সাজু আজ স্কুল থেকে ফিরে কিছু খায়নি। ঘরে বাটিতে তার জন্য জল দেয়া ভাত ছিল। প্রতিদিন ফিরেই তার জন্য মায়ের বেড়ে রাখা ভাত খেয়ে নেয়। কিন্তু আজ খায়নি। ঘরে ঢুকেই সাজুর মা দেখলো সাজু বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে।
অন্যদিন হলে সে এসেই খেলতে চলে যায়। কিন্তু আজ যায়নি দেখে ওর মা বেশ অবাক হলো। কাছে গিয়ে সাজুর গায়ে হাত দিলো। সাজু একমনে ছিল। হঠাৎ স্পর্শ পেয়ে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে মা। সাজুর চোখ ভেজা ছিল। ওর মা স্পষ্ট বুঝতে পারলো সাজু অনেকক্ষণ কেঁদেছে।
কি রে সাজু ভাত খাসনি কেন?
সাজু কোনো কথা না বলে মার কোলে মুখ গুঁজে দিলো।
স্কুলে মারামারি করেছিস?
উঁহু।
তাহলে কাঁদছিস কেন?
কোন উত্তর দেয় না।
মা আমাকে একটা স্কুল ব্যাগ কিনে দেবে? আমার বন্ধুরা সবাই ব্যাগে করে বই নিয়ে যায়। আমারও যদি একটা ব্যাগ থাকতো বেশ ভালো হতো না মা?
ওর মা চুপ করে থাকে। চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। সাজুর বাবার আর্থিক অবস্থা একেবারে খারাপ। ওর বাবা একটা নসিমন চালাতো। মাস তিনেক আগে নসিমন দুর্ঘটনায় পড়লে ওর বাবার ডান পায়ে গুরুতর আঘাত লাগে। গোড়ালির হাড় ফেটে যায়। সেই চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে সংসারের অনেক কিছুই বিক্রি করে দিতে হয়। শেষমেশ ওর মা এক বাড়িতে কাজ নেয়। একদিকে ওর বাবার চিকিৎসা ব্যয় জোগান অন্যদিকে সংসারের খরচ। সবমিলিয়ে সাজুর লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কোনোমতে সাজুর লেখাপড়া ওর মা চালিয়ে নিচ্ছে। বেশি দাম না হলেও এই সামান্য আবদার মেটানোর ক্ষমতাও ওর মার নেই। সাজুও এটা বোঝে। ছেলেমানুষি মন কতক্ষণ আর নিজেকেআটকে রাখতে পারে। ওর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুরাদ। মুরাদের সাথেই ও স্কুলে যায়। মুরাদরা দুই ভাই। ওরা প্রতিদিন কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যায়।
স্কুল ব্যাগ । অলোক আচার্যদেখতে কী যে ভালো লাগে! একটা ব্যাগের জন্য তখন ওর প্রাণটা আনচান করে ওঠে। মনে মনে ভাবে ওরও যদি একটা স্কুল ব্যাগ থাকতো তাহলে বেশ হতো! মুরাদের মতো সাজুও সব বই ব্যাগের ভেতর নিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে স্কুলে যেতো। তা ছাড়া এখন ও ক্লাস ফাইভে পড়ে। কয়েকদিন পরেই ও হাইস্কুলে যাবে। তখন তো ও বড় হয়ে যাবে।
ওখানে সব বড়রা লেখাপড়া করে। ওর যদি তখনও একটা স্কুল ব্যাগ না থাকে লজ্জার শেষ থাকবে না; মাঝে মাঝে মনে হয় মুরাদের কাছে একটা পুরাতন স্কুল ব্যাগ চেয়ে নেবে। ওর তো অনেক পুরাতন ব্যাগ আছে। সেখান থেকে একটা দিলে এমন কিছু ক্ষতি হবে না। শেষ পর্যন্ত মুরাদের কাছে আর ব্যাগ চাওয়া হয়ে ওঠেনি সাজুর। পাছে ওর মা লজ্জা পায়। সাজু ওর মাকে খুব ভালোবাসে। সে কিছুতেই ওর মার কষ্ট চায় না। গত কয়েকদিন ধরেই সাজু একটা স্কুল ব্যাগ কেনার জন্য বায়না করছে। সামনেই সাজুর জন্মদিন ছিল। প্রতি বছর সাজুর জন্মদিনে সাজুর বাবা কিছু না কিছু উপহার দেয় তাকে। গত জন্মদিনেই সাজুকে একটা সুন্দর লাল রংয়ের হাফ প্যান্ট কিনে দিয়েছে। কিন্তু এবারের কথা ভিন্ন। ওর বাবা তো অসুস্থ। মার তো দেয়ার মত সামর্থ্য নেই। সাজু চুপচাপ থাকে। কিছু মাকে বলে না। মন খারাপ করে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে। সাজুর মা সব বুঝতে পারে। কিন্তু তার কি-ই বা করার আছে। তার ভাগ্যই তাকে আজ এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। সত্যি সত্যি সাজুর জন্মদিনে মা তার জন্য একটা নতুন ব্যাগ কিনে আনে। ব্যাগ পেয়ে সে আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরে। জন্মদিনে সকালে সাজুর মা টাকা জোগাড়ের জন্য বের হয়।
তারপর একজনের সহায়তায় নিজের একব্যাগ রক্ত বিক্রি করে। সেই রক্ত বিক্রি করার টাকা দিয়ে সাজুর জন্য ব্যাগ কিনে বাড়ি ফেরে। সেদিন রাতে সাজু ব্যাগে বইগুলো গুছিয়ে মাথার পাশে রেখে ঘুমাতে যায়। মাকে জড়িয়ে ধরে সে স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের দেখে মার হাত ধরে সে অনেক দূরে হেঁটে যাচ্ছে। তার কাঁধে মার কিনে দেয়া ব্যাগ। সাজু যখন ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল ওর মা তখন ছেলেকে জড়িয়ে ধরে স্বপ্ন দেখছিল। সেই স্বপড়ব ঘুমিয়ে না জেগে। তার ছেলে একদিন অনেক দূরে যাবে অনেক…।

Share.

মন্তব্য করুন