মুসলিম নব জাগরণের কবি হিসেবে ফররুখ বাংলা কাব্য সাহিত্যে খুবই আলোচিত এক নাম। নজরুল পরবর্তী সমকালীন কবিদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। ইসলামি ঐতিহ্যের নবরূপকার হিসেবেও ফররুখ আহমদ সর্ব মহলে সমাদৃত। শিশু-কিশোরদের তিনি তাঁর হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন ঈর্ষান্বিত ভালোবাসায়। তাঁর প্রমাণ মেলে ছোটদের জন্য লেখা ফররুখের শত শত ছড়া, কবিতা, গান ও হামদ-না’তে।
কবি ওয়ার্ডস ওয়ার্থ বলেছেন :The child is the father of the man. আর কবি গোলাম মোস্তফা বলেছেন- ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা, সব শিশুদের অন্তরে।
এ দু’কবির মর্মবাণী উপলব্ধি করে ফররুখ বলতেন, শিশুর মধ্যে নিহিত থাকে বিপুল সম্ভাবনা। আজকের শিশু আগামী দিনের দায়িত্বশীল নাগরিক। তারাই পরিচালনা করবে দেশ ও জাতিকে। ছোটবেলা থেকে যদি তাদের আপন কৃষ্টি ও সভ্যতার আলোকে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা না যায়, তবে তা হবে জাতির জন্য চরম মরণাঘাত। এ বিশ্বাসকে সামনে রেখে তিনি আমাদের আশপাশের বিবিধ বিষয়, ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং প্রচলিত পুঁথি সাহিত্য থেকে সুন্দর সুন্দর উদাহরণ প্রয়োগে রচনা করেন এক একটি ছড়া, কবিতা ও কিস্সা কাহিনি।
ছোটদের জন্য ফররুখের প্রথম বই ‘পাখির বাসা’ বের হয় ১৯৬৫ সালে। প্রকাশ করে বাংলা
একাডেমি। ছোটদেরকে কবি এ পৃথিবীর ‘নতুন মানুষ’ রূপে আখ্যায়িত করে তাদের নামে উৎসর্গ ‘পাখির বাসা’। উৎসর্গীত সে পঙক্তিটি:
নতুন মানুষ এল যারা
খোদার দুনিয়াতে,
ছোট্ট আমার ‘পাখির বাসা’
দিলাম তাদের হাতে।
পাখির বাসা, মজার ব্যাপার, পাখ-পাখালি, পাঁচ মিশালি, রূপ-কাহিনি, সিতারা ও শাহীন এবং চলার গান এ সাতটি পর্বে বিভক্ত বইটি। যাতে ৪৪টি ছড়া-কবিতা সন্নিবেশিত। অপূর্ব ছন্দে প্রথম কবিতা ‘পাখির বাসা’য় কবি কিশোর মনে দোল ছড়ান-
আয় গো তোরা ঝিমিয়ে পড়া
দিনটাতে,
পাখির বাসা খুঁজতে যাব
এক সাথে।
কোন্ বাসাটা ঝিঙে মাচায়
ফিঙে থাকে কোন্ বাসাটায়
কোন্ বাসাতে দোয়েল ফেরে
সাঁঝ রাতে।
ঝিলের ধারে ঝোঁপের মাঝে
কোন্ বাসাটা লুকিয়ে আছে
কোন্ বাসাটায় বাবুই পাখির
মন মাতে।
নদীর ধারে নিরালাতে
গাঙ শালিকের বাস যেটাতে
রাত্তিরে সে থাকে, এখন
নেই যাতে ॥
অপরের দয়ায় যারা বেঁচে থাকতে চায় তারা কখনো সুখী হতে পারে না। কবি তাই ছোটদের স্বনির্ভরতার ডাক দিয়েছেন রূপক ছড়া ‘চড়ুই পাখির বাসা’য় :
চড়ুই পাখি চালাক তবু ভাই
নিজের বাসার ঠিক ঠিকানা নাই,
পরের দালান বাড়ি খুঁজে
থাকে সে তার মাথা গুজে
সবাই তাকে খারাপ বলে
বলে যে দূর ছাই।
পরের দয়ায় বাঁচতে যারা চায়,
দুঃখ তাদের ঘোচানো যে দায় ॥
পরের কোঠায় চড়ুই পাখি
