মা বলেছিল দিন কতক পরেই কুয়াশা কেটে যাবে। আবার সূর্যিমামা হেসে খেলে উঠবে। আমাকেও তখন আর বাইরে খেলাধুলা করতে নিষেধ করবে না। কিন্তু মায়ের সেই বলা পর্যন্তই! তার কথা আর ফলে না। দিন কতক করতে করতে মায়ের গলাও ব্যথা হয়ে গেছে। আর আমি? কেবলই দিন গুনে গেছি। ক্লাস টুতে পড়ি, ভালোই মজা করে এক দুই তিন বলতে পারি। শুধু তাই না, পাঁচের ঘর পর্যন্ত নামতা গোনা শিখে গেছি এই কিছুদিন আগে। যাই হোক। গুনে গুনে প্রায় তেরোটি দিন চলে গেল। কিন্তু কুয়াশা কেটে যাবার নামগন্ধ নেই। চারপাশ কি যে ঠাণ্ডা! একেবারে বরফ হয়ে গেছে পুরো এলাকা। সেদিন ছোট মামাকে ডেকে অনুরোধ করলাম, ‘মামা, তুমি মাকে বলে আমাকে একটু খেলতে দিতে বলো না।’
‘কেন রে, এত ঠাণ্ডার ভেতর আবার খেলাধুলা কেন? তুই তো ভালোই ঠাণ্ডা-সর্দি বাধানোর ফন্দি এঁটে বসে আছিস। বাইরের অবস্থা দেখেছিস?’ বেশ গম্ভীর ভঙ্গিতে আমাকে ঝেড়ে দিল মামা। কোথায় একটু সাহায্য চাইলাম অথচ মামা কড়াকড়ি লেকচার দিয়ে দিল। একবার সাহস করে বলতে চাইলাম যে গুনে গুনে তেরোটা দিন তো একই অবস্থা দেখে আসছি। আমি তো তবুও গুনেছি, তুমি কি কছুটা করেছো শুনি! কিন্তু গুরুজন মানুষ। মামা হন। তার সাথে তো আর বেয়াদবি চলে না। আর সব থেকে বড় ব্যাপার, বেয়াদবি করলে মা আমাকে আস্ত রাখবে না। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে বিজ্ঞের মত বললাম, ‘মামা, ঘরে থাকলেই আমার বেশি ঠাণ্ডা লাগে। বাইরে একটু খেলাধুলা করলে তো শরীর গরম রাখা যায়।’
‘এহ! শরীর গরম রাখতে তোর খেলাধুলা করতে হবে, তাই না! যা যা, ঘরে গিয়ে লেপকাঁথা গায়ে চড়িয়ে শুয়ে থাক। ফালতু বাহানা বানাবি না।’ এই বলে ছোট মামা দপাদপ পা ফেলে প্রস্থান করল। আমার যে কী পরিমাণ রাগ হল, বলে বোঝাতে পারব না। বাইরের কী অবস্থা দেখতে ঘরের বাম দিকের জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম। জানালাটা বন্ধ ছিল, বুকে একটু সাহস এনে সেটা খুললাম। খুলতেই হুড়হুড় করে ঠাণ্ডা বাতাস এসে আমাকে প্রায় জমিয়ে বরফ বানিয়ে ফেলে এমন অবস্থা। সাহস যা ছিল সেটাও জমে বরফ! কিন্তু মিনিট দুয়েক পরেই বেশ মজা পেতে শুরু করলাম। বুক ভরে প্রকৃতির ঠাণ্ডা বাতাসের স্বাদ নিলাম। চারিদিকে চোখ বুলাচ্ছি, সামনে-বামে-ডানে। আহা! সব একেবারে ধবধবে সাদা। কুয়াশা যেন সবকিছু আঁকড়ে রেখেছে। আকাশের দিকে তাকাতেই বুকটা চিনচিন করে উঠল। কোথাও মেঘের দেখা নেই। সূর্যের দেখা নেই। আলোর দেখা নেই। আছে শুধু কুয়াশা। ধ্যাত!
