ক্রিকেট রেকর্ডের খেলা। বেশির ভাগ রেকর্ডই বীরত্বমাখা। এক ক্রিকেটার অন্যকে টপকে রেকর্ড গড়েন। এক দেশ আরেক দেশকে হারিয়ে রেকর্ড গড়ে। কেউবা শিরোপা জিতে রেকর্ড গড়ে। তবে সব রেকর্ডই গৌরবের নয়। কিছু রেকর্ড আছে লজ্জার, যেগুলো কেউ গড়তে চায় না। অনিচ্ছায়ই এসব রেকর্ড হয়ে যায় কোন কোন দল বা ক্রিকেটারের। যেমন দলীয় সর্বনিম্ন স্কোরের রেকর্ড কিংবা সবচেয়ে বেশি বার শূন্য রানে আউট হওয়ার রেকর্ড। এই রেকর্ড কেউ কি আর গড়ত চায়!
তবু কাউকে না কাউকে তো সেই রেকর্ডের মালিক হতেই হয়। আজ আলোচনা করবো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে কম রানে অলআউট হওয়ার রেকর্ডগুলো নিয়ে।

টেস্ট : নিউজিলান্ড
টেস্ট ক্রিকেটের জন্ম আজ থেকে ১৪৩ বছর আগে।  ১৮৭৭ সালের ১৫-১৯ মার্চ ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচটিতে অংশ নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড। তবে টেস্টের ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক স্কোরটি লেখা আছে নিউজিল্যান্ডের নামের পাশে। ১৯৫৫ সালে দেশের মাটিতেই তারা এই ঘটনার জন্ম দিয়েছিল ইংলান্ডের বিপক্ষে। সেটি ছিল ইতিহাসের ৪০২ নম্বর টেস্ট। নিউজিল্যান্ড টেস্ট খেলা শুরু করেছিল ১৯৩০ সালে।ত তাই তারা যে তখন নতুন দল ছিল সেটা বলা যাবে না।
অকল্যান্ডের ওই টেস্টে আগে ব্যাট করে প্রথম ইনিসে ২০০ রান করে ব্ল্যাক ক্যাপসরা। জবাব দিতে নেমে ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংস শেষ হয় ২৪৬ রানে। তাই মাচটিতে প্রতিদ্বন্দ্বীতার আভাসই পাওয়া যাচ্ছিল; কিন্তু নিউজিল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামতেই পাল্টে যায় পরিস্থিতি। শুরু হয় আসা-যাওয়ার মিছিল। ২৬ রানে অলআউট হয় জিওফ রাবোনের দল। ইংলিশ বোলারদের কেউ যে সেদিন একক তাণ্ডব চালিয়েছেন তা নয়। আসলে কিউই ব্যাটসমানরাই একের পর এক উইকেট বিলিয়ে দিয়েছেন। একজন মাত্র ব্যাটসমান দুই অংকের ঘরে পৌঁছতে পেরেছিলেন। স্কোরবোর্ডের চেহারাটা ছিল এমন (১১, ১, ০, ১, ১, ৭, ৫, ০, ০, ০*, ০)। প্রথম উইকেটের পতন হয়েছিলত দলীয় ৬ রানে। এরপর যথাক্রমে ৮, ৯, ১৪, ১৪, ২২, ২২, ২২, ২৬, ২৬, ২৬ রানে একের পর এক উইকেট পড়তে থাকে।
২৭ ওভারে শেষ হয় নিউজিল্যান্ডের ইনিংস। তিন দিনে শেষ হওয়া ম্যাচটি ইংল্যান্ড জিতে নেয় ইনিংস ও ২০ রানে। ইংলিশ বোলাদের মধ্যে বব অ্যাপলেয়ার্ড ৭ রানে ৪টি, ব্রেইন স্টাথাম ৯ রানে ৩টি উইকেট নেন। এছাড়া ফ্রাঙ্ক টেসন ২টি ও জনি ওয়ার্ডল ১ উইকেট নেন।
এর আগে দীর্ঘ ৫৯ বছর এই লজ্জার রেকর্ড বয়ে বেড়িয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৮৯৬ সালে পোর্ট এলিজাবেথে ইংল্যান্ডের কাছে ৩০ রানে অলআউট হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৯৫৫ সালে এসে নিউজিল্যান্ড নিজেদের কাঁধে তুলে নেয় সেটি। এরপর নিউজিল্যান্ড ৬৫ বছর ধরে সেই রেকর্ড বয়ে চলছে তাদের কে মুক্তি দেবে?
টেস্টে সর্বনিম্ন স্কোরের ৫টির মধ্যে চারটিই দক্ষিণ আফ্রিকার (৩০, ৩০, ৩৫, ৩৬)। আর সর্বনিম্ন পাঁচ স্কোরের চারটি হয়েছে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, বাংলাদেশের সর্বনিম্ন টেস্ট স্কোর ৪৩। ২০১৮ সালের জুলাইতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অলআউট হয়েছিল সাকিব আল হাসানের দল।

