ঝন্ঝন্ করে কাচের কিছু একটা ভাঙলো। আরে কি ভাঙলো? বাটি, গেলাস না পেয়ালা? বড়মামু অস্থির হয়ে ওঠেন।
– হায় রে অর্ক, ভেঙে ভেঙে একেবারে শেষ করে ফেল।
মা বলেন, তুমি থামো তো দাদা, দেখি আগে কে ভেঙেছে। অর্ক ভেঙেছে কে বলল?
– তুই থাম তো তিন্নি। বলি অর্ক ছাড়া আর ভাঙবেটা কে? বাড়িতে আসার পর থেকে তো দেখছি, কোনদিন কি তোর ছেলে ভালো কিছু করেছে? বল্ করেছে?
মা মাথা নুইয়ে বসে থাকেন বড় ভাইয়ের কথায়। বড় মামু কানাডা থেকে দেশে ফিরেছেন মাস দুয়েক হলো। এতদিন এখানে ওখানে ঘোরাফেরা করেছেন। সিলেটে দশ দিন, সুনামগঞ্জে চৌদ্দ দিন, হবিগঞ্জে সাত দিন, ময়মনসিংহে বিশ দিন ও গাজীপুরে নয় দিন কাটিয়ে ঢাকায় ছোট বোনের বাড়িতে এসেছেন। এখান থেকেই সোজা বিমানবন্দরে যাবেন।
এসেই যখন পড়েছেন তখন একমাত্র ভাগ্নে অর্ককে একটু গড়েপিটে দিয়ে যাবেন না? এটা তার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আপনজন বলে কথা।
– শোন, ছেলেকে শাসন করব, তুই মাঝখানে কোন কথা বলবি না তিন্নি। একেবারে স্পিকটি নট।
ছোট্ট কাজের ছেলে অন্তু যে ফড়িঙের মতো দৌড়ে দৌড়ে কাজ করে সে বিকট আওয়াজে চেঁচিয়ে ওঠে, দেইখ্যা যাও গো মামু, খালায় সুন্দর গেলাসটা ভাইঙ্গা ফালাইছে।
খালা মানে ঠিকে বুয়া আনুর মা, ও যেন টগবগ টগবগ ঘোড়ার পিঠে চড়ে কাজ করতে আসে। আধ ঘণ্টার ভেতরে বাসন মাজা, ঘর ঝাঁট দেয়া ঘর মোছা সব সারা। ‘যাইগা গো’ বলে নেচে নেচে ওর প্রস্থান। গেলাস ভাঙার খবর শুনে মামু একেবারে চুপ। আনুর মাকে কিছু বলার সাহস তার নেই। কথায় কথায় ও এমন ফোঁস করে ওঠে যে মামা নত মুখে পরাজয় স্বীকার করে নেন।
অর্ক কি করে ভাঙবে- ও তো ইস্কুলে।
অন্তু মামুর কাছে এসে বলে, কি গো মামু ভয় পাইলেন নাহি আনুর মায়েরে?
– গেলি?
এ সময় ফিরে আসে অর্ক। ধপাস করে টেবিলে পেট মোটা ক্যাম্বিসের ব্যাগটা রাখতেই অন্তু কানে কানে বলে, জবর শরম পাইছে মামায়।
ঘটনা শুনে করুণ নিঃশ্বাস ফেলে অর্ক। বড় মামু এ বাড়িতে আসার পর বড্ড কষ্টের দিন শুরু হয়েছে ওর। যেন যত দোষ অর্ক ঘোষ। অর্ক যেন কোন ভালো কাজ করতেই পারে না। মামার সামনে দাঁড়িয়ে করুণ মুখে অর্ক বলে, আমি তো সব সময় ভালো কাজের চেষ্টা করি মামু। বিশ্বেস করো।
দাঁত মুখ খিঁচিয়ে মামু বলেন, ছাই করিস, আসা অব্দি তো শুনলাম না, একটু কিছু ভালো করেছিস। বুক ভাঙা নিঃশ্বাস ফেলেন মামা, তোর ভূত-ভবিষ্যৎ বলতে কিছুই নেই, বর্তমানও কি আছে? কিচ্ছু নেই।
অপমানে-দুঃখে ঠোঁট নাড়তে থাকে অর্ক। -বেশ, না থাকুক, তোমার কি? আপন মনে কথাগুলো বলে অর্ক, মামা যেন শুনতে না পায়। মামা বয়সে বড় যে, বড়দের মুখে মুখে তর্ক করতে নেই।
