এক ॥ রহস্যময় দ্বীপ

জাপান সমুদ্রের মাঝের ছোট একটি দ্বীপ ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। বুনো লতাগুল্মে আচ্ছাদিত উত্তর দিকের অনেকটা অঞ্চল। অজস্র ছোট ছোট টিলা আর ঢিবিতে ভরা দ্বীপটির বেশির ভাগ এলাকা। ঐ দ্বীপটি দেখতে ছিল অন্য দ্বীপগুলোর চাইতে একেবারেই আলাদা ধরনের।
রাতের সমুদ্রের ঢেউগুলো যখন একটানা এসে আছড়ে পড়ত দ্বীপের বেলাভূমিতে তখন অদ্ভুত এক রকমের শিসের মতো শব্দ শোনা যেত। যেন দ্বীপটি কাউকে আহ্বান করছে। গাছপালা কাঁপিয়ে অবিরাম বয়ে যেত ছমছমে বাতাস। বুনো ফুলের উগ্র গন্ধকে বয়ে নিয়ে যেত বাতাস। চাঁদের ম্লান আলোতে কখনো কখনো সেই দ্বীপটিকে কিরকম রহস্যময় মনে হতো। যেন অপার্থিব একটা অঞ্চল। আর সেই রহস্যঘেরা দ্বীপটির মাঝখানে, দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মাঝে ছিল একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার। যেন সেটি গোপনে থাকে। এই গবেষণাগারটি যিনি স্থাপন করেছেন তার নাম তাকাদো নিশিমুরা। এমন বিচিত্র জায়গাতে কেউ যে গবেষণাগার তৈরি করে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে পারে তা রীতিমতো আশ্চর্যজনক। তাকাদো নিশিমুরা সাংঘাতিক রকমের গোপনীয়তা রক্ষা করে তার সেই গবেষণাগারটি নির্মাণ করেছেন। এটির নির্মাণকাজে এতোটাই সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছিল যাতে পুরো বিষয়টাই রহস্যময় কুয়াশার আবরণে ঢাকা ছিল। নির্মাণকর্মীরা কাজ করে গেছে অতি সঙ্গোপনে। সেই দুর্গম দ্বীপে যন্ত্রপাতি নিয়ে যাওয়া হতো অত্যন্ত গোপনীয়তায়। তাকাদো নিশিমুরা একজন রহস্যময় মানুষ। গোপনে সেই গবেষণাগারটিতে কাজ করেন।
বাইরের পৃথিবীর সাথে তার তেমন যোগাযোগ নেই। অনেকটা বিচ্ছিন্ন অবস্থাতে তিনি সেখানে থাকেন। তার গবেষণাগারে অল্প সংখ্যক কর্মী কাজ করে। কাছের ছোট বন্দর থেকে কয়েকজন কর্মী যান্ত্রিক বোটে করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাজ করতে আসে। তারা নিঃশব্দে কাজ করে যায় তাকাদোর নির্দেশ মতো। ঐ দ্বীপটিকে ঘিরে আশপাশের মানুষের মাঝে বেশ কৌতূহল রয়েছে। কিন্তু তারা কোনো রকমের রহস্যভেদ করতে সক্ষম হয়নি। দ্বীপটিকে ঘিরে যে রহস্য বলয় রয়েছে তা কোনোমতেই তারা ভেদ করতে পারেনি। শুধু কৌতূহল ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর রহস্য আরো বেশি ঘনীভূত হয়েছে।
তাকাদো নিশিমুরার কঠিন নির্দেশ রয়েছে তার সহকর্মীদের প্রতি। কোনোভাবেই যেন গবেষণাগারটির প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা না করে। এ বিষয়ে মুখে যেন কুলুপ এঁটে রাখে। যেসব জেলেরা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায় তারাও ঐ দ্বীপটিকে এড়িয়ে যেতে চায়। কেউ সেখানে যেতে চায় না। কেন যেতে চায় না তারও কোনো কারণ অবশ্য জানাতে পারে না। যেন ঐ দ্বীপটিকে নিয়ে কোনোরূপ আলোচনা করা যাবে না। তাতে তাদের অমঙ্গল হতে পারে। বলা যেতে পারে দ্বীপটির বিষয়ে নানা ধরনের কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে ঐ অঞ্চলের ধীবর সম্প্রদায়ের মাঝে।
এক রাতে দ্বীপটিতে এক রহস্যময় ঘটনার সূচনা হলো। গভীর রাতে সেই দ্বীপের ভেতর থেকে রক্ত হিম করা ভয়ানক এক চিৎকারের শব্দ ভেসে এলো। শব্দটার ধরন ছিল অনেকটা এ রকম যেন একটা বুনো জন্তু বিকৃত কণ্ঠে গর্জন করছে। ভয়ঙ্কর সেই শব্দটা কিছুক্ষণ শোনা গেলো। তারপর সব চুপ। নিস্তব্ধ হয়ে গেলো প্রকৃতি।
যেসকল জেলে নৌকা করে রাতে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিল তারা সেই বিচিত্র শব্দ শুনে আতঙ্কে শিউরে ওঠে। তারা এক ভীতিজনক অবস্থায় শিহরিত হয়।
কে এমনভাবে শব্দ করছে?
তারা এই প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। দ্বীপটির রহস্য আরো বেড়ে যায়।

