তেলাদার নাম শুনে তোমরা আবার ভেবে বসো না যে তিনি তেলের ব্যবসা করেন। তাহলে কিন্তু মস্ত বড় ভুল করবে। তবে হ্যাঁ, এ কথা বললে মিথ্যে হবে না যে তিনি একটা জলজ্যান্ত তেলের পিপে। না, নারকেল অথবা বাদাম তেলের নয়! একেবারে খাঁটি সরষের তেলের। সত্যি বলতে কি সেই এতোটুকুন থেকেই সরষের তেলের প্রতি তেলাদার নাকি ভীষণ টান।
সেই ছেলেবেলার কথা। একবার নাকি শিশু তেলাদা, দুপুর বেলা বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে, চুপি চুপি রানড়বা ঘরে গেলেন।
না, হেঁটে নয়-হামাগুড়ি দিয়ে। দুধের ‘সর’ই হয়তো খেতেন।
কিন্তু দুধ তো বেড়ালের ভয়ে শিকেয় তোলা। কি আর করবেন? হঠাৎ তাঁর চোখে পড়লো চুলোর পাশে লাল বোতলে তরল পদার্থ। ব্যস্। যেই দেখা অমনি কাজ। বোতলটা চুলোর কাছে তুলে ধরে ঢক্ ঢক্ করে প্রায় আধপোয়া খানিক…!
আর তার পরেই চিৎকার! খাঁটি সরষের তেলের ঝাঁঝটাতো কম নয়…! বাড়ি শুদ্ধ সবাই ছুটে এলো।
কী ব্যাপার?
কী হয়েছে?
কেউ ভাবলো বঁটিতে হাত কেটেছে। কেউ ভাবছেন পিঁপড়ে কামড়েছে। মহাকাণ্ড।
তেলাদার তখন বোঝাবার ক্ষমতা নেই। কিন্তু একটু পরেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো। তেলাদার মুখ আর বুক ভাসানো তেলের লালচে স্রোত দেখেই সবাই বুঝতে পারলো যে তেলাদা সরষের তেল পান করেছেন।
কাজেই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে তেলাদার তেলানুরাগ সেই তখন থেকেই।
ইনি আমাদের পাড়ার ‘কমন’ দাদা।
বয়স বেশি নয়।
মাত্র ত্রিশের কাছাকাছি।
শরীরটা তেল কুচকুচে নাদুস-নুদুস।
গোলগাল হাত-পা।
দুটো ড্যাবডেবে চোখ।
মোটকথা সব মিলিয়ে একটা জলজ্যান্ত তেলের পিপে।
তেলাদার হাতের তালু দুটো হাতির থাবার মতো তুলতুলে নরম। কাজেই তাঁর চড়চাপড় বড় একটা মনে থাকবার নয়।
আমাদের এই তেলাদার একটা ভয়ানক রোগ আছে। সেটা হচ্ছে ‘তেলাতঙ্ক’ রোগ। অর্থাৎ তেলাপোকার ভয়।
যেভাবে যে অবস্থায় থাকুন না কেন- তেলাপোকা দেখলে তিনি আর তিনি থাকেন না। তা ছাড়া তেলাপোকাদেরও দোষ দেয়া যায় না। চোখের সামনে অমন তেলতেল গন্ধওয়ালা জিনিসটার ওপর লোভ হওয়াটা এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়।
তেলাদা সক্কাল বেলা গায়ে সরষের তেল মেখে সূর্যের দিকে মুখ করে ব্যায়াম করেন। তারপর মাথায় এক খাবলা তেল ঢেলে নাইতে যান। আর সব শেষে গরম মুড়িতে তেল মেখে নাস্তা করেন। আর সর্দি হলে তো কথাই নেই। সরষের গুলি এবং সরষে- বাঁটা মাছ পথ্য করেন। অর্থাৎ সরষের দৌলতে তিনি জীবনধারণ করেন।
