পৃথিবীতে এমন অনেক রহস্যজনক ঘটনা ঘটে যা মানুষকে হতবাক করে দেয়। এইসব ঘটনার রহস্যভেদ করার জন্য বিজ্ঞানীরা যুগের পর যুগ পরিশ্রম করছেন। অনেক রহস্যের উদঘাটন হলেও এমন কিছু ঘটনা রয়েছে যার কারণ সম্পর্কে এখনও জানা যায়নি। টাংগুসকা ইভেন্ট তেমন একটি ঘটনা। মস্কো থেকে হাজারখানেক মাইল পূর্বে, উত্তরে আর্কটিক সাগর থেকে শুরু করে দক্ষিণে মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত, উরাল থেকে মাঞ্চুরিয়ার মাঝে এক জনবিরল জায়গা আছে।
এই অঞ্চলটি আসলে আয়তনে পুরো পশ্চিম ইউরোপ থেকেও বড়। এই একাকী প্রান্তরের কেন্দ্রে আছে টাংগুসকা নদের গুপ্ত উপত্যকা। এই নদীর নামকরণ করা হয়েছে টাংগাস জনগোষ্ঠীর নামে। প্রায় পঞ্চাশ হাজার একরের একটি বন আছে ওখানে, যে বনে গ্রীষ্মের দিনগুলোতে অগণিত পাইনের মাঝে চরে বেড়ায় বল্গা হরিণের দল। ছোট্ট এই জনগোষ্ঠী মূলত ঐ বনে হরিণ এবং ভালুক শিকার করে জীবনধারণ করে।
৩০ জুন, ১৯০৮ সাল। ভোর হয়েছে, আরেকটি নতুন দিনের শুরু। নীল আকাশের মাঝে রোদ খেলা করছে। কোথাও মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। অমন সময় আকাশের বুকে ভয়াবহ বিস্ফোরণটা হলো। ঐ বিস্ফোরণের ফলে উৎপন্ন আগুনের গোলা এত ভয়াবহ রকমের উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল যে, সূর্যকে মনে হচ্ছিল অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেছে। আর ঐ বিস্ফোরণের সময় উৎপন্ন উত্তাপের কথা বলতে গিয়ে একজন কৃষক বলেছেন মনে হচ্ছিলো যেন, আমা শার্ট শরীরের উপরেই একেবারে ঝলসে যাচ্ছিল।’
এমনকি ঐ উত্তাপে তার এক প্রতিবেশীর রুপোর প্লেট, কাঁটা চামচ ইত্যাদি গলেই গিয়েছিল। অনুসন্ধান করতে গিয়ে আরো চমকে দেয়া তথ্য বেরিয়ে এলো। জানা গেল, ঐ বিস্ফোরণ মূলত সেমেনভ থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটারের মতো দূরের এক জায়গায় হয়েছিল।
আরেকজন কৃষক, ভাসিলি ইলিচের ভাষ্যমতে, এত বিশালাকারের আগুন সবকিছুকে ঘিরে ফেলেছিল যে, এই আগুন পুরো বন, বনের সব বল্গা হরিণ, এমনকি অন্যান্য সব প্রাণীকেও ধ্বংস করে ফেলে। তিনি এর সাথে বেশ কিছু প্রতিবেশীকে নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখেন, কিছু পুড়ে যাওয়া হরিণের লাশের অবশিষ্টাংশ ছাড়া আর সবকিছু রাতারাতি নেই হয়ে গিয়েছে।
অসম্ভব উজ্জ্বল ঐ আগুনের গোলা মুহূর্তের মাঝে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ছুটে এসেছে উত্তর-পশ্চিমে। পৃথিবী জুড়ে পাওয়া গেছে ভূমিকম্পের তরঙ্গ, আর বায়ুমণ্ডলের মাঝে চাপ-তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে, ছাড়িয়ে গেছে রাশিয়া এবং ইউরোপকেও। ৮০০ কিলোমিটার দূরেও এই বিস্ফোরণ দৃশ্যমান ছিল।
ঠিক ঘটনার সময়, ঘটনাস্থল থেকে হিসেব করলে পৃথিবীর ব্যাসের মোটামুটি এক-চর্তুাংশ দূরে অবস্থিত লন্ডনে সেদিন এত আগে দিনের শুরু হয়ে গিয়েছিল যে, মধ্যরাতের আকাশ দেখে মনে হচ্ছিলো আসন্ন বিকেল।
