উৎসবের দিন।
সারাদেশ আনন্দে মশগুল। গরিব-ধনী সবাই আজ সমান। সবাই ঘর থেকে বেরিয়েছে উৎসবে যোগ দিতে। রাজপ্রাসাদের সামনে বিশাল মাঠ। তাতে মানুষের এত ভিড় যে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। স্বয়ং বাদশা আজ প্রজাদের সঙ্গে মিশে যে যা উপহার দিচ্ছে তা সানন্দে গ্রহণ করছেন।
দেখতে দেখতে রাত হয়ে এলো। কিন্তু এখনো বাদশাকে উপহার দেওয়া শেষ হয়নি। চারিদিকে এখনো নাচ-গান, হৈ-হল্লাও চলছে। প্রধানমন্ত্রী ভিড় ঠেলে প্রবেশ করে প্রজাদের উদ্দেশে বললেন, তোমাদের কারো কিছু দেওয়া বাকি আছে এখনো?
সামনে দাঁড়ানো প্রজারা কেউ কিছু বলল না। এমন সময় পিছন থেকে ভিড় ঠেলে একজন লোক এগিয়ে এলো। তার চেহারা এবং পোশাক দেখে মনে হলো ভিনদেশী। সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল তার সাথে ডানাওয়ালা একটি ঘোড়া। দেখতে অনেকটা রূপকথার গল্পের পক্ষিরাজ ঘোড়ার মতো। ঘোড়াটিকে জীবন্ত মনে হচ্ছে। ওর লাগাম ধরে টেনে নিয়ে লোকটি বাদশার সামনে কুর্নিশ করে দাঁড়াল। বলল, জাঁহাপনা! আপনাকে উপহার দেবার জন্য আমি এই আধুনিক পক্ষিরাজ ঘোড়াটি নিয়ে এসেছি। আজ আপনি অনেক সুন্দর সুন্দর উপহার পেয়েছেন কিন্তু আমার মনে হয় এমন সুন্দর ও আশ্চর্য উপহার পাননি। এই ঘোড়াটি একটি উনড়বত মানের রোবট।
এর পিঠে চড়ে আপনি মহাবিশ্বের যে কোনো গ্রহে যেতে পারবেন; এটা কোনো বাধার সম্মুখীন হবে না। লোকটির কথা শুনে বাদশা অবাক হয়ে গেলেন। ঘোড়াটি দেখে সত্যি আসল ঘোড়ার মতোই মনে হচ্ছে। বাদশা লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কিন্তু তোমার কথার সত্যতা কী?
লোকটি জবাব দিলো,
জাঁহাপনা! আপনি কাউকে এর পিঠে চড়িয়ে দিন, তারপর সুইচ টিপলেই হাতে-নাতে প্রমাণ পাবেন। পাশেই রাজপুত্র স্বনন ছিল। বাদশা স্বননকে ইঙ্গিত করতেই সে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলো। লোকটি কিভাবে ঘোড়াটি চালাতে হয়, কিভাবে ফিরে আসতে হয় ইত্যাদি বুঝিয়ে দিতে লাগছিল। কিন্তু স্বনন এমনই অধীর হয়ে উঠছিল যে সব কথা কানে না তুলে শুধু ছুটে চলার সুইচে চাপ দিতেই পক্ষিরাজ শোঁ-শোঁ করে মাটি থেকে আকাশের পানে উঠে গেল। দেখতে দেখতে মহাশূন্যে মিলিয়ে গেল।
অনেকক্ষণ কেটে যাবার পর লোকটি বলল, রাজপুত্র তো ফিরে আসতে পারবেন না। পক্ষিরাজ কিভাবে থামাতে হয়, কিভাবে ঘোরাতে হয় এসব কথা ভালো করে না শুনেই তিনি সুইচে টিপ দিয়েছেন। ওর কানের ভিতরে একটি সুইচ আছে সেটি না টিপলে তিনি আর ফিরে আসতে পারবেন না।
এ কথা শুনে বাদশার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কি সর্বনাশ! তাহলে উপায়? সব দোষ পড়ল ঘোড়াওয়ালার ওপর। বাদশা ক্রুদ্ধ হয়ে হুকুম দিলেন, এই কে আছিস, তোরা এই মুহূর্তে একে কয়েদখারায় বন্দি করে রাখ। স্বনন ফিরে না এলে ওকে জ্যান্ত কবর দেওয়া হবে।
বাদশার হুকুম পেয়ে লোক-লস্কর এসে ঘোড়াওয়ালাকে কারাগারে নিয়ে গেল। ওদিকে স্বনন ঘোড়ার পিঠে উড়ছে তো উড়ছেই। ক্রমশ সে মেঘের রাজ্য পার হয়ে আরো উপরে উঠতে লাগল। নিচে তাকিয়ে দেখল পৃথিবীর আর কিছুই চোখে পড়ছে না। পক্ষিরাজ এত জোরে ছুটে চলছে যেন নীল আকাশের গায়ে আছড়ে পড়বে।
