গাড়িটা আস্তে-ধীরে এগিয়ে প্রায় মেয়েটির গা ঘেঁষে ব্রেক করলো। মাথার ওপর জ্বলজ্বলে রোদ- গাছের ছায়ায় ছায়ায় হাঁটছিলো মেয়েটি। শাহবাগ থেকে সে যাচ্ছে আজিমপুরের দিকে। গাড়ি দেখে চমকে উঠলো মেয়েটি। বড় বড় চোখ করে তাকালো গাড়িতে বসা ভদ্রমহিলার দিকে। মেয়েটির হাতে ফুল। দুটো গোলাপের সাথে একটি কুঁড়ি। ভদ্রমহিলা হাসলেন। বললেন, ফুল বিক্রি করবে? তোমার ফুলগুলো বেশ সুন্দর লাগছে।
– না। এ ফুল আমি বিক্রি করবো না।
– তা’হলে ফুল নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?
– আজিমপুর কবরস্থানে। আমার মায়ের কবরে ফুল দিতে।
ভদ্রমহিলার স্বামী সাজ্জাদ সাহেব বললেন, আবিদা ও কী বলছে শুনেছো? এতটুকু মেয়ে অথচ তার মায়ের প্রতি এতোটাই ভক্তি-শ্রদ্ধা যে সে তার মায়ের কবরে ফুল দিতে যাচ্ছে। আমরা কখনো কি আমাদের মা-বাবার মৃত্যু-দিনের কথা ভাবি! আবিদা ম্যাডাম সে কথার উত্তর না দিয়ে মেয়েটিকে বললো, আজ কি তোমার মায়ের মৃত্যু দিবস?
– হ্যাঁ। দু’বছর আগে এই দিনে মা আমাদের ছেড়ে চলে যায়।
– তোমার নাম কী?
– আমার নাম মাহিরুন।
আবিদা ম্যাডাম গাড়ির দরজা খুলে বললেন, গাড়িতে ওঠো। আমরা ঐদিকেই যাচ্ছি, তোমাকে কবরস্থানে নামিয়ে দিবো। তা ছাড়া তোমার সঙ্গে অনেক গল্পও করবো। এর আগেও তোমাকে ফুল বিক্রি করতে দেখেছি। মাহিরুন বললো, খালাম্মা আমি হেঁটেই যেতে পারবো।
– বাঘের মতো রোদ্দুর, তোমার গরম লেগে যেতে পারে। তোমার
বাবা কী করেন?
– বাবা রিক্সা চালায়।
– আর কেউ আছে?
– আমার একটা বড় ভাই আছে, সে মোটর গ্যারেজে কাজ করে।
– গাড়িতে ওঠো তোমাকে কবরস্থানে নামিয়ে দেবো। তুমি এখন আর ফুল বিক্রি করো না?
– করি তো।
– তোমাকে দেখেছি কয়েকবার। কথা বলতে চেয়েছি কিন্তু সুযোগ হয়নি। অনেকদিন পর আজ তোমার হাতে ফুল দেখে ছুটে এলাম।
মেয়েটি চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, কিছু মনে করবেন না- আজকাল কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। শহরে প্রতিদিন আমাদের মতো মেয়েরা চুরি হয়ে যাচ্ছে।
দুষ্টু লোকেরা ছেলে-মেয়েদের ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করছে। আবার এ কথাও শুনেছি যে, ছেলে-মেয়েদের অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে কিডনি নিয়ে নেয়। সেই কিডনি অনেক টাকায় বিক্রি করে অন্য লোকদের কাছে।
আবার বিদেশেও পাচার করে দেয় মেয়েদের। যারা এই সমস্ত কাজ করে তারা কি মানুষ না জানোয়ার! মেয়েটির কথা শুনে সাজ্জাদ সাহেব বললেন, মা তুমি ঠিক কথাই বলেছো। আমাদের সমাজে এসব জঘন্য কাজ প্রায়ই হচ্ছে। তোমার কথা শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। বোকা আর লোভী ছেলে-মেয়েরাই খারাপ লোকদের খপ্পরে পড়ে জীবন হারায়। এই কথাগুলো তুমি তোমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবীদের কাছেও বলো। লোভ মানুষকে ধ্বংসের পথে ডেকে নিয়ে যায়। আবিদা ম্যাডাম বললেন, মাহিরুন তোমার বুদ্ধি দেখে আমি অবাক হচ্ছি। তোমার বয়স কতো হবে? মাহিরুন বললো এগারো বছর চলছে।
– তোমার নাম কে রেখেছিলো?
