সটিংশনয়ের পর শুরু হয় বিখ্যাত ‘মেসজইক এরা’ বা ডাইনোসর যুগ। যার সমাপ্তি ঘটে সর্বশেষ মাস এক্সটিংশন ক্রাটেসিআসে। শুরু হয় স্তন্যপায়ীদের রাজত্ব।
প্রকৃতিতে অসংখ্য প্রাণী জন্ম নেবে এবং সেগুলো প্রকৃতির নিয়মেই পৃথিবী ত্যাগ করে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। মানুষের কোনো অবদান না থাকলেও পৃথিবীত নিয়মিতভাবে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতো। কিন্তু প্রকৃতির সেই স্বাভাবিক বিলুপ্তির হারের চেয়ে মানুষের দ্বারা প্রভাবিত বিলুপ্তির হার অত্যন্ত বেশি যা প্রাণিকুলের জন্য আশঙ্কাজনক।

Share.

মন্তব্য করুন