জন্ম এক দেশে; কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন অন্য দেশের হয়ে। ক্রিকেট দুনিয়ায় এমন তারকার সংখ্যা কম নয়। শুধু যে বর্তমান সময়ে খেলছেন তাই নয়, অতীতেও ছিলেন এমন অনেকে। বব উলমার, এন্ডি ফ্লাওয়ার, এন্ড্রু সাইমন্ডস, কেভিন পিটারসনরা জন্মভূমি বাদ দিয়ে অন্য দেশের পতাকার জন্য লড়াই করেছেন। এই লেখায় আমরা তুলে ধরবো বর্তমান সময়ের কয়েকজন এমন তারকাকে নিয়ে। যাদের কেউ পরিবারের সাথে, কেউ বা ব্যক্তিগত খেয়ালে দেশ ছেড়েছেন। যেখানে গিয়ে স্থায়ী হয়েছেন সেই দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।

ভিনদেশী তারকা । আহমেদ ইবনে হাবিবইয়ন মরগান
ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ স্বপ্নপূরণের সেনাপতি ইয়ন মরগান। ক্রিকেটের সবচেয়ে মর্যাদার এই শিরোপাটি ইংলিশদের অধরাই ছিল। তবে ২০১৯ বিশ্বকাপে তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তবে ইংল্যান্ডকে সেই বহু কাঙ্ক্ষিত বিশ্বকাপ শিরোপাটি এনে দিয়েছেন ভীনদেশী একজন। তিনি ইয়ন মরগান। তোমরা হয়তো অনেকেই জান যে, ইয়ন মরগান কিন্তু ইংলিশ নন, জাতিতে তিনি আইরিশ। আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে জন্ম নেয়া মরগান ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিলেন আয়ারল্যান্ডের হয়েই; কিন্তু আয়ারল্যান্ডের তখন টেস্ট স্ট্যাটাস ছিলো না। মরগান স্বপ্ন দেখতেন ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত ফরম্যাট টেস্ট খেলার। তাই তো নিজের দেশ ছেড়ে নাম লেখান ইংল্যান্ড দলে। আয়ারল্যান্ডের হয়ে ২৩টি আন্তর্জাতিক ওয়ানডে খেলার পর তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টে আইসিসির অনুমতি নিয়ে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে ইংল্যান্ডের অধিনায়কও হন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, মরগান যখন ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ শিরোপা এনে দিলেন তার মাত্র কয়েক মাস আগেই আয়ারল্যান্ড টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে যায়। ২০০৬ সালে আয়ার‌্যান্ডের হয়ে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক মরগানের। ২০০৯ সালের এপ্রিলে আয়ার‌্যান্ডের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলে পরের মাসেই ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষেক তার। আগে থেকেই ইংল্যান্ডের ঘরোয়া কাউন্টি কিকেটে নিয়মিত খেলার কারণে এবং নাগরিকত্ব থাকার কারণে তার আইনগত কোন সমস্যা হয়নি।

ভিনদেশী তারকা । আহমেদ ইবনে হাবিববেন স্টোকস
ইয়ান মরগান যদি ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ জয়ের সেনাপতি হন, তবে তার সেরা অস্ত্রটির নাম বেন স্টোকস। ফাইনালে স্টোকসের দুর্দান্ত লড়াইয়ের গল্প নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি তোমরা? কোনদিন ভোলার কথাও নয়। ফাইনাল ছাড়াও পুরো বিশ্বকাপেই ব্যাট কিংবা বল হাতে দলকে দারুণসব মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন এই পেস বোলিং অলরাউন্ডার। জেনে অবাক হবে, মরগানের মতো স্টোকসের শেকড়ও ইংল্যান্ডে নয়।
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে জন্ম নেয়া বেন স্টোকস ১২ বছর বয়সে পরিবারের সাথে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। পড়াশুনার পাশাপাশি খেলতে শুরু করে ক্রিকেট। ২০১১ সালে ইংল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। এক পর্যায়ে স্থায়ী জায়গা করে নেন ইংল্যান্ড দলে। আর গত জুলাইয়ে সেই জন্মভূমি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দারুণ এক ইনিংস খেলে শিরোপা এনে দেন ইংল্যান্ডকে। স্টোকসের বাবা ছিলেন রাগবি খেলোয়াড়। পরবর্তীতে হয়েছেন কোচ। পরিবারের শেকড় নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী মারয় সম্প্রদায়ের।