রকেট, ডাবলু, গাব্বু, বুম্বা, গাবলু, টিটো- কতো বন্ধু ওর, ওদের মামারা ঠিক যেন রসে ডোবা রসগোল্লা। মামা-ভাগ্নে মিলেমিশে একাকার। বেলুন মামা, বাদল মামা, নূরু মামা ওদেরকে দেখলে মনে হয় কবি এমন ধারা মামাদের দেখেই লিখেছেন- ‘মামার বাড়ি ভারি মজা, কিল চড় নাই।’
মামারা রসে ডোবা রসগোল্লার মতো কী যে নরম আর তুলতুলে হয়। আর অর্কের কপালে জুটেছে এই খরখরে মামা। মামার সারমন দেয়া অবিরত চলছে।
– খালি আলসেমি। জানিস ইংরেজিতে একটি কথা আছে- ‘আইডল মাইন্ড ইজ ডেভিলস ওয়ার্কশপ।’
-এর মানে? অর্ক অবাক চোখে মামার দিকে তাকায়।
– মানে হলো- ‘অলস মন শয়তানের কারখানা।’
– বাঃ রে, আমার মন অলস হলো কোথায়? ইস্কুলে যাই, পড়াশোনা করি, হোমওয়ার্ক আছে, রাতে টিচার আসেন।
আমাকে তুমি খামোকা বকুনি দাও বড়মামু।
– আমি কি তোর শত্রু? বকুনি দেই আমি? বললিটা কি?
তিন্নি, এ্যাই তিন্নি- শোন তোর ছেলের কথা।
– এই তো ইস্কুল থেকে ফিরলি, এবার কি করবি?
– রেস্ট নেব।
– এরপর?
– খাব।
– তারপর?
– শোব।
– এই তো শুয়ে থাকবি, আলসে কোথাকার।
– আরে মামা, আমি কি শোবও না? কি যে বলো না তুমি। শুয়ে শুয়ে একটু ভাবব না? ইস্কুলে সিনিয়র আর জুনিয়র টিমের খেলা হবে শুক্রবার বিকেলে। আমি স্টপার, চোখ বুজে খেলার প্ল্যানটা ঠিক করতে হবে না?
– খালি মুখে মুখে তর্ক, তোর চেয়ে বাড়ির লেপচু কুকুরটা ঢের ঢের বুদ্ধি রাখে।
লোমে ঢাকা কুকুরটি জুলজুল চোখে তাকায় অর্কের দিকে। বলে, ছিঃ ছিঃ অর্ক, মানুষের সাথে কুকুরের তুলনা? তবেই বোঝ।
বেজায় দুঃখে দিন কাটছে অর্কের।
শুভ্র আর মিমো প্রাণের বন্ধু দু’জন জিজ্ঞেস করে- ‘এই অর্ক, কি হয়েছে রে তোর? মন খারাপ করে চুপচাপ বসে আছিস কেন? টু বি ভেরি ফ্রাংক।’
কথা বলে না অর্ক।
ক্লাসের পড়া শেখেনি, স্যার এজন্য বকুনি দিয়েছেন। কান দুটি মলেছেন কিংবা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলেছেন, এই বাঁদর, ইস্কুলে কি চেহারা দেখাতে এসেছিস- এ সব কথা ক্লাসের বন্ধুদের অনায়াসে বলে হালকা হওয়া হয়, কিন্তু না, মামা আর ভাগ্নের মিষ্টি সম্পর্কটা রাবড়ি আর আমের মতো, সেই সম্পর্কে যদি ফাটল ধরে, ফাটল ধরার বাকি আর কি আছে। বড় মামু বাড়ি আসার পর থেকেই তো খটোমটো সম্পর্ক তৈরি করেছে- ঘরের এই কথা কি কাউকে বলা যায়? ভীষণ টাচি ব্যাপার ওগুলো।
বিকেলে চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে বড়মামু মুখে টপাটপ ফেলছেন পাঁপড় ভাজা, কাজুবাদাম আর নারকেলের বরফি। উপাদেয় খাবার খেতে খেতে তৃপ্তিতে দু’চোখ বুজে বুক ভাঙা নিঃশ্বাস ফেলেন।
– ঠিক আছে অর্ক, পড়াশুনায় ভালো হোসনি, প্লেয়ারও তো হতে পারতিস।
– সে আর হইনি বুঝি?
