কার্তিকের পরের মাস অগ্রহায়ণ; চিরায়ত বাংলার আমনপ্রধান অঞ্চলে নিয়ে আসে আশীর্বাদ। ধান কাটার ভরা মৌসুম হলো এই মাস। ফসলি মাঠের ঢেউ উপচে পড়ে কৃষকের গোলা, আঙিনা ও চাতালে। এই সময়ে নতুন ধানে কিষাণ-কিষাণীদের আনন্দ আর ব্যস্ততার সীমা থাকে না। বর্তমানে কৃষিকাজের সবক্ষেত্রেই প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। হেমন্তে সারা বছরের পরিশ্রমের ঘামে ফলানো ফসল কৃষকে মরমে সোনালি প্রলেপ মেখে দেয়। তাই যুগ যুগ ধরে এ মাসটি ‘নবঅন্ন’ নতুন ভাত বা ‘নবান্ন’ নামে পরিচিত পেয়ে আসছে।
এ সময় সব কৃষকের ঘরে থাকে নতুন ধান। ওই ধানের চাল দিয়ে কৃষক পরিবারে পিঠা-পুলি তৈরির ধুম পড়ে যায়। অগ্রহায়ণ তখন রূপ নেয় উৎবের আমেজে। এ উৎসবে হরেক রকম পিঠা তৈরি হয়। নামের মতোই বৈচিত্র্যময় পিঠাগুলো স্বাদে অনন্য। যেমন- চিতই, পাকানো, পাকোয়ান বা পাক্কন, পাটিশাপটা, কুশলি, ভাপা, পাতা, ভাত, কাটা, নকশি, পুলি, দুধ বা ভিজানো, ছিটা, লবঙ্গ, গোকুল, ম্যারা, মুঁঠা, সিদ্ধ, পুতুল, লরি, চাছি, সাগুদানা, ঝুড়িসীতা, তারাজোড়া, জামাই, জামদানি, হাদি, পাটা, তেজপাতাসহ অসংখ্য বাহারি নামের পিঠা বাড়িতে বাড়িতে তৈরি করা হয়। এই সময় আত্মীয়স্বজন বেড়াতে আসে। তাদের নতুন চালের পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করানো হয়। এভাবেই গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে পড়ে নবান্নের আমেজ।
ঋতুকন্যা হেমন্ত । রবিউল ইসলামবেলী, সন্ধ্যামালতী, দোপাটি, বক, জুঁই, কামিনী, গোলাপসহ অসংখ্য ফুল হেমন্তে ফুটে প্রকৃতিকে সুরভিত করে তোলে। বাংলাদেশের নদীর রূপ-রঙ এক রকম এবং সাগরের অন্য রকম। কিন্তু নদী ও সাগরের যে মিলনস্থল অর্থাৎ মোহনা এর সৌন্দর্য মোহনা এলাকার মানুষ ছাড়া তেমন কেউ জানেন না। কার্তিক মাস ঠিক ওই রকম- দুই ঋতুর মোহনার মতো। এ কারণেই বাংলাদেশের প্রাণ ও প্রকৃতি দেখার সবচেয়ে সুন্দর সময় এই কার্তিক মাস। হেমন্তে দেখা যায় অখ- নীল আকাশ। শরৎ থেকে হেমন্ত খুব পৃক নয়, শীত থেকে তেমন বিচ্ছিন্ন নয় এর প্রকৃতি। এটি শীত-শরতের মাখামাখি একটি সিড়বগ্ধ সুন্দর বাংলা ঋতু। হেমন্তের শিশির ভেজা ঘাসের ডগা যেন মুক্তার মেলা। সকাল বা সন্ধ্যায় অদৃশ্য আকারে ঝরে আকাশ থেকে।
আবহমানকাল থেকে কমনীয়তার প্রতীক এই শিশির। ভোরের কাঁচারোদ, মৃদৃ হিমস্পর্শ প্রাণে শিহরণ জাগায়। বাংলাদেশে হেমন্ত আসে ধীর পদক্ষেপে, শীতের পরশ আলতো করে গায়ে মেখে।