– আমার মা।
– তুমি কি পড়ালেখা করো?
– বেলা দশটার সময় পথকলিদের স্কুলে যাই। টাকা-পয়সা দিতে হয় না। বই, কলম, খাতা স্কুল থেকেই দেয়। পড়তে আমার খুব ভালো লাগে।
– পড়ালেখা শিখে তোমার কী হতে ইচ্ছে করে?
– আমাদের মতো গরির লোকেরা কি অনেক লেখাপড়া করতে পারে? অনেক পড়ালেখা না জানলে বড় হওয়া যায় না।
– ধরো কেউ তোমার লেখাপড়া করার সুযোগ করে দিলো, তুমি এমএ পাস করলে- তখন তুমি কী করবে?
– আমার শিক্ষক হতে ইচ্ছে করে।
– কেন?
– শিক্ষক হলে ভালো ভালো কথা ছাত্রদের বলা য়ায়।
– থাকো কোথায়?
– হাতিরপুল বস্তিতে।
– তোমার বাবার নাম কী?
– কুদ্দুস মোল্লা।
ম্যাডাম তখন বললেন, তুমি এখন যাও। তোমার মায়ের কবরে ফুল দিয়ে আসো। আমরা এই গাছের ছায়ায় একটু বসি। তুমি ফিরে এলে আমরা তিনজন মিলে কিছু খেয়ে নেবো।
এতক্ষণে মাহিরুনের মনটা বেশ ফুরফুরে বাতাসের মতো হয়ে উঠেছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে যে, এই সাহেব আর ম্যাম হয়তো একটুও খারাপ মানুষ না। মাহিরুন বললো, আচ্ছা। বলেই সে তাড়া পায়ে ছুটলো কবরস্থানের দিকে। কবরের সামনে দাঁড়াতেই চোখ দুটো ভরে উঠলো অশ্রুতে। মনে জাগলো কত না স্মৃতি। মেয়েটি কেঁদে-কেঁদে বললো, আল্লাহ তুমি আমার মাকে ভালো রেখো। আর মাকে বললো, মা তুমি আমার জন্য দোয়া করো। তারপর দু’হাতে চোখের পানি মুছে চলে এলো রাস্তায়। মনে মনে বললো, এখন আমি কোথায় যাবো! আব্বা যদি রিক্সা নিয়ে এদিকে আসতো তা’হলে রিক্সা করে ঘরে ফিরে যেতাম। হঠাৎ মনে পড়লো ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলার কথা। তারা কি আমার জন্য এখনো ওখানে বসে আছে? কিন্তু আমি যে কথা দিয়েছি ফিরে গিয়ে তাদের সাথে দেখা করবো। মাহিরুন আবার দ্রুত পা চালালো। দূর থেকেই দেখলো ওনারা ফুটপাথে বসে আছেন- পাশেই চকচকে গাড়িটা। মাহিরুন তাদের কাছে যেতেই ম্যাডাম বললেন, তুমি তো লক্ষ্মী মেয়ে। আমি জানতাম তুমি ঠিক ফিরে আসবে। এবার বলো তুমি কী খেতে চাও? ভাত না অন্য কিছু? মাহিরুন বললো, আমি কিচ্ছু খেতে চাই না। ভদ্রলোক বললেন, তা হবে না। তোমাকে খেতেই হবে। আগামীকাল সকাল দশটায় তোমাদের