আমার বয়স তখন দশ-এগারোর বেশি নয়। পাড়ার মানুষ আমাকে দেখে বলতো- এই হলো রমজান শেখের নাতি। আমি খুব একটা তাকাতাম না তাদের দিকে। শুনে আমার বেশ ভালো লাগতো। কেন না দাদুকে পাড়ার সবাই সম্মান করতো। ভয়ও করতো। দাদুর চেহারা ছিল বাঘের মতো। রয়েল বেঙ্গল বাঘের মতই চলতেন নির্ভীক। তবে ক্রাচে ভর দিয়ে। কাঠের তৈরি ক্রাচ্। উপরের দিকটা একটু চওড়া আর কালো চামড়া দিয়ে মোড়ানো। দেখতে একটু অন্যরকম। দাদুর পায়ে ব্যথা ছিলো কিনা জানি না। ঘরে ক্রাচ্ ছাড়াই হাঁটা-হাঁটি করতেন। কিন্তু নিজের ঘর ছেড়ে বাইরে যাওয়ার সময় ক্রাচ্ তাঁর বাঁ বোগলে ধরা থাকতো। অনেক সময় মনে হয়েছে ক্রাচ্ বোগলে নিয়ে চলাফেরা বুঝি দাদুর অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। তাই বলে দাদুর কাছে কিছু বলা বা জানার সাহস ছিলো না আমার। শুধু আমার নয়, বাড়ির কারোর সাহস ছিলো না দাদুর মুখের উপর কথা বলা।
বাইরের কারোর সাথে তেমন একটা কথা বলতেন না দাদু। সে সময় পাড়ায় একটি মাত্র তিনতলা বাড়ি- যা ছিলো আমাদের। আমাদের বাড়িটা ছিলো শহরতলিতে। দাদুর বয়স তখন ষাটের উপরে। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, ফ্রাঞ্চকাট দাড়ি। পরিপাটি চেহারা। সাদা পায়জামার সাথে আর্দির পাঞ্জাবি। গলায় সোনার চেইন। বড় বড় চোখ। সে চোখের দৃষ্টি যেনো চলে যেতো বহুদূর। দাদুকে কখনো চশমা পরতে দেখি নাই। নিচের একটা ঘরে থাকতেন দাদু। ঘর ভরা সুন্দর-সুন্দর আসবাবপত্র। বড় একটা ইজি চেয়ারে বসে তিনি বই পড়তেন। শ্বেত-পাথরের একটা টেবিলে বসে তিনি খেতেন। মা আর ছোট চাচী খাবার নিয়ে আসতেন দাদুর ঘরে। রাতে মাছ, মাংস খেতেন না। ঘন দুধের সাথে সব্রি কলা কখনো মিষ্টি।
বাবা আর ছোট চাচা শুয়ে-বসে দিন কাটাতেন। দাদু কিছুদিন পর-পরই যেতেন শহরে। বাড়ি ফিরতে কখনো-কখনো রাত হয়ে যেতো। শহর থেকে টাকা নিয়ে আসতেন। বাবা অথবা ছোট চাচা দাদুকে বলতেন, আমরা কেউ আপনার সঙ্গে যাই। আপনার বয়স হয়েছে, পথে কোনো বিপদ হলে কে আপনাকে দেখবে। দাদু বলতেন, আমার সঙ্গে তোমাদের যেতে হবে না। তোমরা নিজেদের কাজের ব্যবস্থা করে নাও। আমি মারা গেলে তখন তো বিপদে পড়বে। বাবার কাছে শুনেছি, দাদু শহরে কিছু একটা করতেন। চাকরি না ব্যবসা তা তারা জানতেন না। তখনই দাদু তিনতলা বাড়ি করেন। তারপর মাঝে-মাঝে শহরে গিয়ে টাকা নিয়ে আসেন।
একদিন আমি স্কুল থেকে ফিরে বাইরে খেলা করছি।
আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় একশত গজ দূরে লোহার গেইট। তো সেখানে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকলেন। আমি এগিয়ে গেলাম। লোকটি বললো, তোমার নাম কী? আমি বললাম, আরিফুল হাসান।
– সুন্দর নাম। আচ্ছা এ বাড়িটা কি রমজান শেখের?
– জি।
– তিনি তোমার কী হন?
– আমার দাদু।
– তিনি কী বাড়িতে আছেন?