হুঁ ঘটনা তো শুনলাম।
– কী শুনলে বলো।
– বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ‘এগ অ্যান্ড স্পুন’ রেসে দৌড়ের মাঝখানে সেদ্ধ ডিমটা খেয়ে নিয়েছিস। তাই তো?
হাসির রোল ওঠে। লজ্জায় লাল হতে হতে মলিন হয়ে ওঠে অর্কের মুখ।
– তুমি সবার সামনে বড় লজ্জা দাও মামু। সে কি আমি ইচ্ছে করে করেছি? দৌড় দিতে গিয়ে সবার থেকে যখন পিছিয়ে পড়েছি, ফার্স্ট-সেকেন্ড কিছুতেই হতে পারব না তখনই তো সেদ্ধ ডিমটা ছাড়িয়ে মুখে দিয়েছি।
– বেশ করেছিস।
– তো কি করব? ডিমটা তো ক্লাসের ছেলেরা খেয়েই ফেলত।
– স্টুপিড কোথাকার।
– কেন মামা, খেলায় হেরে গেছি বলে স্টুপিড বলবে কেন? ইংরেজিতে তাহলে কেন বলে ফেইলিওর ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস।
– খবরদার! বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে থাকা বড়মামা উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে ফুটতে উঠে বসেন।
– ফেল করতে করতে তুই কবে পাস করবি শুনি?
মামার সামনে থেকে সেদিন পালিয়ে বাঁচে অর্ক।
দিন দুয়েক পর বাংলা ক্লাসে স্যার ভাবসম্প্রসারণ লিখতে দিলেন, ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়।’ ভাব যত বড় করে পারা যায়, লিখতে থাকে।
চকিতে অর্কের মনের ভেতর যেন চকমকি পাথর জ্বলে ওঠে। সত্যি সমান যায় না? এও কি হয়? মামা ভিসার মেয়াদ বাড়াবে না। ক’দিন পরই বিশাল বিমানে চড়ে হুঁশ-হুঁশ করে ফের চলে যাবে কানাডা? বড় মামুর সব সময়ের অত্যাচার থেকে, হুল ফোটানো কথা থেকে বাঁচবে তো?
মা যে কী! খালি পেছন থেকে আদুরে গলায় বলতে থাকে- ও বড়দা, আর ক’টা দিন থেকে যাও না প্লিজ। দূর দেশে গেলে আবার কবে ফিরবে কে জানে!
বড় মামার জবাব, না-রে, অনেক দিন হয়ে গেল- মনে মনে ক্লাসরুমে বসে চোখ বুজে বলতে থাকে, বড় মামু, চলে যাও তুমি, প্লিজ।
অর্কের বুকের ভেতর আনন্দ টইটম্বুর হয়ে ওঠে। সে লিখতে থাকে, কেবলই লিখতে থাকে। মনের ভাবকে ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করতেই থাকে।
স্যার এক সময় বলেন, কি রে অর্ক ভাব-সম্প্রসারণ না রচনা লিখতে বসেছিস রে?
