ঈদ আনন্দের সাথে তোমরা সবাই পরিচিত। ঈদ মানে খুশি। বছর ঘুরে এই ঈদ উৎসব আমাদের জীবনে বয়ে আনে অনাবিল আনন্দ। মহান স্রষ্টা মুসলমানদের জন্য বছরে দু’টি খুশির দিন নির্ধারণ করেছেন, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। আজ আমি তোমাদের ঈদুল আজহার কাহিনী শোনাবো।
ঈদুল আজহাকে আমরা সবাই কোরবানির ঈদ বলে জানি। কোরবানি মানে কী, তা দিয়েই কাহিনীটা শুরু করতে চাই। ‘কোরবানি’ আরবি শব্দ। আরবি ‘কুরবুন’ বা ‘কুরবানুন’ থেকে এর উৎপত্তি, যার অর্থ নৈকট্য, উৎসর্গ, ত্যাগ ইত্যাদি। অতএব কোরবানি বলতে আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে তাঁরই দেওয়া বিধান অনুযায়ী ত্যাগ বা উৎসর্গ করাকে বুঝি। ঈদেত আমরা আনন্দ করি, নতুন নতুন জামা-কাপড় পরি আর যতসব মজার খাবার খেয়ে তৃপ্তি পাই। অথচ এই আনন্দময় ঈদটার সাথে ত্যাগের সম্পর্কটা কী তা আমাদের জানতে হবে বৈকি! তা হলে চলো, শুনি সেই ইতিহাসটা!
কোরবানির এই ইতিহাসটা বেশ পুরনো। দুনিয়ার প্রথম মানব হজরত আদম আ.-এর সময় থেকেই কোরবানি চলে আসছে। তারপর সকল নবী-রাসূলের সময়ে তো বটেই, শেষনবী হজরত মুহাম্মদ সা.-এর আমলেও কোরবানির নিয়ম প্রচলিত ছিল।
আল-কুরআনে সূরা মায়েদার ২৭ নম্বর আয়াতের আদম আ.-এর দুই ছেলের কোরবানির ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘আর তাদেরকে আদমের দুই ছেলের সঠিক কাহিনী শুনিয়ে দাও। তারা দু’জন কোরবানি করলে তাদের একজনের কোরবানি কবুল করা হলো। অন্য জনেরটা কবুল করা হলো না।’ তবে ঐ কোরবানির ঘটনার সাথে ঈদুল আজহার কোরবানির প্রেক্ষাপট একেবারেই আলাদা। বর্তমানে যে কোরবানি প্রচলিত আছে তা মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আ.-এর প্রাণাধিক প্রিয়পুত্র হজরত ইসমাইল আ.-কে কোরবানি করার ঘটনার সাথে জড়িত।
হজরত ইবরাহিম আ.-এর সুন্নাত হিসেবে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয় আরবি জিলহজ মাসের ১০ তারিখ। ঈদুল আজহার নামাজ জিলহজ মাসের ১০ তারিখে নির্ধারিত থাকলেও জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ এই তিনদিনকে হালাল পশু কোরবানির বিধান রয়েছে ইসলামে। আরবি জিলহজ মাসে ঈদুল আজহা পালিত হয় বলে মহান আল্লাহ এই মাসকে মর্যাদাবান বলে আখ্যায়িত করেছেন। মহান আল্লাহতাআলা বলেছেন, ‘হে আদম সন্তান! আল্লাহতাআলা জিলহজ মাসকে অত্যন্ত মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। সুতরাং তোমাদের উচিত এ মাসের মাহাত্ম্য ও মর্যাদার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং হাঁটা-চলা-ফেরা, আরোহণ ও পদব্রজ অর্থাৎ জীবনের সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করা।’