– জি আছেন।
– ওনাকে একটু ডেকে দেবে? তোমার দাদুকে গিয়ে বলবে জহুরুল নামে একজন লোক আপনাকে ডাকছে। আমি দৌড়ে দাদুর ঘরের সামনে গেলাম। দরজার পর্দা সরিয়ে দেখলাম, দাদু ইজি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে আছেন। আমি সাহস করেই তাঁর ঘরে ঢুকে বললাম, দাদু একজন লোক আপনাকে ডাকছেন। দাদু চোখ বড় করে বললেন, কে ডাকে।
– লোকটার নাম জহুরুল। মাথায় হ্যাট, পরনে শার্ট, প্যান্ট।
নামটা শুনেই দাদু যেনো চম্কে উঠলেন। বললেন, সে কোথায়? আমি বললাম, গেটের সামনে। দাদু ধীরে-ধীরে চেয়ার থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। চুপি-চুপি লোকটাকে দেখলেন- তারপর বললেন, লোকটাকে গিয়ে বল দাদু ঘুমাচ্ছে। দেখা হবে না। আমি গিয়ে বললাম, দেখা হবে না। দাদু ঘুমাচ্ছেন। এখন তাকে ডাকা যাবে না। লোকটা আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলেন তারপর আর কোনো প্রশ্ন না করে চলে গেলো। আমি ফিরে এলে দাদু বললেন, লোকটা আর কিছু বললো?
– না।
– লোকটাকে কখনো এদিকে আসতে দেখলেই আমাকে জানাবি।
আমি তখন অবাক হয়ে ভাবলাম, দাদু কেনো লোকটার সঙ্গে দেখা করলেন না। কেনো তাকে দেখে ভয় পেলেন। সারা বাড়ি চেয়ে থাকতেন দাদুর দিকে। আমি সেই বয়সেও বুঝতে পারতাম, এ বাড়ির মণিকোঠায় বসে আছেন দাদু। তিনি ছাড়া কারো কোনো উপায় নেই। যেদিন সকাল-সকাল খাওয়া-দাওয়া সেরে, পরিপাটি পোশাক পরে দাদু ক্রাচে ভর দিয়ে শহরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তেন, সেদিন বাবা আর ছোট চাচা আরাম করে বিছানায় পড়ে থাকতেন। মা বাবার সঙ্গে এ নিয়ে ঝগড়াও করতেন। দুপুরের পর মা, চাচী ঘন-ঘন বারান্দায় গিয়ে পথের দিকে তাকাতেন। দাদুর ফিরতে দেরি দেখে মায়ের মুখে যেনো সন্ধ্যা ঘনাতো। বাবা আসছেন না কেনো? দাদু ফিরে এলে সবাই চিন্তামুক্ত হতেন।
লোকে বলতো, রমজান শেখের টাকায় শেওলা পড়েছে। তিনি বড় বড় নোট শুকান ছদে। আমি অবশ্য কখনো এমনটি দেখিনি। বাবা রোজ সকালে দাদুর ঘরে ঢুকে টাকা হাতে নিয়ে বের হতেন। সংসারের যাবতীয়খরচ চালাতেন দাদু। আমি ভাবতাম, দাদুর বুঝি অনেক টাকা। কিন্তু বাড়িতে তাঁর টাকা থাকতো না। হাত খালি হওয়ার আগেই দাদু যেতেন শহরে। বাড়ির অন্যরা বলাবলি করতেন, শহরের ব্যাংকে দাদুর টাকা থাকে। তিনি সেখান থেকেই টাকা আনেন।
মাঝে-মাঝে দাদু হাওয়া খেতে বের হতেন। নির্জন মাঠের দিকে অথবা পুরনো রেললাইনের ধারে যেতেন। সঙ্গে থাকতো কাঠের ক্রাচ্। ক্রাচে ভর দিয়ে চলতেন আনমনে। দাদু কলতলা গেলেও ক্রাচ্ তাঁর বাঁ হাতে ধরা থাকতো। ক্রাচ্টা যেনো দাদুর সঙ্গের সাথি।