স্যারের কথায় চমকে ওঠে দেখে, সত্যিই তো, রচনা লিখে ফেলেছে সে, খাতাটি যে প্রায় ফুরিয়ে এলো।
কদিন থেকে মামার মাথায় নতুন বাই উঠেছে। পরিষ্কার করো, ঘর, ছিমছাম করো, বাড়ি ছাফাই করো, চায়ের পেয়ালায় ছোট ছোট চুমুক দিতে দিতে মামা বলতে থাকেন- জিনিসপত্রে একেবারে ঠাসাঠাসি হয়ে আছে ঘরদোর। অর্কের বই খাতাপত্রের কথা বলে তো আর লাভ নেই। বিদেশে পুরনো কাপড় চোপড় একেবারে ফেলে দেয়। আমাদের অর্ক, ওর শার্ট-জ্যাকেট আলনা ওয়ারড্রবে ঠাসা। তোকেও বলি তিন্নি, জেলির শিশি, হরলিকসের বোয়াম, কোকের বোতল, মিষ্টির বাক্স জমিয়ে একেবারেই পাহাড় করে রেখেছিস। নারে অর্ক, তুই একেবারেই হোপলেস। বিদেশে তোর মতো ছেলেরা নিজেরা ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ ডিনার তৈরি করে, তুই তো নিদেন পক্ষে ঘরটা ছাফাই করতে পারিস।
কথা বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গেলেন বড়মামু। মা সংসারের কাজকর্ম নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। অর্ক অন্তুকে নিয়ে ঝাড়– দিয়ে ঘর পরিষ্কার করছে। আজকে মামাকেও অবাক না করে ছাড়বে না। ডু অর ডাই, করিব নয়তো মরিব। দর দর করে ঘাম ঝরছে অর্কের চুল বেয়ে। গায়ের গেঞ্জি ভিজে একেবারে চুপসে গেছে। নাহ- আজ আর রেস্ট নেই, আজকের শ্লোগান হলো- সাফাই করো, ঘর-দোর ঝকঝকে করে তোল।
দুপুরে খেয়ে দেয়ে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে আছে। রাস্তায় হাঁক দেয় কাগজওয়ালা।
– ডাক ডাক অন্তু, শিগগির ডাক। হারি আপ। ক্লান্ত সুরে অন্তু বলে, আর ফারি না অর্ক ভাইয়া। না না- আজ কাজের শেষ না দেখে ছাড়ব না। মামুকে তাক লাগিয়ে দিতেই হবে।
অন্তুও তুখোড় ছেলে, বাসায় হাজারো ফুট ফরমাশ খাটে।
এই অন্তু, মোড়ের দোকান থেকে বলপেন নিয়ে আয়, রিফিল নিয়ে আয় তো। চিকেন ফ্ল্যাভারের ম্যাগি নুডলস আর দু’প্যাকেট চিপস আনবি কিন্তু।
বাড়ির সবার অর্ডারে ও দারুণ খুশি, ছুটে ছুটে অন্তু সব নিয়ে আসে। ও বলল, কুছ পরোয়া নেই।
কাগজওয়ালা ডেকে এনে অন্তু বলে, বস্-গাটরি বান্ধা সব দিয়া দ্যান। ঘর পরিষ্কার হোক-মামায় খালি প্যাঁচাল পাড়ে।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে বড় মামু বেজায় খুশি।
– এত দিনে কাজের মতো কাজ করেছিস অর্ক।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবি, বাড়িঘর ঝকঝকে তকতকে থাকবে- তবেই না শুয়ে বসে আরাম।
গুড বয় অর্ক, ইয়ু আর অ্যা ভেরি ভেরি গুড বয়। মা বললেন, তুমি অর্ককে খালি বকাবকি কর বড়দা। এবার দেখলে তো?
– আমি যা করি তোদের ভালোর জন্য করি রে তিন্নি। তোর একটি মাত্র ছেলে, বখে গেলে কেমন হবে বলত? তাও তো ঠিক, মা মাথা নাড়েন।
বিকেলে ঠাণ্ডা বাদলা হাওয়া বইছে বলে, মামু চা না খেয়ে কফি খেলেন। একটু হাঁটাহাঁটি অভ্যাস তার। ডাক্তার মানে অর্কের বাবা বলেছেন, সকালের চেয়ে বিকেলেই হাঁটাহাঁটি করা ভালো। এ জন্য বিকেলটাই বেছে নিয়েছেন মামু। বাইরে যাবার সময়ই ঘটল বিপত্তি।
– এই-এই অর্ক, আমার জিনসের শার্ট কই?
– একটু খুঁজে দ্যাখো না মামু, এখানেই কোথাও হবে।
– আমার জিনসের প্যান্ট?
– আমার জ্যাকেট?
বড় মামু কাঁদো কাঁদো সুরে আহাজারি করতে থাকেন।
নেই-নেই কিছু নেই। মাতম শুরু হয় বাড়িতে। ঘর পরিষ্কার করবি, সাফাই করবি-পুরনো ছেঁড়া কাপড়-চোপড়, খবরের কাগজ-বইপত্র ওগুলো বিক্রি করে দিবি, তা নয়- মায়ের টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি- যে শাড়িটি ভীষণ প্রিয় ছিল মায়ের, বড় মামুর দরকারি শার্ট-প্যান্ট ওগুলো কিছুই নেই।
করুণ মুখে মামা বলেন, দেখলি তোর ছেলের কাণ্ড?