ভয়ঙ্কর দানব গডজিলা । আলী ইমাম

দুই ॥ বিচিত্র গবেষণা

ভোরবেলায় বিজ্ঞানী তাকাদো নিশিমুরাকে দেখা গেল অস্থিরভাবে গবেষণাগারের বারান্দায় পায়চারি করতে। তাকে তখন বেশ উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিল। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে দুশ্চিন্তার ছাপ। উস্কোখুস্কো হয়ে আছে তার মাথার চুল।
তাকাদোর সচিব তরুণী নোগুচি সেখানে আসে। তার কাছে তাকাদোর এ ধরনের অস্থিরতাকে অস্বাভাবিক লাগে।
সচিব নোগুচি ব্যাগ্রকণ্ঠে জানতে চায়, ‘স্যার, আপনি কি অসুস্থতা বোধ করছেন?’
অধ্যাপক তাকাদো থতমত খেয়ে বলেন, ‘কই না তো।’
: কিন্তু আপনাকে এখন যেন কী রকম বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। অধ্যাপক প্রসঙ্গ পালটে বলেন : আচ্ছা নোগুচি, তুমি কি ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের কাহিনিটি জানো?
: জানি স্যার। মেরি শেলীর লেখা। কবি পার্সি বুসি শেলীর স্ত্রী। বলা হয়ে থাকে যে ঐ কাহিনিটি হচ্ছে গিয়ে পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনি। ওটাকে সেই মর্যাদাইত দেয়া হয়েছে।
বইটি নোগুচির পড়া ছিল। দারুণ রোমাঞ্চকর একটি কাহিনি। যা পড়লে গা শিউরে ওঠে। ভোরের নরম আলো চারপাশে প্রসন্নভাবে ছড়িয়ে আছে। গাঙচিলদের ঝাঁক উড়ে যায়। বাগানের ফুল ঝোপগুলোর ওপরে প্রজাপতিরা উড়ছে। কিন্তু এ রকম শান্ত, প্রসন্ন পরিবেশে অধ্যাপক তাকাদোকে এতো বিপর্যস্ত মনে হচ্ছে কেন? নোগুচি ব্যাপারটি বুঝতে পারল না।
আবার বলছেন একটি হরর বইয়ের কথা। বীভৎস উপাখ্যানের জন্য যা বহুল আলোচিত। অধ্যাপক তাকাদো হঠাৎ করে আজ সকালে এমন একটি গা ছমছমে বইয়ের কাহিনি কেন জানতে চাইছেন! কী এমন ঘটেছে! নোগুচি বলল, ‘জানেন স্যার, ঐ বইটির বিষয়বস্তু কিন্তু আমাকে যথেষ্ট চমকিত করেছিল। অধ্যাপক জানতে চান, ‘কোন বিষয়?’
: ঐ বইটিতে একটি মৃত মানুষের মধ্যে প্রাণ সঞ্চারের মতো বিচিত্র বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছিল। লেখিকা সেখানে অদ্ভুত এক ধারণা দিয়েছিলেন।
: সেই ধারণাটি কি সম্ভবপর হয়েছিল?
: হয়েছিল। আর সেইটাইতো হচ্ছে গিয়ে লেখাটির বৈশিষ্ট্য। শুধুমাত্র প্রাণ সঞ্চারই নয় বরং লেখিকা সেই সঞ্চারের মধ্য দিয়ে একটি মানুষকে সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। ধীরে ধীরে জেগে উঠেছিল সেই মৃত আত্মাটা। কিন্তু সেটিতো ছিল লেখিকার বিচিত্র, অদ্ভুত ধরনের এক কল্পনা!
প্রফেসর তাকাদো যেন তার সচিব নোগুচির এমন কথার সাথে একমত হতে পারলেন না। তিনি দ্বিমত পোষণ করলেন।
: না, সেটি শুধুমাত্র কোনো কল্পনা ছিল না। কারো নিজের হাতে তৈরি কোনো জিনিস যদি ভয়ানক রকমের কুৎসিত রূপ পেয়ে যায় তবে তাকে শেষ পর্যন্ত বিনষ্ট করে ফেলতে হয়। ব্যাপারটি যদিও খুব দুঃখজনক। যার পরিণতি ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক।
নোগুচি ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যে অধ্যাপক তাকাদো কেন সকালবেলা দিনের শুরুতেই এ রকম একটি রোমহর্ষক বিষয়ের অবতারণা করছেন। স্নায়ু কাঁপা একটি বিষয়।
ব্যাপারটি নোগুচির নিকটে অসংলগ্ন বলে মনে হচ্ছে।
অধ্যাপক তাকাদো বিষাদমাখা গলায় বললেন : ‘আসলে জিনিস যে তৈরি করেছিল সে তো আর চায়নি যে তার সৃষ্টিটি অমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠুক। সবাই তাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হবে।
নিজেকে আর কোনোভাবেই সংরবণ করতে পারলেন না অধ্যাপক তাকাদো। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি। তখন প্রচণ্ড রকমের আবেগতাড়িত মনে হচ্ছিল অধ্যাপককে।
নোগুচি বিব্রত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে বুঝতে পারছে না প্রফেসর হঠাৎ করে কেন এ ধরনের বিচিত্র আচরণ করছেন।
প্রফেসর বিষণ্ন কণ্ঠে বলতে থাকেন, ‘আমিও তো চেয়েছিলাম যে আমার সৃষ্টি সমস্ত পৃথিবীর জন্যে কল্যাণ বয়ে আনবে। শুভকর হবে। তিল তিল করে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমি এটাকে আবিষ্কার করেছি। আমি তো সর্বান্তকরণে চেয়েছিলাম যে আমার এই আবিষ্কার জগৎ সংসারের উপকারে আসবে। আমি গত পঞ্চাশ বছর ধরে অক্লান্ত গবেষণা করে একে আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছি।’
নোগুচি এই বিষয়টি ভালো করেই জানে যে প্রফেসর তাকাদো কতো নিষ্ঠাবান। যেন এক গভীর সাধনায় একান্তভাবে মগ্ন হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন তার গবেষণাগারের একান্তে নিভৃতে বসে গবেষণা করে গেছেন। আর তিনি তার এই গবেষণার কাজটি করেছেন খুবই গোপনীয়তার সাথে। তাদের কেউ জানতো না যে প্রফেসর ঠিক কোন বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন। কারো সাথেই তার গবেষণার বিষয়টি নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা করেননি। নোগুচি শুধু তার প্রশাসনের সাচিবিক দায়িত্বটুকু পালন করেছে। গবেষণার বিষয়টি জানতে চায়নি। গবেষণার বিষয়টি সম্পর্কে বলতে অধ্যাপক তাকাদো অনিচ্ছুক ছিলেন। গবেষণাগারের অন্যান্য কর্মীরাও সঠিকভাবে জানতো না অধ্যাপকের কাজের মূল বিষয়টি কী। প্রফেসর তাকাদো তার নিজস্ব ঘরে বসে একাকী গবেষণার কাজটি চালিয়ে গেছেন। তার ল্যাব কক্ষের দরজা বন্ধ থাকত। প্রফেসরের গবেষণার পুরো বিষয়টি তাই ঐ গবেষণাগারের সকলের নিকট রহস্যের আবরণে ঢাকা ছিল। কিন্তু এখন প্রফেসরের এমন চিন্তাক্লিষ্ট চেহারা দেখে মনে হচ্ছে যে তিনি তার সেই আবিষ্কারটি নিয়ে এখন আতঙ্কিত।
নোগুচির জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে প্রফেসর বললেন, ‘আমি তো আমার আবিষ্কারকে খুব ভালো করেই জানি। আর তার শেষ পরিণতিটাও বুঝি। খুব বেশি দিন আর তার আয়ু নেই। সে এই পৃথিবীতে আর কোনোভাবেই টিকে থাকতে পারবে না।’
নোগুচি বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘কেন টিকে থাকতে পারবে না। তাহলে কি টিকে থাকার মতো যোগ্যতা সে অর্জন করতে পারেনি। সে কি দুর্বল? অথর্ব?’
প্রফেসরকে তখন ভিন্ন রকমের দেখায়! তার মুখের ধরন যায় পালটে। চোখ দুটো ঝিকিয়ে ওঠে।
: মোটেই না। সে অসম্ভব রকমের বলশালী। সে এতোটাই শক্তিশালী যে তার যেন কোনো তুলনা নেই। তার চাইতে বেশি শক্তিশালী প্রাণী এই পৃথিবীতে আর কেউ কোথাও নেই।
: তাহলে তো বোঝা যাচ্ছে যে সে হচ্ছে ভয়ানক শক্তিমান। তাহলে আপনি কেন তার এমন দুঃখজনক পরিণতির কথা ভাবছেন। আর ভেবে আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছেন। আমি তো এই বিষয়টাকে একেবারেই মেলাতে পারছি না।
প্রফেসর তাকাদোকে চিন্তিত দেখায়।
: আমার এই চিন্তার প্রধান কারণটি হচ্ছে যে- সে হচ্ছে সবার চাইতে বেশি শক্তিশালী। আর সে কারণেই তো আমি ওটাকে অনেক দূরে রাখতে চেয়েছিলাম। যাতে কোনোভাবেই সে আর লোকালয়ে আসতে না পারে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যে আমার এই ধারণাটি সম্পূর্ণরূপেই ভুল ছিল।
নোগুচি দেখতে পায় যে, প্রফেসর তাকাদোর চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। প্রফেসর তাকাদো ভীতসন্ত্রস্তভাবে বারান্দার রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়েন।
: জানো নোগুচি, গতকাল গভীর রাতে আমি সেই সঙ্কেতটি অনুধাবন করতে পেরেছি। আমি সঙ্কেত পেয়েছি। আর এটা হচ্ছে ভীষণ রকমের অশুভ এক সঙ্কেত। সে ছুটে আসতে চাইছে।
: কোথায়?
: লোকালয়ে। সে এই দ্বীপ ছেড়ে দিয়ে শহরে যাবে। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখো। ওর এই শহরে যাওয়ার ইচ্ছেটা কিন্তু ওর জন্য মোটেই ভালো হবে না। আসলে ওর জন্য গভীর নির্জনতাই হচ্ছে গিয়ে সবচাইতে ভালো। আসলে ভুলটা হয়েছে আমারই। আমি ওটাকে সঠিকভাবে শিক্ষা দিতে পারিনি। সে কারণে সে এতো দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে গেল। আর এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধিটা ছিল অভাবনীয়। অচিন্ত্যনীয়। ভয়ঙ্কর একটাকে আমি সৃষ্টি করেছি। অতি ভয়ঙ্কর!
: কি নাম আপনার সৃষ্টি সেই প্রাণীটির?
প্রফেসর তাকাদো নিশিমুরা কেমন ফিসফিস করে বলেন, ‘আমি ওর নাম রেখেছিলাম গডজিলা! প্রফেসর তাকাদো অস্থিরভাবে চলে যান। নোগুচির কানে প্রাণীটির নাম প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, গডজিলা! গডজিলা!