স্বননের এতক্ষণ পর চেতন হলো যে পক্ষিরাজকে ফেরানোর সুইচ কোনটি তা তার জানা নেই। সে এতই আনন্দে মশগুল ছিল যে ফেরার কথা তার মাথায়ই আসে নি। সে পক্ষিরাজের গলায়, মাথায় পিঠে বিভিন্ন জায়গায় সুইচ খুঁজতে লাগল কিন্তু ফেরার সুইচ খুঁজে পেল না।
ওদিকে পক্ষিরাজ চলছে তো চলছেই। সে রেগে গিয়ে পায়ের জুতো খুলে পক্ষিরাজের মুখে ও কানে আঘাত করল। স্বনন লক্ষ্য করল ঘোড়াটি মোড় ঘুরিয়ে দিলো এবং গতিও ধীর হয়ে গেল। স্বনন বুঝতে পারল ওর কানে কিংবা মুখে কোথাও থামানোর সুইচ রয়েছে। ও
পক্ষিরাজের কানে ভিতরে হাত দিতেই একটা ছোট বোতাম পেয়ে গেল। সেটি আরেকবার টিপতেই পক্ষিরাজের গতি আরো কমে গেল। স্বনন নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল একটা অট্টালিকার মতো মনে হচ্ছে। পক্ষিরাজ আস্তে আস্তে অট্টালিকার ছাদে পা রাখল।
স্বনন পক্ষিরাজ থেকে নেমে আশপাশে তাকালো।
আধুনিক পক্ষিরাজ ঘোড়ার গল্প । আশরাফ পিন্টুকোথাও কোনো গাছ-পালা নেই। কেমন অচেনা এক পরিবেশ। ও ছাদ থেকে নিচে নামার পথ খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর দেখল- ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে একটি সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই একটি আলোকরশ্মি পর তার চোখ পড়ল। দেখল একটি রুমে আলো জ্বলছে। স্বনন কৌতূহলী হয়ে সেই খোলা জানালা দিয়ে দেখল ভিতরে এক অপরূপ সুন্দরী মেয়ে ঘুমিয়ে আছে।
স্বনন অনেক চেষ্টা করে দরজা খুলে আস্তে আস্তে রুমের ভিতরে ঢুকে পড়ল। মেয়েটির কাছে এসে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। এমন অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে সে এর আগে দেখেনি। ও মেয়েটির একটি হাত স্পর্শ করল। স্পর্শে মেয়েটি জেগে উঠল। ভয়ে সে চিৎকার দিবে এমন সময় স্বনন তার মুখ চেপে ধরল। বলল, আমি ইরানের রাজপুত্র। ভুল করে এখানে চলে এসেছি। তোমাকে সব খুলে বলছি।
স্বননের কথা শুনে মেয়েটি অবাক হলো। বলো কী! এটা তো পৃথিবীর বাইরের একটি গ্রহ। তবে সৌরজগতের মধ্যেই এর অবস্থান। এর নাম ইউরেনাস। আমি তোমাদের পৃথিবীরই মেয়ে, ইরাকের রাজকন্যা। নাম শবনম। দুষ্ট এলিয়েনরা আমাকে ধরে এখানে নিয়ে এসেছে।
মেয়েটির কথা শুনে স্বননও অবাক হলো। বলল, আমার সঙ্গে আধুনিক পক্ষিরাজ ঘোড়া আছে। চলো আমরা পৃথিবীতে পালিয়ে যাই।
স্বননের প্রস্তাবে শবনম রাজি হয়ে গেল। এ বন্দিদশা থেকে কে না মুক্তি চায়? এ ছাড়া স্বননের ব্যবহারও তাকে মুগ্ধ করেছিল। স্বনন শবনমকে নিয়ে সন্তর্পণে ছাদে উঠে গেল। সে পক্ষিরাজের পিঠে চেপে বসল এবং শবনমকেও পিছনে বসাল। চড়ার পূর্বে সে পক্ষিরাজের সবকিছু পরীক্ষা করে নিয়েছিল যাতে পথে আবার কোনো বিপদ-আপদ না ঘটে।
স্বনন গলার কাছের সুইচটি চাপ দিতেই পক্ষিরাজ বিদ্যুৎবেগে ছুটে চলল। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর তারা পৃথিবীতে তাদের রাজ্যে পৌঁছিল। স্বনন পৌঁছিয়ে দেখল চারিদিকে করুণসুরে সানাই বাজছে। বুঝতে পারল তার নিখোঁজ হবার কারণেই রাজ্যজুড়ে শোক পালন হচ্ছে। স্বনন শবনমকে নিয়ে বাদশার রুমে ঢুকে পড়ল।
