একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছিল শিশুটি, অনেকগুলো চিন্তা এসে ভর করছিল তার মাথায়। তার এক বোন আছে, সে-ও শিশু, সার্বক্ষণিক সঙ্গী তারা। সারাটা দিন দু’জনের বিস্ময়ের সীমা থাকে না। তারা ফুলের সৌন্দর্য দেখে বিস্মিত হয়, তারা আকাশের উচ্চতা আর নীল রঙ দেখে অবাক হয়, উজ্জ্বল পানির গভীরতা দেখে আশ্চর্য হয়, আর ভেবে বিস্মিত হয় এই সুন্দর পৃথিবী যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই খোদার মহত্ত্ব ও ক্ষমতা কতই না বড়।
তারা মাঝে মাঝে বলাবলি করে, ধরো, এই পৃথিবীর সকল শিশু যদি মারা যায় তাহলে কি এই সব ফুল, পানি, আকাশ দুঃখ পাবে? ওদের বিশ্বাস, তাদের কষ্ট হবে। কারণ, তারা বলে, কুঁড়িগুলো ফুলগুলোর শিশু, আর পাহাড়ের ধার ঘেঁষে লাফাতে লাফাতে নেমে আসে যে ক্রীড়ামগ্ন স্রোতধারা তারা হচ্ছে পানির সন্তান; সারারাত আকাশে লুকোচুরি খেলে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উজ্জ্বল ফুটকিগুলো তারা নিশ্চয়ই হবে নক্ষত্রদের সন্তান।
তারা সবাই যখন দেখবে তাদের খেলার সাথী মানবশিশুরা আর নেই তখন তারা ভারি দুঃখ পাবে। একটা পরিষ্কার জ্বলজ্বলে তারা আছে, সে রোজ অন্যদের থেকে আগে ওঠে, গোরস্থানের ওপরে। বেশ বড় আর সুন্দর অন্যদের থেকে, তারা ভাবে। প্রত্যেক দিন রাতে তারা তাকে দেখার জন্য জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ায় হাত ধরাধরি করে। যে আগে দেখে সে-ই চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ওই যে তারাটা, আমি দেখতে পেয়েছি!’
আর প্রায়ই তারা একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে। তারা জানে কখন এটা উঠবে, এবং কোথায়। এভাবে তার সাথে তাদের এমন বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে যে শুতে যাওয়ার সময় তারা আবার তাকে দেখে বিদায় জানানোর জন্য। ঘুমিয়ে পড়ার আগে বলে, ‘খোদা তারাটার ওপর শান্তি বর্ষণ করুন!’
কিন্তু ওই ছোট্ট বয়সেই বোনটা ভারি অসুস্থ হয়ে পড়ল, সে এতটাই দুর্বল হয়ে গেল যে সে আর রাতে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারে না।
তখন ভাইটি বিষণড়বচিত্তে তারাটার দিকে তাকায়, আর বিছানায় মলিন মুখে শুয়ে থাকা অসুস্থ বোনটার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে, ‘আমি তারাটাকে দেখতে পেয়েছি!’ তখন মেয়েটির মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে, দুর্বল কণ্ঠে সে বলে, ‘খোদা, আমার ভাই আর তারাটার ওপর শান্তি বর্ষণ করুন!’
দ্রুত সেই সময় ঘনিয়ে এলো যখন ছেলেটি হয়ে পড়ল একা, বিছানায় আর কারো মুখ দেখা যায় না, গোরস্থানে একটা নতুন ছোট্ট কবর দেখা যায় যেটা আগে ছিল না। তারাটা ছেলেটির ওপর কিরণ ছড়িয়ে দেয়, আর সে কবরটার দিকে তাকিয়ে থাকে অশ্রু-ঝাপসা চোখে।
এখন, এই কিরণগুলো এত উজ্জ্বল যে মনে হয় যেন তারা পৃথিবী থেকে বেহেস্ত পর্যন্ত একটা ঝিকমিকে রাস্তা তৈরি করেছে। একা একা বিছানায় শুয়ে তারাটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে ছেলেটি, স্বপ্নে দেখে যেখানে সে শুয়ে আছে সেখানে ফেরেস্তারা মানুষ বোঝাই একটা ট্রেনকে উজ্জ্বল রাস্তাটার ওপর টেনে নিয়ে চলেছে। আর তারাটা তার সামনে খুলে দিয়েছে আলোর এক বিশাল জগৎ, যেখানে এরকম আরো অনেক ফেরেস্তা তাকে স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে।
এই অপেক্ষমাণ ফেরেস্তারা তারার দিকে বয়ে নিয়ে যাওয়া লোকগুলোর দিকে হাস্যোজ্জ্বল চোখে তাকাচ্ছে, কেউ কেউ তাদের সারি থেকে বের হয়ে এসে লোকেদের কাঁধে আদর করে চুমু খাচ্ছে, তাদের সঙ্গে নেমে আসছে আলোর ফোয়ারা, তারা তাদের সঙ্গ পেয়ে এত খুশি যে, তা দেখে বিছানায় শুয়ে ছেলেটি আনন্দে কাঁদতে থাকে।
নক্ষত্রের স্বপ্ন । চার্লস ডিকেন্স । অনুবাদ : নাজিব ওয়াদুদকিন্তু ওইসব আত্মাদের সবাই তাদের সঙ্গে চলে যায়নি। তাদের একজনকে সে চেনে। একদা বিছানায় শুয়ে থাকা অসুস্থ মুখটি এখন দীপ্তিময় এবং আনন্দোজ্জ্বল, বোনটিকে তাদের মধ্য থেকে চিনে নিতে তার কষ্ট হয় না।
তার বোনের আত্মাটি তারার প্রবেশপথে দাঁড়ায়, লোকেদের বয়ে নিয়ে যাওয়া ফেরেস্তাদের নেতাকে জিজ্ঞেস করে, আমার ভাইটি এসেছে কি?’