নিজেরে হায় দিল ফাঁকি,
পরের দয়ায় চড়ুই পাখি
গোলাম হলো তাই ॥
ছোটদের জন্য কবির এ পরিশ্রম বৃা যায়নি। পাখির বাসা প্রকাশিত হবার পরের বছর ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক ‘ইউনেস্কো পুরস্কার’ দেয়া হয় কবিকে। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় ফররুখের দ্বিতীয় শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ ‘নতুন লেখা।’ প্রকাশ করে আহমদ পাবলিশিং হাউস। এ বই এর মোট ৬৯টি ছড়া-কবিতায় কবি বাংলার রূপ-প্রকৃতি, ঋতুবৈচিত্র, দেশপ্রেম এবং মানব চরিত্রের নানা দোষগুণ অপরূপ ভঙ্গিতে তুলে ধরেন। প্রতিটি ছড়া-কবিতায় রয়েছে ছোটদের জন্য বিচিত্র জ্ঞান-সম্ভার আর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিক্ষা। যেমন :
ক. বন্ধু নির্বাচন-
‘বন্ধু যদি বেড়াও খুঁজে
চিনবে তাকে চক্ষু বুজে।’
‘লোকটা কেমন?’
মন্দ কি আর
মন্দ শুধু স্বভাবটা তার
হর হামেশা বাইরে ঘরে
দ্বন্দ্ব-মানে ঝগড়া করে,
হিংসুটে আর কিপ্টে বেজায়
ফূর্তি শুধু পরের কথায়।
খ. পথের গান-
কাজের মানুষ নয়রে যারা
কথার বোঝায় মরে তারা,
ছেঁড়া কাাঁয় তাদের স্বপড়ব
লুটায় ধূলি পারা ॥
নাইরে কাজে শঙ্কা যাদের
নাইরে ভয়ের মানা,
তাদের কাজেই সবুজ নিশান
মেলে সবুজ ডানা ॥
তারাই ফাঁকা তেপান্তরে
নতুন দিনের মিনার গড়ে
তারাই হেসে যায় পেরিয়ে
সাগর;-সাহারা ॥
গ. সাজ পোশাক-
‘একটা মানুষ ছিল শুধু করতো যে সাজ-সজ্জা
অন্য কোন কাজেতে ভাই পেতো সে খুব লজ্জা,
লেবাসটাকে ভাবতো সে তার শরাফতের অঙ্গ,
মানুষ কেন তাকে নিয়ে করছে এমন রঙ্গ?’
‘শরাফতের দাবী শুধু আছে মহৎ কর্মে,
নাই মোটে তা’ সাজ পোশাকে,
হাড্ডিতে আর চর্মে।’
হরফের ছড়াভাষাসৈনিক কবি ফররুখ মাতৃভাষা বাংলাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন। সেই ভালোবাসার সুস্পষ্ট নিদর্শন ছোটদের জন্য লেখা কবির ‘হরফের ছড়া’ বইটি। বাংলা বর্ণমালাকে শিশুদের কাছে ছন্দে ছন্দে সুখপাঠ্য করে তোলার জন্য তিনি এ বইটি লেখেন।
১৯৬৮ সালে ‘হরফের ছড়া’ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমী। আমরা এখানে তিনটি বর্ণের পরিচয় দিচ্ছি :
ক-য়ের কাছে কলমিলতা
কলমিলতা কয় না কথা,
কোকিল ফিঙে দূর থেকে
কলমি ফুলের রঙ দেখে।
ঝ-য়ের পাশে ঝিঙে
ঝিঙে লতায় ফিঙে,
ঝিঙে লতা জড়িয়ে গেলো
কালো গরুর শিঙে।
ব-য়ের কাছে বন-বিড়াল
আনলো ডেকে সাত-শিয়াল,
বোল-বোল-বোল আমের বোল
বাদুড় এসে বাজায় ঢোল।
একসময় কবি ছোটদের জন্য নানা বিষয়ে কবিতা রচনা করেন। নাম কবিতাগুচ্ছ। আর সেসব কবিতায় পাখির মুখে আল্লাহ্র গুণগান প্রকাশ করেন। যেমন তাঁর বুলবুলিকে নিয়ে চার পঙক্তির একটি শিশুতোষ কবিতা-
‘বুলবুলি গো বুলবুলি
কোথায় যাবে সুর তুলি?’