ভয়ঙ্কর দানব গডজিলা । আলী ইমাম

তিন ॥ ডিম ফুটে বেরুলো

নোগুচি প্রফেসর তাকাদোর এতক্ষণের অসংলগ্ন কথাগুলোর ভেতর থেকেও ধারণা করতে পারে যে প্রফেসর একটি রহস্যময়, বিচিত্র প্রাণীকে সৃষ্টি করেছেন। গতকাল গভীর রাতে দ্বীপ থেকে সেই ভয়ঙ্কর প্রাণীটির গর্জন শোনা গেছে। গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে আসা ধীবরেরা সেই শব্দ শুনেছে। গবেষণাগারেও প্রাণীটির কথা ছড়িয়ে গেছে।
নোগুচি প্রফেসর তাকাদোর প্রিয় সহকারী কাওয়াবাতাকে খুঁজে বের করল। নোগুচির কেন জানি ধারণা হলো যে কাওয়াবাতা হয়তো প্রাণীটি সম্পর্কে জানে।
: আচ্ছা কাওয়াবাতা, তুমি কি আমাকে একটা কথার পরিষ্কার উত্তর দেবে?
: কী কথা?
: গডজিলা সম্পর্কে তুমি কী জানো? নোগুচির প্রশ্নে চমকে যায় কাওয়াবাতা।
: তুমি গডজিলার কথা জানলে কিভাবে?
: স্বয়ং প্রফেসর তাকাদো কিছুক্ষণ আগে নিজেই আমাকে বলেছেন।
কাওয়াবাতা অবাক হলো। এই প্রাণী সৃষ্টির বিষয়টি খুবই গোপনীয়তার সাথে এতদিন রক্ষা করা হচ্ছিল। ঘুর্ণাক্ষরেও যেন কেউ টের না পায়। কিন্তু স্বয়ং প্রফেসর যখন নোগুচিকে প্রাণীটি সম্পর্কে বলেছেন তখন তো আর লুকিয়ে রাখা যায় না।
: এই গডজিলা হচ্ছে একটা অদ্ভুত ধরনের জন্তু। বিশাল তার আকার। প্রায় চারশো ফুটের মতো। দেখতে অনেকটা ঠিক প্রাগৈতিহাসিক অতিকায় প্রাণী ডাইনোসরের মতো। নোগুচি কথাটি শুনে হতভম্ব হয়ে যায়।
: বলছো কি! এ রকম প্রাণীতো প্রায় সাত কোটি বছর আগেই লুপ্ত হয়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে।
: সেটা হয়তো প্রাণিবিজ্ঞানের ইতিহাস বলছে। কিন্তু অধ্যাপক তাকাদো তা বলেন না। বিশ্বাসও করেন না। তিনি দীর্ঘদিন গবেষণা করে সেই বিশাল প্রাণীটিকে আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। আর সেটা ঘটেছে এখানেই। নোগুচির বিস্ময়ের পালা যেন আর শেষ হতে পায় না। সকাল থেকেই রোমাঞ্চকর কথা শুনে আসছে।
: এটা এখানে কী করে সম্ভবপর হলো? আমরা তো এর কিছুই টের পেলাম না।
: এটা সম্ভবপর হয়েছে প্রফেসর তাকাদোর অসম্ভব বুদ্ধিমত্তার জন্যে। যে বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তিনি গোপনীয়তার এমন একটি বেষ্টনী তৈরি করেছিলেন যেখান এমন সব মারাত্মক কাণ্ড ঘটেছে সবার চোখের আড়ালে। প্রফেসর গহিন জঙ্গলের ভেতরে আরো একটি ল্যাব তৈরি করেছিলেন। প্রফেসর তাকাদো সেই প্রাণী সৃষ্টির গবেষণাটি সেখানেই সম্পন্ন করতেন।
নোগুচি প্রফেসর তাকাদোর গোপনীয়তা রক্ষার বিস্ময়কর দক্ষতার কথা ভেবে অভিভূত হয়ে যায়। লোকটির যে অপরিসীম ক্ষমতা রয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। লোকটির পাশাপাশি থেকেও তার রহস্যজনক অবস্থানটিকে ধরতে পারেনি।
কাওয়াবাতা বলে চলেছেন, ‘প্রফেসর তাকাদো অবশ্য দীর্ঘদিন থেকেই সরীসৃত জাতীয় প্রাণীদের সম্পর্কে গবেষণা করছিলেন। গবেষণার স্থান হিসেবে বেছে নিলেন জাপান সাগরের এই ছোট, নির্জন দ্বীপটিকে। এই গবেষণাগারের বিষয়টি এতদিন গোপনীয় ছিল। গত মাসে সেখানেই জন্ম নিয়েছে গডজিলা। সেই গহিন অরণ্যের গোপন ল্যাবে। যে বিষয়টি তোমরাও জানতে পারোনি। তোমরা শুধু এই ল্যাবটির সাথেই পরিচিত। এখানকার কাজ সম্পর্কেই অবহিত। অথচ এর আড়ালেই কী মারাত্মক আর বিশাল ঘটনাটি ঘটে গেছে।
নোগুচি কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়, ‘তার মানে হলো অত বড় বিশাল প্রাণীটি এখন মাত্র এক মাসের। কিভাবে এটা সম্ভব হলো?
: প্রফেসর তাকাদো এর জন্ম দিয়েছেন আণবিক বিকিরণ প্রক্রিয়ার সাহায্যে। আর এই আশ্চর্যজনক ঘটনাটি সম্ভবপর হয়েছে অদ্ভুত ধরনের জিন মিউটেশন পদ্ধতিতে।
প্রফেসর গিরগিটির জিন আর কুমিরের জিন নিয়ে গবেষণা করছিলেন। দ্বীপটিতে হঠাৎ করে আণবিক বিকিরণ ঘটে। একদিন দ্বীপটা কেঁপে উঠল। বাতাস সাংঘাতিক রকমভাবে তেতে উঠল। এর অদ্ভুত ধরনের একটা প্রভাব গিয়ে পড়ল গবেষণাগারে। একটা টেস্টটিউব হঠাৎ করে কাত হয়ে পড়ল টেবিলে। আর তার ভেতরের সমস্ত তরল পদার্থ গড়িয়ে গিয়ে পড়ল পাশের এক রাসায়নিক জারে। প্রফেসর কোনো খেয়ালে যেন সেই মিশ্রণ তরলকে একটা সিরিঞ্জের ভেতরে পুরলেন। তারপর খাঁচায় আটকে থাকা একটি গিরগিটির শরীরে সেই সিরিঞ্জের তরলটা প্রয়োগ করলেন। আর সেটি ছিল একটি বহুরূপী গিরগিটি। ঐ দ্বীপের ঘন জঙ্গল থেকে ধরা হয়েছিল গিরগিটিটাকে। যার গায়ের রঙ ছিল নীলচে কালো। পিঠের মাঝখানটায় ছিল একটা বড় আকৃতির বাঁকানো দাঁড়া। লম্বায় এক ফুটের মতো ছিল ঐ মাংসাশী প্রাণীটি। অন্য গিরগিটির সাথে সেটাকেও খাঁচায় পুরে রেখে দেয়া হলো। এক সময় গিরগিটিটার ডিম পাড়ার সময় হয়। সেটাকে তখন আলাদা করে সরানো হলো। এর মধ্যে তার শরীরে বেশ কিছুটা পরবর্তন হয়েছে। ওটার দাঁতগুলো বড় হয়েছে। একদিন গিরগিটিটা ডিম পাড়লো।
বেশ কয়টি নীলচে ধূসর রঙের ডিম। ডিমগুলো আকারে বেশ বড় ছিল। দিন কয়েক পর প্রাণীটা মারা যায়। এক ভোরবেলায় দেখা গেল যে ঐ প্রাণীটা মরে পড়ে আছে। ডিমের ভেতরের লালচে হলুদ রঙের তরল জিনিস বেরিয়ে জমাট বেঁধে আছে। শুধু একটা ডিম ঠিক অবস্থায় ছিল। অধ্যাপক তাকাদো খুব সাবধানে সেই ডিমটাকে খাঁচা থেকে বের করে আনলেন।
এরপর থেকেই অধ্যাপক তাকাদোর ভেতরে একটা পরিবর্তন দেখা যায়। মানুষটা অনেক বদলে গেল। সবসময় ঐ ডিমটাকে গভীর মনোযোগের সাথে পরিচর্যা করতেন। যেন তার সমস্ত অভিনিবেশ ছিল ঐ ডিমটিকে ঘিরে। গবেষণাগারে বসে শুধু সেই ডিমটাকে নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন।
অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে পড়লেন তাকাদো। সারাক্ষণই সেই ডিমটিকে নিয়ে সময় কাটাতেন। একটা বড় কাচের বাকসের মধ্যে রাখা হয়েছে ডিমটাকে। বাকসোটির ভেতরে ছিল অসংখ্য লাল, নীল, সবুজ তারের সংযোগ। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যে ঐ ডিমটি প্রতিদিন আকারে বাড়ছিল।
এভাবে ডিমের আকার বৃদ্ধির খবর কিন্তু শোনা যায় না। বেশ তাড়াতাড়ি করে বেড়ে চলছিল ডিমটি। আর এটি ছিল অস্বাভাবিক একটি ঘটনা। ডিমের এ রকম বৃদ্ধি অধ্যাপক তাকাদোকে উত্তেজিত করে রেখেছিল। কেন জানি তার কাছে মনে হচ্ছিল যে এরপর ডিমটি থেকে এক বিচিত্র ঘটনার জন্ম হবে। যাতে চমক থাকবে। একদিন অধ্যাপক তাকাদো দেখলেন যে ডিমটির বৃদ্ধি হওয়ার বিষয়টি বন্ধ হয়েছে। ডিমের রঙও পরিবর্তিত হয়েছে। বাকসোটির পাশেই রাখা ছিল একটি যন্ত্র। সেটা থেকে তথ্য পাওয়া গেল যে এবার ডিমটি ফাটার সময় হয়েছে। সবচাইতে আশ্চর্যের বিষয়টি হচ্ছে যে, এর মধ্যে ডিমটির আকার একটা বয়স্ক মানুষের চাইতেও উঁচু হয়েছে।
অধ্যাপক তাকাদো তার অল্প কয়জন ঘনিষ্ঠ সহকারীকে জানালেন যে, ‘আমরা এখন ডিমটির ফাটার জন্য অপেক্ষা করছি। ডিম ফাটার সময় অত্যাসনড়ব। সকলে তখন যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত ছিল তা হলো ঐ বিরাট আকারের ডিমটি থেকে যে প্রাণীটা বেরুবে তা দেখতে হবে কী রকম।
এক ধরনের অজানা শঙ্কা ঘিরে রেখেছিল তাকাদোর সহকারীদের। অনেকেই অবশ্যই ডিমের বিষয়টি জানত না। এদিকে অধ্যাপক তাকাদোর মাঝে কোনো রকমে ভাবান্তর ছিল না। তিনি বিচলিত বোধ করছিলেন না। তাকে দেখে মনে হতো যেন নতুন কোনো সৃষ্টির নেশায় তিনি মগ্ন হয়ে আছেন।