বস্তিতে আমরা যাবো। তোমার বাবাকে বলে রাখবে সে যেনো কোথাও না যায়। আর একটি কথা- তুমি আর তোমার খালাম্মা এখানেই থাকো। আমি গাড়ি নিয়ে প্যাকেট লাঞ্চ নিয়ে আসি। আমরা এখানে বসেই তিনজন খেয়ে নেবো। ম্যাডাম বললেন, ভালো কথা বলেছো তুমি এখনি যাও। মাহিরুন বললো, এখানে খেতে বসলে কাক আর কুকুরে বিরক্ত করবে। কাকেরা ওপর থেকে পায়খানা করে দিতে পারে।
ভদ্রলোক মাহিরুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই মেয়ে, তোমার মাথায় এতো বুদ্ধি এলো কী করে? মাহিরুন বললো, আমাদের গ্রামে বিলাত আলী নামে একজন ডাক্তার ছিলেন। তিনি খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতেন। রোগীর বাড়িতে গিয়ে রোগী দেখে ওষুধ দিতেন। নামাজ-কালাম পড়তেন। এমন সুন্দর মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। তিনি কাঠের বাঁটের ছাতাটা সব সময় সঙ্গে রাখতেন। খুব কড়া রোদ না হলে তিনি ছাতা ফুটাতেন না। তবে গাছ-পালার ছায়া বিছানো পথে তিনি ছাতাটা মেলে ধরতেন মাথার ওপর।
একদিন আমি হাসতে-হাসতে বললাম, গাছ-পালার ছায়ায় আপনি ছাতা মাথায় দেন কেন? সবাই গাছের ছায়ায় ছাতা বন্ধ করে হাওয়া খায় গা ঠাণ্ডা করে। তিনি বললেন, গাছে পাখি থাকে ওরা এমনই যে গাছের তলায় মানুষ দেখলে পায়খানা করে দেয়। তাতে জামা-কাপড় নষ্ট হয়। সেই অবস্থায় নামাজ পড়া যায় না।
মাহিরুনের গল্প শুনে সাহেব বললেন, ডাক্তার সাহেব মনে হয় ঠিক কথাটাই বলতেন। আর কথা নয়, এবার চলো আমরা নিউ মার্কেটে যাই। তাদের সঙ্গে মাহিরুনও গাড়িতে উঠলো এবার। ভালো হোটেলে গিয়ে তিনজন মিলে ভালো-মন্দ খেলো। তারপর গাড়ি করে ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা চলে গেলেন। মাহিরুন হাত নেড়ে তাদের বিদায় জানালো।
সন্ধ্যায় মাহিরুনের বাবা ফিরে এলো। বাবা বললো, আমার মা কি সারাদিন না খেয়েই আছে- কিছু খেয়েছিস?
– হ্যাঁ খেয়েছি।
– কী খেয়েছিস?
– পোলাও, মাংস, ডিম সেভেনআপ আরও অনেক কিছু।
– বাবার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলে না।
– না বাবা, সত্যি খেয়েছি।
– এতসব খাবার কে খাওয়ালো তোকে?
