ইতিহাস সমৃদ্ধ এক রত্ন কোহিনুর। গোটা বিশ্বব্যাপীই কোহিনুর সবচেয়ে আলোচিত হীরা। ভারতীয় উপমহাদেশে এর জনপ্রিয়তা আরো বেশি। এই হীরার জন্মস্থানই যে পৃথিবীর এই প্রান্তে! সর্বাধিক জনপ্রিয় ও বহুল আলোচিত বিশ্বের সবচেয়ে হীরাগুলো একটিও এই কোহিনুর। কয়েকশো বছরের একটি দীর্ঘ ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে এই হীরার নামের সাথে। কোহিনুর শব্দটি মূলত ফারসি শব্দ কোহ-ই-নুর থেকে এসেছে। যার অর্থ পর্বতের আলো। কখনো এই হীরা শোভা পেয়েছে মুঘল দরবারে, কখনো ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছে ইরানি যোদ্ধাদের হাতে, কখনো আবার সমৃদ্ধ করেছে আফগান শাসক কিংবা পাঞ্জাবি মহারাজাদের।
এটি ডিম্বাকৃতির শ্বেতহীরা। বর্তমান ওজন ১০৫ ক্যারেট (২১.৬ গ্রাম) বা ৩১৯ রতি। প্রাথমিকভাবে ওজন ছিল ৭৫৬ ক্যারেট। এই মুহূর্তে কিছুটা স্থবিরই রয়েছে কোহিনুরের অবস্থা। সেই উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে প্রায় ১৭০ বছর যাবৎ এটি রয়েছে ব্রিটিশদের মালিকানায় এবং এর বর্তমান অবস্থান টাওয়ার অফ লন্ডনে, ক্রাউন জুয়েলসের অংশবিশেষ হিসেবে। কিন্তু ব্রিটিশদের মালিকানা নিয়ে যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে অনেক ভারতীয়ের। কেননা তাদের বিশ্বাস, ব্রিটিশরা এই ভারতবর্ষ থেকে চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে আলোর পর্বত নামধারী এই অমূল্য রত্নটিকে।
কোহিনুর কখনো ক্রয়-বিক্রয় করা হয়নি। এতে ৩৩টি পার্শ্ব রয়েছে। বিভিন্ন সময় হীরাটি হিন্দু, পারসি, মুঘল, তুর্কি, আফগান, শিখ এবং ব্রিটিশ শাসকদের অধিকারে ছিল। স্যার ওলফের মতে, কোহিনুর মুঘলদের অধিকারে ছিল ২১৩ বছর, আফগানদের অধিকারে ছিল ৬৬ বছর এবং ২০১১ সাল নাগাদ ব্রিটেনের অধিকারে ১২৭ বছর।
কালের অববাহিকায় কোহিনুর হীরা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বহু কিংবদন্তি, উপকথা ও গল্পগাথার। মানুষের মননে ঢুক গেছে বিভিন্ন ভ্রান্ত ও অন্ধবিশ্বাস। সেগুলো দূর করার উদ্দেশ্যে ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে উইলিয়াম ডালরিম্পল ও অনীতা আনন্দ রচিত ‘কোহিনুর : দ্য স্টোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ইনফেমাস ডায়মন্ড’ নামক বইটি।
বইটি থেকে আমরা জানতে পারি, ১৮৪৯ সালে কোহিনুর যখন তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির হাতে আসে, তখন তিনি প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেন রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে সেটি পাঠানোর। কিন্তু কেবল হীরাটি পাঠালেই হবে কেন! সেটি যে ঠিক কতটা মূল্যবান, তাও তো রানীর সামনে তুলে ধরতে হবে। তাই লর্ড ডালহৌসি ঠিক করলেন, রতড়বটির সাথে এর একটি আনুষ্ঠানিক ইতিহাসও প্রেরণ করবেন তিনি। সেই লক্ষ্য অনুযায়ী তিনি নিয়োগ দেন দিল্লির একজন জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট, থিও মেটক্যাফকে। মেটক্যাফের কাজ ছিল কোহিনুরের ইতিহাসের ওপর গবেষণা করা এবং সেই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা।
