অরিন ও অন্তরা। তারা দু’বোন। অরিন বড়। অন্তরা ছোট। তারা দু’বছরের ছোট-বড়। তবে দেখতে যেন একই রকম। একজনের মাপে জামা-জুতো কিনলে তা দু’জনেই পরতে পারে। তারা দু’বোন দুই বান্ধবীর মতো। একসাথে খেলে। একসাথে স্কুলে যায়। একসাথে খায়। তাদের দু’জনের মাঝে গলায় গলায় মিল। একদিকে তাদের যেমন- এমন গলায় গলায় মিল অন্যদিকে আবার ঝগড়াও কম হয় না। তাদের ঝগড়া হয় জামা-কাপড় নিয়ে। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে। খেলাধুলা করতে গিয়ে। পড়তে গিয়ে। বসতে গিয়ে। শুইতে গিয়ে। আরো কত কী করতে গিয়ে যে তাদের ঝগড়া হয় তার যেন হিসেব নেই। তবে তাদের ঝগড়া হল মিষ্টি-ঝগড়া। এই আছে, এই নেই। তাদের বাবা তাদের জন্য কোনো কিছু কিনলে দু’জনের জন্যই কিনেন। জামা-কাপড়, বই-খাতা, কলম, জুতো যা-ই কিনেন অরিন ও অন্তরার জন্য একসাথেই কিনেন। তারপরও তাদের মাঝে ঝগড়া চলে সকাল-দুপুর-রাত। তবে তাদের পাড়া-প্রতিবেশী দু’বোনকে কখনোই ঝগড়া করতে দেখেনি। শুনেনি। তারা ঝগড়া করে বাড়ির ভেতরে। ঘরের ভেতরে। অন্যরা দেখবে কেমনে। আর যদি কখনো কেউ এসে দেখেই ফেলে তখন তারা দু’জনেই হেসে-খেলে কথা বলে। যাতে করে কেউ বুঝতে না পারে।

এইতো সেদিন অরিন, অন্তরা আর বাবা-মা একসাথে খেতে বসে। অরিনের ছোটবেলা থেকেই একটা অভ্যাস ছিল, সে যখন মাছ, গোশত বা ডিমের তরকারি দিয়ে ভাত খেত তখন সে মাছ, গোশত বা ডিম থালার একপাশে রেখে ঝোল আর তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে নিত। আর ওগুলো খেতো পরে। অন্যদিকে অন্তরা ছিল তার উল্টো। সে আগভাগে মাছ, গোশত বা ডিম এসব খেয়ে তারপর ঝোল দিয়ে ভাত মাখিয়ে বলে উঠত- তার মাছ, গোশত বা ডিম অরিন তার থালা থেকে নিয়ে গেছে। পরে এ নিয়েই চলত দু’বোনের মাঝে ঝগড়া। অরিন তার থালার মাছ, গোশত বা ডিম দিতে চাইত না। অন্যদিকে অন্তরাও অরিনের থালা থেকে না নেওয়া পর্যন্ত শান্ত হতো না। মা তাকে যতই দিত না কেন, তাতে যেন তার পেট ভরত না। সে অরিনের থালা থেকে নেবেই নেবে। অবশেষে অরিন তাকে দিতে বাধ্য হত। না হলে তার কান্না আর কে থামায়। সে কাঁদতে থাকবে আর থেকে থেকে অরিনের গায়ে চিমটি কাটবে। চিমটি কাটবে অরিনও। এভাবেই শুরু হতো দু’বোনের ঝগড়া। দু’বোনকে একসাথে জামা-জুতো কিনে দিলে অন্তরারটা আগে ছিঁড়ে যেত। তার কারণ হল, অন্তরা নতুন-জামা-জুতো পেলে সে আর পুরান-জামা-জুতো ছুঁয়েও দেখত না; যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা ছিঁড়বে। আর অন্তরার জামা-জুতো যখন আগেভাগে ছিঁড়ে যেত তখনই শুরু হত দু’বোনের মাঝে ঝগড়া। অন্তরা করত কী- অরিনের জামা-জুতো নিয়ে টানাটানি করত। অরিন তারটা দিতে না চাইলেও সে জোর করে নিয়ে পরত। না দিলেই শুরু হত তার কান্না-কাটি। অবশেষে তাকে সেই জামা-জুতো দিতেই হত। এভাবেই কাটত তাদের দিন-মাস-বছর।