অর্ক আর ওর সহযোগী অন্তু তো অবাক, কোনটা ভালো কোনটা খারাপ কিছুতেই ওরা বুঝতে পারছে না। ঘর সাফাই করো-করেছি, তাও আবার কুকুর কান্না? অন্তু সাহস করে বলেই ফেলে, অর্ক ভাইয়া তো বহুত সাফ সুতরা করছে।
এবার মাও মহাখাপ্পা।
– হয়েছে, তোমার আর চোরের সাক্ষী বাটপাড় হতে হবে না।
মামা ছুটে আসেন, এই একটি কথাও নয়, চুপ করে বসে থাক।
খুব সাফ সুতরা করেছিস দু’জনে মিলে।
করছি তো, ব্যারাছেঁড়া লাগাইছেন আফনে।
মামা হতবাক হয়ে যান। পুচকে ছোড়ার মুখে এত বড় কথা? কোথায় ওর বস? পালের গোদা অর্ক?
– এই, এই অন্তু, আয় এদিকে, চড়িয়ে মুখ লম্বা করে দেব।
নেহাৎ ভালো দৌড় জানে অন্তু, ছোটে ঠিক খরগোশের মতো, তাই ও পালিয়ে বাঁচে। সব বেচে একশ সাত চল্লিশ টাকা রোজগার করেনি ওরা?
বাবা হাসপাতালের ডিউটি সেরে বাড়িতে ফিরে বলেন,
‘মামা-ভাগ্নে যেখানে, আপদ নাই সেখানে।’
বাবা তো ছড়া কেটেই খালাস, আপদ-বালাই যে মামা সব অর্কের ঘাড়ে চাপিয়ে বসে আছেন, সে খবর তো বাবা রাখেন না।
আরেক বিপত্তি, কাগজওয়ালা ব্যাটা এরপর থেকে অর্কের পিছু ছাড়ে না। ইস্কুলে যেতে-আসতে পিছু পিছু ঘোরে।
– ভাইজান, ও ভাইজান-জিনিসপত্র দেবেন না?
-উহু, প্রায় বিনে পয়সায় জিনিস নিয়েছ, আর নয় বাবা। যা-ভাগ।
কাগজওয়ালা মাথার টুকরি নিয়ে রাস্তায় প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। গুনগুন করে বলে, আমার কি দোষ? আমারে ডাকছ, গেছি। জামা-কাপড় দিছ, নিছি- আমি তো জোর কইরা কিছু আনি নাই। শিক্ষিত মাইনষের পোলাপানরা বড় সাইড টক করে।
পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে সে অর্ককে। পিছু পিছু আবার এসেছে নাকি? পড়ি কি মরি করে মাথার টুকরি নিয়ে-দে ছুট।
অর্ক ওর দিকে অবাক হয়ে তাকায়।
লে হালুয়া। আমি আবার কি করলাম? মৃদু নিঃশ্বাস ফেলে বাড়ির পথ ধরে অর্ক। বাড়ি তো নয়, এ যেন সিংহে ডেরা।
দুদিনের জন্য মা যাবেন গাজীপুরে ফুলমাসীর বাড়িতে।
বাড়িতে বড় মামু আছেন, তাই কোন ভাবনা নেই মায়ের। বাবা সারাদিন থাকেন হাসপাতালে, নয়তো রোগী দেখতে চেম্বারে।
তাই বড়মামুই একমাত্র ভরসা। মনে মনে ডুকরে ওঠে অর্ক।
-মা, মা গো কার কাছে রেখে যাচ্ছ আমাকে? এতো সিংহের ডেরা।
– কিছু বললি অর্ক?