‘না।’
ছেলেটি দু’বাহু বাড়িয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ও বোন, আমি এখানে! আমাকে নিয়ে যাও!’ তখন বোনটির হর্ষোজ্জ্বল চোখ পড়ে তার ওপর। তখন রাত। ছেলেটি অশ্রুসিক্ত চোখে দেখে তারার আলোয় তার ঘরটি ঝলমল করছে।
তারপর থেকে শিশুটি তারাটির দিকে এমনভাবে তাকায়
যেন সেটাই ঘর ও গন্তব্য, যখন সময় হবে তখন সেখানে যাবে সে; আর সে ভাবে- সে কেবল পৃথিবীর নয়, তারারও লোক সে, কারণ তার বোনের আত্মা আগেই চলে গেছে।
সেই ছেলেটির এক ভাই জন্ম নেয়, কথা বলতে শেখার আগেই সে তার ছোট্ট দেহটাকে মোচড় দেয়, এবং মারা যায়।
ছেলেটি তারা, আত্মা, লোকভর্তি ট্রেন, ফেরেস্তাদের সারি আর ওইসব লোকেদের ওপর তাদের হাস্যোজ্জ্বল দৃষ্টির স্বপ্ন দেখে।
তার বোনের আত্মা ফেরেস্তাদের প্রধানকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমার ভাইটি এসেছে কি?’
সে বলে, ‘সে নয়, অন্য একজন।’
বোনের কোলে ভাইটির আত্মাকে দেখে ছেলেটি চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ও বোন, আমি তো এখানে! আমাকে নিয়ে যাও!’ তার দিকে তাকায় বোনটি, হাসে। তারাটি উজ্জ্বল দীপ্তি ছড়ায়।
ছেলেটি তরুণ হয়ে ওঠে। একদিন যখন সে বই নিয়ে ব্যস্ত, তখন পুরনো ভৃত্য এসে বলে, ‘তোমার মা আর নেই। আমি তার কাছ থেকে তার প্রিয় পুত্রের জন্য দোয়া নিয়ে এসেছি!’
আবার সে রাতে তারাটিকে দেখে, আর সেই সব আগের সঙ্গীদের। তার বোনের আত্মা ফেরেস্তা-প্রধানকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমার ভাই এসেছে?’
সে উত্তর দেয়, ‘তোমার মা!’
গোটা তারকা জগৎজুড়ে আনন্দের প্রচণ্ড চিৎকার ছড়িয়ে পড়ে, তার দুই সন্তানের সঙ্গে মায়ের মিলন ঘটেছে যে!
ছেলেটি দু’বাহু বাড়িয়ে চেঁচাতে থাকে, ‘ও মা, বোন গো, ভাই গো, আমি এখানে রয়ে গেলাম যে! আমাকে নিয়ে যাও!’ তারা উত্তর দেয়, ‘এখনো নয়।’ তারকাটি জ্বলজ্বল করতে থাকে।
সে একজন পুরোদস্তুর মানুষ হয়ে ওঠে, তার চুল ধূসর হয়ে যাচ্ছে। সে আগুনের পাশে চেয়ারে বসে আছে, দুঃখ ভারাক্রান্ত, অশ্রুসিক্ত মুখ। তারা ওঠে। তার বোনের আত্মা ফেরেস্তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘এসেছে আমার ভাই?’
‘না। তার কুমারী মেয়ে।’
মানুষটি, যে ছিল একদা শিশু, দেখতে পায় তার সদ্য হারানো কন্যাটিকে, ওই তিনজনের মধ্যে এক বেহেস্তি সৃষ্টি। সে বলে, ‘আমার কন্যার মাথা আমার বোনের বক্ষে, আর তার বাহু জড়িয়ে ধরেছে আমার মায়ের কাঁধ, আর তার পায়ের নিচে পুরনো কালের শিশুটি; আমাকে সইতে হচ্ছে তার বিয়োগযন্ত্রণা! সকল প্রশংসা খোদার!’
তারকাটি জ্বলতে থাকে। এইভাবে একদিন সেই শিশুটি বৃদ্ধ হয়, তার মসৃণ মুখে বলিরেখা পড়ে, তার পদক্ষেপ হয় ধীর আর দুর্বল, তার পিঠ বেঁকে যায়।
একদিন রাতে সে বিছানায় শুয়ে, চারপাশে তার সন্তানেরা দাঁড়িয়ে। সে কাঁদছে, যেমনটি কেঁদে এসেছে এতদিন–‘আমি তারাটিকে দেখতে পাচ্ছি!’ তারা ফিসফিস করে বলে, ‘উনি মারা যাচ্ছেন।’
সে বলে, ‘এই হচ্ছি আমি। আমার থেকে পোশাকের মতো খসে পড়ছে আমার বয়স, আমি তারাটির দিকে চলেছি শিশু হয়ে। ওগো আমার খোদা, তোমাকে ধন্যবাদ যে তুমি এটাকে এমনভাবে উন্মুক্ত করে রেখেছ আমার জন্যে, অপেক্ষমাণ আমার সেই প্রিয়জনদের স্বাগত জানাতে!’
নক্ষত্রটি তখন জ্বলজ্বল করছিল, কিরণ ছড়াচ্ছিল তার কবরের ওপর।

Share.

মন্তব্য করুন