বুলবুলি কয়, ‘খানে কা’বা;- কা’বা ঘরে যাই
চলার পথে খোদার হাম্দ; নবীর তারিফ গাই ॥’
ছড়ার আসর১৯৭০ সালে ছোটদের জন্য ‘ছড়ার আসর’ নামে অনিন্দ্য সুন্দর একটি ছড়ার বই প্রকাশিত হয়। যা বাজারে আসার সাথে সাথে নিঃশেষ হয়ে যায়। প্রতিটি শিশু-কিশোর এমন কি বড়দের কাছেও প্রাণীজগত সম্বন্ধে জানার তীব্র আগ্রহ চোখে পড়ে। এজন্য দেশে দেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে অনেক চিড়িয়াখানা।

চিড়িয়াখানা

আর চিড়িয়াখানা ছোটদের জন্য এক রহস্যময় পৃথিবী। একটু সুযোগ পেলেই সবাই ছুটে যায় চিড়িয়াখানার বিচিত্র জীব-জন্তুকে দেখে নিতে। ছোটদের জন্য প্রকাশিত ফররুখের ‘চিড়িয়াখানা’ শিশু-সাহিত্য জগতে এক অনন্য সংযোজন। শিল্পী সবিহ্উল্ আলমের আঁকা সুদৃশ্য প্রচ্ছদ, ৩৪টি কবিতার প্রতিটিতে সংশ্লিষ্ট জীব-জন্তুর স্কেচ সংযোজনের সুবাদে ‘চিড়িয়াখানা’ বইটি সবার কাছে লোভনীয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। ১৯৮০ সালের ১০ জুন কবির ৬২তম জন্ম দিবসে, ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, রাজশাহী প্রকাশ করে ‘চিড়িয়াখানা।’ এর প্রথম কবিতা-
দেখতে যাব কাজের ফাঁকে
প্রাণীর বাসা জগৎটাকে,
খোদার গড়া এই দুনিয়ায়
কেউ পানিতে, কেউ বা ডাঙ্গায়,
কেউ বা ঘোরে শূন্য হাওয়ায়,
দেখি আজব চিড়িয়াখানায় ॥
কবি আল্লামা ইকবালের প্রিয় পাখি হলো শাহীন আর ফররুখের ঈগল। কবির প্রত্যাশা আমাদের শিশু কিশোর তরুণরা ঈগলের মতো স্বাধীন স্বভাব অর্জন করবে। সুস্বাদু পুষ্টিকর হালাল খাদ্য খাবে। আপন মনে ঊর্ধ্বাকাশ, নীল আসমানে উড়ে বেড়াবে। ঈগলের মতো তাদের দৃষ্টি হবে সুদূর প্রসারি। শিকার হবে নিশ্চিত। তারা চিত্তে প্রবল শক্তি অর্জন করবে। বুকে থাকবে উচ্চ আশা। সাহসে বলিয়ান এই তরুণ কিশোররা বেঁচে থাকবে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পনড়ব ঈগলের মতো। কবি চিড়িয়াখানায় ঈগল নামক ছড়ায় লেখেন :
ঈগল পাখি, স্বর্ণ ঈগল সকল পাখির রাজা
নীল আকাশে উড়ে যে তার মন থাকে তরতাজা,
উঁচু আশা ঈগল পাখির, সাহস ভরা বুক,
মুক্ত, স্বাধীন জীবনে তার নাই ভাবনা দুখ,
পাল্লা দিয়ে ওড়ে ঈগল সবার উপরে;
পাহাড় চূড়ায় বাঁধে বাসা মেঘের শহরে ॥