ভিনদেশী তারকা । আহমেদ ইবনে হাবিবইমরান তাহির
উইকেট নিয়ে দুই হাত উঁচু করে দৌড় দেয়া ইমরান তাহিরের উদযাপন সবার কাছেই পরিচিত। আমাদের আজকের লেখা যাদের নিয়ে সেই ভিনদেশী তারকাদের অন্যতম ইমরান তাহির। পাকিস্তানের লাহোরে জন্ম ইমরান তাহিরের। ঘরোয়া ক্রিকেটও খেলেছেন দেশের মাটিকে। পাকিস্তানের কিংবদন্তী লেগ স্পিনার আবদুল কাদিরের কাছে দীক্ষা নিয়েই তিনি মূলত লেগ স্পিনার হয়ে ওঠেন। পাকিস্তানের অনূর্ধ-১৯ এবং ‘এ’ দলেও খেলেছেন তাহির। তবে জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন; কিন্তু এরপর হঠাৎ করেই দেশ ছাড়েন। প্রথমে যান ইংল্যান্ডে, সেখান থেকে চলে যান দক্ষিণ আফ্রিকায়। তবে ‘সাত সাগর তের নদী’ পাড়ি দিয়েও ক্রিকেটটা ছাড়েননি। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করে জায়গা করে নেন দক্ষিণ আফ্রিকা দলে।
২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা দলে প্রথম ডাক পান তাহির; কিন্তু আইসিসি জানান, দেশ পরিবর্তনের শর্ত পূরণ করতে হলে ২০১১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তাহিরকে দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে হবে। সময়সীমা পার হওয়ার পর আবার তাকে ডাকেন নির্বাচকরা। সেই থেকে নিয়মিত খেলছেন প্রোটিয়াদের হয়ে। টেস্ট ছেড়েছেন আগেই। এবারের বিশ্বকাপ শেষে ১০৭ ম্যাচের ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় বলেছেন তাহির। তবে সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে জাতীয় দলে খেলতে চান আগামী বছরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত।

ভিনদেশী তারকা । আহমেদ ইবনে হাবিবউসমান খাজা
ইসলামাবাদে জন্ম নেয়া উসমান খাজা ৫ বছর বয়সে বাবা তারিক ও মা ফাইজার সাথে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী হন। তবে অন্য অভিবাসীদের মতো খাঁজা পরিবার দেশের সাথে বিচ্ছিন্ন নয়। কৈশোরে, তারুণ্যে উসমান খাজা অনেকবারই পাকিস্তান বেড়াতে গিয়েছেন। এক সাক্ষাৎকারে নিজের দ্বৈতপরিচয় প্রসঙ্গে বলেছিলেন, জীবনের বড় একটি সময় সেখানেই কাটিয়েছি। পাকিস্তান আমার জন্মভূমি সেটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানকার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বন্ধন আমার হৃদয়ে। আমার বাবা-মা একই সাথে অস্ট্রেলিয়ান ও পাকিস্তানি। আমি তাদের সাথে সব সময়ই উর্দুতে কথা বলার চেষ্টা করি’।
বামহাতি টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান উসমান খাজার অস্ট্রেলিয়া দলে অভিষেক ২০১১ সালে। টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা শুরু। অ্যাশেজ সিরিজে ইনজুরিতে পড়া রিকি পন্টিংয়ের বদলি হিসেবে দলে জায়গা হয় তার। শুরু দিকে তারকা খেলোয়াড়দের ভিড় থাকায় দলে নিয়মিত জায়গা হতো না খাজার। যে কারণে ওয়ানডে অভিষেক হতে সময় লেগেছে দুই বছর (২০১৩)। তবে গত এক বছর ধরে নিয়মিত খেলছেন। খেলেছেন গত বিশ্বকাপেও। উসমান খাজার জন্যই স্টিভ স্মিথ নিজের প্রিয় তিন নম্বর জায়গা ছেড়ে চার নম্বরে ব্যাট করেন এখন। অ্যাশেজ সিরিজের সময় একটি প্রস্তুতি ম্যাচে নেতৃত্বও দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়াকে। যে কারণে তার মধ্যে আগামী দিনে অস্ট্রেলিযার অধিনায়কের ছায়া দেখা যাচ্ছে।