মেয়েটির নাম মাহিরুন । দেলোয়ার হোসেনমাহিরুনের তখন সারাদিনের ঘটনা খুলে বললো বাবার কাছে। আর বললো, বাবা আগামীকাল সেই ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা আমাদের বস্তিতে আসবে। বাবা অবাক হয়ে বললো, তিনারা এখানে আসবেন কেন? মাহিরুন বললো কি জানি; তোমার সঙ্গে কথা বলবে। তবে বাবাতো প্রথমে আমি তাদের খারাপ লোক ভেবেছিলাম, পরে বুঝলাম, না- তারা আসলেই ভালো মানুষ। বাবা মনে-মনে ভাবলেন এর মধ্যে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। ‘গরিবের বাড়িতে হাতির পারা’-এলেই বুঝা যাবে।
পরদিন কুদ্দুস মোল্লা আর রিক্সা নিয়ে বের হলো না। অপেক্ষায় থাকলো কখন সেই ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা আসে। মনে মনে বললো, যদি বুঝি তাদের উদ্দেশ্য খারাপ তা’হলে গাড়ি ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলবো। গরিব মানুষের কি মান-সম্মান থাকতে নেই। আমাদের টাকা-পয়সা নেই কিন্তু মনে সৎ সাহস তো আছে।
ঘিঞ্চি গলির মধ্যে গাড়ি করে যাওয়া একবারেই অসম্ভব। তখন সকাল প্রায় দশটা। সাজ্জাদ সাহেব একটা ছেলেকে ডেকে বললো, কুদ্দুস মোল্লাকে চেনো? এই বস্তিতেই থাকে, রিক্সা চালায়। ছেলেটি বললো, চিনবো না ক্যান মাহিরুনের আব্বা। ঐ সামনের দিকে আগাইলে ডান দিকের ঘরে থাকে।
একটু ডেকে দিতে পারো? বলবে এক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা আপনাকে ডাকছে। এর মধ্যেই গাড়ির চারদিকে ছেলে-মেয়েদের ভিড় জমে উঠেছে। ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে ডেকে আনলো কুদ্দুস মোল্লাকে। সাথে মাহিরুনও এসেছে। কুদ্দুস মোল্লা সালাম দিয়ে বললো, আপনারা বড় লোক মানুষ : কোথায় যে বসতে বলি। সাজ্জাদ সাহেব বললেন, ব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই আমরা দুটো কথা বলেই চলে যাবো।
– কি বলতে চান বলুন।
– মাহিরুন কি তোমার মেয়ে?
– হ্যাঁ আমার মেয়ে।
– গাড়িতে বসেই তোমার মেয়েটিকে দু-তিন দিন ফুল
বিক্রি করতে দেখেছি কিন্তু কথা বলতে পারিনি। গতকাল ও তার মায়ের কবরে ফুল দিতে যাচ্ছিল তখন ওকে দেখি, কথাও বলেছি। ও পড়ালেখা করে বড় হতে চায়। ওর সেই আশা আমি পূরণ করতে চাই। তোমার মেয়েটার অনেক বুদ্ধি। মাহিরুন চেষ্টা করলে অনেক বড় হতে পারবে। আজকাল কাগজে প্রায়ই দেখা যায় অমুখ দিনজুরের মেয়ে পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। তাদের কারোর ইচ্ছে ডাক্তার হওয়া, কারো ইচ্ছে শিক্ষক হওয়া আবার কেউ ব্যারিস্টার হতে চায়।
– আপনাদের উদ্দেশ্য কি সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না। এই শহরে ধান্ধাবাজ লোকের অভাব নেই। একটা বিপদ ঘটলে, আমি গরিব মানুষ আপনার সাথে লড়তে পারবো না।
– তুমি ঠিকই বলেছো। এ কথা মাহিরুনও বলেছে।
আমি এখন যা বলছি, তা একটু মন দিয়ে শোন। তুমি এবং তোমার মেয়ে আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে যাবে। আমার বাড়ি মিরপুর-১১। আমি তোমাদের আবার এখানে রেখে যাবো। এর মধ্যে ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমার অফিস মতিঝিল, এই আমার অফিসের কার্ড। এটা তোমার কাছে রেখে দাও। এই বস্তির আরো পাঁচজনকে ডাকো- তারা দেখুক যে আমি তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি।
এসব কথার কোনো আগা-মাথা বুঝতে না পেরে কুদ্দুস মোল্লার মাথাটা কেমন ঘুরপাক খেতে লাগলো। সে বললো, আপনার কথা আমি কিছুই বুঝবার পারলাম না। একটু খোলাসা করে কন। তখন ম্যাডাম বললেন, তোমার মেয়েটিকে আমরা মানুষের মতো মানুষ করতে চাই। ওকে আমাদের খুব পছন্দ।
– কেনো, আপনাদের ছেলে-মেয়ে নেই?