চিড়িয়াখানায় প্রকাশিত আরেকটি ছড়া উটকে নিয়ে। মরুভূমির জাহাজ উটকে আমরা খুব ভালোবাসি। এটি আল্লাহ্‌র অপার দান। উট আমাদের প্রিয় নবীজিকে আমরণ বহন করেছে। কবি সংক্ষেপে অথচ অত্যন্ত চমৎকারভাবে উটের ছড়ায় লেখেন :
উট চলে ভাই ধূ ধূ বালু মরুভূমির পথ ঘুরে,
ভুখ পিয়াসে শান্ত থেকে দূরান্তরে যায় দূরে,
মাথার ওপর গণগণে রোদ আগুন যেন দেয় ঢেলে
মানুষ পিঠে নিয়ে তবু উট চলে দুই চোখ মেলে,
খোদার রহম,- মরুভূমির শ্রেষ্ঠ বাহন উট দেখি,
‘মরুর জাহাজ’ নাম হয় তাই, -বন্ধু খাঁটি; নয় মেকি ॥
বিশ্ব সাহিত্যে সমাদৃত আরব্য উপন্যাস ‘আলিফ লায়লা’ ও ইরানের জাতীয় কবি মহাকবি আবুল কাসেম ফেরদৌসির ‘শাহ্নামা’ এদেশের ঘরে ঘরে বহুল পঠিত। গল্পাকারে, পুঁথি-গদ্যে, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মুসলিম বাংলার প্রতিটি ঘরে ওসব কাহিনি প্রচলিত। ছোটদের প্রিয় কবি ফররুখ ‘আলী বাবার কিস্সা’, ‘আলাউদ্দীনের কিস্সা’, ও ‘সাত মনযিলের কাহিনি’ এ ৩টি গল্পের মাধ্যমে রচনা করেন ‘কিস্সা কাহিনি’ নামক শিশুতোষ কাব্য। ১৯৮৫ সালে এটি প্রকাশ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। ‘আলোকলতা’ নামে ছোটদের জন্য আরো একটি কবিতার বই প্রকাশ করে তারা। বাংলার বিলে-ঝিলে-মাঠে, নদ-নদী-পুকুরে ও গৃহাঙিনায় ফুটে থাকে বিচিত্র ধরনের ফুল। শাপলা-শালুক, কদম-কেয়া, গোলাপ-ডালিয়া, হাস্নাহেনা, রজনীগন্ধা, ঝুমকো-জবা আরো কতশত ফুল। সুসজ্জিত মলাট আর ২৩টি ফুলের ছড়া ছবিসহ ১৯৮৫ সালে ‘বাংলাদেশ শিশু একাডেমি’ ফররুখের ‘ফুলের সজ্জা’ প্রকাশ করে।
উপরোক্ত ৮টি শিশুতোষ গ্রন্থ ছাড়া ফররুখ ছোটদের জন্য আরো ১০টি বই এর পাণ্ডুলিপি লেখেন। যার কিছু প্রকাশ পেয়েছে অন্যগুলো এখনো প্রকাশের মুখ দেখেনি। ফলে সুন্দর সুন্দর, শিক্ষামূলক অনেক ছড়া-কবিতা থেকে বঞ্চিত রয়েছি আমরা এবং আমাদের দেশের লক্ষ-কোটি সত্যসন্ধানী শিশু-কিশোর।
অপ্রকাশিত সে পাণ্ডুলিপি গুলি হলো : ১। সাঁঝ সকালের কিস্সা, ২। খুশির ছড়া, ৩। মজার ছড়া, ৪। ছড়ার আসর (২), ৫। ছড়ার আসর (৩), ৬। রংমশলা, ৭। জোড়া হরফের খেলা, ৮। পড়ার শুরু, ৯। পাখির ছড়া এবং ১০। পোকামাকড়।

Share.

মন্তব্য করুন