বন্ধুরা, তা হলে এবার শুনি হজরত ইবরাহিম (আ)-এর সেই কোরবানির ঘটনা, যা আজও মুসলিম জাতি অতি পবিত্রতা ও শ্রদ্ধার সাথে আমল করে আসছে। আল্লাহর একজন প্রিয় নবী ছিলেন হজরত ইবরাহিম আ.। ইরাকের এক পুরোহিত পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম আজর এবং মাতার নাম আদনা। পিতা ছিলেন মূর্তিপূজারি। কিন্তু ইবরাহিম আ. সত্যকে গ্রহণ করে আল্লাহর প্রিয়পাত্রে পরিণত হন। এ জন্য নিজের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এবং তখনকার বাদশাহ নমরুদের চক্ষুশূলে পরিণত হন তিনি। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ইবরাহিম আ.-কে আগুনে পুড়ে মারার সিদ্ধান্ত নিলো। তারপর আগুনে ফেলাও হলো তাঁকে। তবে মহান আল্লাহর বিশেষ রহমতে তিনি বেঁচে যান। এটা ছিল নবী ইবরাহিম আ. এর ওপর এক কঠিন পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হলেও আত্মীয়-স্বজন ও স্বীয় জাতির লোকদের ব্যবহারে তিনি নিরাশ হয়ে পড়লেন। তাই ইবরাহিম আ. দেশ ত্যাগ করলেন। সিরিয়া ও মিসর ঘুরে তিনি ফিলিস্তিনে গিয়ে ইসলাম প্রচার করতে লাগলেন।
ইবরাহিম আ.-এর বৃদ্ধ বয়সে তাঁর স্ত্রী হাজেরার ঘরে এলো এক পুত্রসন্তান। তাঁর নাম রাখা হলো হজরত ইসমাইল। দেখতে দেখতে পুত্র ইসমাইল আ. বড় হলেন। এমন সময় ইবরাহিম আ. আরেক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। একরাতে স্বপ্নযোগে তাঁর ওপর মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রিয়বস্তু কোরবানি করার এক নির্দেশ এলো। এ জন্য ইবরাহিম আ. একশত দুম্বা কোরবানি করে দিলেন। পরের রাতে আবার একই স্বপ্ন দেখার পর ইবরাহিম আ. একশত উট কোরবানি করে দিলেন। তাতেও কাজ হলো না। আবার নির্দেশ এলো, ‘তুমি তোমার প্রিয় বস্তুকে কোরবানি কর।’
হজরত ইবরাহিম আ. এবার ভাবনায় পড়ে গেলেন। তবে তাঁর বুঝতে বাকি রইল না যে, একমাত্র প্রিয় পুত্র ইসমাইলই আ. -কে কোরবানি করা ছাড়া তাঁর সামনে কোনো পথ নেই। পুত্রকে কোরবানি করার জন্য ইবরাহিম আ. মনস্থির করলেন। একদিন তিনি পুত্রকে ডেকে তাঁর স্বপ্নের কথা খুলে বললেন এবং তাঁর মতামত জানতে চাইলেন। বালক ইসমাইল আ. পিতার কথা শুনে অবাক হলেন না। তিনি আল্লাহর খুশির জন্য নিজে কোরবানি হতে রাজি হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, ‘হে পিতা! আপনি যে আদেশ পেয়েছেন তা বাস্তবায়ন করুন, ইনশাআল্লাহ আমাকে ধৈর্যশীলদের মাঝে পাবেন।’
হজরত ইবরাহিম আ. প্রিয় পুত্রকে কোরবানি করার জন্য স্ত্রী হাজেরাসহ রওয়ানা হলেন। মক্কার অদূরে মিনা প্রান্তরে গিয়ে তিনি পুত্রের চোখ বেঁধে ফেললেন। তারপর ইবরাহিম আ. ইসমাইলের গলায় ছুরিত চালালেন। কিন্তু প্রথম চেষ্টায় তিনি ব্যর্থ হলেন। পুত্র ইসমাইল আ.-এর পরামর্শে ইবরাহিম আ. পুত্রকে উপুড় করিয়ে চোখ বন্ধ করে আবার ছুরি চালালেন। কি ভয়ানক ঘটনা, তাই না! তবে মহান আল্লাহর কি শান! চোখ খুলেই ইবরাহিম আ. দেখতে পেলেন একটি দুম্বা জবেহ হয়ে পড়ে আছে, আর পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন প্রাণাধিক পুত্র ইসমাইল আ.।
