হাবিব, আরমান আর শরীফ ওরা তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একে অন্যের সাথে দহরম মহরম সম্পর্ক। যেখানেই যাবে এক সাথে যাবে; খেলার মাঠে, স্কুলে, পার্কে, পাখি শিকারে। এমনকি জুমার দিন মসজিদেও যায় একসাথে। আবার গোসল করতে গেলেও এক সাথে। তাদের দেখে অনেকে গর্ববোধ করে।
আজ ছুটির দিন। সকাল আটটায় আরমান ও শরীফ হাবিবদের বাড়ির উঠোনে এসে হাজির। এসেই ডাকাডাকি শুরু- হাবিব, এই হাবিব ঘরে আছিস? হাবিব ঘর থেকে বের হয়। তোরা এত তাড়াতাড়ি চলে এলি যে?
শরীফ মুচকি হেসে বলে- আজ না নয়টায় আরশিনগর যাওয়ার কথা? ও আচ্ছা আমিতো ভুলেই গেছি। আয় ভেতরে আয়, আমি এক্ষুনি রেডি হচ্ছি। শরীফ ও আরমান হাবিবের পিছু পিছু ঘরে ঢোকে। আজ স্কুল বন্ধ হওয়ায় তিন বন্ধু আরশি নগর ঘুরতে যাবে। কিছুক্ষণ পার্কে ঘোরাঘুরি করে তারপর যাবে আরশিনগর গণ-গ্রন্থাগারে। যেটাকে বলা হয় আরশিনগর জ্ঞানের ভুবন। ছুটি পেলেই তিন বন্ধু অন্যদের মত ব্যাট বল হাতে নিয়ে খেলার মাঠে ছুটে যায় না। তারা যায় জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করতে। সেখানে গিয়ে তারা নিজেদের পছন্দ মতো বই পড়ে; নজরুল, ফররুখ ও রবীন্দ্রনাথের করিতা পড়ে। কখনো আল মাহমুদ, হুমায়ূন আহমেদ অথবা আহমদ ছফার বই পড়ে কাটিয়ে দেয় পুরো দিন। এমনকি খাওয়া-দাওয়ার কথাও ভুলে যায় তারা।
আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। তিন বন্ধু রওয়ানা হয়ে গোলো। হাবিবদের বাড়ির পাশ দিয়ে একটা খাল বয়ে গেছে। খালটি তেমন একটা বড় নয়। এটা বড় একটা খালের প্রশাখা। হাবিবদের বাড়ি থেকে খাল পাড় হয়ে মেইন রোডে উঠতে হয়। তিন বন্ধু খাল পাড় দিয়ে ক্রমাগত হেঁটেই চলছে। হঠাৎ আরমান থমকে দাঁড়াল।
আরমানের আচমকা এই আচরণে হাবিব ও শরীফ চমকে গেল। আরমান তার পকেট থেকে রুমাল বের করে নাক চেপে ধরল। আর বিরক্তিকর স্বরে বললো। উহ্! কি বিশ্রী গন্ধ। এমন গন্ধ আমি জীবনে অনুভব করিনি। মানুষ যে কত মূর্খ রয়ে গেছে? এখনো মরা পশু-পাখি খালে ফেলে। পরিবেশটা একবারেই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। প্রতি বছর এত এত প্রচারণা করার পরও মানুষ মৃত পশু পাখি মাটিতে পুঁতে ফেলে না। অথচ এসব মৃত পশু-পাখি মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। যার ফলে গাছপালা অতিদ্রুত বৃদ্ধি পায়। এবং হিউজ পরিমাণ অক্সিজেন সাপ্লাই দিয়ে পরিবেশকে রাখে ভারসাম্যপূর্ণ। আরমান এক নাগাড়ে এতগুলো কথা বলে থামল। ততক্ষণে হাবিব ও শরীফের নাকেও রুমাল উঠেছে।
হাবিব দেখার চেষ্টা করলো। খালে কিছু দেখা যায় কিনা। কিন্তু না কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কোনো মরা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তার কৌতূহল এবার দ্বিগুণ হলো। তাহলে কিসের এত গন্ধ ?
