রাজন ইফতির হাত ধরে খুব নরম ও ভদ্র ভাষায় বললো, ‘দোস্ত আমারে তুই মাফ করে দে, আমি ভুল করেছি। আমি আর কখনো তোর সাথে এমন আচরণ করবো না।’ ইফতি লক্ষ করলো, রাজনের চোখে অশ্রু টলমল করছে। হঠাৎ রাজনের এই পরিবর্তন দেখে ইফতির বিশ্বাসই হচ্ছে না যে মানুষ এতো তাড়াতাড়ি বদলাতে পারে! ইফতি ক্লাসের সবচেয়ে ভদ্র ছেলেদের একজন আর রাজন একটু দুষ্টু প্রকৃতির। ইফতি স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না। কথা বলার সময় একটু তোতলায়, প্রায় কথাই রিপিট করে বলে।
এই নিয়ে রাজন প্রতিদিন ক্লাসে ইফতিকে ক্ষেপায়। ঝগড়া এড়াতে ইফতি তখন ক্লাস থেকে বেরিয়ে যায়।
গতকালও রাজন ইফতির তোতলামি নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে। সহ্য করতে না পেরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিল ইফতি। এমন সময় তাকে হেডস্যার দেখে রুমে ডেকে পাঠান। ইফতি স্যারের রুমে গিয়ে দাঁড়াতেই হেডস্যার তাকে এক নজরে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘কী হয়েছে ইফতি? মন খারাপ নাকি?’
‘জি-জি, ম-মানে কিছু হয়নি স-স্যার।’ ইফতির উত্তরে স্যার সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ডাক পড়লো ইফতির বন্ধু সাফতির। স্যার সাফতির কাছ থেকে সব কিছু শুনলেন। ইফতি কাঁদতে কাঁদতে বললো ‘স-স্যার, আ-আমি কি ই-ইচ্ছে ক-করে এমন ক-করি?’ স্যার ইফতির মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন। স্যার সবাইকে ক্লাসে পাঠিয়ে দিলেন। ছুটির আগে স্যার রাজনকে ডেকে পাঠালেন। রাজন ভয়ে ভয়ে স্যারের কক্ষে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। স্যার রাজনের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘রাজন মাথা নিচু কেন? এ দিকে তাকাও!’ রাজন মাথা তুলে দেখলেন স্যারের পাশে একজন মধ্যবয়স্ক লোক বসে আছেন।
লোকটি স্যারের সাথে কথা বলছেন, তবে কথা বলার সময় গলার মাঝে একটা বোতামের মতো আছে ঐটাতে চেপে ধরছেন এবং নিঃশ্বাসও ফেলছেন ঐ বোতামের সাহায্যে। স্যার পাশে বসা লোকটির দিকে ইশারা করে রাজনকে বললেন, ‘তিনি আমার বন্ধু, এক সময় তিনিও শিক্ষক ছিলেন কিন্তু আজ তিনি আমাদের মতো স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারেন না।’ রাজন লোকটির দিকে তাকাল, দেখল উনার দুই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। হেডস্যার বললেন, ‘আমাদের স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা তিনি যাকে যেমন ইচ্ছা সৃষ্টি করেন।’ আমাকে তোমাকে স্বাভাবিক কথা বলার মতো শক্তি ও সামর্থ্য দিয়েছেন যা তিনি ইফতিকে দেননি। সুতরাং তুমি যখন তাকে ব্যঙ্গ করো তখন সে কষ্ট পায়, সেই সাথে কষ্ট পান মহান আল্লাহ, যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন। এই যে দেখ আমার বন্ধু এক সময় স্বাভাবিক কথা বলতে পারতেন কিন্তু আজ পারছেন না। আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলে আমাকে বা তোমাকে ইফতির মতো বা আমার এই বন্ধুর মতো অবস্থা করতে পারেন। সুতরাং আমাদের কখনো আল্লাহর সৃষ্টির নিয়ে ব্যঙ্গ করা উচিত নয়।’
তিনি আরো বললেন, শোন! আল-কুরআনে সূরা আলে ইমরানের ৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। তিনি ব্যতীত অন্য কোনো উপাস্য নেই। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” শোনো রাজন! আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে বৈচিত্র্যময় সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদেরকে পরীক্ষা করেন। আমাদের উচিত সকল সৃষ্টির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা। রাজন নীরবে স্যারের কথা শুনছিল, আর নিজেকে কখনো স্যারের বন্ধু আবার কখনো ইফতির জায়গায় কল্পনা করছিল। নিজেকে সে অপরাধী মনে করতেই দু’চোখ বেয়ে পড়তে লাগল অনুতাপের অশ্রুধারা। ততক্ষণে স্কুলের সব ছাত্র চলে গেছে। সে সিদ্ধান্ত নিলো আগামিকাল সবার আগে ইফতির কাছে মাফ চাইবে। আর কখনো এ ধরনের অন্যায় করবে না।

Share.

মন্তব্য করুন