ঋতুকন্যা হেমন্ত । রবিউল ইসলামপ্রকৃতির ম্লান, ধূসর ও অস্পষ্টতার অনুভূতি যখন হানা দেয় চেতনলোকে, তখনই বোধকরি বুঝতে পারা যায় হেমন্তের আগমন ঘটেছে। হেমন্ত আসে মৌন, শীতল ও অন্তর্মুখীনতা নিয়ে। বাঙালির উৎসব বলতেও হেমন্ত; যার নেপথ্যে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলার হাজার বছরের কৃষিসংস্কৃতি। ষড়ঋতুর এদেশে প্রকৃতির বর্ণছটা আর নবান্নের আমেজে হেমন্ত যখন হাজির হয় বাংলার ঘরে ঘরে, প্রকৃতিতে, তখন হালকা কুয়াশা চুইয়ে নামে প্রান্তরে। উঠোনে ঝরে পড়া শিউলি কিংবা বুনো ঘাসের ডগায় শিশিরের সকরুণ মিনতি ফুটে ওঠে যেন বুকে স্রোত জাগিয়ে ভাটি অভিমুখে তরতরিয়ে ছুটে চলে বাঁকফেরা নদী। উত্তরের হিম হিম বাতাসে শুষ্ক হয়ে আসে শরীর, তবু নদীর চরে কিশোরের দল ঘুড়ি-উৎসবে মাতে। নদীতে ভেসে চলে জেলেদের ডিঙি, কখনো বেদেবহর। বিলে মৌসুমের মাছ ধরা উৎসবে গ্রামের শৌখিন মাছশিকারির ঢল, পলো হাতে। চোখ আটকে যায় শুকনো জলাশয়ে ঝিমানো কচুরিপানার বেগুনি-শাদা ফুলকলিতে। ফসলহীন খেতের আলপথে জংলি ফুল পাখা মেলে। পথে পথে সবুজ বুনোলতায় পতঙ্গের খুনসুটি। একটি-দুটি ফুলও ঝরে পড়ে ঘাসের নরম কার্পেটে। কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ ডাকে দুপুরের সঙ্গী হতে। মনে হয়, কোনো নবীনা কনেবউয়ের মুখের উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। লাজুক রঙের বাহার।
পথের বাঁকে হালকা বাতাসে ওড়ে হেমন্তের ধুলো, ধানের পরশ মাখা। নির্জন ব্যালকনিতে খসে পড়ে হলুদ পাতা, কিছু ফুল। ঘুঘুডাকা নিঝুম বিকেল, কানে ফুলের ঝুমকো বসিয়ে গালফোলা চঞ্চল কিশোরী গাছে হেলান দিয়ে শোনে বিকেলপাখির কিচিরমিচির। হিমহিম, স্বল্পায়ু দিন ক্রমে মিইয়ে যায় সন্ধ্যায়, চিকন চাঁদের মৃদু আলোয়। সন্ধ্যার আকাশ থেকে দু-একটা তারাও হয়তো খসে পড়ে! প্রকৃতিতে ব্যাপক প্রভাবসঞ্চারী, উৎসবের আনন্দ নিয়ে আসা শরতের শাদা ঝালর মুছে যেতে না যেতে কখন যে শান্ত-সুন্দর-স্নিগ্ধ হেমন্ত প্রকৃতিকে রাঙিয়ে তোলে এমন মনোলোভা দৃশ্যে, তা টেরই পাওয়া যায় না। আবহমান বাংলা ছাড়া কোথাও কি মেলে এমন অপরূপ দৃশ্য? হেমন্ত প্রকৃতির ছবি এর চেয়েও হয়তো অনেক বেশি শোভাবেষ্টিত, যা বর্ণনাতীত। হেমন্ত শুধু দৃশ্যের নয়; গন্ধের, শস্যের, আলস্য-পূর্ণতা-বিষাদের করুণতামাখা লাবণ্যময়ী ঋতু হেমন্ত।
উপলব্ধির যথার্থ অনুবাদ অসম্ভব হলেও হেমন্তের এই রূপ প্রত্যক্ষ করে মনে পড়ে যায় বাংলার প্রকৃতি নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের অমর উচ্ছ্বাসকাব্য ‘এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী’র কথা। আবার হেমন্তের এমন মনোহারী রূপে জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথা না বললেই নয়, ‘আবার আসিব ফিরে, ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়… কার্তিকের নবান্নের দেশে… কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এই কাঁঠাল ছায়ায়…।’

Share.

মন্তব্য করুন