একদিন দুপুরবেলা খুব গরম পড়ে। মা বেলের শরবত বানান। তখন তারা দু’বোন স্কুলে ছিল। কিছুক্ষণ পরই তারা চলে আসে। মা তাদের দু’জনকে দু’গ্লাস শরবত দেন। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে ঠিক পাঁচ মিনিট সময় চলে যায়। দু’জনের একজনও শরবত খায় না। অরিন খেতে চাইলেও অন্তরা তাকে খেতে দেয় না। অন্তরার ধারনা-নিশ্চয় অরিনের গ্লাসের শরবতটা মিষ্টি বেশি। তাই সে অরিনেরটা খেতে চাইল। অন্যদিকে অরিনও তাকে দিতে চায় না। এ নিয়েও তাদের মাঝে শুরু হয় ঝগড়া। অবশেষে সে শরবত আর কেউই খেতে পারেনি। হঠাৎই কোত্থেকে একটা বিড়াল এসে দু’জনের শরবতই ফেলে দিয়ে দৌড় দেয়। এতে একজন আরেকজনকে দোষারোপ করে। অরিন বলে, তোর জন্য শরবত খেতে পারিনি। অন্তরা বলে, তোর জন্য শরবত খেতে পারিনি। এভাবেই চলে যায় কিছু সময়। তারপর অন্তরা অরিনকে চিমটি মেরেই ভোঁ-দৌড়…।

পিছু পিছু ছুটে অরিনও। তার কিছুদিন পর হঠাৎ করেই একদিন অরিনের গায়ে প্রচণ্ড জ্বর আসে। জ্বরে সে কাঁপতে থাকে। বাবা ডাক্তার ডাকেন। ডাক্তার এসে জ্বর মাপেন। তারপর ঔষধ দিয়ে চলে যান। বাবা দোকানে গিয়ে কেক, রুটি, কলা আনেন। অরিনকে এগুলো খেয়ে পরে ঔষধ খেতে বলেন। অরিন কেক, রুটি, কলা কোনো কিছুই সে খায় না। এসব তার ভালো লাগে না। ভাতও খায় না। ঔষধ খায় খালি পেটে। এভাবে দুদিন চলে যায়। জ্বর কমে না। অন্তরা সারাক্ষণ আপুর পাশেই বসে থাকে। গামছা ভিজিয়ে শরীর মুছে দেয়। মাথায় পানি ঢালে। হাত-পা টিপে দেয়। অরিনের মুখে হাসি নেই বলে হাসে না অন্তরাও। মনমরা হয়ে বসে থাকে। কখনো দু’হাত তুলে বোনের জন্য দোয়া করে; আপুটি যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায়। অরিন কখনোবা জ্বরে আবোল-তাবোল কথা বলে ওঠে। দু’দিন না খেয়ে মুখটাও কেমন যেন শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। শুধু কি অরিনেরই এমন দশা? সাথে অন্তরারও। সেও খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তার অসুখ-টসুখ কিছু নেই। অরিন কিছু খায় না বলে সেও কিছু খায় না। বোনের কষ্টে সেও কষ্ট পায়। অরিন যখন জ্বরে আর শরীর ব্যথায় হঠাৎই চিৎকার করে ওঠে, তখন কেঁদে উঠে অন্তরাও। দু’মেয়ের এমন অবস্থা দেখে তাদের মা-ও থেকে থেকে চোখের জল মুছেন। বাবারও যেন চিন্তার শেষ নেই। মা অন্তরাকে খেতে বলে। সে খায় না। পরে অরিনকে বুঝান, ‘দ্যাখ মা, তুুই খাচ্ছিস না বলে অন্তরাও কিছু খাচ্ছে না। আর তোরা না খেয়ে থাকলে আমরা কি করে খাই বল? জ্বর হলে কারোরই কোনো খাবারে রুচি থাকে না। তাই বলে কি একেবারে না খেলে চলবে? এতে তো সমস্যা আরো বাড়বে। তোর বাবা আর আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। অন্তরার কথা ভেবে হলেও তোকে খেতে হবে মা। না হলে সেও যে এভাবে না খেয়ে থাকতে থাকতে একসময় অসুস্থ হয়ে পড়বে। মায়ের কথা শুনে জল-টলমল-করা দু’চোখে অরিন অন্তরার দিকে তাকায়। দেখে যে, অন্তরার দুচোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। অরিন অবাক হয়ে ভাবে, ‘বরাবর যে অন্তরা আমার খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করত, জোর করে যে আমার খাবার খেয়ে ফেলত, সেই অন্তরা আজ আমি খাচ্ছি না বলে সেও খাচ্ছে না! আমি কাঁদছি দেখে সেও কাঁদছে! আমার কষ্টে সেও কষ্ট পাচ্ছে!’ ভাবতে ভাবতে চোখের জল মুছে। পরে অন্তরার সহযোগিতায় শোয়া থেকে ধীরে ধীরে উঠে বসে। তারপর অন্তরাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘কিরে, আমি খাচ্ছি না বলে তুইও খাচ্ছিস না কেন? জ্বর তো আমার। তুই তো সুস্থ আছিস। তুই যদি আমার মতো না খেয়ে থাকিস তাহলে তুই তো অসুস্থ হয়ে পড়বি। তুই না বরাবর আমার খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করতি। তাহলে এখন আমি খাচ্ছি না বলে তুই কেন খাচ্ছিস না? দু’দিন ধরে টেবিলে কত খাবার পড়ে আছে। তুই তা ছুঁয়েও দেখছিস না। শুনেছি, গতকাল মামা নাকি তোর আর আমার জন্য জামা কিনে পাঠিয়েছে। তাও তুই প্যাকেট খুলে দেখিসনি। এর আগে তো মামা আমাদের জন্য যখনই কোনো জামা বা অন্যকিছু এনেছে তুই আমাকে প্যাকেটটাও ছুঁতে দিসনি- যতক্ষণ পর্যন্ত তোর পছন্দেরটা না নিতি। আমি নিতাম শেষে। আর এখন তুই…।