একদিন লোকের মুখে খবর শুনে কান্নার হাট বসলো বাড়িতে। বাবা, চাচা ছুটলেন, মাঠের দিকে। জায়গাটা বেশ নির্জন। দাদু পড়ে আছেন সেখানে। বাঁ পাঁজরে বেশ বড় একটা ছুরি বিঁধে আছে। রক্তে লাল হয়ে গেছে তাঁর জামা-কাপড়। বাড়িতে আনার পর ডাক্তার এলেন। শহরের বড় হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু যাওয়ার আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন দাদু। দারোগা, পুলিশ এলো। পাড়ার মানুষ এসে হায়-হায় করতে লাগলো। সবার মুখে এক কথা- এই ভালো মানুষটারও যে ভয়ানক শত্রু ছিলো তা- কে জানতো। তাঁকে তো কোনো দিন কারোর সাথে ঝগড়া ফ্যাসাদ করতেও দেখিনি। কার কি এমন ক্ষতি করেছিলো যে, তার জন্য তাঁকে জীবন দিতে হলো।
দারোগা সাহেব বাড়ির বড়দের সাথে কথা বললেন। জানতে চাইলেন, তাঁর সাথে কারোর শত্রুতা ছিলো কি না। কোনো লোক এ বাড়িতে যাতায়াত করতো কি না। অথবা তিনি কারোর বাড়িতে যেতেন কি না। পুলিশের জেরার মুখে বড়রা মেপে-মেপে কথা বলছেন। আমি ছোট মানুষ আমার কাছে কোনো কথা জানতে চায়নি। আমিও কিছু বলিনি। এমনিতেই একান্ত প্রয়োজন না পড়লে কেউ পুলিশের কাছে যায় না। তবে, বড় হয়ে মনে হয়েছিলো, জহুরুল নামের সেই লোকের কথা পুলিশের কানে দিতে পারলে হয়তো খুনের রহস্য জানা যেতো।
যাইহোক, দাদুর কুলখানি করা হলো। তিনি নামকরা ব্যক্তি ছিলেন, তাই তাঁর কুলখানিও করা হলো বড় করে। বাবা চাচার হাতে গুছিয়ে রাখা যে টাকা-পয়সা ছিলো, সেসব খরচ হলো। এ ছাড়াও কিছু ধারও করতে হয়। পুলিশ অন্ধের মতো কিছুদিন ছোটাছুটি করেছিলো কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এ ব্যাপার নিয়ে তারা আর মাথা ঘামায়নি।
দাদুর মৃত্যুর পর বাবা সে ঘরে তালা লাগিয়ে দেন। একদিন বাবা, চাচা দাদুর ঘরের তালা খুললেন। ঘরের ভ্যাপসা গন্ধ নাকে লাগলো। জানালা খুলে দেয়া হলো, আলো এসে পড়লো ঘরে। এর মধ্যেই মিহি ধুলার আস্তর পড়েছে সব কিছুর ওপর। দাদুর আলমারি খুললেন। চারটি তাক খালি করা হলো। দাদুর একটা ব্যাগ আর জামা-কাপড় ছাড়া সেখানে অন্য কিছু পাওয়া গেলো না। শুধু ব্যাগের মধ্যে দু’শ টাকা ছিলো। সবার মুখে যেনো ছাই পড়লো।
বাবা বললেন, মানিক বাবার পাসবুক গেলো কোথায়?
চাচা বললেন, আমিও তো তাই বলি। আবার নতুন করে খোঁজা শুরু হলো। মা আর চাচীও এ কাজে হাত লাগালেন। সারা ঘর তন্ন-তন্ন করে খোঁজা হলো। খাট্ থেকে বালিশ, কাঁথা তোশ্ক নামানো হলো- টেবিল, চেয়ারের নিচে পর্যন্ত দেখতে বাদ থাকলো না। কিন্তু পাসবই বা কোনো কাগজ-পত্র পাওয়া গেলো না। চাচা বললেন, তা’হলে কি বাবার কোনো ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট ছিলো না। বাবা বললেন, অ্যাকাউন্ট না থাকলে টাকা আসতো কোথা থেকে। বাবা যে নিঃস্ব ছিলেন, এ কথা বিশ্বাস করা যায় না।
– ঘরের লোক কেনো- বাইরের লোক বিশ্বাস করবে না।
– কতবার বলেছি, আমরা কেউ যাই আপনার সঙ্গে।
উনি রাজি হতেন না। তাঁর কথার উপরে কথা বলিনি কোনোদিন।
– তা’হলে টাকা আসতো কোথা থেকে। কারো কাছে ব্যবসা করতে মোটা অংকের টাকা দিয়েছিলেন কি? হয়তো সেখান থেকেই টাকা আনতেন।
– তেমন কোনো কাগজপত্রও তো ঘরে নেই।
চাচা বললেন, এখান থেকে কেউ কি কিছু সরিয়ে নিলো?