ভিনদেশী তারকা । আহমেদ ইবনে হাবিবইমাদ ওয়াসিম
ইংল্যান্ডের ভূখণ্ডের মধ্যে অবস্থিত ছোট্ট দেশ ওয়েলসে ১৯৮৮ সালে জন্ম ইমাদ ওয়াসিমের। সেখানেই কেটেছে শৈশব। আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি প্রতিনিধিত্ব করছেন পাকিস্তানের হয়ে। যদিও সেই অর্থে ইমাদকে বিদেশী বলা যায় না, কারণ তার জন্ম পাকিস্তানি পরিবারেই। তাই ছোটবেলা থেকেই এশীয় ও মুসলিম সংস্কৃতির ছোঁয়াতেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। দেশে ফিরে পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়ে জায়গা করে নেন অনূর্ধ-১৯ দলে। এরপর ২০১৫ সালে টি-টোয়েন্টি দিয়ে পাকিস্তান জাতীয় দলে অভিষেক এই অলরাউন্ডারের। ছিলেন ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ী দলে। তবে টেস্ট অভিষেক হয়নি এখনো। বামহাতি অফ স্পিনার ইমাদ ওয়াসিম সীমিত ওভারের ক্রিকেটে নিয়মিত পারফরমার। সেই সাথে লোয়ার মিডল অর্ডারে ভালো ব্যাটিংও করেন।

ভিনদেশী তারকা । আহমেদ ইবনে হাবিবসিকান্দার রাজা
জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে বর্তমান সময়ের সেরা পারফরমারদের একজন অলরাউন্ডার সিকান্দার রাজ। ১৯৮৬ সালে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোটে জন্ম নেয়া সিকান্দার পরিবারের সাথে ২০০১ সালে জিম্বাবুয়েতে স্থায়ী হন। পাকিস্তানের থাকতেই শুরু করেছিলেন ক্রিকেট খেলা। সেটাকেই বয়ে নিয়ে যান জিম্বাবুয়েতে। মাঝখানে স্কটল্যান্ডে গিয়ে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারংয়ে ডিগ্রি নিয়ে আবার ফিরে আসেন জিম্বাবুয়েতে। এবার শুরু করেন পুরোদমে ঘরোয়া ক্রিকেট। নজর কাড়েন নির্বাচকদের। ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক তার জিম্বাবুয়ের জার্সিতে। নাগরিকত্ব পেতে দেরি না হলে ২০১১ সালেই তার অভিষেক হতো।

উপরোক্ত ক্রিকেটাররা ছাড়াও এমন আরো অনেক ক্রিকেটার আছে যাদের সবার কথা লিখতে গেলে জায়গা সাঙ্কুলান হবে না। ইংল্যান্ডের জোফরা আর্চারের জন্ম ওয়েস্ট ইন্ডিজের বার্বাডোজে। আদিল রশীদের জন্ম পাকিস্তানে। নিউজিল্যান্ডের ইশ সোধির জন্ম ভারতে।

Share.

মন্তব্য করুন