কিন্তু তিনি খুব একটা সুবিধে করতে পারেননি। ইতোমধ্যেই বাজারে কোহিনুর সম্পর্কে যেসব অতিকথন প্রচলিত ছিল, সেগুলোরই পুনরুল্লেখ করেন তিনি তার প্রতিবেদনে। অথচ তার সেই প্রতিবেদনটিকেই রেফারেন্স হিসেবে ধরে এরপর থেকে হাজার হাজার নতুন আর্টিকেল ও বই প্রকাশিত হয়েছে, নির্মিত হয়েছে বহু তথ্যচিত্রও।
এভাবেই কোনো এক সময়ে কোহিনুর বিষয়ক যেসব তথ্য ছিল নিছকই মনগড়া, শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশে সৃষ্ট, সেগুলোই পরবর্তীতে বিবেচিত হতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে।
ডালরিম্পলও আনন্দের লক্ষ্য ছিল, অতি রঞ্জনগুলোকে ছেঁকে সেখান থেকে বাস্তব সত্যগুলোকে বের করে নিয়ে আসা এবং সেই কাজটি তারা বেশ সফলভাবেই করতে পেরেছেন বলে রায় দিয়েছেন অনেক সমালোচক।
বর্তমানে কোহিনুরের প্রকৃত ইতিহাস জানতে অনেকেই নির্ভর করছেন এই বইটির ওপরই। ইতিহাসে কোহিনুরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অন্তত আরো দু’টি হীরকখন্ডের প্রমাণ পাওয়া যায়। একটি হলো দরিয়া-ই-নূর এবং অপরটি ‘গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড’ হিসেবে পরিচিত দুর্লভ হীরা।
কোহিনুর হীরা । সজল চৌধুরী১৭৩৯ সালে ইরানি শাসক নাদির শাহের লুটের অংশ হিসেবে তিনটি হীরাই ভারতবর্ষ ত্যাগ করেছিল। কেবল ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকে যখন কোহিনুর পুনরায় পাঞ্জাবে ফিরেছিল, তখন থেকেই এটি সর্বশ্রেষ্ঠ হীরার তকমা পেতে শুরু করে এবং এটি নিয়ে উচ্ছ্বাস শুরু হয়। শাহজাহানের রাজদরবারে কোহিনুরের ওজন পরীক্ষা করা হয়। ফরাসি রত্ন ব্যবসায়ী তাভারনিয়ার যাচাই করে দেখেন, তার ওজন ২৬৮ ক্যারেটের সামান্য বেশি।
ভেনিসের হীরক কর্তনকারী হরটেনসিও জর্জিস প্রথম অদক্ষ হাতে এ হীরা কেটে ফেলেন। এত বড় সর্বনাশ করায় সম্রাট শাহজাহান তাকে ১০ হাজার রুপি জরিমানা করেন। অনেকেই মনে করে থাকেন, প্রকৃত কোহিনুর হয়তো একদম নিখুঁত ছিল। কিন্তু আদতে তা সত্য নয়। এর ওপর অনেকগুলো হলুদ রঙের দাগ ছিল। কয়েকটি দাগ তো এত বড় ছিল যে, সেগুলোর কারণে হীরাটি ঠিকভাবে আলো প্রতিফলনের ক্ষমতাই হারিয়েছিল। এ কারণেই রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী, যুবরাজ আলবার্ট এত বেশি আগ্রহী ছিলেন হীরাটিকে নতুন করে কাটানোর জন্য। অনেকেরই দাবি, কোহিনুর হীরাটি নাকি ত্রয়োদশ শতকে ভারতের কোল্লুর খনি থেকে এসেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কবে, কোথায় এটি উত্তোলিত হয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া একদমই সম্ভব নয়। এই অনিশ্চয়তা একে এত বেশি রহস্যময় করে তুলেছে।
