শেষ রাতের দিকে বনপলাশ নামের ছোট্ট নিরিবিলি শহরটার উপর দিয়ে এক আশ্চর্য রকমের শিরশিরে বাতাস বয়ে যায়। এই পাতা খসানো বাতাস উঠে আসে পাশের পুঁইলতা নামের ছিপছিপে পাহাড়ি নদীটি থেকে। আবছা অন্ধকারে ডুবে থাকা বনপলাশ শহরের কাঠের বাংলো ঘরগুলোর জানালায় গিয়ে যেন টোকা দেয় এই বাতাস।
পাশের পলাশ আর শালবনের গন্ধমাখা এই বাতাসের খোঁজ যে পেয়েছে তার বুকেই বুঝি রিনরিন করে ওঠে একটা অন্য রকমের অনুভূতি। এখন যেমন হচ্ছে পিকুর। মাস কয়েক হলো ওরা এসেছে এই পাহাড়ি শহরে। ওর বাবার বদলির চাকরির সুবাদে এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতে হয় পিকুকে। বনপলাশ শহরে ওর সবচাইতে প্রিয় হচ্ছে শেষ রাতের এই পাতাকাঁপা বাতাস। এই বাতাস জানলায় টোকা দিয়ে যেন বলে, আমরা এসে গেছি।
শাল আর পলাশ গাছ থেকে তখন শুকনো পাতা যায় খসে। পাখিদের ডাকে জেগে ওঠে বনভূমি। তখন বিছানা থেকে উঠে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় পিকু। একটা ট্রেন ঝকর ঝকর শব্দ করে চলে যায়। পিকু তখন কাঠ বারান্দায় এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। দূরের বিল থেকে উঠে আসা যাযাবর হাঁসের ঝাঁক তখন উড়ে যাচ্ছে শহরের উপর দিয়ে। পিকু হাঁসদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পায়। ঘর থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে এসে সামনের গাছগুলোতে বসে থাকা পাখিদের ভালো করে দেখতে থাকে। হঠাৎ করে যদি দেখা পেয়ে যায় রূপকথার সেই আশ্চর্য পাখিটিকে। যে পাখির নাম হোমা। কল্পনার রঙে মেশানো সেই রঙিন অবাক করা পাখিটিকে অনেক দিন থেকে খুঁজছে পিকু। যতগুলো বনে গেছে সেখানেই আকুল হয়ে খুঁজছে। শেষ পর্যন্ত প্রচণ্ড রকমের একটা জেদ চেপে গেছে তার মনে। যে করেই হোক হোমা পাখিকে খুঁজে বের করতেই হবে। কাঁকনপুরে যখন ওরা ছিল তখন এক বিদেশি বার্ড ওয়াচার তাকে বলেছিলেন, এই অঞ্চলের বনে হোমা পাখিকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
একটু একটু করে লেবুপাতার রঙের মতো ভোরের আলো ফুটতে থাকে। পিকু কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে মাঠে। শিশির ভেজা সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে বেশ ভালো লাগে। সামনের লাল সুড়কির রাস্তা দিয়ে কয়েকটি দেহাতি লোক ঝাঁকা মাথায় চলে যায়। এরা সারারাত পুঁইলতা নদীতে মাছ ধরেছে। একমাত্র এই নদীতেই শুধু মহাশোল মাছ পাওয়া যায়। আর কোনো নদীতে এই মাছটিকে এখন আর দেখা যায় না। বিলুপ্ত হয়ে গেছে মাছটি। তাই পুঁইলতার নদী থেকে জেলেরা যদি কখনও মহাশোল মাছ ধরতে পারে তখন ভোরের মাছের হাটে বেশ একটা উৎসবের মতো সাড়া পড়ে যায়।
