১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। সে কি আনন্দ! আনন্দ আর উল্লাস। আনন্দের বাঁধভাঙা জোয়ার। শত হারানোর বেদনার মধ্যে কষ্টের অর্জন। এ যেনো পূর্ণিমার চাঁদ হাতে পাওয়ার আনন্দ। পিতার হারানো সন্তানের হাহাকার। ভাই হারানো ভাই-বোনের কষ্ট, ছেলে হারানো মা-বাবার বেদনা, হাতে মেহেদি ও পায়ে আলতামাখা নববধূর স্বামী হারানোর বিরহ। এ যেনো হাজারো কষ্টের পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে বিজয়ের নিশান ওড়ানোর আনন্দ। সব আনন্দের যোগফল আমাদের বিজয় দিবস। আমাদের বহুত্যাগ, কোরবানি ও অসংখ্য আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর।
আমরা বহু বছর আর বহুকাল ছিলাম পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ। ছিলাম অবরুদ্ধ। যেনো খাঁচায় বন্দী পরাধীন পাখি। অসীম নীল আকাশ, দিগন্ত জোড়া মাঠ আর মুক্ত বিহঙ্গ সবই ছিলো আমাদের জন্য নিষিদ্ধ। যেনো ডানাকাটা পাখি। শুধু অবারিত আকাশের দিকে তাকিয়ে করুণ চাহনি ছাড়া, আমাদের কারোর করার কিছু সাধ্য ছিলো না একদম। ভাষার রাজ্যে উড়াল দেয়া ছিলো সীমিত। কেড়ে নেয়া হয়েছিলো মুখের ভাষা। চলন বলন আর কথনে ছিলো বাধার প্রাচীর। শিক্ষা শিল্প সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ছিলো দুর্ভেদ্য দেয়াল। চতুর্দিকে শুধু সীমাবদ্ধতা আর সীমাবদ্ধতা।
খাঁচায় আবদ্ধ পাখি যেমন উড়তে চায় বিনা ভিসায় দেশ থেকে দেশান্তরে। ছুঁতে চায় সুনীল সুদূরের আকাশটাকে। ডানা মেলে ভেসে বেড়াতে চায় আপন মনে, অবারিত মুক্ত আকাশে। আর মানুষ! সেতো স্বাধীনচেতা। স্বাধীনভাবে চলা ফেরা তার সৃষ্টিগত সহজাত প্রবৃত্তি। বাংলার দামাল ছেলেরা! যাদের শরীরে শহীদ তিতুমীর ও খানজাহান আলীর রক্ত। তারা কি কখনো বাধা মানে? পোষ মানতে চায় কখনো? নত হয়ে থাকা কি তাদের শোভা পায়? তাদের কি কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে? তা কি হতে পারে? না, পারে না।
সত্য আর সুন্দরের জন্য তারা সব সময় থাকে উন্মুখ। সোচ্চার থাকে তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য। সদা ব্যাকুল ও সোচ্চার থাকে তারা। আল্লাহ প্রদত্ত অধিকার ও স্বাধীনতা লাভের জন্য। আল্লাহর সুন্দরতম সৃষ্টি উপভোগ করে তার কাছে নত হওয়ার জন্য। আর এটিই প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। চিরন্তন ও সত্য।
আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন কর্মের স্বাধীনতা। যাতে এ স্বাধীনতা কোনো ক্রমেই স্বেচ্ছাচারিতা না হয় সে জন্য ব্যবস্থা রেখেছেন আখিরাতে জবাবদিহিতা। মহান আল্লাহতা‘য়ালা সূরা কাহাফের ২৯ নং আয়াতে বলেন, “বলুন, হে নবী! সত্য বা দ্বীনে হক এসেছে তোমাদের পালনকর্তার কাছ থেকে। সুতরাং যার ইচ্ছা সে তা বিশ্বাস করুক বা মেনে চলুক। আর যার ইচ্ছা সে তা অবিশ্বাস বা অমান্য করুক।”
বন্ধুরা, এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আমাদের কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়? আমরা যদি সত্যানুসন্ধানী হই তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে ইতিবাচক হতে হবে। দ্বীনে হক বা সত্য দ্বীন মেনে আমাদেরকে স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করতে হবে।
