‘আমাদের জন্য এটি গর্বের বিষয় যে আমাদের দলে সাকিব আল হাসানের মতো খেলোয়াড় রয়েছেন। সে একজন পরিপূর্ণ ক্রিকেটার। ব্যাটিং, বোলিং কিংবা ফিল্ডিং; সব দিকেই সাকিব সেরাদের একজন।’ এবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপের মাঝপথে সংবাদ মাধ্যমের কাছে এই উক্তিটি করেছিলেন জাতীয় দলের স্পিন বোলিং কোচ ও ভারতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার সুনীল যোশি।
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার মাইক হাসি তো সাকিবকে বিশ্বকাপের সেরা তারকা হিসেবেই ঘোষণা দিয়েছেন। শুধু যোশী কিংবা হাসি নয়, এবারের বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসান যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন তাতে সারা বিশ্বই মুগ্ধ। অনেক দিন ধরেই ক্রিকেট বিশ্বে অলরাউন্ডার হিসেবে সাকিব অপ্রতিদ্বন্দ্বী। র‌্যাংকিংয়ে তার আশপাশে যারা আছে তারা কেই তার সমমানের নন। তবু এই বিশ্বকাপে রেকর্ড বইয়ের অনেকগুলো পাতা উল্টে-পাল্টে দিয়েছেন সাকিব আল হাসান। বিশ্বকাপের ইতিহাসেই ব্যাটে-বলে এমন অলরাউন্ড নৈপুণ্য আর কেউ দেখাতে পারেননি। বিশ্বকাপ শেষে আইসিসির বিশেষজ্ঞ প্যানেল যে বিশ্বকাপের সেরা একাদশ বেছে নিয়েছে সেখানেও স্থান পেয়েছেন এই টাইগার অলরাউন্ডার। শুধু বাংলাদেশ নয়, ক্রিকেট ইতিহাসেরই সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডাদের তালিকায় সাকিব আল হাসানকে রাখতে হবে যে কোন সময়।
অভিষেকের পর থেকেই সাকিব আল হাসান ক্রমশই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন দলের অপরিহার্য সদস্য হিসেবে। ব্যাট, বল দুই ভূমিকাতেই দলকে জয় এনে দিয়েছেন অনেক ম্যাচে। ২০০৬ সালে জাতীয় দলে অভিষেকের পর থেকে অনেক রেকর্ড একে একে দখলে নিয়েছেন। আইসিসির র‌্যাঙ্কিংয়ে সব ফরম্যাটেই সেরা অলরাউন্ডার ছিলেন একাধিক বার; কিন্তু বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে ঠিক এতটা জ্বলে উঠতে পারেননি আগের আসরগুলোতে। এবার যেন সাকিব পণ করেই মাঠে নেমেছিলেন নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করতে। বিশ্ব ক্রিকেটও এবার যেন নতুন করে চিনেছে সাকিব আল হাসানকে। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হিসেবে। এখন অপেক্ষা আরো বড় কিছুর।