ভয়ঙ্কর দানব গডজিলা । আলী ইমাম

চার ॥ ভয়াল ভয়ঙ্কর

এক গভীর রাতে বিচিত্র ধরনের একটা শব্দ শুনতে পেয়ে অধ্যাপক তাকাদোর ঘুমটি ভেঙে যায়। তিনি তখন থাকতেন দ্বিতীয় গবেষণাগারের পাশের ছোট বাড়িতে। তার নিকট মনে হচ্ছিল যে ঐ বিচিত্র শব্দটা আসছে গবেষণাগারটি থেকে। তাকাদো তাড়াতাড়ি তার আরেক সহকারী ওজুমাকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন গবেষণাগারের দিকে। একেবারে গহিন জঙ্গলের ভেতরে গবেষণাগারটি। গাছপালায় ঢাকা। ছমছমে বাতাস বইছে। নিশাচর পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে। তারা দু’জন সাবধানে গবেষণাগারে প্রবেশ করেন।
ওজুমা মেঝেতে টর্চের আলো ফেলল। তার মনে হলো একটা বিশাল কালো ছায়া যেন সামনে থেকে সরে গেল। তারা ঘরে ঢুকে কোনায় রাখা কাচের বড় বাকসে টর্চের আলো ফেলে দেখলেন বিরাট ডিমটা ভেঙে পড়ে আছে। আর ছাদ পর্যন্ত কালো পাহাড়ের মতো একটা কিছু দাঁড়িয়ে আছে। সেই জমাট বাঁধা কালো ছায়াটা খানিকটা নড়ল। শরীরটাকে দোলালো। সেই নড়ে ওঠার দরুন
গবেষণাগারের বিভিন্ন স্থানে রাখা কাচের জিনিসপত্রগুলো ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ল। ছায়াটি ছিল অদ্ভুত আকৃতির একটা জন্তুর। সেই জন্তুটা হিংস্র কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল। সেই ডাকের শব্দটা ছিল ভীষণ তীক্ষ্ণ।
প্রফেসর তাকাদো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন বিশাল সেই সরীসৃপটির দিকে। তার মুখের কোনায় অদ্ভুত এক হাসি। ওজুমা কী রকম হতবিহ্বল অবস্থায় রয়েছে।
অধ্যাপক তাকাদো ওজুমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এর খুব খিদে পেয়েছে। এটার জন্যও এখুনি খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।
ওজুমা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘কিন্তু সেই জন্তুটা যে কী খায় তাতো জানি না। কী আনব?
প্রফেসর জানালেন, ‘তুমি চট করে ওর জন্য টুনা মাছের টিনগুলো নিয়ে এসো।
ওজুমা দৌড়ে গিয়ে ভাঁড়ার থেকে টুনা মাছের কয়েকটা টিন তুলে নিয়ে আসে।
এসে দেখে এক অদ্ভুত দৃশ্য। অধ্যাপক তাকাদো সে বিশাল জন্তুটার কাছে গিয়ে বিড়বিড় করে কিসব যেন বলছেন। আর জন্তুটাও দেখছে অধ্যাপক তাকাদোকে। বিশাল জন্তুটার নীল চোখ জ্বলছে ধক ধক করে। অধ্যাপক তাকাদোর হাতে ধরা যন্ত্রটা থেকে থিরথিরিয়ে নরম সবুজ আলো বেরুচ্ছে। জন্তুটা সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রয়েছে সেই কম্পিত আলোর শিখার দিকে।
এদিকে গবেষণাগারের কয়েকজন কার্মচারী কৌতূহলী হয়ে সেখানে আসে। তারা এ রকম অভাবনীয় এক দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। এ রকম বিশাল আকৃতির একটি প্রাণীকে ওরকমভাবে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে দারুণ আতঙ্কিত হয়। কেউ কেউ ভয়ে চিৎকার করতে থাকে। জন্তুটাও তখন বিরাট হাঁ করে চিৎকার করে উঠল। উপর থেকে একটা বিরাট কালো মাথা নিচুতে নেমে এসে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টুনামাছগুলো কপ কপ করে গিলতে থাকে। সমস্ত টুনা মাছ খেয়ে শেষ করে ওপরের দিকে মুখ তুলে ভয়ঙ্করভাবে গর্জন করল। তারপর সেই জন্তুটা তার বিশাল মাথাটিকে এদিকে সেদিকে নেড়েছে তখনই গবেষণাগারের ছাদটি ধসে পড়ল। কয়েকজন লোক ছিটকে পড়ে মূর্ছা যায়। জন্তুটা এরপর পেছনের ঘন অন্ধকারের ভেতরে মিলিয়ে যায়।
এভাবে দুঃস্বপ্নের মতো গবেষণাগারের কর্মীদের রাতটি কাটল।
ভোরে দিকে ওজুমাকে দেখা গেল ভীত চোখে চারপাশে তাকাচ্ছে। আতঙ্কের রেশটা তার চোখ-মুখ থেকে তখনও যেন কাটেনি।
অধ্যাপক তাকাদো ওজুমাকে আশ্বস্ত করলেন, ‘গডজিলা গভীর জঙ্গলের দিকে চলে গেছে। ওজুমা বিড়বিড় করে শুধু বলল, ‘গডজিলা, গডজিলা।’ এই নামটি তাকদোর দেয়া। ওজুমা কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়, ‘তা আপনি এ প্রাণীটার নাম গডজিলা রেখেছেন কেন?’ প্রফেসর তাকাদো এমন নামকরণের কারণ জানালেন।
‘আমি দুটো জাপানি শব্দ দিয়ে এই নামকরণ করেছি। এর মানে হলো তিমির মতো বিশাল আর গরিলার মতো শক্তিশালী।’
অধ্যাপক তাকাদো জানালেন, ‘দ্বীপের চারদিকে সমুদ্র। এর বাইরে জন্তুটা অবশ্য কোনোভাবেই যেতে পারবে না। আমি এখন ওটার খোঁজে যাই। ওটাকে তো আমিই সৃষ্টি করেছি।
ওজুমা কম্পিত কণ্ঠে বলে, ‘না জানি এই গডজিলা জন্তুটা কী সর্বনাশ ঘটায়। যে রকম ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল ওটাকে। আর যেভাবে গর্জন করছিল। ওটা এখন মহা আতঙ্ক। ভাগ্যিস, এই দ্বীপটা জনমানবহীন। এখানে কোনো জনবসতি নেই। শুধুমাত্র গবেষণাগারের সাথে সংশ্লিষ্ট আমরা কয়জন রয়েছি। আমরাও এখন মারাত্মক ঝুঁকির মুখে।’
অধ্যাপক তাকাদো জানালেন, ‘আমি সেই জন্তুটার খোঁজে যাচ্ছি।’
রাইফেল আর দূরবীন নিয়ে অধ্যাপক তাকাদো গভীর জঙ্গলের দিকে ছুটলেন। একটা অজানা আশঙ্কা যেন তাকে তাড়িত করেছে।
অধ্যাপক তাকাদো পুরো জঙ্গল চষে ফিরে এলেন শেষ বিকেলের দিকে। ওজুমা জানতে চায় গডজিলা জন্তুটা এখন কোথায়?
অধ্যাপক তাকাদোকে যথেষ্ট উদ্বিন্ন দেখাচ্ছে। ওজুমাকে বললেন, ‘আমরা এখন গডজিলার কারণে ভীষণ বিপদের মধ্যে আছি। এই দ্বীপে আর থাকা ঠিক হবে না। এক্ষুনি আমাদের এই দ্বীপটিকে ছেড়ে শহরে চলে যেতে হবে।’
আমাদের রসদপত্র নিয়ে আদিবাসী কুলিরা এখানে রাখা দুটো মোটর বোটের মধ্যে একটাকে নিয়ে পালিয়েছে। আমরা এখন বাকি বোটটাকে নিয়ে চলে যাবো। ওজুমা প্রফেসর তাকাদোর এমন ত্রস্তভাবে চলে যাওয়ার বিষয়টিতে অবাক হয়। এই ভয়ঙ্কর বিশাল প্রাণীটিকে তো তিনিই তার
গবেষণাগারে সৃষ্টি করেছেন। নিউক্লীয় বিকিরণের ফলে ‘জিন মিউটেশন’ এর রহস্যময় এক বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে এই গডজিলাকে। প্রফেসরের কাছে জানতে চায়, ‘কিন্তু আপনার তৈরি সেই গডজিলাটি কোথায়?’