সেবার ঈদের ছুটিতে আমরা থিয়েটারের আয়োজন করলাম। নেহাত ঘরোয়া অনুষ্ঠান। স্থান-আমাদের পুরোন গুদাম ঘর। এককালে চালের বস্তায় ঠাসা ছিল। বর্তমানে বেওয়ারিস প্রাণীদের ‘কমনরুম’। যা হোক। সেটাকেই আমরা সাজিয়ে গুছিয়ে ‘থিয়েটার হল’ বানালাম। সভাপতি-আমাদের তেলাদা। অতিথি-পাড়াতুতো আত্মীয়-কুটুম্বরা। বেশ কয়েকদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর সেই নির্দিষ্ট দিন এবং সময়টি দোরগোড়ায় এসে হাজির হলো।
বাতি জ্বললো।
পর্দা উঠলো।
এবং অনুষ্ঠান শুরু হলো।
প্রথমেই সভাপতির ভাষণ। মালা দেবার পর বেশ একটা হোমরা-চোমরা ভাব নিয়ে মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন তেলাদা। এখানে বলে রাখা দরকার যে আমাদের এই ‘গুদামঘর’ ওরফে থিয়েটার হলের দরমার ওপরটা বর্তমানে খড়-বিচালি আর তেলের পিপের পরিত্যক্ত স্টক।
মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল। হঠাৎ দর্শকদের আসন থেকে ছোট্ট মেয়ে মিতু হাততালি দিয়ে হেসে উঠে বলল, ‘কী মজা! তেলাদা ম্যাজিক দেখাচ্ছে। পেট থেকে দড়ি বের করছে। হি হি হি…।’
মিতুর কথায় তেলাদার দিকে চোখ পড়তেই আমাদের চক্ষুস্থির!
সত্যিই তো!
পাঞ্জাবির নিচ দিয়ে প্রায় হাত দেড়েকের মতো লম্বা পাজামার পাকানো ফিতেটা মৃদু মৃদু দুলছে। কিন্তু সভাপতি তেলাদার সেদিকে হুঁশ নেই। আর কিইবা এখন করা যাবে! তেলাদার গুরুগম্ভীর ভাষণ ততক্ষণে আরম্ভ হয়ে গেছে। বাইরে ঝাউ শাখার ঝিম্ ঝিম্ শব্দ। ফুলের মিষ্টি গন্ধ। সব মিলিয়ে অনুষ্ঠানটি বেশ ভাবময় করে তুলেছে। হঠাৎ দেখি দরজা জানালা এবং দরমার ফাঁক দিয়ে কিলবিল করে অসংখ্য তেলাপোকা বেরিয়ে আসছে। তেলাদা তখন বেশ মুডে বক্তৃতা দিচ্ছেন। থিয়েটার হল করছে গম গম।
বুড়োরা বলাবলি করছেন- না, ছেলেটা বক্তিতে করতে পারে ভালো!
আর স্বাস্থ্যটাও বেশ!
তেলাদার মা বললেন, ‘শত্রুরের মুখে ছাই দিয়ে- যত্নটা কি কম করি। ছেলে তো ঐ একটি।’ ‘তা-বটে-তা বটে!’ সায় দেন অন্যরা।
আর কারো খেয়াল ছিল কিনা জানিনে। কিন্তু আমি দেখছিলাম- এর মধ্যেই বেশ কয়টা তেলাপোকা ফর ফর করে উড়তে আরম্ভ করেছে। ঠিক যেন হেলিকপ্টার।
হঠাৎ বেশ বড়জাতের একটা ফরর টক্ করে পড়বিতো পড় একেবারে তেলাদার তেল চকচকে ঘাড়ের ওপর।
ব্যস। আর যায় কোথায়! স্থান-কাল-পাত্র সব ভুলে তেলাদা এমন এক হাইজাম্প দিয়ে মঞ্চের বাইরে গিয়ে পড়লেন যে তা কল্পনার বাইরে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক সবাই। তেলাদা ততক্ষণে হাইজাম্প, লংজাম্প, সাইডজাম্প- সবরকম জাম্প দিতে দিতে গুদামঘরের পেছনে চাতালে এসে হাঁফাচ্ছেন।
আমরা কয়েকজন ছুটে গেলাম ব্যস্ত হয়ে।
প্রশ্ন করলাম, ‘ব্যাপার কি তেলাদা? কি হয়েছে?’
বিনিময়ে প্রথমেই তিনি কয়েকটা গাঁট্টা বসিয়ে দিলেন আমাদের মাথায়। তারপর দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, ‘হতচ্ছাড়া পাজি ইডিয়টের দল কোথাকার। বাঁদরামির জায়গা পাসনি আর? তোরা জানতিসনে যে ওখানে ঐ নোংরা পোকাগুলো থাকে?’