পিকুর আবদুল চাচা ধনেপাতা আর পেঁয়াজকলি দিয়ে মহাশোল মাছ চমৎকার রাঁধতে পারে। এই বনপলাশ শহরে এসে পিকুর আবদুল চাচা তাই খুব খুশি। সবসময় অপেক্ষা করে থাকে কখন হাট থেকে আঁশ চকচকে একটা মস্ত মহাশোল মাছ কিনে আনবে। আর পিকু অপেক্ষা করে থেকে কখন হঠাৎ করে চিলচিলে রোদের ভেতরে ফুড়ুৎ করে উড়ে যাওয়া একটা হোমা পাখিকে দেখতে পাবে সে।
হয়তো পাখিটাকে ধরতেও পারবে। তাহলেই সে হোমা পাখির বিবরণ লিখে পাঠাতে পাবে পাখিবিষয়ক জার্নালে। অমনি সে বার্ড ওয়াচার হিশেবে বিখ্যাত হয়ে যাবে। সবাই তাকে জানাবে প্রচুর অভিনন্দন। বলবে, পিকু, শেষ পর্যন্ত একমাত্র তুমিই পেলে হোমা পাখির সন্ধান। এই তো হচ্ছে রূপকথার পাখি আর তুমি হলে বার্ড ওয়াচারদের মধ্যে এক রাজপুত্র।
পাখিদের ডাকে চারপাশের বনভূমি ধীরে ধীরে সরব হয়ে উঠছে। এক সতেজ গন্ধ ভাসছে বাতাসে। কাঁচা আতাফলের মতো সেই গন্ধ। পিকু জানে এই গন্ধটা আসছে এক ধরনের বাদামি বুনো ফল থেকে। পাহাড়ি ঝোপে হয় বাদামি ফলটা।
পিকু ধীরে ধীরে প্রবেশ করে বনের ভেতরে। কয়েকটা কাজুবাদামের গাছ বাঁ দিকে। মাটি আর পাথর মিশিয়ে রাস্তা। শুকনো শালপাতা জমে আছে রাস্তার উপর। শাল, পিয়াল, মহুয়া, শিশু, গামারি গাছের সারি। কিছু দূরে কয়েকটা টিলা। পিকু বাইনোকুলার দিয়ে খুঁজছে হোমা পাখিকে। তার এক নেপালি বন্ধু জানিয়েছে, এই দিকের বনে হোমা পাখি দেখা হয়তো সম্ভব। কারণ নেপালের তরাই বন থেকে বনপলাশের বন বেশ কাছে। আর তরাই বনে কয়েকবার দেখা গিয়েছিল হোমা পাখিদের।
সাঁই করে একটা পাখি উড়ে এসে বসল সামনের ধূসর গাছের ডালে। পাখিটার লেজের নিচে রূপোলি দুটো রিবন যেন ঝুলছে। সেদিকে তাকিয়ে দারুণ উত্তেজনায় ধুকপুক করে উঠল পিকুর বুক। তা হলে এটাই কি সেই পাখি! এতদিন ধরে যাকে বনে-বাদাড়ে আকুল হয়ে খুঁজছে সে।
পাখিটা সেই রূপোলি রিবন দুটোকে পতপত করে উড়িয়ে আবার নীল আকাশে ছুটে গেল। একটা আশ্চর্য ঝিলিক যেন। ডানা ছড়িয়ে লেজ উঠিয়ে শূন্যে ভেসে গেল পাখি। এবার ঠিক ঠিক চিনতে পেরেছে পিকু। পাখিটার ঝুঁটি আছে। এটাই হলো গিয়ে সেই আশ্চর্য রহস্যময় হোমা পাখি। এক ডাল থেকে উড়ে গিয়ে অন্য ডালে বসল। বাইনোকুলার দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পারছে পাখিটাকে। ধপধপে রূপোলি শাদা। এর মধ্যে মাথা, গলা, ঘাড় ও ঝুঁটি ধাতব নীলচে কালো। পিঠের উপর দিকে শাদা পালকের ভেতরে অস্পষ্ট কালো টান। ডানা ও লেজের পালক শাদা। কয়েকটাতে শাদার মাঝখানে কালো লম্বা লাইন।