প্রফেসর খানিকটা যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। তাকে এখন গডজিলাকে এই দ্বীপে রেখে চলে যেতে হচ্ছে। কতো গবেষণা করেই না তিনি এই প্রাণীটিকে সৃষ্টি করেছিলেন।
ওজুমার প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, ‘গডজিলা বোধ হয় জঙ্গলে ভালোই আছে। একটা বিশাল অজগর আর প্যানথারকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলাম। ও দুটো প্রাণীর শরীরের ক্ষতচিহ্ন দেখে মনে হলো যে গডজিলার সাথে তাদের ভয়ানক লড়াই হয়েছে। কিন্তু আমাদের এক্ষুনি দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে হবে। এখানে থাকাটা আর কোনোভাবেই নিরাপদ না।’
দু’জন তাড়াতাড়ি তাদের রসদপত্র গুছিয়ে নিয়ে মোটর বোটে উঠল। কয়েকটি তেলের টিন ছিল বোটে। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
মোটর বোটটি যখন স্টার্ট নিতে যাবে তখন জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা আদিবাসী কুলি চিৎকার করতে করতে ছুটে এলো। দূরে জঙ্গলের ভেতরে প্রচণ্ড তোলপাড় শুরু হয়েছে। মড়মড়িয়ে বিশাল গাছপালা ভেঙে পড়ছে। গাছগুলোকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলা হয়েছে। ঘন জঙ্গল ভেদে করে কালো পাহাড়ের মতো ছুটে বেরিয়ে আসে গডজিলা। এসেই সামনে পড়া কুলিটাকে ছোঁ মেরে তুলে নেয়। তীব্র মরণ চিৎকার শোনা যায় কুলিটার।
অধ্যাপক তাকাদোকে কোনোমতে জাপটে ধরে ওজুমা মোটর বোটে উঠে এসে স্টার্ট দেয়। তারা তখনও কুলিটার আর্ত চিৎকার শুনতে পাচ্ছিল। রক্তহিম করা সে চিৎকার।
অধ্যাপক তাকাদো বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, ‘তবে কি গডজিলা মানুষখেকো হয়ে গেছে। এতোটা ভয়ানক হিংস্র হয়ে ওঠার তো কথা না। তবে কি নিউক্লিয়ার মিউটেশন পদ্ধতিতে মাত্রাগত কোনো ভুল হয়েছে। মাত্রার হেরফের ঘটেছে। ব্যাপারটা আমি আর ভাবতে পারছি না।’
অধ্যাপক তাকাদো তার কপালের পাশটা চেপে ধরেন। যেটা দপদপ করছিল।
প্রফেসরের মাথায় অসহ্য রকমের যন্ত্রণা হচ্ছে গডজিলার কথা ভেবে। কপালের শিরা উপশিরাগুলো যেন ছিঁড়ে যেতে চাইছে। কী পরিণতি হতে যাচ্ছে তার সৃষ্টি গডজিলার? এই প্রশ্নটি তাকে বিপন্ন করে ফেলছে।
মোটর বোটে করে সেই নির্জন দ্বীপ থেকে তারা দু’জন ফিরে এলো কাছের বন্দর নগরী শিনকানজুতে। সেখানে অধ্যাপক তাকাদোর আরো একটি ল্যাবরেটরি রয়েছে।
দ্বীপ থেকে শিককানজু বন্দরের নিজস্ব ল্যাবে ফিরে আসার পর থেকেই অধ্যাপক তাকাদোকে বেশ গম্ভীর দেখাতো। সারাক্ষণ চুপচাপ বসে থাকেন নিজের পাঠ কক্ষে। মাঝে মাঝে অস্থিরভাবে পায়চারি করেন। দ্বীপে গবেষণাগারটিতে এখন আর কেউ থাকে না।
একদিন ওজুমা হন্তদন্ত হয়ে এলো তাকোদার পাঠকক্ষে। তাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছে।
: জানেন প্রয়েসর, সাংঘাতিক খবর। আপনার গডজিলা কিন্তু এসে গেছে!
: মানে কী বলতে চাইছেন?
: গডজিলাকে এবার সমুদ্রের পূর্ব উপকূল ভাগে দেখা গেছে।
: সে কি! গডজিলা কি তাহলে দ্বীপ ছেড়ে চলে আসছে এদিকে। সমুদ্র সাঁতরে আসছে। মারাত্মক ঘটনা!
ওজুমা যেন ভয়ঙ্কর দানব প্রাণীটার সমুদ্র সাঁতরানোর দৃশ্যটা মনের চোখে দেখতে পায়। ধেয়ে আসছে গডজিলা। সে এসে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে দেবে। দৃশ্যটা ভাবতেই ওজুমা শিহরিত হয়ে ওঠে। প্রফেসর ব্যাগ্র কণ্ঠে তখন জানতে চান, ‘আর কি জেনেছো গডজিলা সম্পর্কে? বলো আমাকে।’
: একদল টুনামাছ শিকারি উপকূলে দেখতে পায় গডজিলাকে। হঠাৎ করে প্রাণীটা তাদের সামনে পড়ে। প্রথমে তারা ঠিক বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল তিমি বা ঐত জাতীয় কোনো সামুদ্রিক প্রাণী বুঝি এগিয়ে আসছে। কারণ গডজিলা তখন শুধুমাত্র তার পিঠটাকে ভাসিয়ে রেখেছিল। জেলেদের নৌকার কাছাকাছি এসে সে মুখ তোলে। ঐ রকমের বিকট চেহারার প্রাণীটিকে দেখে জেলেরা চমকে যায়। ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু প্রফেসর বললেন, গডজিলা ঐ নির্জন দ্বীপটি থেকে বেরুলো কিভাবে?
অধ্যাপক তাকাদোর চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ে। তার কপাল কুঁচকে গেছে।
: আমি মনে করেছিলাম যে গডজিলা হয়তো ঐ নির্জন দ্বীপেই থেকে যাবে। ওকে তো আমিই সৃষ্টি করেছি। ওটা ছিল আমার একটা গবেষণার ফল। প্রাণীটা থাকবে লোকালয়ের বাইরে গহিন জঙ্গলে। কিভাবে এ ধরনের কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি হওয়া প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে তা নিয়ে গবেষণা করবো। ওর কথা যেন লোকে জানতে না পারে। তাইতো গডজিলার বিচরণের জন্য জাপান সমুদ্রের ঐ জনমানবহীন দ্বীপটাকে বেছে নিয়েছিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল গোপনে ঐ প্রাণীটার স্বভাব নিয়ে গবেষণা করার। কিন্তু আমার ধারণা ভুল হয়ে গেছে। আমি বোধ হয় একটি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করেছি। তার জন্য এখন মারাত্মক খেসারত দিতে হবে। ঐ দ্বীপে খাবারে টান পড়াতে সে এখন এগিয়ে আসছে উপকূলের দিকে। হয়তো আমাদের এই বন্দর নগরী শিনকানজুতেও আসবে।
: প্রাণীটা তাহলে সাঁতার জানে।
: ঠিক। গডজিলা হলো একটা উভচর প্রাণী। সে পানিতে ডাঙায় সমভাবে বিচরণ করতে পারে। পানির নিচে দীর্ঘ সময় ধরে ডুবে থাকতেও পারবে। তার সেই শারীরিক ক্ষমতা রয়েছে।
ওজুমা বুঝতে পারে নিজের সৃষ্টি করা প্রাণীটিকে নিয়ে এখন অধ্যাপক তাকাদো ভীষণ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের কাহিনীটি তার জানা। যে কিনা নিজের স্রষ্টাকেই বিনাশ করতে চেয়েছিল। তবে কি প্রফেসর সে রকমের কোনো পরিণতির কথাই ভাবছেন! আতঙ্কিত ওজুমা বলে, ‘গডজিলা যদি উপকূল ছেড়ে আরো সামনের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। তাহলে তো ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে।
: সেটা অবশ্যই আসবে। হয়তো এতক্ষণে এসেও পড়েছে।