হঠাৎ তিনে সাকিব
বিশ্বকাপের আগে হঠাৎ করেই ঘোষণা এলো সাকিব আল হাসান তিন নম্বরে ব্যাটিং করবেন। বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডারের তিন নম্বর পজিশন নিয়ে সঙ্কট অনেক দিনের। গত ১০ বছরে বেশ কয়েকজনকে দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে এই পজিশনে থিতু হওয়ার; কিন্তু কেউ পারেননি। ওয়ানডে ক্রিকেটে তিন নম্বর পজিশনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কখনো দ্রুত উইকেট পড়ে গেলে নতুন বলেই ব্যাটিং করতে হয়, আবার উদ্বোধনী জুটি বড় হলে ইনিংসের মাঝপথে নেমে পুরনো বলে ইনিংস গড়ার কাজ করতে হয়। অর্থাৎ ওপেনার ও মিডল অর্ডার দুই ভূমিকাতেই ব্যাট করতে জানতে হয় তিন নম্বরকে। তাই এই পজিশনে সাধারণত দলের সেরা ব্যাটসম্যানকেই পাঠানো হয়। ভারতের বিরাট কোহলি, নিউজিল্যান্ডের কেন উইলিয়ামসন, পাকিস্তানের বাবর আজম, ইংল্যান্ডের জো রুট, দক্ষিণ আফ্রিকার ফাফ ডু প্লেসিস, অস্ট্রেলিয়ার স্টিভ স্মিথ নিজ নিজ দলের তিন নম্বরে ব্যাটিং করেন।
বাংলাদেশ দল অনেক দিন ধরেই তিন নম্বরে যোগ্য কাউকে খুঁজে পাচ্ছিল না। বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলতে যাওয়ার আগে ক্রিকেট বোর্ড থেকে জানানো হয় এখন থেকে সাকিব আল হাসান ওয়ানডেতে তিন নম্বরে ব্যাটিং করবেন (টেস্টে তিনে ব্যাট করেন মুমিনুল হক)। সেই সিরিজে তিন ম্যাচে দুটি অপরাজিত হাফ সেঞ্চুরির ইনিংস খেলে ভক্তদের আশ্বস্ত করেন সাকিব। অনেক দিনের তিন নম্বরের শূন্যতা পুরনের স্বপড়ব বুঝি ধরা দিল! এরপর বিশ্বকাপে যা করলেন তা তো সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিল। অথচ সাকিব নিজেই বলেছেন, তিন নম্বরে তার ব্যাটিং করার প্রস্তাবে শুরুতে রাজি হয়নি টিম ম্যানেজমেন্ট। এর জন্য অনেককে বুঝিয়ে রাজি করাতে হয়েছে তাকে। এখন কী আফসোসটাই না হচ্ছে সবার। সাকিব আরো আগে এই পজিশনে ব্যাটিং করা শুরু করলে তার কাছ থেকে অনেকগুলো সেঞ্চুরি হয়তো পাওয়া হতো। ৫-৬ নম্বরে ব্যাটিং করে তো আর বড় ইনিংস খেলার সুযোগ পাওয়া যায় না খুব একটা।

আমাদের সাকিব বিশ্বসেরা সাকিব । আহমেদ ইবনে হাবিববিশ্বকাপে সাকিব
সাকিব আল হাসানের ক্যারিয়ারের চতুর্ বিশ্বকাপ ছিলো এবারের ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপে খেলতে গেছেন ওয়ানডের এক নম্বর অলরাউন্ডার হিসেবেই। ২০০৭ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপের মাঠে নেমেছিলেন। ২০১১ সালে দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে নিজেই নেতৃত্ব দিয়েছেন দলকে।
অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে ২০১৫ বিশ্বকাপে ছিলেন দলের সিনিয়র সদস্য। আগের সবগুলো বিশ্বকাপেই সাকিব শুরু করেছিলেন হাফ সেঞ্চুরি দিয়ে। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই ৭৫ রানের ঝলমলে একটি ইনিংস খেলে জানান দেন এবার তিনি আরো পরিপূর্ণ হয়ে এসেছেন।
পরের ম্যাচে আবারো ৬৪ রানের ইনিংস নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। এরপর টানা দুটো সেঞ্চুরি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১২১ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অপরাজিত ১২৪ রানের ইনিংস। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪১ রানে আউট হওয়ার পর শেষ তিন ম্যাচে আবার টানা তিন হাফ সেঞ্চুরি। সব মিলে ৮ ম্যাচে ৮৬ গড়ে ৬০৬ রান। এতো গেল রানের কথা। বল হাতেও সাকিব আল হাসান ছিলেন সফল। নিয়েছেন মোট ১১ উইকেট। বলতে গেলে একাই দলকে টেনে নিয়েছেন এই কৃতি অলরাউন্ডার। অন্য ক্রিকেটারা তার সাথে তাল মিলিয়ে খেলতে পারলে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ফলাফলটা অন্যরকম হতে পারতো।