ধারণা করা হয়েছিল কোহিনুর কোনো খনি থেকে উত্তোলন করা হয়েছিল কিন্তু ডালরিম্পল ও আনন্দের বইটিতে জোর দিয়ে দাবি করা হয়েছে, কোহিনুর কোনো খনি থেকে উত্তোলন করা হয়নি, বরং এটি তোলা হয়েছে সম্ভবত দক্ষিণ ভারতের কোনো শুষ্ক নদীপৃষ্ঠ থেকে। এ কথা অবশ্যই সত্য যে হীরা এক মহামূল্যবান রত্ন। বিশেষত হিন্দু ও শিখদের কাছে এটি যেন অমূল্য। কিন্তু মুঘল ও ইরানিদের বিষয় আলাদা। তারা হীরার থেকেও বেশি পছন্দ করত বৃহৎ, আকাটা, উজ্জ্বল রঙের পাথর। আর সে জন্যই কোহিনুর হীরাকে মুঘলদের সবচেয়ে মূল্যবান ধন বলে যে দাবি করা হয়, তা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয় না।
বস্তুত, মুঘলদের রাজকোষে ছিল বহু ধরনের মূল্যবান ধন-সম্পদ। কোহিনুর সেগুলোরই একটি। কিন্তু মুঘলরা সবচেয়ে বেশি অধিগ্রহণ করেছিল যে বস্তুটি, তা হীরা নয়। বরং তাদের বেশি ঝোঁক ছিল বাদাখশানের লোহিতক ও বার্মার পদ্মরাগমণির ওপর।
১৪ শতকের প্রথম দিকে তুর্কি রাজবংশের সেনারা অপহরণ ও লুটতরাজের জন্য দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে। ১৩১০ সালে আলাউদ্দিন খিলজির সেনাপতি মালিক কফুর, ওয়ারঙ্গলেত একটি সফল অভিযান পরিচালনা করেন।
কাকাতিয়া রাজ্য ও অন্যান্য দক্ষিণ ভারতীয় রাজপ্রাসাদ ও মন্দিরগুলো লুট করা হয়। যার মধ্যে কোহিনুরও ছিল। এরপর হীরাটি তুর্কি রাজবংশের কাছেই ছিল। এরপর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হতে হতে এটা দিল্লির সুলতানদের অধিকারে আসে।
কিন্তু ১৫২৬ সালে তুর্কি-মুঘল যুদ্ধে তুর্কিরা পরাজিত হয়। জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় হীরাটি বাবরের দখলে চলে আসে। বাবর ও তার ছেলে সম্রাট হুমায়ুন দু’জনেই এটিকে ‘বাবরের হীরা’ বলে পরিচিত করিয়েছেন।
পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাহজাহানের হাতে আসার আগ পর্যন্ত হীরাটি মুঘল তোষাখানায় পড়ে ছিল। সম্রাট শাহজাহান, তার সুসজ্জিত ময়ূর সিংহাসনে হীরাটি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমগ্র ভারতবর্ষ দখল করে নিলে কোহিনুরসহ ময়ূর সিংহাসন তাদের দখলে চলে যায়। কোম্পানি হীরাটি রানীকে ভেট হিসেবে প্রদান করে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোহিনুর বিশ্বের সবচেয়ে বড় হীরা তা নয়। এর অবস্থান মাত্র ৯০তম। এ কারণেই টাওয়ার অব লন্ডনে এর আকৃতি দেখে অনেক দর্শনার্থীই অবাক হন। কেননা ঠিক পাশেই রাখা দু’টি কালিনান হীরার সাথে তুলনা করলে কোহিনুরকে সত্যিই অনেক ক্ষুদ্রাকৃতির বলে মনে হয়।

Share.

মন্তব্য করুন