– না না মা, কিছু না মা।
খালি বাড়িতে মামা আদেশ দিলেন ভাগ্নেকে, শোন অর্ক, কেউ এলে খবরদার দরজা খুলবি না। চোর-ছ্যাঁচড় আসে নাকি কে জানে, আমি তো সবাইকে চিনিও না। সব সময় অ্যালার্ট থাকবি। বি কেয়ারফুল।
সবাইকে চেনো না তো বাপু, এই একটাই সুযোগ-ডিট করে ছাড়ব তোমাকে।
বড় মামু আপন মনে বলেন, এই তোর মা, দরজায় কেউ কড়া নাড়ল, ডোরবেল বাজাল তো হয়েই গেল। ওর ওপরে কেউ যদি বলে সুনামগঞ্জ-সিলেট থেকে এসেছি, দু’জায়গার নাম শুনলে তিন্নিকে আর আটকানোই যায় না। কার ছেলে নাম কি, কি কাজে এসেছে, কিছুই জিজ্ঞেস করে না। চোর না ছ্যাঁচড় জিজ্ঞেস করতে হবে না? তুই তো তিন্নিরই ছেলে, তোকেও বিশ্বাস নেই। খরখরে চোখে মামার দিকে তাকায় অর্ক। উনি কানাডা থেকে এসেছেন ছোট বোনের ছেলেকে গড়ে-পিটে মানুষ করার জন্য। দাঁড়াও, মানুষ-করার প্লান বানচাল করছি তোমার। ওয়েট অ্যা বিট মামু।
এই তো গতকালের কথা। মা গামলা ভর্তি রকমারি পিঠে ভেজেছেন, সবাইকে খেতে দিলেন। আদর করে ছেলেকে ডাকলেন- অর্কু, এই অর্কু।
বড়মামু পিংপং বলের মতো খপ করে ধরলেন মাকে।
– এই তো তোমার দোষ তিন্নি, নামকে বিকৃত করা। অর্ক নামের কোন অর্থ আছে? অর্কের অর্থ সূর্য, অর্কটা কী? কিচ্ছু না, নাথিং।
পাটিসাপটা পিঠেতে তৃপ্তির কামড় দিতে দিতে মামা বললেন, আর একটা ব্যাপার মোটেও ভালো নয় তিন্নি।
– কি বড়দা?
– তালের বড়া ভেজেছ, মুগের পিঠে পাটিসাপটা বানিয়েছ ভাল কথা ছেলে তো খাবেই, আদর করে ডেকে এনে অর্কু বাবা, অর্কু সোনা বলার দরকার কি? ছেলে মেয়ের আদর বুকের ভেতর চেপে রাখতে যেন ওরা বুঝতে না পারে।
মামার শাসনের বহর দেখে বাবা দারুণ খুশি। সারাদিন হাসপাতাল আর রোগী নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, অল্পদিনের জন্য হলেও অভিজ্ঞ মামার শাসনে থেকে ছেলেটা মানুষের মত মানুষ হবে। খুশিতে বুক ভরপুর বাবার। যাহোক- এ দু’দিন শুধু মামা আর ওরা দু’জন।
এক ফাঁকে চুপটি করে অর্ক পাশের বাড়িতে অপূর্বদা আর রিন্টুদার কাছে গেল। মামা জানতেও পারল না। সারাদিন মামা খেয়ে-শুয়ে আর খবরের কাগজ পড়ে কাটালেন।
ভাগ্নেকে বললেন- খবরদার বাইরে যাবি না।
অন্তু বিকেলের দিকে বলল, একটা মানুষরেও আইজ বাড়িতে ঢুকতে দেই নাই মামু।
– বেশ করেছ। থ্যাংক ইয়ু।
অর্ক বলল- তোমার কথা আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি মামু। কাউকে ঘরে ঢুকতে দেবো না।
– সাবাস, এই তো চাই।
সন্ধ্যের পর মামা টিভি খুলে বসেন। পায়ের কাছে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে অন্তু। অর্ক ওর পড়ার টেবিলে। সুনসান এই সন্ধ্যায় বুক কাঁপিয়ে ডোরবেল বেজে ওঠে।
একবার নয়, দুবার নয়, তিন তিনটে বার।
অন্তু দরজায় লাগানো ‘আই’ দিয়ে দেখে বলে, মামা দুইডা বড় বড় ব্যাডা আইছে।
চোখ পাকিয়ে মামু বলেন, খবরদার দরজা খুলবে না। পড়ার টেবিল ছেড়ে অর্ক আসে।
– কি ব্যাপার?
দরজায় লাগানো সেফটি চেন ঢিলে করে নেয় ভালো করে পরখ করে অর্ক বলে, মামু, তোমাকে একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করে নিয়ে যাবে তো, তাই কথা বলতে এসেছেন। ফুলের তোড়াও এনেছেন। বলে দেব ওদেরকে তুমি বাড়ি নেই?