রেকর্ড বইয়ে ওলট-পালট
বিশ্বকাপের এক আসরে কোন ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ রান ৬৭৩। ২০০৩ সালে ১১ ম্যাচ খেলে এই রান করেছিলেন ভারতের শচীন টেন্ডুলকার। সাকিব আল হাসান এবার ম্যাচ খেলেছেন ৮টি। শ্রীলঙ্কার সাথে ম্যাচটি বৃষ্টিতে বাতিল না হলে কিংবা বাংলাদেশ সেমিফাইনালে উঠতে পারলে সাকিব হয়তো ছাড়িয়ে যেতে পারতেন দ্য গ্রেট শচীনকে। তবে সেই রেকর্ড না হলেও এমনিতে যা হয়েছে তাই বা কম কিসে? শচীন শুধু ব্যাট হাতে দলকে টেনেছেন, আর সাকিব ছয় শতাধিক রান করার পাশাপাশি উইকেটও নিয়েছেন ১১টি।
বিশ্বকাপের এক আসরে ছয় শ’ রান আর ১০ বা তার বেশি উইকেট নেয়ার নজির আর কেউ গড়তে পারেননি। তবু সাকিব আল হাসান ম্যান অব দ্যা টুর্নমেন্টের পুরস্কার জিততে পারেনি দলীয় ব্যর্থতার কারণে। দল হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো বিশ্বকাপের পয়েন্ট টেবিলে ৮ নম্বরে।
উদারহণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছিলেন সনথ জয়সুরিয়া, সেবার চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল শ্রীলঙ্কা; ব্যাট হাতে ২২১ রানের সাথে ৭টি উইকেট নেন শ্রীলঙ্কান এই ক্রিকেটার। ১৯৯৯ সালে ম্যান অফ দ্যা টুর্নামেন্ট হন ল্যান্স ক্লুজনার, তার দল দক্ষিণ আফ্রিকা সেমিফাইনালে নাটকীয়ভাবে হেরে যায়; সেবার ২৮১ রান করার পাশাপাশি ক্লুজনার নিয়েছিলেন ১৭টি উইকেট। ২০১১ সালে যুবরাজ সিং ৩৬২ রান ও ১৫ উইকেট নিয়ে বিশ্বকাপের সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন, সেবার বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। এ থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, সাকিব বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন।
বিশ্বকাপের এক আসরে ৭ বার পঞ্চাশ বা তার বেশি রানের ইনিংস খেলেছিলেন শচীন ২০০৩ সালে (১১ ম্যাচে)। সাকিব এবার সেই রেকর্ড স্পর্শ করেন ৮ ম্যাচ খেলেই। কাজেই বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসান কী করেছেন তা এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যাচ্ছে। এসবের পাশাপাশি তামিম ইকবালের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশী হিসেবে ওয়ানডেতে ছয় হাজার রান পূর্ণ করেছেন বিশ্বকাপেই।

সর্বকালের সেরার পথে
সব মিলে এবারের বিশ্বকাপ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিব আল হাসানের সংগ্রহ ১১ হাজার ৬০১ রান (টেস্ট, ওডিআই ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে)। পাশাপাশি উইকেট সংখ্যা ৫৫৩টি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০ হাজার রান ও ৫০০ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব আগে ছিল শুধু জ্যাক ক্যালিস ও শহীদ আফ্রিদির। তৃতীয় অলরাউন্ডার হিসেবে তালিকায় যুক্ত হয়েছেন সাকিব। তার মধ্যে আফ্রিদিকে সাকিব ইতোমধ্যেই ছাড়িয়ে গেছেন। এখন রয়েছেন ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে। বয়স ৩২। আরো ৭/৮ বছর সুস্থতার সাথে খেলে যেতে পারলে যে ক্যালিসকেও ছাড়িয়ে যাবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর তাহলে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে সাকিব আল হাসানকে স্বীকৃতি দিতে এতটুকু কার্পণ্য করার সুযোগ থাকবে না।

এক নজরে সাকিব
১৯৮৭ সালের ২৪ মার্চ মাগুরায় জন্ম সাকিব আল হাসানের। বাবা চেয়েছিলেন ছেলে ফুটবলার হোক; কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক ছিল তার প্রচুর। শৈশবে একবার সাকিবের বাবা রাগ করে তার ব্যাট কেটেও ফেলেছিলেন। তবে ছেলের অদম্য আগ্রহ দেখে এক পর্যায়ে তিনি রাজি হয়ে যান। এরপর সাভারের বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ পান সাকিব। আর জাতীয় পর্যায়ে তার খেলা শুরু অনূর্ধ-১৯ দলের হয়ে ২০০৫ সালে। পরের বছর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে ওয়ানডে দিয়ে লাল-সবুজ জার্সিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক তার। এরপর খেলে গেছেন ধারাবাহিকভাবে। ছুটি কিংবা ইনজুরি ছাড়া কখনো বাদ পড়েননি দল থেকে। শুরুর দিকে খেলতেন মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে। দলের প্রয়োজনে টুকটাক বোলিং করতেন। ২০০৮ সালে চট্টগ্রামে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে কোচ জিমি সিডন্স সাকিবকে স্পেশালিস্ট স্পিনার হিসেবে খেলানোর ঘোষণা দেন। সেখান থেকেই মূলত অলরাউন্ডার সাকিবের যাত্রা শুরু।

Share.

মন্তব্য করুন