জামান সাহেব অফিস থেকে এসে কারো সাথে কোনো কথা না বলে একেবারে চুপ করে নিজ ঘরে বসে রইলেন। স্বামীর চেহারা দেখে স্ত্রী রাহিমা বেগমের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। জামান সাহেবের যখন রাগ চরমে ওঠে তখন একেবারে চুপসে যান। অথবা তিনি যখন অনেক কষ্ট পান তখনও এই অবস্থা হয়। কিন্তু আজ কী হয়েছে মিসেস জামান আন্দাজ করতে পারছেন না।
একটু ভয় নিয়েই মিসেস জামান জানতে চাইলেন, ‘কী ব্যাপার, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? অফিসে কোনো প্রবলেম?’ হ্যাঁ/না কোনো জবাব না দিয়ে উল্টো জানতে চাইলেন, ‘রাজিব এখনো স্কুল থেকে আসেনি?’
‘না এখনো আসেনি তবে আসার সময় হয়েছে এখনই চলে আসবে।’ বললেন মিসেস জামান।
এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো, মিসেস জামান দরজা খুলতেই রাজিব ঘরে ঢুকলো। হন্তদন্ত হয়ে মায়ের কাছে খাবার চাইল। মা বললেন, ‘তোর বাবা অফিস থেকে এসে এখনো খায়নি। তোর খোঁজ করছিলেন।’
রাজিব কাঁধের ব্যাগটা রেখে বাবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে প্রবেশের অনুমতি চাইল।
‘খেয়ে তারপর আমার ঘরে একবার এসো’- বাবার নরম কণ্ঠের ছোট্ট আদেশ। রাজিব খাবার শেষ করে বাবার কক্ষে প্রবেশ করলো, পেছনে ছেলের সাথে মা। ‘বল বাবা, কী হয়েছে?’
রাজিবের উৎসাহী তাড়া। জামান সাহেব কয়েকটা কাগজ বের করে ছেলের হাতে দিলেন। পেপারগুলো দেখে রাজিবের হাত-পা অনবরত কাঁপছে। এ কী! তাহলে বাবা আজ সব জেনে গেছে! রাজিব কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। মিসেস জামান ছেলের হাত থেকে পেপারগুলো নিয়ে চোখ বুলাতেই চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। এক মাসে পাঁচ দিন স্কুলে যায়নি। অথচ প্রতিদিন বাসা থেকে স্কুলের উদ্দেশে বেরিয়েছিল। ক্লাস টিচারকে বোকা বানাতে ছুটির দরখাস্ত দিয়েছে তাতে অভিভাবকের স্বাক্ষরের স্থানে নিজেই স্বাক্ষর করেছে।
আজ রাজিবের ক্লাস টিচার ফোন করে স্কুলে ডেকেছিলেন এবং এই দরখাস্তের কপিগুলো দিয়েছেন। মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে রাজিব কিছু খারাপ বন্ধুর পাল্লায় পড়েছে। আজও সে স্কুলে যায়নি। ‘এই সব কী রাজিব? তুই প্রতিদিন স্কুলে যাস অথচ ক্লাসে উপস্থিত না থেকে কোথায় যাস?’
বাবার এমন প্রশ্নে কোনো জবাব দিতে পারে না রাজিব। ‘আমার ছেলে স্কুল ফাঁকি দিয়ে, বাবার স্বাক্ষর জাল করে টিচারকে বোকা বানাচ্ছে, ভাবতেই ঘেনড়বা লাগে আমার’- এই বলে ছেলেকে ধিক্কার দিলেন।
মিসেস জামান তো হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন। ‘এ কী করলি রাজিব! তুই এমন কাজ কেমনে করতে পারলি? বেরিয়ে যা, তোর মুখ আর আমি দেখতে চাই না’- বলেই পাশের রুমে চলে গেলেন। রাজিব বাবার পা জড়িয়ে ধরে বলছে, ‘বাবা ভুল হয়ে গেছে আমি আর কখনো এমনটি করবো না। বিশ্বাস করো, আমি এই কয়দিন পাড়ার বন্ধুদের সাথে মাঠে ত্রিকেট খেলছি!
কোনো মন্দ বা খারাপ কাজের সাথে যায়নি।’ রাজিবের অনুশোচনা দেখে বাবার হৃদয় প্রশান্ত হলো। তিনি ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, শোনো! আমাদের প্রিয় নবী একদিন সাহাবীদের উদ্দেশে বললেন, “আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গোনাহ সম্পর্কে বলবো? সাহাবীরা বললেন, হ্যাঁ আমাদের বলুন। তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শিরক করা, পিতা-মাতার সাথে নাফরমানি করা (কষ্ট দেয়া) এবং মিথ্যা বলা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।” (বোখারি শরিফ ৫৫৪৬ নম্বর হাদিস) বর্ণনাকারী সাহাবী আবু বাকরা (রা.) বলেন, ‘শেষ কথাটি রাসূল (সা.) বারবার বলতে থাকেন, এতো বেশি বলেছেন যে আমরা নবীজির চুপ হয়ে যাওয়াকে শ্রেয় মনে করতে লাগলাম।’
শোনো রাজিব! তুমি যা করেছ তা হলো : মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে শিক্ষককে ধোঁকা দিয়েছ। এর জন্য তোমার পিতা-মাতাও কষ্ট পাচ্ছেন। রাজিব বাবাকে আরো শক্ত করে ধরে বললো, ‘বাবা তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও, আর কখনো তোমাদের অবাধ্য হবো না, মিথ্যার ধারে কাছেও যাবো না।’ পিতা ও পুত্র তওবার উদ্দেশ্যে প্রভুর দরবারে হাত তুললেন আর সেই সাথে পেছনে মাও প্রার্থনায় শামিল হলেন।

Share.

মন্তব্য করুন