এমন সময় শরীফ চিৎকার দিয়ে উঠলো। পেয়েছি! ঐ দেখ, জোয়ারের পানির সাথে সাদা বস্তার মত কিছু একটা ওঠানামা করছে। গাছের শেকড়ের কারণে ভেসে যেতে পারছে না। নিশ্চয় কেউ অনেকগুলো মৃত হাঁস-মুরগি বস্তা ভরে ফেলে দিয়েছে। যাতে করে জোয়ারের পানির সাথে ভেসে নদীতে চলে যায়।
আরমান বললো, তুই ঠিকই ধরেছিস। হয়তো বা পোল্ট্রি ফার্মের কতগুলো মুরগি মারা পড়েছে। তাই ওরা বস্তা ভরে সেগুলো খালে ফেলে দিয়েছে।
হাবিব তাদের সাথে একমত হতে পারলো না। সে বললো, তোদের ধারণার ঠিক উল্টোটাও তো হতে পারে। হতে পারে হাশেম মিয়াকে কেউ হত্যা করে বস্তাবন্দী করে খালে ফেলে দিয়েছে। গত তিনদিন যাবত তার কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিনইতো তাদের বাড়িতে পুলিশের লোক আসা যাওয়া করছে।
শরীফ নাছোড়বান্দা, সে একথা মানতে চায় না। সে বলে, যে কাজে যাচ্ছি সে কাজে চল। তোদের গোয়েন্দাগিরি একদম ভালো লাগে না। রকিব হাসানের গোয়েন্দা উপন্যাস পড়তে পড়তে তোদের মাথায়ও ভূত নেমেছে। আরমান শরীফের কথার প্রতিবাদ করে।
আজকাল যেভাবে মানুষ খুন হয়, গুম হয়। হাবিবের কথা তো সত্যিও হতে পারে। তাছাড়া খবরের কাগজ উল্টালেই প্রতিনিয়ত বস্তাবন্দী লাশ, ডোবায় লাশ, পুকুরে লাশ, নদীতে লাশ, ড্রাম ভর্তি লাশ, পথে-ঘাটে শুধু লাশ আর লাশ। আর তুই কি নারায়নগঞ্জের সেভেন মার্ডারের কথা ভুলে গেছিস? কথাগুলো বলে আরমান তার বক্তব্য দৃঢ় করতে চায়। শরীফ এবার চিন্তায় পড়ে যায়। আচ্ছা তাহলে চল পুলিশকে খবর দিই। যা হবার হোক। পুলিশই এর ক্লু বের করবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক তিনজনই আরশিনগর থানায় ফোন করে জানিয়ে দিল ঘটনাটি। প্রথমে পুলিশ আসতে রাজি হয়নি। পরে হাবিবের দৃঢ়তায় তারা আসতে রাজি হয়। তাছাড়া হাশেম মিয়ার নিখোঁজের পর তার স্ত্রী থানায় জিডি করে। সব মিলিয়ে পুলিশ আসতে বাধ্য হয়।
ঘটনাস্থল কাছে হওয়ায় পুলিশ পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে গেল। পুলিশের এভাবে আচমকা উপস্থিতি দেখে মানুষজন ভীড় করতে লাগলো খাল পাড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠলো খাল পাড়। হাবিব পুলিশকে সবকিছু খুলে বললো। পুলিশের দুজন লোক খাল থেকে বস্তাটি উদ্ধার করলো।
এবার বস্তা খোলার পালা। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো। কি জানি বস্তার মধ্যে। বস্তার মুখ খোলা হলো। বেরিয়ে এলো এক অর্ধগলিত লাশ। চেহারায় পঁচন ধরেছে। তবে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এটা হাশেম মিয়ারই লাশ। সারা গ্রাম জুড়ে হইচই শুরু হয়ে গেল। হাশেম মিয়াকে পাওয়া গেছে। তবে জীবিত নয়, মৃত। এই খবর শুনে হাশেম মিয়ার স্ত্রী তো প্রায় বেহুঁশ।
এদিকে পুলিশ লাশ নিয়ে গেছে ময়না তদন্ত করতে। ময়নাতদন্তে বেরিয়ে আসে নির্মম এক নির্যাতনের চিত্র। তার সারা গায়ে চাকুর আঘাত। অর্থাৎ অনেক আঘাত করেই তাকে মেরেছে খুনিরা! পুলিশ ইনস্পেক্টর হাফিজুর রহমান শপথ করেই বলেছেন, এই নির্মমতার শেষ চাই। আর চাই না এমন নির্মমতা। খুনিকে অবশ্যই বের করবো এবং তার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। তিনি আফসোস করে বলেছেন, হায়! যদি শাস্তির ক্ষমতা আমার হাতে থাকতো…! ময়নাতদন্ত শেষে হাশেম মিয়াকে তার বাড়ির পাশেই কবরস্থ করা হয়। দাফন শেষে সবাই নিজ নজ বাড়ির পথে রওয়ানা হয়। কিন্তু ওরা তিনবন্ধু রওয়ানা হয় থানার পথে।
থানায় গিয়ে ওরা ইনস্পেক্টর হাফিজের সাথে কথা বলে। ইনস্পেক্টর হাফিজ খুশি হয়ে তাদেরকে ওসির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ওসি একটি অবাক দৃষ্টি ফেলে বলল, তাহলে তোমরাই সেই তিনবন্ধু?
তোমাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। মামলাটি কখনো আলোর মুখ দেখতো না। এখন বলো তোমরা কি চাও ?
হাবিবই মুখ খুললো। আমরা আসলে একটা আবদার করতে এসেছি আপনার কাছে।
বলো কী আবদার ? ওসি বলল।
হাবিব দৃঢ়তার সাথে বলল, এই মামলাটির তদন্তের ব্যাপারে আমরাও কাজ করতে চাই।
ওসি সাহেব খুশি হলেন। মুচকি হেসে বললেন, তোমাদের সাহস দেখে আমার খুব গর্ব হচ্ছে। এযুগের ছেলেরা ফেইসবুক, ইউটিউব নিয়ে পড়ে থাকে। আর তোমরা কিনা রাষ্ট্রের কাজে সহায়তা করার কথা ভাবছো। প্রত্যেকটি ছেলে-মেয়ে যদি এভাবে ভাবতো ? তাহলে কতই না সুন্দর হতো এই মাতৃভূমিটা। ঠিক আছে তোমরা কাজে নেমে পড়। স্যার, আমরা লাশের বস্তাটা দেখতে চাই। দেখি কোনো আলামত পাওয়া যায় কিনা। হাবিব বিনয়ের সাথে ওসি সাহেবকে বললো।
ওসি সাহেব তাদেরকে লাশের বস্তার কাছে নিয়ে গেলেন। তিনবন্ধু ভালোভাবে বস্তার উপর নজর বুলিয়ে নিলো। তারপর ওসি সাহেব থেকে অনুমতি নিয়ে তিনবন্ধু বাড়ির পথে রওয়ানা হলো। হাবিবের রিডিং রুম। তিনবন্ধু বসেছে মামলার ক্লু বেরত করার জন্য। আরমান প্রথমে মুখ খুললো। একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
কি সেটা, বলে ফেল না। শরীফ আরমানকে খোঁচা দিয়ে বললো। তার আর তর সইছে না। আরমান বলল, জানি না কতটুকু লাভ হবে। তবু বলছি, বস্তাটা হচ্ছে চাউলের। শাহ আলী সুপার মিনিকেট চাউল। যেটার প্রস্তুরকারক সোহেল এন্টারপ্রাইজ। আরমানের কথা শুনে শরীফ তো হেসেই খুন। হাসতে হাসতে বললো, আরে তুই পাগল হয়েছিস ? তুই কি সোহেল এন্টারপ্রাইজকে খুনি বানাতে চাস ?