হ্যাঁ বন্ধুরা, আজকে আমাদের আরও ভাববার বিষয় কি জানো? সেই ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুদীর্ঘ নয়টি মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়। অসংখ্য লোকের শাহাদাত বরণ, বহু লোকের অঙ্গহানি, অগণিত মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমাদের বিজয় অর্জন। সাগর সাগর রক্তে কেনা আমাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয় লাল-সবুজের রক্তিম পতাকা। বিশ্বের মানচিত্রে অবস্থান করে নেয়া আমাদের প্রিয় মানচিত্র।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মরহুম মেজর আব্দুল জলিল বলেছেন, “স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।” অর্থাৎ গাছ লাগানো সহজ কিন্তু তাকে পরিচর্যা করে মহীরুহ বৃক্ষে রূপ দেয়া অত্যন্ত কঠিন। অনুরূপভাবে মোটেই সহজ নয় অর্জিত স্বাধীন দেশের পতাকার সুরক্ষা করা। কোনো ক্রমেই সম্ভব নয় মানচিত্র কিংবা স্বাধীন দেশের অস্তিত্ব রক্ষা করা।
তারপরও স্বাধীনতার সুরক্ষা করার কঠিন ও গুরু দায়িত্ব আমাদের কাঁধের ওপর। স্বাধীনতাকে অর্থবহ ও সুরক্ষিত করার জন্য আমাদেরকে আরও কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। অর্জন করতে হবে বিশেষ কিছু যোগ্যতা। যেমন, আমাদেরকে হতে হবে সু-শিক্ষিত। শিক্ষার আলো ছাড়া জাতিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। তাই সু-শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে সবখানে। কারণ, “যে জাতি যতো শিক্ষিত, সে জাতি ততো উনড়বত।” আমাদেরকে সুশিক্ষা নিয়েই স্বাধীনতার সুখ ও বিজয়ের আনন্দ ভোগের উপযোগী করতে হবে দেশের মানুষকে। ব্যতিক্রম হলে আমাদেরকে হারিয়ে যেতে হবে অন্ধকারের অতল গহ্বরে। আর আমাদের স্বাধীনতার বিজয় হয়ে পড়বে অর্থহীন। আঁকড়ে ধরতে হবে আমাদের নিজস্ব তাহজিব তমদ্দুন তথা সংস্কৃতিকে। কোনো জাতির জাতিসত্তা বেঁচে থাকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে। ধার করে কিংবা অন্ধ অনুকরণ ও অনুসরণ করে অথবা অন্ধকারে হাতড়িয়ে বেশি দিন বেশিক্ষণ চলা যায় না। আগাছা ও পরগাছা বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না। উড়ে যায় সামান্য দমকা হাওয়ায়।
তাই স্বাধীনতাকে যথাযথ মর্যাদা দিতে হলে অবশ্যই নিজস্ব সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠতে হবে আমাদের ভাবি প্রজন্মকে। আর জানা তো আছেই। আমাদের সংস্কৃতির মূল ভিত্তি হচ্ছে এক আল্লাহর একাত্মবাদ ও নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নির্দেশিত পথ ও মত।
স্বাধীনতার সুখ ও বিজয়ের আনন্দ উপলব্ধির জন্য আমাদেরকে যোগ্য হয়ে গড়ে উঠতে হবে। কারণ আগামী দিনের পৃথিবীতে টিকে থাকবে শুধুমাত্র যোগ্যতম লোকেরাই। অযোগ্য লোকের ঠাঁই হবে না কোনো জায়গাতেই কোনা রকম। আর হয়নি কোনো কালেই। আর যোগ্যতার ভিত্তি হবে তথ্যপ্রযুক্তির অস্ত্রে সুসজ্জিত হওয়া। কারণ এটাকে বলা হয় তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। বলা হয়, যার তথ্য প্রযুক্তির জ্ঞান নেই, তার যোগ্যতার থলিতে যেনো কোনো কিছুই নেই।
স্বাধীনতার সুখ লাভের জন্য চাই আগামী দিনের সুস্বাস্থ্যবান জাতি। বলা হয়, সুস্থতা সকল সুখের মূল। অসুস্থ জাতি কোনো কাজই সুন্দরভাবে সম্পাদন করতে পারে না। তাই আগামী দিনে যারা দেশের কারিগর হবেন তাদেরকে মাদকমুক্ত জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে সুস্থ জাতিগঠনে ভূমিকা রাখতে হবে। তাহলেই আত্মা শান্তি পাবে অগণিত আত্মহুতি দেয়া আমাদের উত্তরসূরীরা।
তাই এসো বন্ধুরা, আমরা বিজয়ের গান গেয়ে দৃপ্ত শপথ করি। আর হানাহানি নয় সম্প্রীতির সেতুবন্ধ সৃষ্টি করি। বিভেদ নয় ঐক্যের প্রাচীরের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করি। অপসংস্কৃতি ও কুশিক্ষায় নয় সুস্থ সংস্কৃতি এবং সু-শিক্ষার মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করি। অস্ত্র নয়, কলম ধরি। মাদকমুক্ত জীবন গড়ি। জাতীয় পতাকা আর মানচিত্রের হেফাজত করি। যারা বিজয় এনেছিলো তাদেরকে স্যালুট করি। সকল অন্যায় অবিচারকে গুডবাই জানাই। বিজয়ের অহঙ্কারে, আমরা আমাদের দেশ গড়ি।

Share.

মন্তব্য করুন