চোখ বড় বড় করে প্রচণ্ড মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘নিশ্চয়ই না। আর জানলে কি তোমায় আমরা এখানে আসবার জন্য বলতাম? আমাদের যে তুমি কি ভাবো, তেলাদা!’
পরক্ষণেই চোখে অভিমানের মেঘ জমালাম।
ড্যাবডেবে চোখে তেলাদা চারদিকে তাকাতে তাকাতে বললেন, ‘আহা হা রাগ করিস কেন? তোদের কি আমি কখনো ভুল বুঝতে পারি? এখন যা। আমি বাড়ি যাচ্ছি। শরীরটা যেন কেমন করছে!’
তেলাদা চলে গেলেন। আমরা মঞ্চে ঘোষণা করলাম, ‘হঠাৎ একটা জরুরি সভায় সভাপতিত্ব করবার কথা মনে পড়ায় তেলাদা সেখানে চলে গেছেন। কাজেই সভাপতির হয়ে আমরা সবার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।’
সেদিন কোন রকমে অনুষ্ঠান শেষ করলাম। এরপর থেকে আমরা আর কোনদিন তেলাদাকে সভাপতি করিনি। বলা যায় না। কখন আবার তাঁর ‘তেলাতঙ্ক’ রোগটা হুট করে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
এর মাস কয়েক পরে মিতুর জন্মদিন। পাড়ার অনেকেই নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছে। তেলাদাও এসেছেন। আমাদের বাড়িটা বহুযুগ আগের। দাদুর আমলের। বাড়ির ভেতরে কয়েক হাজার ইঁদুর, টিকটিকি, মাকড়সা আর তেলাপোকার বাসস্থান রয়েছে।
ছোটদের জন্য চাতালে ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
গণ্যমান্য অতিথিদের কয়েকজন বসেছিলেন ঘরের ভেতর। রাজনীতি, সমাজনীতি থেকে শুরু করে সবনীতির আলোচনাই চলছিল পুরোদমে। ঘনামামা, নসুচাচা আর খোকনদা’দের সাথে গল্পে মেতে উঠেছিলেন তেলাদাও। এমনি সময় মিতু একহাতে একটা রঙিন সুতো, আর অন্যহাতে একটা বড়জাতের মসৃণ তেলাপোকা নিয়ে তেলাদার সামনে এসে দাঁড়ালো।
বলল, ‘আমার ফড়িঙের ঠ্যাঙে সুতো বেঁধে দাও না, তেলাদা। আকাশে ওড়াব।’
তেলাদা মিতুর হাতের দিকে মোটেই খেয়াল করেননি। অন্যান্যদের সাথে কথা বলতে বলতে বললেন, ‘কই দে দেখি।’
মিতু হাতের মুঠি খুলে পোকাটা তেলাদার কোলে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘নাও। পালিয়ে যেতে দিও না যেন।’
‘কই?’
তেলাদা কোলের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়াতেই দিলেন এক বিকট চিৎকার। তারপর লাফ মেরে উঠেই একেবারে ভোঁ দৌড়। তাঁর গায়ের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়ে কেঁদে ফেললো মিতু। বলল, ‘তেলাদা আমার ফড়িং নিয়ে পালিয়েছে, এ্যাঁ…এ্যাঁ…।’
তেলাদার হঠাৎ ছুটে পালানো আর মিতুর কান্নায় সবাই ছুটে এলো চারদিক থেকে। কেউ কিছু বুঝতে পারলো না। তেলাপোকাটা ছিটকে গিয়ে চেয়ারের হাতলে বসেছিলো। এবার র্র্ফ টক্ করে একেবারে মিতুর বুকের ওপর গিয়ে বসলো। আর অমনি ফিক করে হেসে ওটাকে খপ করে ধরে ফেললো মিতু।
মা খালারা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজও কি তেলার কোন জরুরি সভায় সভাপতিত্ব করবার কথা মনে পড়লো? যে অমন ধাঁ ধাঁ করে চলে গেল?’
আমরা কয়েকজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম।
পিন্টু ঢোক গিলে বলল, ‘হবে হয়তো।’

Share.

মন্তব্য করুন