বাদশা হঠৎ স্বননকে দেখতে পেয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। আনন্দে তিনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন।
এরপর স্বননকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। স্বননকে বুক থেকে ছেড়ে দেবার পর তিনি লক্ষ্য করলেন কিছু দূরে এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ওর দিকে বাদশার চোখ পড়তেই স্বনন বলল, ও শবনম, ইরাকের রাজকন্যা। ওকে কিডন্যাপ করেছিল ইউরেনাস গ্রহের এলিয়েনরা। আমি ওকে উদ্ধার করে এনেছি।
স্বননের কথা শুনে বাদশা খুব খুশি হলেন। এগিয়ে গিয়ে শবনমকে বুকে টেনে নিলেন।
ওদিকে কারাগারে সেই ঘোড়াওয়ালা মৃত্যুর দিন গুনছিল। সে মনে মনে চিন্তা করছিল ফাঁসি তার অবধারিত। রাজপুত্র তো আর কখনো ফিরে আসবে না। হঠাৎ দেখল- একজন প্রহরী দরজা খুলে কারাগারের ভিতরে প্রবেশ করছে। লোকটি মনে করল প্রহরী তাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছে। কিন্তু পরে যখন জানতে পারল রাজপুত্র ফিরে এসেছে তখন খুশিতে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
প্রহরী লোকটিকে বাদশার খাসকামরায় নিয়ে এলো। বাদশার পাশে বসে স্বনন ও শবনম গল্প করছিল। লোকটি রুমে ঢুকে বাদশাকে কুর্নিশ করে অভিবাদন জানাল।
বাদশা বললেন, তুমি আজ থেকে মুক্ত। আমি আমার ছেলের সঙ্গে একজন রাজকন্যাও পেয়েছি। আমি ওদের বিয়ে দেবো। এ জন্য আমি আজ মহাখুশি। তুমি কী চাও বলো? যা চাও তাই পুরস্কার দেবো। শবনমের দিকে লোকটির চোখ পড়তেই চমকে উঠল।
সে শান্তস্বরে বলল, আমি ওই মেয়েটিকে চাই।
– কি বলছো এসব? তোমার সাহস তো কম নয়?
– ঠিকই বলছেন হুজুর। আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না। আমার তো একটিমাত্র মেয়ে। লোকটি তার মাথার পরচুলা, মুখের দাঁড়ি-মোচ ইত্যাদি ছদ্মবেশ খুলে ফেলল। তখন শবনম তাকে দেখেই চিৎকার করে বলল, আব্বা হুজুর, আপনি এখানে?
– হ্যাঁ মা। তুই নিখোঁজ হবার পর, প্রধানমন্ত্রী আমাকে রাজ্যচ্যুত করে। তখন আমি কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ দেখলাম একটি অচেনা পক্ষিরাজ ঘোড়া। পরে জানলাম এলিয়েনরা তোকে কিডন্যাপ করার সময় তাড়াহুড়া করে একটি যান ফেলে রেখে গেছে। সেই যানটিই হলো ওই পক্ষিরাজ ঘোড়া। সে যাই হোক, মনে মনে চিন্তা করলাম পার্শ্ববর্তী রাজ্যের রাজাকে বলে হারানো সিংহাসন ফিরে পাওয়া যায় কি না। এ কারণেই এখানে আসা।
বাদশা সব শুনে হতবাক হয়ে গেলেন। তাহলে এ লোকটিও ইরাকের বাদশা। এরপর তো আর কোনো কথাই নেই। বাদশা উঠে গিয়ে লোকটিকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, আগে কেন সব খুলে বলেননি। আগে সব বললে আপনাকে এত কষ্ট করতে হতো না।
– আগে বললে কি আপনি এসব কথা বিশ্বাস করতেন?
– যাই হোক। তাহলে রাজপুত্র আর রাজকন্যার বিয়ের দিন ধার্য করা হোক।
– হ্যাঁ, শুভ একটা দিন দেখে ধুমধামের সঙ্গে ওদের বিয়ে হোক।
মহাধুমধামের সঙ্গে রাজপুত্র স্বনন আর রাজকন্যা শবনমের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর ওরা সেই পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চড়ে পৃথিবীর বাইরে হানিমুন করে। এ ছাড়া মাঝে-মধ্যেই পক্ষিরাজ চড়ে দু’জন মহাশূন্যে হাওয়া খেতে যায়।

Share.

মন্তব্য করুন