ভয়ঙ্কর দানব গডজিলা । আলী ইমাম

পাঁচ ॥ ধেয়ে আসছে গডজিলা

প্রফেসর তাকাদোর আশঙ্কটাই সত্যি হলো। ভয়ঙ্কর দানব প্রাণী গডজিলা বিক্রম গতিতে এগিয়ে আসতে থাকে শিনকানজুর দিকে। বন্দর নগরীটির জন্যে সেটা ছিল বিপর্যয়ের পূর্বাভাস। নগরীর অধিবাসীদের কাছে সেটা ছিল অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। অকল্পনীয় বিষয়।
ইতোপূর্বে কয়েকবার তীব্র সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে শিনকানজু
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। জনপদ বিধ্বস্ত হয়েছিল। আকস্মিক সামুদ্রিক আক্রমণের সাথে শিনকানজুর লোকেরা পরিচিত। সামুদ্রিক ছোবলে কিভাব জীবনযাত্রা তছনছ হয়ে যায় তা তারা জানে। কিন্তু এবারের ঘটনাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের।
অচিন্ত্যনীয়। গভীর সমুদ্র থেকে উঠে এসেছে এক জলদানব। যার কথা আগে কখনও শোনা যায়নি। অতি ভয়ঙ্কর সেই দানবটি। তার সামনে যা পড়েছে তাই ধ্বংস করে ফেলছে। তার বিশাল পায়ের নিচে সবকিছুকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। টেলিভিশনে সরাসরি প্রচার করা হচ্ছে জলদানবের খবর। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে মানুষজন। টিভি ভাষ্যকার উত্তেজিত কণ্ঠে জানাচ্ছিলেন, ‘অতি ভয়ঙ্কর এই প্রাণীটাকে যেখানটায় দেখা গিয়েছিল তার থেকে সে এখন কয়েকশো মাইল এগিয়ে এসেছে। এর গতিবেগ প্রচণ্ড। ঘণ্টায় প্রায় চারশো ফুটের মতো। জনসাধারণকে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে। শিনকানজুর মেয়র জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন।
এই অঞ্চলের অধিবাসীরা যেন যে কোনো মারাত্মক পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকে। শহরের প্রশাসন চূড়ান্ত সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। নগরীর বিভিন্ন প্রবেশমুখে বৈদ্যুতিক ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছে। যাতে হাই ভোল্টেজ সঞ্চারিত হচ্ছে। এই ব্যবস্থার প্রতিও জনগণকে সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে। তবে জলদানবটা কোনদিক দিয়ে এগিয়ে আসছে তা এখনো সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। শিককানজুর অধিবাসীরা তখন রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত পার করছে।
সকলেই সন্ত্রস্তভাবে রয়েছে। কখন যে কী ঘটে যাবে তা বলা যাচ্ছে না। গডজিলার সর্বশেষ সংবাদ জানালেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি মাইকে ঘোষণা দিলেন, ‘আপনারা সবাই সতর্ক অবস্থায় থাকুন। এইমাত্র খবর পাওয়া গেছে যে বিশাল জন্তুটা এখন শিনকানজুর উত্তরের প্রবেশ পথের মুখে যে হাইওয়ে আছে সেখানে প্রচণ্ড ভাঙচুর চালাচ্ছে।
আপনারা সবাই যার যার ঘরে ফিরে যান। আমরা ঐ প্রাণীটিকে আটকানোর জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছি।
এ রকম ঘোষণা শোনামাত্র চারপাশে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। রাস্তার লোকজন এলোমেলো ছুটোছুটি করতে থাকে। পুলিশ বাহিনী অস্ত্র হাতে প্রস্তুত হয়ে থাকে। তারা যেন এক যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে শত্রুপক্ষের মোকাবেলা করছে।
ভয়ার্ত লোকজন পালাচ্ছে। পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ‘এখনও প্রাণীটি শহরে প্রবেশ করেনি।’
একজন লোক বলে, ‘এসে পড়তে কতক্ষণ? পথঘাটে তখন বিরাজ করছে চরম বিশৃঙ্খল এক অবস্থা।
টিভি ভাষ্যকার জানাচ্ছেন, ‘এই বিশাল জন্তুটা যে কোথা থেকে এসেছে তা কেউ জানে না। এর মধ্যে জন্তুটির সাথে পুলিশ বাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। তাতে অবশ্য প্রাণীটির এখন পর্যন্ত কোনো ক্ষতি হয়নি। শক্তিশালী বন্দুকে বুলেট ছুঁড়েও এর গতিরোধ করা সম্ভবপর হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশানুযায়ী এখন সেনাবাহিনী যোগ দিয়েছে। তারা হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান নিয়ে নেমেছে। সেই সাথে মিসাইলও প্রস্তুত। পরিস্থিতি এতোটাই মারাত্মক আকা ধারণ করছে। জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
জাপান সরকার বিষয়টির প্রতি সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখছে। স্বয়ং জাপান সম্রাট এতে গভীর উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছেন। মন্দিরে প্রার্থনা করা হচ্ছে। এক দুঃসাহসী ফটোগ্রাফার ঐ প্রাণীটির একটি ছবি তুলতে পেরেছেন। সেই ছবিটি এখন আপনাদেরকে এবার দেখানো হচ্ছে।’
তখন টিভি পর্দা থেকে ভাষ্যকারের মুখটি মিলিয়ে যায় আর সেখানে ভেসে উঠল ভয়ঙ্কর এক প্রাণীর মুখ। অনেকেই বিস্ফারিত চোখে দেখল গডজিলাকে। বহুতলা ভবনগুলোকে খেলনার মত দেখাচ্ছে প্রাণীটির সামনে। হঠাৎ করে প্রাণীটি তার বিশাল লম্বা লেজটিকে জাপটালো। অমনি একটি ভবন ধসে পড়ল।
প্রাণীটির নাম যে গডজিলা তা জানাল ভাষ্যকার। তাদেরকে সেই প্রাণীটির নাম জানিয়েছেন প্রখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানী প্রফেসর তাকাদো। তিনি জানিয়েছেন যে ঐ প্রাণীটি সম্পর্কে আগামীতে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য জানাবেন। তিনি প্রাণীটির রহস্য জানেন।
তখন টেলিভিশন ক্যামেরার জুম লেন্সে গডজিলাকে দেখানো হচ্ছিল। পুলিশের গাড়ি থেকে প্রাণীটাকে লক্ষ্য করে সার্চলাইটের জোরালো আলো ফেলা হচ্ছে। সেই আলো-আঁধারিতে আরো বেশি ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে প্রাণীটিকে। অতিশয় কদাকার আর বীভৎস এক মুখের খিঁচুনি।