পাখিটা পুঁইলতা নদীর দিকে উড়ে চলে গেল। এবার নিশ্চিত হলো পিকু। সে আজ রূপকথার আশ্চর্য সুন্দর পাখিটাকে আবিষ্কার করতে পেরেছে! একটা অদ্ভুত ভালো লাগার শিহরণ ছড়িয়ে গেল তখন তার ভেতরে। দৌড়ে নিজের ঘরে এলো পিকু। শেলফ থেকে নামাল পাখিবিষয়ক কয়েকটি জার্নাল। পাতা উল্টিয়ে চলল। পেয়ে গেল হোমা পাখি সম্পর্কে বিবরণটি ।
এ এক বিশ্বনন্দিত পাখি। এর সম্পর্কে বলা হয়, এই পাখি আকাশে উড়তে উড়তেই ডিম পাড়ে। আর ডিম মাটিতে পড়তে পড়তে বের হয় শাবক। এই শাবক মাটি ছোঁয়ার আগেই আকাশে উড়ে যায়। প্রাচীন আখ্যানে বলা হয়েছে, ওই পাখির পালক যে রাজার মুকুটে শোভিত হবে তিনি হবেন দিগ্বিজয়ী। বলা হতো, কারো শরীরে ওই পাখির ছায়া পড়লে তিনি অচিরেই রাজা হবেন। অতীতের ইউরোপে বিশ্বাস ছিল হোমা পাখি কেবল শিশিরি খেয়ে বেঁচে থাকে। তাদের পা থাকে না। সে জন্য তারা কখনও মাটিতে নামে না। এমন ধারণা ছিল যে, এ পাখিকে আগুনে পুড়িয়ে মারা যাবে না। সামান্য ছাই থেকেই আবার নতুন পাখি হয়ে জন্মায়। মালই দ্বীপের অধিবাসীরা এই পাখিকে বলত দেবতার পাখি। ওর নাম ছিল স্বর্গীয় পাখি। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এর নাম হলো প্যারাডাইস বার্ড। ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ ওয়ালেশ হোম এই পাখির সন্ধানে নিউগিনি দ্বীপে জাহাজ ভিড়িয়ে ছিলেন।
অনেক দিন সেখানে কাটিয়েছেন তিনি রূপকথার এই পাখিটির খোঁজে। পিকুকে এখনই এই বনপলাশের বনে হোমা পাখি দেখার কথা ঢাকায় জানাতে হবে। ফোন করতে হবে তমাল ভাইয়ের কাছে। তমাল ভাই হচ্ছে পাখি দেখা ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। শীতের যাযাবর পাখিদের নিয়ে তার তোলা ভিডিও ডিসকভারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছিল। তমাল ভাই পাখি দেখার জন্য এ জঙ্গলে একবার এসেছিলেন। বনপলাশ থেকে ঢাকায় ফোন পাওয়া যায় না। কিন্তু কি আশ্চর্য, সেদিন একটু চেষ্টা করতেই ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেল। তমাল ভাইকে পেয়ে গেল সে।
বনপলাশের দুধরাজ । আলী ইমামহ্যালো তমাল ভাই, দারুণ এক ব্যাপার। আমি এখানে আজ হোমা পাখিকে দেখতে পেয়েছি।
বলিস কি পিকু, এটা তো বিরাট এক আবিষ্কার। তুই ঠিক চিনতে পেরেছি তো পাখিটাকে?