তুলনা করতে গেলে বলতে হবে, ঘটনাটা যদি আমেরিকার শিকাগোতে ঘটতো, এর আলো পেনসিলভানিয়া, টেনেসি এবং টরোন্টো থেকেও দেখা যেতো। ইস্ট কোস্টে দাঁড়ালে, কিংবা আটলান্টা যতটুকু দক্ষিণে, সেখানে কিংবা পশ্চিমে রকি পর্বত পর্যন্তও এর গর্জন শোনা যেত। এবং সবকিছু স্বাভাবিক হতে হতে লেগে যেত দু’মাস। আর, এই বিস্ফোরণ সেদিন বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে এত বেশি ধোঁয়া আর ধুলো ছুড়ে দিয়েছে যে, বিশ্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশেও পৃথিবীর ছায়ায় সূর্যের আলো ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।
বহির্বিশ্ব থেকে মহাজাগতিক কিছু এসে আমাদের বায়ুমণ্ডলে আঘাত করেছে, এটুকু তো নিশ্চিত। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। অ্যারিজোনায় এরকম একটি বিশাল গর্ত আছে, যা মূলত একটি ধূমকেতুর আঘাতের ফলে তৈরি হয়েছে। আসলে ওটা ছিল একটি ছোট পাথরখণ্ড, এদেরকে বলা হয় গ্রহাণু। কিন্তু ‘টাংগুসকা ইভেন্ট’ নামে পরিচিত এই ঘটনা ছিল পুরোপুরি অন্যরকম।
বিজ্ঞানীরা সে সময় ধারণা করে নিয়েছিলেন, বিশালাকারের কোনো উল্কাপি- হয়তো পৃথিবীকে সরাসরি আঘাত করার আগে বাতাসে থাকতেই বিস্ফোরিত হয়েছে এবং ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে চারপাশে। এবং এর ফলেই অমন ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে।
কয়েক বছর পরে, ১৯২৭ সালে চেকোস্লোভাকিয়ান বিজ্ঞানী লিওনিদ কুলিকের নেতৃত্বে বিজ্ঞানীদের একটি দল ঘটনাস্থলে গেল অনুসন্ধান চালাতে। যদি বিস্ফোরণের জন্য দায়ী জিনিসটি সৌরজগতের কোনো জায়গা থেকে ছুটে আসা টুকরো কোনো গ্রহাণু বা উল্কাপিন্ড হয়ে থাকে, তাহলে এর চিহ্ন হিসেবে ঘটনাস্থলে তো একটি গর্ত অন্তত থাকবে।
তারা ওখানে গিয়ে অমন কিছুর চিহ্নও খুঁজে পেলেন না।
তারা আবিষ্কার করলেন, আকাশের যে জায়গায় বিস্ফোরণটা হয়েছিল, ঠিক ঐ বরাবর নিচে মাটিতে বিশাল অংশ জুড়ে কাদা কাদা সবকিছু যেন একেবারে জমে সমান হয়ে গেছে।
যেন হাজারখানেক বুলডোজার দিয়ে পুরো বনটাকে একেবারে সমান করে ফেলা হয়েছে লন্ডনের মতো আকারের কোনো শহরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য। এই সমান জায়গাকে ঘিরে আছে পুড়ে যাওয়া ভাঙাচোরা গাছের ধ্বংসাবশেষ। এর আশপাশের অনেকটা জায়গাজুড়ে ভাঙাচোরা ম্যাচের কাঠির মতো গাছের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে।
বোঝা যায়, ভয়াবহ কোনো হারিকেন এখানে এসে আছড়ে পড়েছিল, নিজের ভেতরে জমে থাকা সবটুকু উন্মাদনা পুরোপুরি উসুল করে নিয়েছিল ঠিক এখানে এসেই।
এটা আসলে ছিল ঐ বিস্ফোরণের ধাক্কা। এর ফলে এই অঞ্চলের সব ধরনের জীবন একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এবং পরবর্তী মোটামুটি পঁচিশ বছরের মতো সময় এই জায়গা ওভাবেই পড়েছিল, বিধ্বস্ত অবস্থায়।
পরবর্তীতে ৩০ মিটার গভীর করে মাটি খুঁড়েও দেখা হয়েছে, কিন্তু কোনো ধরনের মহাজাগতিক কোনো পদার্থ, ধূমকেতু, উল্কাপিণ্ড বা গ্রহাণুর সামান্য চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সরল কথায়, সেদিন পৃথিবীকে যা-ই আঘাত করে থাকুক, ওটা রাতারাতি বাতাসে মিলিয়ে গেছে!