অরিনের কথা শেষ হতে না হতেই অন্তরা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। পরক্ষণেই অরিনকে সে জড়িয়ে ধরে। তারপর সে কী কান্না! অন্তরার কান্না দেখে কাঁদে অরিনও। দু’জনেই কাঁদতে থাকে। অন্তরা কান্না-জড়িত-কণ্ঠে বলে, ‘আপু! আপুরে! তোর সাথে আমি যতই কাড়াকাড়ি করি, মারামারি করি, তোকে ছাড়া আমি অন্ধরে আপু। দু’চোখে শুধু অন্ধকার দেখি। তোকে ছাড়া আমি খেতে পারি না। তোকে ছাড়া আমি পড়তে পারি না। চলতে পারি না। বলতে পারি না। তুই যে আমার সুখ। আমার শান্তি। আমার সব কিছুই যে তুই-রে আপু।’ এই বলে অন্তরা আর কথা বলতে পারে না। কান্নায় যেন বুক ফেটে যাচ্ছে। অন্তরার এমন কান্না দেখে অরিনও কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমি যেমন তোর সবকিছু, তেমনি তুইও যে আমার সব-রে অন্তরা। আমার প্রাণ। আমার নিঃশ্বাস। তোকে ছাড়া আমি কি পারব একটা দিন একা একা থাকতে? কাঁদিস না বোন। আমার কিচ্ছু হবে না। দেখিস, দু’এক দিনের মধ্যেই আমি ঠিক সুস্থ হয়ে উঠব।’ অন্তরা অরিনকে জড়িয়ে ধরেই ফুঁঁপিয়ে ফুঁঁপিয়ে থাকতে থাকে। অরিনও আর কোনো কথা বলে না। দু’বোনের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে জল। এভাবে কেটে যায় কিছু সময়। পাশেই বসে থাকা তাদের মা শায়লা বেগম আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মুছেন। পরে অরিন আর অন্তরার চোখের জলও মুছে দেন। তারপর টেবিল থেকে কেক, রুটি, কলা হাতে নেন। অরিনের দিকে বাড়িয়ে দেন। পরে অরিন অন্তরাকে, অন্তরা অরিনকে এবং তারা দু’বোন তাদের মাকে আর মা তার দু’মেয়েকে একটু একটু করে খাইয়ে দেন। এরই মাঝে তাদের বাবাও এসে তাদের পাশে বসেন। অরিন তার বাবার মুখে এক টুকরো কেক তুলে দেয়। বাবা অরিন আর অন্তরার মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন বলতে চেয়ে থেমে যান। পরে অরিন ও অন্তরা দেখে যে, বাবার দু’চোখেও জল চিকচিক করে উঠছে।

জিনিয়াস মাহমুদ
বড়মা, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

Share.

মন্তব্য করুন