হজরত ইবরাহিম আ. প্রিয় পুত্রকে কোরবানি করার যে উপমা পেশ করলেন, তা ছিল সত্যিই অভাবনীয়। এটা ছিল মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি হজরত ইবরাহিম আ.-এর ত্যাগ ও ভালোবাসার পরম নিদর্শন। ইবরাহিম আ.-এর এই কোরবানির কারণে মহান আল্লাহ অত্যন্ত খুশি হলেন। এই ঘটনার মাধ্যমে ইবরাহিম আ. ‘খলিলুল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত হলেন। খলিলুল্লাহ মানে আল্লাহর বন্ধু। হজরত ইবরাহিম আ.-এর কোরবানির এই ঘটনাকে চির অম্লান রাখার জন্য মহান আল্লাহ সচ্ছল মুসলমানদের জন্য প্রতি বছর ১০ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনদিন হালাল পশু কোরবানি ওয়াজিব করে দিয়েছেন। সূরা আল-কাউসারে আল্লাহতাআলা বলেছেন, ‘তোমার রবের জন্য সালাত আদায় কর এবং কোরবানি কর।’
এ প্রসঙ্গে এক হাদিসে বলা হয়েছে, হজরত যায়েদ ইবনে আরকাম রা. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, একবার সাহাবীগণ আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এ কোরবানি কী?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘এটা তোমার পিতা হজরত ইবরাহিমের সুনড়বাত।’ (ইবনে মাজাহ ও আহমাদ) কোরবানির গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে মহানবী সা. আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোরবানি দেবে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ হজরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত অন্য এক হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন, ‘কোরবানির দিন মানুষ যে কাজ করে তার মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক পছন্দনীয় হচ্ছে রক্ত প্রবাহিত করা (কোরবানি করা।)’ রাসূল সা. আরও বলেন, ‘কোরবানির পশুর রক্ত জমিনে পরার আগেই আল্লাহর কাছে এক বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। অতএব, তোমরা আনন্দ মনে কোরবানি কর।’
প্রিয় বন্ধুরা, আশা করি কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহার পেছনের ঘটনা তোমাদের কাছে পরিষ্কার হয়েছে। আমরা জানতে পারলাম, আল্লাহর আদেশ পালনে আল্লাহর নবী ইবরাহিম আ. কত আন্তরিক ও অটল-অবিচল ছিলেন। ওদিকে হজরত ইসমাইল আ.-ও পিতার আনুগত্য ও আল্লাহর নির্দেশ পালনে ছিলেন আপোসহীন। পিতার আদেশ পালন করে মহান আল্লাহর খুশির জন্য নিজের জীবনকেও হাসিমুখে বিলিয়ে দিতে ইসমাইল আ. দ্বিধাবোধ করেননি। ঈদুল আজহার খুশির দিনে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, এটা সত্যিকারের কোরবানির দিন, মহান ত্যাগের দিন।
ছোট্ট বন্ধুরা! আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ স্বীকার করার যে শিক্ষা আমরা ইবরাহিম আ. ও ইসমাইল আ.-এর ঘটনার মধ্য দিয়ে পাই, তা আমাদের সবার জীবনে কাজে লাগাতে হবে। ঈদের খুশি তখনই সার্থক হবে, যখন আমরা ঈদুল আজহার থেকে সঠিক শিক্ষা লাভ করতে পারব। আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করবো। নিজের প্রিয় বস্তু হলেও প্রয়োজনে তা গরিব দুঃখী ও অভাবী মানুষের জন্য বিলিয়ে দেবো। পরিশেষে এই কামনা করি, ঈদুল আজহা যেন সবার জন্য বয়ে আনে অনাবিল আনন্দ। ত্যাগের মহিমায় এই ঈদ হউক আমাদের জীবন চলার পাথেয়। ঈদের নির্মল আনন্দ উপভোগ করে একটি সুন্দর জীবনের পথে আমরা সবাই এগিয়ে যাবো-এটাই হউক আমাদের দৃপ্ত অঙ্গীকার।

Share.

মন্তব্য করুন