বাবা রেগে উঠলেন। এসব তুই কী বলছ্সি। ঘরের চাবি তো আমার কাছে। তুই কি আমাকে সন্দেহ করছিস?
– তা কেনো। এ রকম কি হয় না। আমাদের অজান্তে কেউ কাজটা করলো।
– তাই বা কি করে হবে। ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গেলে বাবার সই লাগবে না।
ভেবে কোনো কূলকিনারা না পেয়ে চুপ করলো সবাই। কিন্তু মনের চিন্তা মনেই থাকলো। দাদু থাকতে কোনো অভাব ছিলো না। দিব্যি দাদুর ঘর থেকে টাকা বের হতো। রাতে মা বাবাকে বললেন, এ তো দেখছি- তাজ্জব ব্যাপার। বাবা তো সামান্য দু’শ টাকার মানুষ ছিলেন না।
– তবু এটাই তো দেখা যাচ্ছে।
– চাবি তোমার কাছে রাখা ঠিক হয়নি। তোমার ছোট ভাই কিন্তু তোমাকেই সন্দেহ করছে।
– মানুষ সব সময় সঠিক বিচার-বিবেচনা করে কথা বলে না। সন্দেহ জিনিসটা এমন, একবার মনে ঢুকে গেলে সহজে তাকে ঝেড়ে ফেলা যায় না।
বাড়ির আব্হাওয়া ভারি হয়ে উঠলো। মা, চাচীর হাসি-খুশি মুখ ছাইমাখা হয়ে গেলো। শুকনো মুখে আমি এদিক-সেদিক ঘুরি। কি যেনো কি হয়ে গেলো।
চলি-ফিরি আগের মতই কিন্তু কি যেনো নেই। ফিস্ফাস চলতে লাগলো বাড়ির আনাচে-কানাচে। তারপর তুচ্ছ সব জিনিস নিয়ে চলতে লাগলো মন কষাকষি। আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না।
একটা দিনের কথা আজও মনে পরে। শীতের এক সকালে বাগানের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। দাদুর সখের বাগান। এখন আর কারোর বাগান করার সখ নাই। দাদু মারা যাওয়ার পাঁচ-ছয় মাস পর গাছে-গাছে গোলাপ ফুটে ছিলো। ঘাসের আগায় জ্বল-জ্বল করছিলো শিশির বিন্দু। কান্তি বাবু এলেন। মাঝ বয়সী ভদ্রলোক। ক্লিন সেভ, দু’একটি চুল পেকেছে। জামা-কাপড়ের বাহারি আলাদা। আমাকে দেখে বাগানের ধারে এসে তিনি বললেন, এটা কি রমজান শেখের বাড়ি?
– জি।
– তিনি বাড়িতে আছেন।
– তিনি মারা গেছেন।
– যা সন্দেহ করেছিলাম, তাই হলো। তাঁর ছেলেরা আছেন?
– আপনি ভেতরে এসে বসুন। আমি বাবাকে ডেকে দিচ্ছি।
বৈঠকখানায় বসলেন তিনি। বাবা আর চাচুর সাথে অনেকক্ষণ কী সব আলাপ আলোচনা করে সবাই দাদুর ঘরে গেলেন এবং আবার খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। এবার লেপ-তোশক, বালিশ ছিঁড়ে ফালা-ফালা করা হলো।
বাবা, চাচার হাল দেখে আমার বুক দুরো-দুরো করে কাঁপছিলো। বাতাসে তুলা ভেসে বেড়াচ্ছে। সবাই ঘেমে নেয়ে উঠেছে। সেই ঘামের সাথে তুলা লেগে বাবা আর চাচাকে পাগলের মতো দেখাছিলো। সেদিন ব্যাপারটা আমাদের জানা হয়ে গেলো। দাদু বছরে দু’তিনবার যেতেন কান্তি বাবুর কাছে। সেখান থেকেই টাকা আনতেন দাদু। বিনিময়ে হীরা আর দামি-দামি পাথর দিতেন বাবুকে। বাবু সে সব আরো চড়া মূল্যে বিক্রি করতেন বড় বড় লোকদের কাছে। সেবার দাদু সময় মতো শহরে যাননি বলেই তিনি ছুটে এসেছেন খবর নিতে।
এত করেও কোথাও কিছু না পেয়ে বাবু বললেন, রমজান শেখের আর কী কী ছিলো? বাবা বললেন, আর কী কী ছিলো মানে? বাবু বললেন, যেখানে হীরা আর পাথরগুলো লুকিয়ে রাখা যায়। আমার হঠাৎ মনে পড়লো দাদুর ক্রাচ্টা কোথায়? সেটা তো দেখছি না। আমি বললাম, বাবা দাদুর যে ক্রাচ্ ছিলো সেটা কোথায় গেলো।
তখন ক্রাচের কথা শুনে সবাই চম্কে উঠলো। তাই তো- তিনি যে সব সময় ক্রাচ্ ব্যবহার করতেন, সেটা কোথায়? এতদিন ক্রাচের কথা কারোর মনেই পড়ে নাই। বাবু বললেন, খোকা ঠিকই বলেছে। আপনাদের বাবার ক্রাচ্টা অন্যরকম করে তৈরি করা ছিলো। আমার মনে হচ্ছে সেই ক্রাচের ভিতরই রাখা ছিলো হীরা আর দামি-দামি পাথর।
চাচা অবাক হয়ে বললেন, বাবা ক্রাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করতেন, তার মধ্যে হীরা রাখা কি সম্ভব?