ভয়ঙ্কর দানব গডজিলা । আলী ইমাম

ছয় ॥ গডজিলাকে চরম আঘাত

শিনকানজুর প্রবেশমুখের হাইওয়েতে গিজগিজ করছে মিলিটারি আর পুলিশ। মোটা তারের জালের বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ সবসময় সেই তারের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কয়েকটি সামরিক হেলিকপ্টার উড়ছে।
জন্তুটা শিনকানজুতে প্রবেশ করতে চাইলে প্রথমে ঐ বৈদ্যুতিক বেষ্টনী তাকে বাধা দেবে। ঐ বেষ্টনীর পেছনে দুটো শক্তিশালী মেশিনগান বসানো হয়েছে। মেশিনগানের পাশেই আকাশের দিকে উঁচু করে রাখা সার্চলাইট। প্রচুর সংখ্যক মিলিটারি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল হাতে তৈরি। এমন সময় সেখানে একটি ট্যাঙ্ক এসে থামল। ট্যাঙ্ক চালককে জানানো হলো হেলিকপ্টার থেকে জন্তুটাকে লক্ষ্য করা হচ্ছে। জন্তুটাকে দেখতে পাওয়া মাত্র বেতারে খবর আসবে। এক সামরিক কর্মকর্তা জানালেন, ‘কোনোভাবেই আর ঝুঁকি নেয়া যাবে না। বৈদ্যুতিক বেষ্টনীতে জন্তুটা বাধা পাওয়া মাত্রই আমরা আক্রমণ চালাবো। আমাদের উদ্দেশ্য হবে জন্তুটাকে তাড়িয়ে সমুদ্রের দিকে নিয়ে যাওয়া। তাহলে বিমান থেকে মিসাইল ছুড়ে মেরে এটাকে শেষ করা যাবে। ওপরে হেলিকপ্টারগুলো চক্কর দিয়ে চলেছে। হঠাৎ সামরিক কর্মকর্তার ওয়্যারলেসে- ‘বিপ বিপ বিপ’ শব্দ শোনা গেল। অফিসার শুনলেন জন্তুটা এসে পড়েছে। আর মাত্র কয়েকশো ফুট দূরে আছে।
সকলে সামনের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে দূরের কিছু বোঝা যাচ্ছে না। সামনের অন্ধকারটা যেন আরো বেশি ঘনীভূত হলো। আর মাটি কাঁপিয়ে সেই অন্ধকারের তালটা ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। এক সময় সেটা তারের বেষ্টনীর সামনে এসে দাঁড়াল। সেনাবাহিনী আর পুলিশ বাহিনীর সামনের দিকের সদস্যরা দেখলেন যেন আকাশ ফুঁড়ে দুটো বিশাল পা এসে দাঁড়িয়েছে। হেলিকপ্টারগুলো জন্তুটার মাথার কাছাকাছি উড়ে আসে। সব কয়টি হেলিকপ্টার থেকে জোরালো আলো ফেলা হলো সেই জন্তুর মাথায়। সবাই একটা বিশাল হিংস্র চোখ দেখতে পায়। দপ করে জ্বলে উঠেছে চোখটা। এরপর জন্তুটা আকাশ কাঁপানো বিকট চিৎকার দিয়ে উঠল।
সবগুলো সার্চলাইটের আলো ঘন অন্ধকারের বুক চিরে বুলেটের মত জন্তুটার বিশাল শরীরের দিকে ছুটে গেল। সামরিক কর্মকর্তা নির্দেশ দিলেন, ‘আরো ওপর থেকে আলো ওর মুখে ফেলে ফোকাস করো।’
আলো ফেলে গডজিলার বিশাল হাঁ করা মুখটাকে দেখা গেল। প্রাণীটা তার মাথাটাকে দু’পাশে জোরে জোরে দোলাচ্ছে। তার মাথার ধাক্কায় একটা হেলিকপ্টারের প্রপেলার ভেঙে যায়। তাতে আগুন ধরে যায়।
আরো একটু এগিয়ে আসে জন্তুটা। তার সামনে তারের জালের বেষ্টনী। জন্তুটা তখন তার বিশাল মাথাটিকে নামিয়ে লোহার জালটিকে কামড়ে ধরল। সাথে সাথে প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক শক খেয়ে তার শরীরটা থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। কানফাটানো চিৎকার দিয়ে সে পিছিয়ে যায়। তার কাঁটাঅলা বিশাল লেজটা বেষ্টনীর ওপরে আছড়ে পড়ল। এতে বেষ্টনীটা চোখ ঝলসানো আলো ছড়িয়ে ভেঙে পড়ে। বিকট গর্জন করে ওঠে জলদানবটা। ধকধকিয়ে জ্বলছে তার দু’চোখ। প্রাণীটা এবার তার বিশাল পা বাড়াল সামনের দিকে।
সৈনিকরা সমানে মেশিনগানের গুলি ছুঁড়ছে। গডজিলা তাতে ভ্রুক্ষেপ করল না। দুদিকে তার লেজ চাবুকের মত আছড়ে পড়তে থাকে। সামরিক ব্যবস্থা তছনছ হয়ে যায়। সার্চলাইটগুলো ভেঙে পড়তে থাকে। গডজিলার বিশাল পায়ের চাপে সবকিছু দলে পিষে যায়। গাড়িগুলো ভেঙেচুরে যায়। মিলিটারিদের এক নাগাড়ে গুলি চালানোয় জন্তু দানবটার গতিরোধ করতে পারল না। বিশাল ক্ষমতা যেন প্রাণীটির। গডজিলা অপ্রতিরোধ্য। অমন শক্তিশালী ট্যাঙ্ককেও গুঁড়িয়ে দিচ্ছে প্রাণীটা।