শরীফকে থামিয়ে দিয়ে হাবিব আরমানের কথার সমর্থন দিয়ে বললো, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম না শরীফ। আমরা এটাকে একটা ক্লু ধরতে পারি। তাছাড়া আরো একটা ক্লু আমি পেয়েছি। বস্তার গায়ে মার্কার পেন দিয়ে একটা সিরিয়াল নাম্বার লেখা। আর তা হল- RT-MR-200/12-07-18 তার মানে, R ট্রেডার্স, মিনিকেট রাইস ২০০ বস্তা সেল। আর ১২-০৭-১৮ তারিখ। এতটুকু বলে শরীফ থামলো। তার চেহারায় বিজয়ের হাসি। হাবিব বললো, তুই ঠিক ধরেছিস। তবে জ দিয়ে যেকোনো একটা নাম হতে পারে। যেমন, রতন, রাহুল, রাবেয়া, রহিম ইত্যাদি। এসব নিয়ে গাবেষণা করতে করতে যোহরের আযান হয়ে গেল। তিনবন্ধু মসজিদে নামাজ পড়ে যে যার বাড়িতে চলে গেল। বাকি তদন্ত সন্ধ্যার পর। মাগরিবের নামাজ সবাই বাজারের মসজিদে পড়লো। নামাজ শেষে তিনজনে তিন দিকে চলে গেল। কথামতো আধাঘন্টা পর সবাই মসজিদের ঘাটলায় একত্রিত হলো।
আরমান জানালো, R দিয়ে ২ টি দোকান পেয়েছে। একটি কসমেটিক অন্যটি হোটেল। শরীফ বললো, আমিতো জ দিয়ে কোনো দোকানই খুঁজে পাইনি। হাবিব এবার চিন্তায় পড়ে গেল। কারণ সেও R দিয়ে কোনো দোকান খুঁজে পায়নি। হাবিব ভাবলো, তার মানে বস্তাটা এই বাজার থেকে কেনা হয়নি। জিরকা নগর যেতে হবে এক্ষুনি। তিনবন্ধু রওয়ানা হয়ে গেল জিরকার উদ্দেশ্যে। দশ মিনিটেই পৌছে গেল জিরকা।
অটোরিক্সা থেকে নামতেই হাবিবের চোখে পড়লো একটি চাউল দোকান। রতন ট্রেডার্স। আরমানও দেখে ফেললো। এবং একরকম উত্তেজিত হয়েই বলে ফেললো, ইউরেকা ইউরেকা, পেয়েছি পেয়েছি। তার এমন পাগলামি দেখে কয়েকজন পথচারী হেসেই ফেললো। হাবিব ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল তাকে। তার পর শরীফ ও আরমানকে পাঠালো R দিয়ে আর কোনো মুদি বা চাউলের দোকান আছে কিনা।
কিছুক্ষণ পর শরীফ ও আরমান ফিরে এলো জিরো পয়েন্টে। ততক্ষণে হাবিবও রতন ট্রেডার্স থেকে বেরিয়ে এল। হাবিব হাত দিয়ে ওদের দুজনকে ইশারা করলো। তার যেন সেদিকে না যায়। তিনবন্ধু একত্রিত হয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। তারা যখন খালপাড় বরাবর এলো ঠিক তখনি দেখা হলো আইয়ুব আলীর সাথে। মুখটা বাংলা পাঁচের মত করে বললো, এই পিচ্ছিরা শোনো, তোমরা নাকি হাশেম হত্যার তদন্তে নেমেছো। এসব বাদ দিয়ে পড়াশুনা করোগে। ছোট ছোট পোলাপান আজকাল সেয়ানা হয়ে গেছে। এসব বলতে বলতে লোকটা তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
তারাও চলে গেল বাড়িতে। সবাই হাবিবদের বাড়িতেই গেল। হাবিবের পড়ার রুমে বসে তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে কথা বলছে হাবিব।
আরমান ও শরীফ অধীর আগ্রহে শুনছে তার কথা। হাবিব, আরমান এ শরীফকে অন্যদিকে পাঠিয়ে দিয়ে একাই গেল রতন ট্রেডার্সে। যেন কেউ সন্দেহ না করে। রতন ট্রেডার্সে গিয়ে সে বিভিন্ন চাউলের দাম জিজ্ঞেস করতে থাকে। আর এই সুযোগে দেখে নেয় যে, বস্তার উপর সিরিয়াল নাম্বার ও তারিখ লেখা আছে কিনা। কিন্তু না কোনো বস্তাতেই এরকম চিহ্ন নেই। হাবিব পড়ে গেল মহাচিন্তায়। কিন্তু সে দমবার পাত্র নয়। সে বুদ্ধি করে দোকানীকে বললো, ‘অ্যাংকেল, কয়েকদিন আগে আমার আব্বু আপনাদের দোকান থেকে চাউল নিয়েছিল। চাউলগুলো নাকি খুব ভালো। আরও একবস্তা নিতে চাই।’
দোকানদার তাকে কয়েকটি বস্তা দেখিয়ে বলল কোনগুলো নিয়েছে তুমি জান ?