কতদিন যে মেঘ দেখি না। আকাশ পরিষ্কার না থাকলে মা কখনোই আমাকে বাইরে খেলতে দেয় না। ঝকঝকে আলো বাতাসের একেকটা দিন আমার কাছে একেকটা ঈদের দিনের মতই আনন্দের। অনেক মজা করে বন্ধুদের সাথে হৈ-হুল্লোড় করে, খেলাধুলা করে সারাবেলা কাটিয়ে দেয়া যায়। ইশ! কেন যে মেঘ কুয়াশার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে অভিমান বাসা বাঁধতে থাকে। এইবার আমি বলেই বসলাম, ‘যাও, মেঘের সাথে দিলাম আড়ি। লাগবে না তাকে!’
অভিমান করার কিছুক্ষণ পরেই আমার কান্না পেতে থাকে। কী মুশকিল। এখন এই মরামুখো কান্না ঠেকাই কী করে? মা যদি দেখে আমি কান্না করছি তাহলে খবর আছে আমার! বলবে বাইরে খেলতে দেয়নি বলে খিস্তি শুরু করে দিয়েছি। শেষে আবার বাবাকে গিয়ে নালিশ করবে। আর বাবা রেগে গেলে আমার আর নিস্তার নেই। আহা! এ দেখছি ভালোই বিপদ হলো। হঠাৎই মা আমাকে ডাকতে শুরু করল। আমি মুহূর্তেই ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু নিজেকে সামলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে? ডাকছ কেন?’
‘এই দিকে আয়, গরম গরম ভাপা পিঠা বানাচ্ছি। খেতে আয়।’
মায়ের কথা শুনে মুহূর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেল। ভাপা পিঠা আমার খুব পছন্দের। খুব। মায়ের মুখে ভাপা পিঠার নাম শুনেই জিভে জল এসে গেছে আমার। পেটের ভেতরেও ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে। লক্ষ্য করলাম, এখন আর আমার কান্না কান্না ভাবটা আসছে না। যাক বাবা, বাঁচা গেল। এবার আমি যাই। মায়ের বানানো ভাপা পিঠা খেতে হবে। এই শীতে, কুয়াশা আর শত ঠাণ্ডার মাঝেও এই এক মজা। মায়ের হাতের পিঠা যে খাওয়া যায়!
মায়ের হাতের বানানো পিঠা খেতে খেতে অন্য এক ভুবনে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এতই মনোযোগ সহকারে খাচ্ছিলাম যে বাইরে কী হচ্ছে না হচ্ছে তার কিছুই খেয়াল করলাম না। খাওয়া শেষ করে যখন হাত ধুয়ে মায়ের শাড়ির আঁচলে হাত মুছছিলাম তখন লক্ষ্য করলাম চারপাশে মৃদু রোদের আভা। ব্যাপার কী? একটু আগে না দেখলাম কুয়াশায় সব ঢাকা। আর এখন রোদের আভা আসছে কোথা থেকে? রানড়বাঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আকাশে মেঘ বাবাজির দেখা মিলল। কুয়াশা সরে গেছে। কাঁচা রোদ এসে পড়েছে চারপাশে। আমার মুখে হাসি ফুটল বড় আকারে। পাশের বাসার ছেলেমেয়েরা খানিক বাদেই হৈ-হুল্লোড় করতে করতে বেরিয়ে আসল। খেলবে ওরা। আমি এক ছুটে মায়ের কাছে গেলাম। দেখলাম তার মুখে মুচকি হাসি। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই বলল, ‘খুব বেশি সময় বাইরে থাকা চলবে না, ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই আবার বাসায় ফিরে আসবে। স্কুলের পড়া পড়তে হবে।’ মায়ের কথা শোনা মাত্রই দৌড়ে তার গলা জড়িয়ে ধরলাম। গালে ছোট্ট করে একটা চুমু দিলাম। তারপর ছুট লাগালাম বন্ধুদের উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণ আগে মেঘের সাথে দেওয়া আড়ি তুলে নিলাম। মেঘগুলো যে কি দুষ্টু! আমি বাসা থেকে বেরুতেই আমার সঙ্গে যেন চারপাশ ছোটাছুটি শুরু করে দিল। ভালোই হলো। দারুণ মজা হবে।

Share.

মন্তব্য করুন