দেখে নিব, কিভাবে রক্ষা করিস এবার তোর ধানের জমি! আমি যদি না থাকতাম এই এলাকার কোনো জমির পাকা ধান গোলায় উঠতো না। আর আমাকে তুই তাড়িয়ে দিলে? কথাগুলো বলতে বলতে রাগে গজগজ করতে করতে নগেন ওঝা মোকাররম স্যারের বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। মোকাররম স্যার মুচকি মুচকি হাসছেন আর চেয়ে চেয়ে নগেনের চলে যাওয়া দেখছেন। নগেন এই এলাকার ওঝা আদি কাল থেকে পৈতৃক সূত্রে সে এলাকার তান্ত্রিক।
প্রতিবার যখন ধান কাটার ধুম লাগে তখন সে বাঁশের তৈরি একটি টুকরি ও বস্তা নিয়ে বের হয়ে পড়ে ধান কালেকশন করতে। তার দাবি যে সে এলাকার ধানিজমি শিলা বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করে। আর সে জন্যই তাকে প্রতিবার এক টুকরি করে ধান দেয়া লাগবে। এটা নতুন কিছু না সেই আদি কাল থেকেই এই রেওয়াজ চলে আসছে। কি হিন্দু কি মুসলমান কেউ কখনো এই রেওয়াজের বিরোধিতা করেনি। অনেকের মনে এই বিশ্বাসও পয়দা হয়েছে যে নগেন ওঝা মন্ত্র দ্বারা শিলা বৃষ্টি দূরে সরিয়ে দেয়। কেননা আকাশে মেঘে আনাগুনো শুরু হলে ঝাঁটা হাতে নগেন ওঝা তৈরি থাকে আর বৃষ্টি শুরু হলে সে মাঝারের মাঠে ঝাড়ু দিতে শুরু করে। এতে করে নাকি আসমানের সব শিলা এই এলাকায় না পড়ে অন্য এলাকায় গিয়ে পড়ে। এই দৃশ্য দেখে অনেকেই বিশ্বাস করে নিয়েছে যে সত্যি নগেন মন্ত্রপূত ঝাড়ুর মাধ্যমে শিল তাড়িয়ে থাকে। এই অন্ধ বিশ্বাসের কারণে হিন্দু-মুসলিম সকল বাড়ি থেকে সে ধান কালেকশন করে আসছে বংশ পরম্পরায়।
ইউনিভার্সিটি শেষ করে মোকাররম স্যার এলাকার একটি স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছেন। তিনি কুসংস্কার ও শিরকমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজ করতে চান। সবচেয়ে বড় একটি কুসংস্কার তাদের সমাজে প্রচলিত আছে আর তা হলো নগেন ওঝা এলাকার শিলাবৃষ্টি প্রতিরোধ করে কৃষকের ধান রক্ষা করে। বছরে দুইবার নগেনকে ধান না দিলে তার জমিতে শিলা পড়ে পাকা ধান জমিনে মিশে যাবে। সেই ভয়ে নগেনের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলতে সাহস করে না। মোকাররম স্যার সর্বপ্রম মসজিদে এই কুসংস্কার নিয়ে কথা বলেন। ইমাম সাহেবও মোকাররম স্যারের সাথে একমত কিন্তু সমাজপতিদের ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস করে না। স্কুলে বিজ্ঞান ক্লাসে মোকাররম স্যার শিলাবৃষ্টির কারণ সম্পর্কে ছাত্রদের বলেন যে “ঝড়ো আর সঙ্কটপূর্ণ আবহাওয়াতে যখন শক্তিশালী উষ্ণ বায়ুপ্রবাহ উপরের দিকে উঠতে থাকে এবং অপেক্ষাকৃত শীতল বায়ু নিচের দিকে নামতে থাকে তখন মেঘমালায় যে পানির কণা থাকে তা জমে বরফ হতে শুরু করে। সেখানে বায়ুর তাপমাত্রা অনেকাংশে শূন্য ডিগ্রিতে নেমে আসে। এর প্রভাবে জলীয়বাষ্প ঠাণ্ডা হয়ে বরফের দানায় পরিণত হয়। যখন বরফের টুকরা বড় হয়ে যায় তখন আর বায়ুপ্রবাহের সাথে ভেসে থাকতে পারে না এবং বায়ুস্তর ভেদ করে নিচের দিকে ধাবিত হতে থাকে এটাই হলো শিলাবৃষ্টি।” তিনি বলেন, এই পদ্ধতিকে বা ধাবমান শিলা খণ্ডকে ঝাড়ু দিয়ে সরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। মোকাররম স্যারের কথায় অনেক ছাত্রছাত্রীই সায় দেয়।
মোকাররম স্যার আরো বলেন, “মেঘমালা থেকে বৃষ্টি, শিলা ও বজ্র তৈরি হয় এই সব মহান আল্লাহ তায়ালা অসীম কুদরত। আল্লাহর নির্দেশে মেঘমালা সঞ্চারিত হয়। দুনিয়ার কোনো মানুষ এই সব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র আল-কুরআনের সূরা নূরের ৪৩ নং আয়াতে বলেছেন, “তুমি কি দেখ না আল্লাহ তায়ালা মেঘমালাকে সঞ্চালিত করেন। অতঃপর মেঘমালাকে একত্রিত করেন এবং তা পুঞ্জীভূত করেন স্তরে স্তরে। তুমি দেখতে পাও সে মেঘ থেকে নির্গত হয় বৃষ্টি। পাহাড়সদৃশ মেঘমালা থেকে বষর্ণ করেন শিলা এবং এমন বিদ্যুতের চমক যেন দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিবে।”
স্কুলের সকল ছাত্রছাত্রী তাদের নিজ এলাকায় এ নিয়ে কথা বলে। পিতা-মাতা ও সাধারণ কৃষকদের বোঝাতে থাকে যে “নগেন ওঝার কথা বিশ্বাস করা শিরকের শামিল। শিলাবৃষ্টি বা আকাশের মেঘমালার গতিরোধ বা গতি পরিবর্তন করা মানুষের সাধ্যের বাইরে। এই ক্ষমতা কেবল আল্লাহ তায়ালার” ছাত্র, শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম সাহেবের প্রচেষ্টায় অনেকেই নগেন ওঝার কর্মকাণ্ড থেকে বিমুখ হয়েছেন। তওবা করেছেন আল্লাহর কাছে। একটি কুসংস্কার ও শিরক থেকে মুসলমানরা ফিরতে শুরু করেছে।

Share.

মন্তব্য করুন