হাবিব উত্তর দিল, সোহেল এন্টারপ্রাইজের সুপার মিনিকেট চাউল। দোকানদার বললো, ওগুলোতো শেষ। দুদিন পরেই চালান আসবে। আচ্ছা অ্যাংকেল, আপনারা কি জেলা শহর থেকে চালান করেন ? হাবিবের ঔৎসুক্য প্রশ্ন। জ্বি জেলা শহরের আরিয়ান ট্রেডার্স থেকে চালান করি। দোকানদার সরল মনে জবাব দিল। এতটুকু শুনে হাবিব দোকানী থেকে বিদায় নিয়ে শরীফ ও আরমানের সাথে মিলিত হল। তারপর বাসায় এনে শরীফ ও আরমানকে পুরো ঘটনা খুলে বললো। পথে আইয়ুব আলীর সতর্কবার্তা আর রতন ট্রেডার্সের জেলা শহরের চালানের দোকান হল তাদের নতুন সূত্র। পরদিন তিনবন্ধু রওয়ানা হয়ে গেল জেলা শহরের উদ্দেশ্য। পথে জ্যামে পড়ে দুই ঘন্টার পথ চার ঘন্টায় পৌঁছল। অনেক খুঁজে পরে, হাবিব ওদের দুজনকে একটা হোটেলে বসিয়ে রেখে একাই গেল।
দোকানে গিয়ে আগে নিজের পরিচয় দিল। আমি হাবিবুর রহমান। রতন উদ্দিনের ভাতিজা, মানে রতন ট্রেডার্সের ভাতিজা? দোকানদার অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, বলো কী করতে পারি তোমার জন্য? গত ১২-০৭-১৮ তারিখে আপনার দোকানে থেকে চালান নিয়েছিল। চালানে নাকি কিছুটা ভুল আছে। একটু দেখতে হবে। দোকানদার আরো অবাক হলো। অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো, তিনি আসলেন না কেন ?
তিনি একটু ব্যস্ত আছেন, তাছাড়া আমার আপাতত পড়াশুনার চাপ নেই। তাই কাকার সাথে ব্যবসায় সময় দিচ্ছি। হাবিবের সহজ সরল জবাব। দোকানদার খুশিই হল বুঝা যায়। দোকানদার জুলাই মাসের চালান খাতা বের করে দেখলো। ট্রেডার্সের চালান হয়েছে ২০০ বস্তা। কই সবই তো ঠিক আছে। এই যে সিরিয়াল নাম্বার RT-MR-200/12-07-18, দোকানদার আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো।
হাবিব বললো, ঠিকই তো, তবে কাকা বলেছেন, ২ বস্তা বেশি গেছে, সামনের চালানে দুই বস্তা কম নিলেই হিসাব মিলে যাবে।
দোকানদার খুশিই হল বুঝা যায়। তাহলে বুঝি এখনো সৎ লোকের বসবাস আছে দেশে। হাবিব দ্রুত বিদায় নিয়ে হোটেলে গিয়ে আরমান ও শরীফের সাথে দেখা করে। তারপর সবকিছু খুলে বলে। তিনজনেই মহাখুশি। অবশেষে তদন্তের অগ্রগতি হলো তিনজলেই রওয়ানা হলো জিরকার উদ্দেশ্যে। রতন ট্রেডার্স যেতে হবে।
দু’ঘণ্টার মাথায় তিনবন্ধু পৌঁছে গেল জিরকা নগর রতন ট্রেডার্সে। হাবিব রতন মিয়াকে সালাম দিয়ে বললো, আমরা একটা বিষয়ে সহযোগিতা চাচ্ছি। দোকানদার বললো, জ্বি, বলতে পারো। হাবিব অনুরোধের সুরে বললো, গত ১২ই জুলাই থেকে যারা যারা আপনার থেকে চাউল নিয়েছে তাদের তালিকাটা চাই।
দোকানদার জানতে চাইলো, তালিকা দিয়ে কি করবে? হাবিব সহজভাবেই বললো, কিছুদিন পর এমনিতেই জানতে পারবেন। এখন যা বলেছি তা করুন। দোকানদার টালিখাতা বের করে হাবিবের সামনে দিল। হাবিব ১২ জুলাই থেকে তালিকা দেখতে লাগলো। দেখতে দেখতে ২৬ জুলাই এসে থমকে দাঁড়ালো। স্পষ্ট লেখা ২৬-০৭-২০১৮, আইয়ুব আলী, আরশিনগর, সুপার মিনিকেট ১ বস্তা, টাকা- ১২৫০/- হাবিব রতন মিয়াকে ধন্যবাদ দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে সোজা থানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। জিরকা থেকে অটোরিক্সা যোগে মাত্র বিশ মিনিটেই থানায় পৌঁছে গেল।