– সম্ভব। উপরের দিকে বেশ চওড়া ভেতরে ফাঁপা ছিলো বলে আমার মনে হচ্ছে। তার মধ্যে পাথর রাখা মোটেই অসম্ভব নয়। অবশ্য একথা আমিও কখনো ভাবতে পারিনি। ওনার পায়ে কি সত্যি ব্যথা ছিলো?
– ঘরে তো বাবা ক্রাচ্ ছাড়াই হাঁটা-হাঁটি করতেন। ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার সময় বাবা ক্রাচ্টি বাঁ হাতে নিতেন। তবে, ব্যথা ছিলো কি না বলতে পারবো না। খোঁজ পড়লো দাদুর ক্রাচ্রে কথা। সবাই বলতে লাগলো- এতদিন ক্রাচের কথা কারো মনে হয়নি কেন!
বাড়িতে ক্রাচ্ নেই। দাদু যেদিন খুন হয়েছিলেন, সেদিনও তাঁর বগলে ক্রাচ্ ছিলো। এবার খুনের রহস্য বোঝা যেতে লাগলো। ঐ ক্রাচের জন্যই দাদুকে খুন করা হয়েছিলো। আবার সেই জহুরুলের কথা মনে পড়লো আমার। দাদু তাকে ভয় পেয়েছিলেন, সেই জহুরুলই যে দাদুকে খুন করেছে, এতে আমার কোন সন্দেহ থাকলো না। কিন্তু তাঁর ক্রাচ্টা গেলো কোথায়! সবাই দাদুকে মাঠ থেকে নিয়ে এলেন কিন্তু ক্রাচের কথা কারোর মনে পড়ে নাই। বাবা মনে হয় আন্দাজেই বলে ফেললেন, ক্রাচ্টা কার হাতে যেনো দেখেছিলাম, ঠিক মনে পড়ছে না। চাচা বললেন, বড় ভাই ভালো করে একবার ভাবুন তো- লোকটা কালো, ফর্সা, বেঁটে না লম্বা।
ভাবতে-ভাবতে বাবার মাথা ঘুরতে শুরু করলো। হায়..হায় করতে লাগলো বাড়ির সবাই। এতো বড় সম্পদ হাত ছাড়া হয়ে গেলো। ঐ ক্রাচের মধ্যে না জানি কত হীরা আর দামি-দামি পাথর ছিলো। শত-শত মুখ একটার পর একটা ভেসে যায় বাবার চোখের সামনে দিয়ে। বাবা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না, কোন মানুষটার হাতে সেদিন ক্রাচ্টা দেখেছিলেন। এ সময় চিৎকার করে উঠলেন বাবা, না-না আমি কাউকে চিনতে পারছি না। শেষে গোপনে সবাই এপাড়া-সেপাড়া রাস্তা-ঘাটে ক্রাচ্ খুঁজতে লেগে গেলাম। কারোর বগ্লে ক্রাচ দেখলেই বাবা ছুটে যান তার কাছে। বিনয়ের সুরে বলেন, দেখি আপনার ক্রাচ্টা। বাবা উল্টে-পাল্টে দেখে বলেন, না এটা না। আমার বাবার ক্রাচ্টা ছিলো অন্যরকম। তার ভিতরটা ছিলো ফাঁপা। তার মধ্যে হীরা রাখা ছিলো। সেই ক্রাচটা হারিয়ে গেছে। মানুষ যেমন লাঠির মধ্যে গুপ্তি রাখে। তেমনি বাবা তার মধ্যে হীরা আর দামি-দামি পাথর রাখতেন।