দেখো তমাল ভাই, আমাকে আর পাখি চেনাতে হবে না তোমাকে! ওটা নির্ঘাৎ হোমা পাখি ছিল। রেশমি ওড়নার মতো লেজ। সেখানে লম্বা পালক, মাথায় ঝুঁটি, বিচিত্র বর্ণের পালক, উজ্জ্বল ডানা।
প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার। আমি খবরটা আজ বিকেলে ক্লাবের সাপ্তাহিক সভায় পেশ করব। গর্বের সঙ্গে জানাব আমাদের ক্লাবের একজন সদস্য বনপলাশের বনে দুষ্প্রাপ্য, বিরল প্রজাতির হোমা পাখির সন্ধান পেয়েছে। যে পাখির খোঁজে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জঙ্গলগুলো চষে ফেলছেন পাখিবিজ্ঞানীরা।
তমাল ভাই, আমি আশা করছি কালকের মধ্যে হোমা পাখিটির ছবি তুলে পাঠাতে পারব।
যত জলদি পারিস ছবি পাঠাবি। আমি তখন ছবিসহ খবরটা পত্রিকায় পাঠিয়ে দেব । কাল থেকেই তুই ছবি তোলার অভিযানে নেমে যা, পিকু। সে আর বলতে হবে না।
সে রাতে বাংলোবাড়ির বারান্দায় চুপচাপ বসেছিল পিকু। বাতাসে অর্কিডের ঝড় দুলছে। বুনো মিষ্টি গন্ধ চারপাশে। আবদুল চাচা থেকে ডাকছে। পিকু রেডিওর নব ঘুরিয়ে দূরের কোনো একটা স্টেশন ধরার চেষ্টা করছে। ঝোপে জোনাক জ্বলছে। ঝিঁঝিদের একটানা ডাক। ঘন থিকথিকে অন্ধকার। একটা ট্রেন চলে যাওয়ার শব্দ শোনা গেল। রেডিওতে দূর ইউরোপের একটা স্টেশন ধরা গেল। বড় দিন উপলক্ষে গির্জার ক্যারল গান বাজছে। পিকুর বুকের ভেতরটা কেন জানি তখন টনটন করে উঠল। ডিমের ভেতরের হলুদ কুসুমের মতো একটা ইচ্ছে বুকে রিনরিন করছে। কিশোরবেলার কথা মনে পড়ছে। কাঁকনপুরের মিশন স্কুল। গির্জাঘরে পিয়ানো বাজিয়ে গান গাইত বব করা চুলের কিশোরী টুম্পা, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে, বিরাজো শুভ্র সুন্দর।’
টুম্পা যখন এই গানটি গাইত, তখন মনে হতো চারপাশে আলোর পাখিরা বুঝি উড়ছে। মনটা তখন কেমন স্নিগ্ধ হয়ে যেত। সেই টুম্পা ক্যান্সারে হঠাৎ করে মরে গেল একদিন।
পিকুর চোখের কোণাটা ভিজে আসছে। আবদুল চাচা পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
পিকু, খেতে আসবে না?
খিদে নেই আবদুল চাচা।
সেকি, সারাদিন টইটই করে বনে ঘুরলে। অনেক দূর পর্যন্ত গেলে। আর এখন কিনা বলছ খিদে পায়নি। তোমার জন্য নিমফুলের বড়া ভেজেছি। আর পুঁইলতা নদীর বিখ্যাত মহাশোলের ঝুড়ি বেঁধেছি।
আসছি আবদুল চাচা।
একি পিকু, তুমি কাঁদছ!