ওসি সাহেব ওদের তিনজনকে দেখে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। তারপর আলাপ হলো- কি খবর তোমাদের? ওসি সাহেব আগ্রহ ভরে জিজ্ঞেস করলেন। জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ। আপনার? সবাই সমস্বরে জবাব দিল, আলহামদুলিল্লাহ। তদন্তের অগ্রগতি কেমন? জ্বি, সুখবর আছে। একজনকে সন্দেহের তালিকায় স্থান দিলাম আশা করি তাকে গ্রেফতার করলেই রহস্য বেরিয়ে আসবে। হাবিবের কণ্ঠে বীরত্বের সুর। মুখে ফুটেছে আনন্দের রেখা।
ওসি সাহেব জানতে চাইলেন, কিভাবে আইয়ুব আলী সন্দেহের এক নাম্বার তালিকায় আসলো? হাবিব তাদের পুরো অভিযানের কথা খুলে বললো। ওসি সাহেব শুনে তো মহাখুশি। তিনি বললেন, আমার বিশ্বাস ওকে ধরতে পারলে পুরো ঘটনা জানতে পারবো আমরা। তোমাদেরকে অশেষ ধন্যবাদ। তোমাদের মত তরুণরা যদি সমাজের অন্যায় অবিচার রোধে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা চালায় তাহলে এদেশ থেকে অন্যায়-অবিচার চিরতরে দাফন হয়ে যাবে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায় বিচার। এদিকে পিয়ন নাস্তা নিয়ে চলে এসেছে। চা-নাস্তা খেয়ে তিনবন্ধু ওসি সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিল।
ওসি সাহেব আইয়ুব আলীকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশের পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি ফোর্স পাঠালেন। এদিকে আইয়ুব আলী শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। তার মাথায় চিন্তা এলো সত্য একদিন উন্মোচিত হবেই। তখন আর রেহাই পাওয়া যাবে না। সে মাত্র ঘর থেকে বের হল। এমন সময় পুলিশের গাড়ি এসে থামল বাড়ির উঠোনে।
ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেল। আর পালানোর সুযোগ নেই। একজন পুলিশ এগিয়ে এসে তার হাতে হাতকড়া পড়ালো। আইয়ুব আলীর এক ছেলে এক মেয়ে। তারা দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কানড়বা জুড়ে দিল। আইয়ুব আলীর স্ত্রীও কাঁদতে লাগলো। পুলিশ ছেলে মেয়ে দু’টোকে তাদের মায়ের হাতে তুলে দিয়ে আইয়ুব আলীকে নিয়ে থানায় চলে গেল।
ঘড়িতে রাত ঠিক নয়টা। আইয়ুব আলী থানা হাজতের এক কোণে জবুবু হয়ে শুয়ে আছে। পুলিশ ইন্সপেক্টর হাফিজুর রহমান হাজতে প্রবেশ করলেন। হাতের লাঠি দ্বারা আইয়ুব আলীকে আস্তে একটা খোঁচা দিলেন। ভয়ার্ত চোখে ইনস্পেক্টরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সে। তারপর হঠাৎ ইনস্পেক্টরের পা জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো। ইনস্পেক্টর হাফিজ খুবই দয়ালু মানুষ। কিন্তু অপরাধীর জম। তবুও তিনি আইয়ুব আলীকে শেষ সুযোগ দিলেন। তিনি নরম স্বরে বললেন, তোমাকে কিছু করবো না। যদি সবকিছু সত্যি সত্যি বলে ফেলো।
আইয়ুব আলী এবার কিছুটা আশান্বিত হলো। তবুও ভয়ার্ত চোখে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকালো একবার। তারপর সে অকপটে স্বীকার করলো খুনের কথা।

Share.

মন্তব্য করুন