১৯৬৫ সালে আবারো একজন পদার্থবিদ, একজন রসায়নবিদ এবং একজন ভূতত্ত্ববিদের সমন্বয়ে গঠিত তিনজনের একটি দল সব ধরনের প্রমাণ, মানে ঐ ঘটনা সংশ্লিষ্ট যত কিছু আছে, সব কিছু খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন। তাদের আশা ছিল, হয়তো তারা এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। যে এক-দুটো গাছ তখনও এত কিছুর মধ্যেও টিকে গেছে, ওগুলোকে পরীক্ষা করে ঐ বিস্ফোরণের ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছিলো।
এটা থেকে সে সময়ের বাতাসের শক্তির ব্যাপারে একটি ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল, আর এ থেকে এত গাছকে পুড়িয়ে ফেলার জন্য মোট কী পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন, সেটা হিসাব করে বের করা গিয়েছিল।
রেকর্ড থেকে দেখা গেল, সে সময় পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র কোনো কারণে খুব বিশৃঙ্খল হয়ে গিয়েছিল এবং সিসমোমিটার থেকে দেখা গেল সেটা ভূমিকম্পের সমান শক্তির কম্পনের রেকর্ড দেখাচ্ছে।
এরপরে বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট আলোর উজ্জ্বলতা এবং সেটার স্থায়িত্ব হিসাব করে দেখা হলো। পরীক্ষা থেকে তারা সিদ্ধান্তে আসলেন, ঐ বিস্ফোরণের ফলে কয়েক সেকেন্ডের মাঝে এক মিলিয়ন বিলিয়ন জুল শক্তি উৎপন্ন হয়েছে এবং চারপাশের উপরে আছড়ে পড়েছে।
এই পরিমাণ শক্তি দিয়ে পুরো যুক্তরাজ্য ১ ঘণ্টা চলতে পারতো! এটাকে মোটামুটি সরলীকরণ করে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের সাথে তুলনা করা যেতে পারে, তাহলে হয়তো কিছুটা বোঝা যাবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিরোশিমায় যে পারমাণবিক বোমাটি ফেলা হয়েছে, সে তুলনায় এই বিস্ফোরণ ছিল প্রায় ১,০০০ গুণ বেশি শক্তিশালী!
হয়তো সেদিন প্রতিপদার্থ দিয়ে তৈরি এক মিটারের মতো একটুকরো পাথর ছুটে এসে আঘাত করেছিল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে। তবে এ সবই অনুমান। সেদিন আসলে কী হয়েছিল, সেই রহস্যের সমাধান আজও হয়নি।
টাংগুস্কার বিস্ফোরণের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হলো, এটি ছিল বিশাল উল্কাপিণ্ড যা মাটি থেকে ৬-১০ কিলোমিটার উপরে এসে জ্বলে ওঠে। প্রতিনিয়তই বহির্বিশ্বের উল্কাপিণ্ড ঢুকে পড়ছে বায়ুমণ্ডলে আর প্রচণ্ড বেগের ফলে বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষে তা জ্বলে উঠে ছাই হয়ে যাচ্ছে। ৩০ মিটার ব্যাসের উল্কাপিণ্ড বায়ুমণ্ডলে ২০ কিলোটন শক্তিতে বিস্ফোরিত হতে সক্ষম। কিলোটন মাপের উল্কাপিণ্ডের বিস্ফোরণ বছরে দু-একবার ঘটছে বায়ুমণ্ডলের উঁচুতে।
আর টাংগুস্কার মতো মেগাটন মাপের বিস্ফোরণের উপযোগী উল্কাপিণ্ড ৩০০ বছরে একবার আঘাত হানে পৃথিবীতে। তবে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এফজেডব্লিউ হুইপল টাংগুস্কা বিস্ফোরণ সম্পর্কে বলেন, ‘এটি ছিল বরফ এবং ধুলাবালির ছোটখাটো ধূমকেতু।
প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে এসে বরফ এবং ধুলাবালি বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে এসে জ্বলে ওঠে এবং পৃথিবীপৃষ্ঠে পৌঁছানোর আগেই তা ভস্মীভূত হয় তাই কোনো আঘাতের গর্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওই সময়ে ইউরোপের আকাশে কয়েকদিন দেখা যায় ধূমকেতু।
বিজ্ঞানী কার্ল সাগান মনে করেন, বরফের ধূমকেতুর আঘাতের ফলেই ঘটে টাংগুস্কার বিস্ফোরণ। রুশ লেখক আলেকজান্ডার কাজানাতসেভ এ বিস্ফোরণ নিয়ে লেখেন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘দ্য এক্সপ্লোসন’।
অনেকে ধারণা করেন ভিনগ্রহের মহাশূন্যযানে বিস্ফোরণ ঘটে টাংগুস্কার ওপর। বিজ্ঞানী ড. ইউরি লাবভিন ভিনগ্রহের মহাশূন্যযানের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়ার দাবিও করেছেন। ২০০৯ সালে টাংগুস্কাতে খুঁজে পাওয়া বিচিত্র চিহ্ন আঁকা কোয়ার্জের টুকরোকে তিনি মহাশূন্যযানের কন্ট্রোল প্যানেলের ধ্বংসাবশেষ হিসেবে দাবি জানান।

Share.

মন্তব্য করুন