কই না তো।
তোমার চোখ ভেজা।
একটা পোকা পড়েছে বোধ হয়। এই দেখো, একটু সাবধানে থাকতে পারো না। বন-পাহাড়ে কত যে জংলি পোকা থাকে।
আবদুল চাচা গজগজ করতে করতে চলে গেল। মা মরা ছেলেটাকে ছোটবেলা থেকেই আগলে রেখেছে। পিকুর বাবা বেশির ভাগ সময়ই বাইরে থাকেন।
সে রাতে পিকু ঘুমিয়ে স্বপড়ব দেখল সে পুঁইলতা নদীর টলটলে পানিতে দাঁড়িয়ে এক মহাশোলের বাচ্চাকে ধরার চেষ্টা করছে। মাছটি রূপোলি ঝিলিক তুলে পানিতে কাঁপছে। পিকুর চোখে-মুখে ছিটকে এসে পড়ছে পাহাড়ি নদী পুঁইলতার শীতল পানি। আর সে সময় পাহাড় থেকে নেমে আসছে একটা কালো ভালুক। ভালুকটা থাবা বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে পিকুর দিকে। নদীতে ছপছপ শব্দ শুনে চমকে তাকাল পিকু। আর তখন দেখল ভালুকটা কেমন হিংস্র চোখে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। ঠিক ওই সময় ঘুম ভেঙে গেল পিকুর। আর তখনই কপাটে শব্দ করছে বনপলাশের শেষ রাতের বয়ে যাওয়া সেই রহস্যময় বাতাস। যে বাতাসে গাছগুলো শুধু পাতা খসিয়ে দেয় অবিরাম।
ঠিক সেই সময় বনপলাশ স্টেশনে শেষ রাতের ট্রেনটি এসে দাঁড়াল। হালকা কুয়াশার ভেতরে ট্রেন থেকে নামল এক লম্বা লোক। সবুজ শাল গায়ে দেয়া সেই লোকটার মাথায় একটা উলের টুপি। দুষ্প্রাপ্য কারাকুলাম ভেড়ার লোম থেকে তৈরি টুপিটি। লোকটি একটু ঝুঁকে হাঁটে। তার হাতে একটা কাপড়ের ব্যাগ। ট্রেনটি থেকে একলাই নামল সে। লোকটি এদিক-ওদিক তাকিয়ে স্টেশনের কোণার চা এর দোকানটার কাছে গেল। জিজ্ঞেস করল এই শহরের বন বিভাগের বড় সাহেবের বাংলোবাড়িটি কোন দিকে। যে বাড়ির ছেলের নাম পিকু।
চা দোকানদার বলল, সামনের কাঠের পুলটা পেরিয়ে গেলেই পাওয়া যাবে বাংলোবাড়িটি।
লোকটি কেমন জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে। তখন জলাভূমি থেকে উড়ে যাচ্ছে নীলশিরদের একটা বড় দল।
এখানে অনেক পাখি থাকে বুঝি?
চা-এর দোকানদার হাই তুলতে তুলতে বলল, শীতে মেলা পাখি আসে এখানে। নদীর মাছ, পোকা, সাপ, শামুক খায়।
এখানকার হাটে-বাজারে এসব পাখি পাওয়া যায়?
মাথা খারাপ, পাখি ধরা এখানে একদম নিষেধ। ওই পিকু সাহেব আর তার বন্ধুরা মিলে এখানে পাখি ধরা একদম বন্ধ করে দিয়েছে।
হুম, তাহলে এখানে পিকু সাহেবের খুব দাপট আছে বলে মনে হয়।
সাহসী ছেলে। সেদিন তো এক লোককে পাখি মারার জন্য থানায় নিয়ে যায় আর কি। শীতের পাখি মারা নাকি একদম বেআইনি কাজ।
সবুজ শাল গায়ে দেয়া লোকটি পিকুদের বাংলোবাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। পিকুর ঘরের জানলার কাচের শার্সিতে চিলচিলে রোদ এসে পড়েছে। কাঠের দরজার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে তাকিয়ে দেখল একটা লম্বা লোক তাদের বাগানে ঢুকছে। সবুজ শাল গায়ে দেখা লোকটির মাথায় উলের টুপি। প্রমেই অপছন্দ হলো পিকুর। কারণ লোকটি দুষ্প্রাপ্য একটি প্রাণীর লোমের তৈরি টুপি পরেছে। এই ধরনের টুপি পরার জন্য ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছিলেন। তৎকালীন ভারতের পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী মানেকা গান্ধী কঠোর সমালোচনা করে ভিপি সিংকে বাধ্য করেছিলেন মাথা থেকে উলের টুপিটি খুলতে। লোকটাকে দেখে তাই পিকু কেমন অস্বস্তি বোধ করল। তার কাছে এসেছে নাকি লোকটা?
পিকু বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।
কাকে চাই?
আমি এসেছি পিকু সাহেবের কাছে। আপনি বুঝি পিকু?
হ্যাঁ, তা আমার কাছে কি?