ভয়ঙ্কর দানব গডজিলা । আলী ইমাম

সাত ॥ শেষ লড়াই

শিনকানজুর মেয়র গডজিলার ভয়ানক আক্রমণের মুখে জরুরি সভা ডাকলেন। দানবটার ভয়াবহ শক্তির খবর পাওয়া যাচ্ছে। কোনোভাবেই প্রাণীটিকে আটকানো সম্ভবপর হচ্ছে না। আলোচনায় গডজিলার অসীম ক্ষমতার কথা উঠে আসে। এটা কোনো প্রাকৃতিক প্রাণী নয়। এই অদ্ভুত রহস্যময় প্রাণীটিকে সৃষ্টি করেছেন প্রফেসর তাকাদো।
যিনি নিজেও রহস্যজনক বলে বিজ্ঞানী মহলে সুপরিচিত বিভিন্ন সময়ে চাঞ্চল্যকার মন্তব্য দিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন।
এই গডজিলা প্রাণীটি আর এক অভাবনীয় চমক। জাপান সাগরের এক নির্জন দ্বীপের গবেষণাগারে তিনি সৃষ্টি করেছেন এই গডজিলাকে। নিউক্লিয় বিকিরণের ফলে ‘জিন মিউটেশন’ এর রহস্যময় এক বিবর্তনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে গডজিলার। জাপানি নাম। যার অর্থ হলো তিমির মতো বিশাল আর গরিলার মতো শক্তিশালী। এই নামকরণ করেছেন স্বয়ং প্রফেসর তাকাদো। তার মতে, একে ধ্বংস করাটা দুঃসাধ্য। শিনকানজুর মেয়র বললেন, ‘দুঃসাধ্য বলে আমাদের তো পিছু হটলে চলবে না। আমাদের সবার জীবন এখন ধ্বংস হতে চলেছে। গডজিলাকে যেভাবেই হোক বিনাশ করতে হবে। কিন্তু কিভাবে? কোন পদ্ধতিতে?’ প্রবীণ সেনা কর্মকর্তার অভিমত হলো, ‘সবদিক বিবেচনা করে ধারণা হচ্ছে যে মাটিতে দাঁড়িয়ে ঐ প্রাণীটির ক্ষতি করা সম্ভব হবে না। ওটাকে বিনাশ করতে হবে আকাশপথে। বিমানবাহিনীর প্রধান জানালেন, ‘তাদের পক্ষ থেকে দক্ষ চালকদের নিয়ে একটা বিশেষ স্কোয়াড তৈরি করা হবে। একসাথে ছয়টি যুদ্ধবিমান যাবে গডজিলা নিধন কার্যক্রমে।’
শিনকানজু শহরে পা রাখল গডজিলা। প্রথমে একটি বহুতলভবনকে গুঁড়িয়ে দিলো। গডজিলার পায়ের নিচে পড়ে পিঁপড়ের মতো পিষে গেল অনেক মানুষ। চারদিক থেকে মানুষজনের আর্ত চিৎকার ভেসে আসতে থাকে। পুরো শিনকানজু তখন ভয়াবহ বিপদের মুখোমুখি। গডজিলা এগিয়ে চলেছে। এমন সময় তার নাকে ধাক্কা মারল ওর পরিচিত প্রিয় একটা গন্ধ। সেটা ছিল টুনামাছের গন্ধ। মাছের বিশাল আড়তের সামনে চলে এসেছে গডজিলা। টুনা মাছের স্তূপ সেখানে। শিনকানজু বন্দরটি টুনা মাছ রফতানির জন্য বিখ্যাত। দ্বীপের গবেষণাগারেত গডজিলাকে প্রথমে টুনা মাছ খেতে দিয়েছিলেন প্রফেসর তাকাদো। ওজুমা বাকসো পেটি খুলে গডজিলার জন্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছিল টুনামাছ। শিনকানজুর মাছের আড়তে এসে গডজিলার খিদেটা যেন চাগিয়ে উঠল। সে মুখ নামিয়ে কপাত কপাত করে টুনামাছ খেতে থাকে। যুদ্ধবিমানগুলো নেমে আসছে নিচের দিক। চালকেরা দেখতে পেয়েছে গডজিলাকে। বিমানের শব্দ শুনে ওপরে মুখ তুললো গডজিলা। বিমানগুলো থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট ছোড়া হলো গডজিলার চোখ লক্ষ্য করে। প্রাণীটার বিশাল চোখ গুলি বিদ্ধ হলো। নরম চোখ ক্ষত বিক্ষত হল রক্তের স্রোত গড়িয়ে নেমে আসছে। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে উঠল জন্তুটি। সে বিমানগুলোকে ধরার জন্য চেষ্টা করল। দক্ষ চালকেরা বিমান ঘুরিয়ে গডজিলার আক্রমণকে এড়িয়ে যেতে থাকে। প্রাণীটা তার লেজের ঝাপটায় চারপাশে তোলপাড় করতে থাকে। একটা বিমান শাঁ করে নেমে আসে গডজিলার গলার দিকে। প্রাণীটির শরীরের নিচের দিকে কোনো রকম কঠিন আবরণ নেই। তার গলাটি নরম চামড়ায় ঢাকা। সেই থলথলে গলা লক্ষ্য করে বিমান চালক বুলেট ছুড়ল। দুলে উঠল গডজিলা। তারপর সেদিকে থেকে ছিল সেই সমুদ্রের দিকে ছুটল। বিমান চালকেরা বুঝতে পারলেন যে এবার প্রাণীটিকে শেষ আঘাত করার সময় এসেছে।
প্রফেসর তাকাদো শিনকানজুর মেয়রকে অনুরোধ জানালেন তাকে যেন গডজিলার অন্তিম মুহূর্তে সেখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। কারণ গডজিলাকে সৃষ্টি করেছেন তিনিই। তাই ওটার শেষ সময়ে উপস্থিত থাকতে চান। মেয়রের নির্দেশে একটা বিমান অধ্যাপক তাকাদোকে নিয়ে গডজিলার দিকে রওনা দিল।
যুদ্ধবিমানগুলো গডজিলাকে সমুদ্রের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে। এই সমুদ্রে থেকে উঠে এসেছে জলদানবটা।
প্রফেসর তাকাদো বিশেষ ব্যবস্থায় বিমান চালকের পাশের আসনটিতে বসেছেন। তিনি স্বচক্ষে গডজিলার বিনাশ পর্বটি দেখতে চান। সকলের কাছে গডজিলা মহা আতঙ্ক হলেও তার কাছে সে ভিন্ন রকমের। তিনি বুঝতে পেরেছেন যে গডজিলাকে সৃষ্টি করাটা ছিল তার জীবনের একটি মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত। ভয়ঙ্কর এই প্রাণীটিা অসংখ্য মানুষের জীবনাবসান ঘটিয়েছে। তার পায়ের নিচে দলে পিষে মেরেছে মানুষজন। বিধ্বস্ত করে দিয়েছে বহু জনপদ। তিনি গডজিলাকে সৃষ্টি করে এক ক্ষমাহীন ভুল করেছেন। সেটার তিনি প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। তিনি গডজিলার মৃত্যু কামনা করছেন।
ছুটে চলেছে গডজিলা। তার একটি চোখ বুলেটের আঘাত ছিন্ন হয়ে গেছে। বাকি চোখে সে ঝাপসা দেখছে। তবু চোখে প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে সে সমুদ্রের দিকে ছুটে চলেছে। কখনও লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। প্রাণীটির কাছে মনে হচ্ছে সমুদ্রের পানিতে ডুবে গেলে তার চোখের যন্ত্রণাটা হয়তো লাঘব হতো।
গডজিলার গলাটাও বুলেট বিদ্ধ হয়ে ছিঁড়ে গেছে। সেখান থেকেও গলগলিয়ে রক্ত ধারা নেমেছে। হঠাৎ সে সমুদ্র দেখল। সমুদ্রকে দেখা মাত্র গডজিলার মাঝে যেন স্বস্তি ফিরে আসে। সমুদ্রে নামার জন্য সে ছটফটিয়ে উঠল। সমুদ্র যেন তাকে ডাকছে। যুদ্ধবিমানগুলো গডজিলার মাথার ওপর দিয়ে এগিয়ে গেল। বিমান চালকেরা গডজিলার সাথে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
প্রফেসর তাকাদোকে বহনকারী বিমানটি ততক্ষণে গডজিলার কাছাকাছি এসে পাক খাচ্ছে।
প্রফেসর তাকাদো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন তার সৃষ্টি করা প্রাণীটির দিকে। তিনি পাইলটকে জানালেন, ‘আমি যে ওটাকে আরো ভালো করে দেখতে চাইছি। আপনি আরো একটু নিচে নামুন। পাইলট তখন জানাল, ‘আমার পক্ষে এর চাইতে নিচে নামা আর সম্ভব না। অন্য বিমান থেকে আমাকে বারণ করা হচ্ছে।’
প্রফেসর তাকাদো ছটফট করে উঠলেন। তিনি জানালা দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন গডজিলাকে।
একসময় একেবারে সমুদ্রের ধারে পৌঁছে গেল গডজিলা।
বিশেষ স্কোয়াডের ছয়টি বিমান ছুটে আসে গডজিলার দিকে। বিমানের আলো ছিটকে এসে পড়ল জলদানবের মাথায়। আলোর ঝলসানির দিকে তাকিয়ে গডজিলা বিশাল হাঁ করল। সাথে সাথে তার মুখের দিকে বিমান থেকে মিসাইল ছুটে যায়। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে গডজিলা থরথরিয়ে ওঠে। সে লাফিয়ে পড়ল সমুদ্রের পানিতে। গডজিলার বিশাল দেহটা ধীরে ধীরে সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যেতে থাকে। তার লেজটা একবার ঢেউয়ের মাথায় আছড়ে উঠল। প্রফেসর তাকোদা দুই হাতে মুখ ঢাকলেন।
দীর্ঘ সময় পর সেই নির্জন দ্বীপটির তীরে বিরাট একটা কিছু এসে সবেগে আছড়ে পড়ল। একটা যন্ত্রণাকাতর গোঙানির মতো শব্দ শোনা গেল। এক সময় থেমে যায় শব্দটা। চারদিক আবার নীরব হয়ে যায়।

Share.

মন্তব্য করুন