ওয়ানডে : জিম্বাবুয়ে
টেস্টে যে লজ্জা নিউজিল্যান্ডের ওয়ানডেতে সেটি জিম্বাবুয়ের। ২০০৪ সালে ঘরের মাঠে তাতেন্দা তাইবুর দল এই ঘটনার জন্ম দিয়েছিল মারভান আতাপাত্তুর শ্রীলঙ্কাার বিপক্ষে। সিরিজের তৃতীয় মাচ ছিলো সেটি।
হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে সেদিন টস হেরে ব্যাট করতে নেমেছিল স্বাগতিকরা। চতুর্থ ওভারে মাতসেকেনেরির রান আউট দিয়ে শুরু। তবে তখনও বোঝা যায়নি সেদিন কী ভয়াবহতা অপেক্ষা করছিল জিম্বাবুয়ের জন। দিলহারা ফার্নান্ডো অষ্টম ওভারে পরপর দুই বলে ডিওন ইব্রাহিম ও তাইবুকে তুলে নিলে শুরু হয় ধ্বংস, স্কোর বোর্ডে রান তখন ১৮। পরের ওভারে চামিন্দা ভাস আবার জোড়া আঘাত হানেন।
এরপর ব্যাটসম্যানদের আসা যাওয়ার মিছিল চলতেই থাকে। স্কোর বোর্ডের চেহারা ছিল এমন ৪, ৪, ৭, ০, ০, ২, ৪, ৩*, ০, ৪, ০। সর্বোচ্চ ৭ রানের ইনিংসটি খেলেছেন ডিওন ইবাহিম। চামিন্দা ভাস ১১ রানে ৪টি, ফারভিজ মাহরুফ ৩ রানে ৩টি এব দিলহারা ফার্নান্ডো ১৮ রান খরচ করে ২ উইকেট নেন। ১৮ ওভারে শেষ হয় ইনিংস। শ্রীলঙ্কা মাচ জেতে ৯ উইকেটে।
এদিনের আগে দলীয় সর্বনিম্ন রানের রেকর্ড ছিলো কানাডার। এর এক বছর ২ মাস আগে তারা এই লঙ্কানদের কাছেই অলআউট হয়েছি ৩৬ রানে। তার আগে আবার ছিল জিম্বাবুয়ের ৩৮ রানের রেকর্ড। অর্থাৎ জিম্বাবুয়ে নিজেদের রেকর্ডই আবার ফিরে পেয়েছে সেদিন। মজার ব্যাপার হচ্ছে ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বনিম্ন স্কোরের এই তিনটি ঘটনাই লঙ্কানদের বিপক্ষে। আবার চার নম্বরে আছে সেই শীলঙ্কাই। ২০১২ সালে তারা ৪৩ রানে অলআউট হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। ৪৩ রানে পাকিস্তানও একবার অলআউট হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে (১৯৯৩)। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বনিম্ন স্কোর ৫৮ (দুই বার)। ২০১১ বিশ্বকাপে ঢাকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে এবং ২০১৪ সালে দ্বিপক্ষীয় সিরিজে একই মাঠে ভারতের কাছে ৫৮ রানে অলআউট হয়েছিল লাল-সবুজের দল।