আমি এসেছি অনেক দূর থেকে। সারা রাত ট্রেন জার্নি করে এসেছি। শুধুমাত্র একটি পাখির খবর জানার জন্য। আমি জানি আপনি সেই পাখিটিকে দেখেছেন। সেই পাখিটার নাম হচ্ছে দুধরাজ, হিন্দিতে বলে শা বুলবুল। একদম দেখা যায় না পাখিটি। আমি অনেক দিন থেকে খুঁজছি।
কেন খুঁজছেন?
ওই দুধরাজ পাখির ডিমের জন্যে। আমার কাজ হলো গিয়ে ওই বিরল পাখিদের ডিম সংগ্রহ করা।
আশ্চর্য, আপনি এই ধরনের ডিম পান?
খুব কম পাই, বলতে গেলে পাই না। বন-বাদাড় সব সাফ হয়ে যাচ্ছে। একবার হঠাৎ করে গোড়াবান পাখির ডিম পেয়েছিলাম রাজস্থানে। ওই পাখিটা একদম বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। আমি ওই ডিম ফুটিয়ে ছানা বের করে বিরল পাখিদের হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে চাই। এটা আমার এক ধরনের নেশা বলতে পারেন। এই জন্যে বিভিন্ন জঙ্গলে কিন্তু কম ঘুরিনি ।
তা আপনি কি করে জানলেন যে আমি দুধরাজ দেখেছি।
জেনেছি, আপনি হোমা পাখি দেখতে পেরেছেন। ওই হোমা পাখি হলো গিয়ে দুধরাজ।
পিকু বুঝল, ঢাকার তমাল ভাইয়ের এই খবরটি পেয়ে এখানে এসেছে লোকটি।
আমি পাখিটিকে দেখেছি। কিন্তু এর বাসাটি এখনও খুঁজে পাইনি। তবে মনে হয় আজ খুঁজলে পেয়ে যাব। পাখিটি জঙ্গলের কোন দিকে উড়ে গিয়ে বসেছে তা কাল ভাল করে লক্ষ করেছি। ওই দিকটা তনড়ব-তনড়ব করে খুঁজলে বাসাটি পেয়ে যাব আশা করি। আমি কিন্তু খানিক পরই ওই পাখির খোঁজে বের হবো।
বাহ, আমি তাহলে ঠিক সময়ে এসে পড়েছি। আমিও যাব আপনার সঙ্গে। তা আপনি একটু বিশ্রাম করুন, আমি ততক্ষণে তৈরি হয়ে নেই।
খানিক পর দেখা গেল বনপলাশের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে পিকু আর সবুজ শাল গায়ে দেয়া সেই লোকটি। গাছের পাতার বুনোট পেরিয়ে রোদ নামতে পারছে না। তাই কেমন অবস্থা অন্ধকার বনপথে। পিকু বাইনোকুলার দিয়ে এদিক-ওদিক দেখছে।
ওই যে হোমা পাখি! পিকু উল্লাসে বলে উঠল।
নীল আকাশে রেশমি পালক উড়িয়ে পাখিটা এসে বসল শিরীষ গাছের ডালে। পিকু বাইনোকুলার দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেল গাছের পাতার ফাঁকে হোমা পাখির বাসাটিকে। সবুজ শাল গায়ে দেয়া সেই লোকটি ফিসফিস করে বলল, দুধরাজ পাখির বাসা।
পিকু টেলিলেন্স দিয়ে পাখিটার কয়েকটি ছবি তুলল।
বুঝলেন, পত্রিকায় যখন এ ছবি আর খবর ছাপা হবে, তখন দারুণ একটা ব্যাপার হবে।
