আমরা প্রকৃতির সানিড়বধ্যের জন্য অরণ্যের খোঁজ করি। নাগরিক ক্লান্ত জীবন থেকে বেরিয়ে উপভোগ করতে চাই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। নিতে চাই সজীব নিঃশ্বাস। কিন্তু যদি এমন হয় যে সেই অরণ্যই হবে মৃত্যুফাঁদ তবে কেমন হবে! ভাবতে গিয়ে খানিকটা হলেও গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। এমনই এক বিভীষিকাময় অরণ্যের সাথে আজ পরিচয় করিয়ে দেবো।
আওকিঘারা বন। পেছনে মাউন্ট ফুজি, তার ঠিক নিচেই ছড়িয়ে রয়েছে বিস্তৃত সবুজ ভূমি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, এ এক অপার সৌন্দর্য! কিন্তু প্রাকৃতিক এ নৈসর্গের আড়ালেই লুকিয়ে আছে মৃত্যুর হাতছানি। আওকিঘারা বন সাধারণ মানুষের কাছে আত্মঘাতী বন হিসেবে সুপরিচিত। জাপানের ফুজি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই অরণ্যকে পৃথিবীর বুকে জেগে থাকা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জায়গাগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে গণ্য করা হয়। অপরিমেয় ঘনত্বের মাঝে অগণিত বৃক্ষরাজির মহাসমুদ্র এবং রহস্যময়ভাবে লোকজনের হারিয়ে যাওয়ার সাক্ষী এই বন। এই অরণ্যকে বৃক্ষরাজির মহাসমুদ্র নামেও ডাকা হয়।
প্রতি বছর এখান থেকে একাধিক লাশ, দেহাবশেষ উদ্ধার করে পুলিশ। এই জঙ্গলটি পৃথিবীর অন্যতম সুইসাইড স্পট হিসেবে কুখ্যাত। পুলিশের মতে জঙ্গলের গভীরে কঙ্কালের ভিড় লেগে রয়েছে। গাছ এবং জংলার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে সেগুলো। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ।
সুইসাইড ফরেস্ট । ফারুক ইসলামজাপানি নথিপত্রের হিসাব অনুযায়ী ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত এখানে গড়ে প্রতি বছর একশত লাশ পাওয়া গিয়েছে। ১৯৯৮ সালে ৭৪টি, ২০০২ সালে ৭৮টি লাশ পাওয়া যায়। ২০০৩ সালে এই সংখ্যা ১০০ তে গিয়ে পৌঁছায়। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে ১০৮ জন ব্যক্তি নিজেদেরকে এখানে হত্যা করে। ২০১০ সালে প্রায় ২৪৭ জন ব্যক্তি আত্মহত্যার উদ্যোগ নিলেও মাত্র ৫৪ জন সফল হয়েছিলো। বর্তমানে দেশটির স্থানীয় সরকার এই হিসাব প্রকাশ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
বলা বাহুল্য, এটিই জাপানের সব থেকে ভূতুড়ে জায়গা। এবার এই জঙ্গল নিয়ে ছবিও করছে হলিউড। তবে জঙ্গলে শুটিং করার অনুমতি মেলেনি। কিন্তু কেন এই জঙ্গলকেই আত্মহত্যার জন্য বেছে নেন সকলে! জাপানিদের বক্তব্য, ১৬ বর্গমাইল দীর্ঘ এই জঙ্গলে বাস করে অদ্ভুত সত্তা। তারাই ডেকে আনে জীবিত মানুষকে। তাদের ডাকও নাকি জঙ্গলের ভিতর থেকে শোনা যায়।
আত্মঘাতী বন, আওকিঘারায় প্রতি মুহূর্তেই যেন অস্বস্তিকর এবং অশুভ আবহের বাস। পরিত্যক্ত ক্যাম্পিংয়ের বিপুল সংখ্যক জিনিসপত্র শুধু মনকে খারাপ করে তোলে। সেলফোন, জিপিএস, এমনকি কম্পাসও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ঘন ঘন মাউন্ট ফুজির অগ্নুৎপাত থেকে নির্গত লাভা আওকিঘারা অরণ্যের মাটির নিচে যে কঠিন আবরণ সৃষ্টি করেছে তাকেই এই উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দায়ী করেছেন ভূ-বিজ্ঞানীরা। আওকিঘারা বনটিতে প্রবেশ করার সময় চোখে পড়ে মরা পাতায় ঢেকে যাওয়া পরিত্যক্ত গাড়ি। কথিত রয়েছে আত্মহত্যায় প্ররোচিত ব্যক্তিরা অরণ্যে প্রবেশ করার সময় তাদের বাহন ফেলে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে।
অরণ্যের সরু পায়ে হাঁটা পথ চিহ্নিত রয়েছে ফিতা, দড়ি এবং প্লাস্টিকের টেপ দিয়ে, যেন তা অরণ্যের মাঝে পথের দিশা রাখতে পারে। কোনো ভ্রমণকারী যেন পথ হারিয়ে দিকভ্রান্ত না হয়।
কিন্তু যারা আত্মহত্যার চিন্তা করছে, তারা এই পথগুলোত প্রথমেই এড়িয়ে চলা শুরু করে। আর তাদের পরিত্যক্ত জিনিস যেমন- ব্যাগ, মোজা, ছাতা, ব্যাকপ্যাক পথের ধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। ট্র্যাকিং করতে করতে ভ্রমণকারী হোঁচট খেতে পারেন বিপজ্জনক গাছের শিকড়ে, যা ভূগর্ভস্থ পানির কারণে পচে নরম হয়ে থাকে। মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা এই পানি ক্রমবর্ধমান বৃক্ষের শিকড়কে আরও বিস্তৃত করে। অরণ্যের সর্বত্রই এমন অবস্থা বিরাজমান।
অরণ্যে প্রবেশ করার পর পথের আঁকেবাঁকে ভ্রমণকারী সতর্ক বার্তা সংবলিত অনেক সাইন দেখতে পান। এসব সাইনে আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে প্রবেশ করা ব্যক্তিকে তার পরিবারের কথা বিবেচনা করতে অনুরোধ করা হয়। প্রয়োজনে আত্মহত্যা প্রতিরোধ কেন্দ্রের সহায়তা চাওয়ার পরামর্শও দেয়া হয়।
সুইসাইড ফরেস্ট । ফারুক ইসলামআত্মহত্যা ঠেকাতে প্রশাসন জঙ্গলের বিভিন্ন জায়গায় পোস্টার লাগিয়েছে। ‘আপনার জীবন মূল্যবান’, ‘আত্মহত্যার আগে বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলুন’, ‘প্রিয়জনের মুখগুলো দয়া করে মনে করুন’- এমন কথাবার্তা লেখা রয়েছে সেখানে।
যারা ভৌতিক আবহ বা অভিজ্ঞতা ভালোবাসেন এমন পর্যটকদের জন্য আওকিঘারা বন, ক্রমেই জনপ্রিয় ভ্রমণের স্থান হয়ে উঠেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা এই অরণ্যে যারা ভীতিকর ছুটি কাটানোর মাধ্যমে নিজেদের সাহসিকতা প্রমাণের চেষ্টা করেন তারা বিকারগ্রস্ত অথবা বিষাদ এর শিকার। কিন্তু যারা এই বিস্ময়কর জায়গায় সত্যি সত্যি প্রবেশ করতে চান, তাদের এই অরণ্যে লুকানো ছায়া বিপদ থেকে সতর্ক থাকতে হবে।

Share.

মন্তব্য করুন