লাফিয়ে ওঠেন মামা।
– সাধে কি আর তোকে স্টুপিড, ফুল- বলি? আসলে তুই তাই। ভেতরে আসতে বল ওদের। খাবার-দাবার আছে কিচেনে?
ছত্রিশ ইঞ্চি বুক পঞ্চাশ বানিয়ে বড়মামু বলেন, খোল দরজা।
ঘরে ঢুকে মাথা নিচু করে মামার হাতে ফুলের তোড়া দেয় ছেলে দুটো। এরপর যে কি ঘটে যায় মামা মোটেও বুঝতে পারেন না। কোত্থেকে মোটা নাইলনের দড়ি আসে, কোথা থেকে লাঠির জোগাড় হয় কিছুই বুঝতে পারেন না মামু। হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকেন ছেলে দু’টির দিকে।
ড্রয়িরুমের সোফার সাথে বেঁধে ফেলে তাকে। তছনছ করতে থাকে সারা ঘরদোর। আলমারি খুলে কাপড়-চোপড় ছৈ-ছত্রাকার করে ফেলে, ড্রয়ার খুলে কাগজপত্র এদিক ওদিক ছড়িয়ে সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে ওরা চলে যায় ঠিক নটার একটু আগে।
বাবা নটায় ফিরেন।
– এ কি কা-! কি হলো রে অর্ক? এ এলাকায় আছি বারো বছর, কোনদিন তো এমন হয়নি। সবকিছু এলোমেলো করেছে অচেনা দুটি লোক কিন্তু একটি পাই পয়সা, জরুরি কাগজ-পত্তর, শাড়ি-কাপড় কিছুই নেয়নি।
রাত সাড়ে দশটায় গলা নামিয়ে ফোন করে অর্ক।
– থ্যাংক ইয়ু অপূর্ব ভাইয়া, তোমার আর রিন্টু ভাইয়ার অ্যাকটিং দারুণ হয়েছে। সুপার্ব, ফ্যানটাসটিক, থ্যাংক ইয়ু সো মাচ।
বড় মামুই শুধু পাথরের মানুষ হয়ে গেলেন। একেবারেই চুপচাপ মুখে কথা নেই-গভীর ভাবনায় ডুবে আছেন তিনি। চিন্তিত মুখে মাথায় আঙুলের টোকা মেরে মেরে মামু মগজটাকে পাকিয়ে নিচ্ছেন। বার বার বলে ছেলে দু’টিকে কোথায় যেন দেখেছি।
ভুরু কুঁচকে অন্তু বলে, মামায় খালি আজাইরা প্যাঁচাল পাড়ে। মামা ভাবেন, দড়িটা বড্ড চেনা চেনা ঠেকছে। হলদে রঙের নাইলনের দড়িটা ঘরের এককোণে জড়ানো ছিল নাকি? ধন্দে পড়ে যান বড়মামা।
ছেলে দু’টির উদ্দেশ্য কি ছিল? চুরি নয়, ডাকাতি নয়- একটা পাই পয়সা ছুঁয়েও দেখল না, শুধু তাকেই বেঁধে ফেলল দড়ি দিয়ে, দমাদম বেশ কয়েক ঘা লাঠি মারল বেশ কিছু সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মামুর মনে।
তিন্নি কালকে ফিরে এলেই কানাডা ফেরার টিকিটের ব্যবস্থা করতে যাবেন, দ্যাটস ফাইনাল।
অর্ক আর অন্তু মনের আনন্দে সেলিব্রেট করছে। কুড়মুড় করে চানাচুর চিবোতে চিবোতে বোতল উপুড় করে কোল্ড ড্রিংকসে গলা ভেজাতে থাকে অর্ক আর অন্তু।
ওদের চাপুর-চুপুর আর গলগল আওয়াজে মেজাজ ফের তেতে উঠতে থাকে বড়মামুর। বরাবরের মতো বলবেন নাকি, এই স্টুপিড, ডোন্ট সাক ড্রিংকস। চুষে চুষে আওয়াজ করে খাচ্ছিস কেন? ম্যানার্স শেখ। কিছুই বলেন না বড়মামু। নিজেকেই নিজে বলেন, বি-কুল। মাথা ঠাণ্ডা রাখো। রাগটাকে সামলে নাও। অর্ক বিচ্ছুটাকে নতুন করে না ঘাঁটানোই ভালো।

Share.

মন্তব্য করুন