টি-টোয়েন্টি : তুরস্ক
বন্ধুরা, এই অনুচ্ছেদের শিরোনামে তুরস্কের নাম দেখে অবাক হয়েছো নিশ্চয়ই! মনে প্রন জেগেছে হয়তো- ইউরোপের দেশ তুরস্ক কি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে? তাই এ বিষয়ে বলার আগে একটি তথ্য জানিয়ে রাখি। আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ও টেস্ট মাচ খেলার জন্য প্রতিটি দলকে আলাদা আলাদা যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। আইসিসি দলের পারফরম্যান্স বিবেচনা করে কোন দলকে টেস্ট কিংবা ওয়ানডে খেলার অনুমতি দেয়। যেমন বাংলাদেশ একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার যোগ্যতা বা ‘ওয়ানডে স্ট্যাটাস’ অর্জন করেছে ১৯৯৭ সালে। আর টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জন করেছে ২০০০ সালে। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া দলগুলোকে বলা হয় আইসিসির পূর্ণ সদস্য। আর অন্যরা সবাই সহযোগী সদস্য দেশ। কিন্তু বছর দুই আগে আইসিসি ঘোষণা করে যে, সহযোগী সদস্য দেশগুলোর সবাই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলতে পারবে। এজন্য আলাদা কোন যোগ্যতা অর্জন করতে হবে না। বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট ছাড়াও দুই সহযোগী সদস্য দেশ নিজেদের মধ্যে যদি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ আয়োজন করে সেগুলো আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির স্বীকৃতি পাবে।
আর এ কারণেই তুরস্ক ঢুকে গেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের রেকর্ড বুকে। ২০১৯ সালের আগস্টে রোমানিয়ায় আয়োজন করা হয়েছিল একটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের। অংশ নিয়েছিল ইউরোপের রোমানিয়া, অস্ট্রিয়া, চেক রিপাবলিক, লুক্সেমবুর্গ ও তুরস্ক। যার প্রত্যেকেই ক্রিকেট বিশ্বে হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলছে।
সেই টুর্নামেন্টে পরপর তিন দিন তিন মাচে ২১, ২৮ ও ৩২ রানে অলআউট হয়ে লজ্জার রেকর্ড গড়ে তুরস্ক তাই সর্বনিম্ন স্কোরের তিনটিই তুরস্কের। চেক রিপাবলিকের বিপক্ষে ২১ রানে অলআউট হওয়া ম্যাচের স্কোরটিই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সর্বনিম্ন দলীয় রানের রেকর্ড এখন।
সে মাচে তুরস্কের ৮ বাটসমান আউট হয়েছেন ০ রানে। তিন জন যথাঙ্ক্রমে ১২, ৪ ও ১ রান করেছে। আর চেক বোলাররা ৪টি অতিরিক্ত রান দিয়েছেন। সে মাচে আগে ব্যাট করে ২৭৮ রান করেছিল চেক রিপাবলিক। তাদের একজন ব্যাটসমান সেঞ্চুরিও করেছিল।
ফুটবল খেলুড়ে দেশ তুরস্ক ক্রিকেটে একেবারেই নতুন। দেশটিতে সরকারিভাবে ক্রিকেটে পৃষ্ঠপোষকতা শুরু হয়নি। বিভিন্ন পেশার কিছু লোকজন অবসরে শখের বসে ক্রিকেট খেলেন, তাদের নিয়েই গঠিত হয় জাতীয় দল। বিশ্ব ক্রিকেটের পেশাদার দলগুলোর মধ্যে নেদারল্যান্ড একবার ৩৯ রানে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪ রানে অলআউট হয়েছিল আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে।

Share.

মন্তব্য করুন