পিকু তখন দেখল, লোকটির চোখ দু’টি বন বেড়ালের মতো ধকধক করে জ্বলছে। লোকটি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সেই শিরীষ গাছটির দিকে। পিকু এবার বলল, চলুন যাই। আমার কিছু বন্ধুকে গিয়ে বলতে হবে এই ঘটনা। আপনাকে তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। আমরা সবাই মিলে একটা পাখি দেখার সমিতি করেছি।
ভালোই হবে। আমি তাদের বলব পাখি দেখার অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। কত কষ্ট করে সংগ্রহ করছি বিরল পাখিদের ডিম।
ওরা দু’জন শুকনো শালপাতার উপর দিয়ে হাঁটতে থাকে। রূপোলি ঝিলিক তোলে আশ্চর্য সুন্দর দুধরাজ পাখিটা বনপলাশের জঙ্গলের ভেতরে তখনও উড়ছে।
সবুজ শাল গায়ে দেয়া লোকটি মুগ্ধ স্বরে বলে, স্বর্গীয় পাখি। এই পাখিকে দেখতে পারাটাও হলো গিয়ে ভীষণ ভাগ্যের ব্যাপার। না জানি কত পণ্যির ফলে আপনার দেখা পেয়েছিলাম, পিকু সাহেব। নইলে আমার মতো সামান্য মানুষ কি আর এমন স্বর্গীয় পাখির সন্ধান এভাবে কখনও পায়? জঙ্গলের বাইরে এসে লোকটি পিকুর কাছ থেকে বিদায় নিল।
সে রাতে ঢাকায় তমাল ভাইকে ফোন করল পিকু। জানালো হোমা পাখির ছবি তোলার কথা।
জানো তমাল ভাই। আজ একটা ব্যাপার হয়েছে। একটা লোক আজ ভোরে এসে বলল সে নাকি দুধরাজ ডিমের খোঁজে এসেছে। আমি বুঝতে পারলাম না, এ লোকটি আমার সন্ধান পেল কি করে?
লোকটির কপালে কি কোনো কাটা দাগ আছে?
তমাল ভাইয়ের কণ্ঠে উত্তেজনার ছোঁয়া।
হ্যাঁ, কাটা দাগ দেখেছি বলে মনে হয়।
সর্বনাশ, ওই লোকটি হলো গিয়ে কুখ্যাত পাখি চোরাচালানকারী বার্মিজ নাগরিক উ তুন। ও নিশ্চয়ই আমাদের ক্লাবের কারও কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করেছে। কয়দিন আগে ঢাকা বিমানবন্দরে কয়েক হাজার মুনিয়া পাখি চোরাচালান করার দায়ে পুলিশ তাকে খুঁজছে। অনেক মুনিয়া মারা গেছে সেই ঘটনায়। পত্রপত্রিকায় খবরটা ছাপা হয়েছিল। এই উ তুন লোকটা আসাম আর নেপালের জঙ্গল থেকে অনেক বিরল পাখি ধরে বিদেশে পাচার করেছে। তার নামে দুষ্প্রাপ্য পাখি চোরাচালানের অনেকগুলো কেস ঝুলছে। সর্বনাশ হয়েছে তমাল ভাই। আমি যে লোকটাকে দুধরাজ পাখির বাসা চিনিয়ে দিয়েছি।
ভোর হতেই পিকু দৌড়ে গেল বনপলাশের জঙ্গলের ভেতর। সেই শিরীষ গাছটার কাছে গিয়ে দেখল, গাছের নিচে দুধরাজ পাখিটির বাসা ভেঙে দুমড়ে পড়ে আছে। পাশে নাইলের কর্ড। বাসায় কোনো ডিম নেই। শুধু সবুজ ঘাসের উপর পড়ে আছে কিছু রেশমি কোমল পালক।
শিরশিরে বাতাসে পালকগুলো পাক খেয়ে উড়ে গেল। ততক্ষণে চোখ ভিজে এসেছে পিকুর। ওর তখন মনে হচ্ছিল কাঁকনপুরের মিশন স্কুলের বব চুলের কিশোরী টুম্পার কথা। পিয়ানোর রিডে আঙুল রেখে যে বিষনড়ব কণ্ঠে বলেছিল, আসলে কেউ কাউকে ভালোবাসে নারে পিকু।

Share.

মন্তব্য করুন