সংসারে ফাটল ধরলো, বাবা, চাচা পৃথক হয়ে গেলেন। কারো কোনো আয় নেই। কেবলই খরচ। এই অবস্থায় বাবা একদিন পাগল হয়ে গেলেন। চাচারও কোনো হাল নেই। জোড়া-তালি দিয়ে সংসার চলতে লাগলো। আরও কিছুদিন পর বাড়ি বিক্রি হলো। তখন ছোট একটা ঘরে আমি মা আর আমার ছোট বোন থাকতাম।
বাবা তখন পাগলা গারদে। এই অবস্থার মধ্যেই আমি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে লাগলাম। একদিন স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকলাম। বি.এ পাস করে চাকরির সন্ধান করছি। শেষে আল্লাহ্‌র রহমতে ভালো একটি চাকরি জুটলো। বাবা মারা গেলেন। সেই শোকে কিছুদিন পর মাও চলে গেলেন।
তখন ক্রাচের কথা আর কেউ ভাবি না। আরো কয়েক বছর পর বাজার করে রেল লাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। সঙ্গে আমার আট বছরের ছেলে। হঠাৎ সে আমার হাত ধরে চিৎকার দিয়ে বললো, বাবা ঐ দেখো তোমার দাদুর ক্রাচ্। আমি চম্কে উঠলাম- আবার সেই ক্রাচ্! দেখি চুল, দাড়ি পাকা এক বৃদ্ধ ফকির ক্রাচে ভর দিয়ে রেল লাইনের অন্য পাশ দিয়ে হেঁটে যাছে। থম্কে দাঁড়ালাম। খেয়াল করে দেখলাম, ক্রাচ্টা সত্যি অন্য রকম- দাদুর ক্রাচের মতই। আমার বুকের মধ্যে তখন ঢিপ-ঢিপ শুরু হয়ে গেছে। একবার ভাবি! ক্রাচ্টা দেখি না। আবার ভাবি, ধুৎ ঐ চিন্তা আর করবো না। এই ক্রাচ্ই আমাদের সংসার ধ্বংস করেছে। বাবা, মা মরেছে, আমরাও ফকির হয়ে গেছি। কিন্তু কে যেনো আমার মনটাকে টেনে নিয়ে গেলো সেই ফকিরের কাছে। ফকিরকে বললাম, দেখি আপনার ক্রাচ্টা। বৃদ্ধ ফকির আমার দিকে তাকিয়ে বললো, বাবা! আমি এই ক্রাচ্ ভর দিয়ে ভিক্ষা করে বেড়াই। এর কি দেখবেন? আমি ক্রাচ্টা হাতে নিয়ে দেখি- সেই ক্রাচ্। উপরের মাথা ধরে টান দিতেই সেটা খুলে গেলো। নিচে চামড়া লাগানো খানিকটা জায়গা ফাঁপা। তার মধ্যে কিছু নেই। আমার চোখে ভেসে উঠলো জহুরুল নামের সেই মানুষটার মুখ।
– এটা আপনি কোথায় পেয়েছেন?
– অনেকদিন আগে পুরনো ওয়াগানের পাশে পড়ে ছিলো। এটা পেয়ে আমার যে কি উপকার হয়েছে, তা আর কি বলবো।
– কি রকম?
– এটার জন্যই তো আমি দ্রুত হাঁটা-চলা করতে পারি।
এই ক্রাচ্টা আমার দাদুর, এর মধ্যে হীরা থাকতো সে কথা আর বললাম না তাকে। একটু হেসে বললাম, এটা যে আপনার অনেক উপকারে এসেছে- শুনে ভালো লাগলো। মনে মনে বললাম, হায়রে ক্রাচ্ তুই এখন ফকিরের হাতে। তারপর তার হাতে দুটো টাকা দিয়ে ছেলেকে নিয়ে বাসার দিকে পা বাড়ালাম।

Share.

মন্তব্য করুন