– না। মাহিরুনকে আমরা আমাদের সন্তানের মতো মানুষ করবো। কেনো করবো সে কথা সাতদিন পর এখানে এসে বলে যাবো। আজ সে কথা বলবো না। কুদ্দুস মোল্লা তুমি মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে উঠো। দুপুরে আমার বাড়িতে লাঞ্চ করবে। তোমাকে গাড়িতে করে আবার রেখে যাবো।
উপস্থিত যারা ছিলো তারা সবাই বললো, কুদ্দুস মিয়া তোমার কপাল খুলে গেলো। আর কথা না বাড়ায়ে সাহেবের সঙ্গে যাও। তুমিও ভালো থাকতে পারবা আর তোমার মা মরা মেয়েটিও মানুষের মতো মানুষ হতে পারবে। দশজনের কথায় কুদ্দুস মোল্লার আর গাড়ি ভাঙার কথা মাথায় এলো না। শেষে ঐ অবস্থাতেই উঠে বসলো গাড়িতে।
রাস্তার পাশেই চারতলা বাড়ি। দারোয়ান গেট খুলে দিলো গাড়ি ভিতরে ঢুকলো। সাজ্জাদ সাহেব থাকেন তিনতলার ফ্ল্যাটে। নিচে গ্যারেজ আর সব ভাড়া দেয়া। সবাই সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো উপরে। কলিং বেল বাজতেই কাজের বুয়া এসে দরজা খুলে দিলো। ড্রইং রুমে বসলো সবাই। ম্যাডাম চলে গেলেন নিজের ঘরে। একটু পরই ফিরে এসে বুয়াকে বললো, দুপুরে এনারা এখানে লাঞ্চ করবে তুমি রানড়বার ব্যবস্থা করো। ড্রইং, ডাইনিং ছাড়াও আরও চারটা রুম। সাজ্জাদ সাহেব কুদ্দুস মোল্লা আর মাহিরুনকে নিয়ে সারাটা ফ্ল্যাট ঘুরে দেখালো। একটা রুমে গিয়ে কুদ্দুস মোল্লা থমকে দাঁড়ালো। দেয়ালে একটা বড় ছবি সুন্দর ফ্রেমে বাঁধানো। ছবিটা অনেকক্ষণ ধরে দেখার পর কুদ্দুস মোল্লা জিজ্ঞাসা করলো এ ছবিটা কার? সাজ্জাদ সাহেব বললেন, আমার মেয়ে- আলোর ছবি।
– সে কোথায়?
– আমার মেয়েটা স্কুল থেকে ফিরতে অ্যাকসিডেন্ট করে। মাথায় আঘাত পায় অনেক চেষ্টা করেও মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলাম না। প্রম যেদিন তোমার মেয়ে মাহিরুনকে আমি দেখি সেদিন তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমার আলো মারা গেছে। কথা বলতে-বলতে সাজ্জাদ সাহেবের দু’চোখ ভরে উঠলো অশ্রুতে। তিনি বললেন, কুদ্দুস মিয়া তুমি কি এখন বুঝতে পারছো মাহিরুনকে কেন আমি পড়ালেখা শিখিয়ে বড় করতে চাই।
কথায় কথায় লাঞ্চের সময় হয়ে গেলো। সবাই মুখ,
হাত ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলো। খেতে খেতে সাজ্জাদ সাহেব বললেন, মাহিরুন আমার এখানেই থাকবে। এর মধ্যেই ওর বইপত্র, খাতা-কলম কিনতে হবে। স্কুলের ড্রেস তৈরি করতে হবে। বাসায় একটা মেয়ে মাস্টার ঠিক করতে হবে। সাতদিন পর আমি ওকে নিয়ে তোমার ওখানে যাবো। আমার মেয়ে আলোর মোবাইল নাম্বারে তুমি মাহিরুনের সঙ্গে যখন ইচ্ছে কথা বলতে পারবে। তোমার মেয়ে তোমারই থাকবে, তবে সে এখন থেকে আমাদেরও মেয়ে।
কুদ্দুস মোল্লা মেয়েকে কিছু বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললো। পরে বললো, ভয়ের কোনো কারণ নেই মা। তুমি এখানেই থাকবে। আমি গরিব মানুষ, আমি তোমাকে মানুষের মতো মানুষ করতে পারতাম না। সাহেব বলেছে, এক সপ্তাহ পর তোমাকে আমাদের বস্তিতে নিয়ে যাবে। বিকালের দিকে কুদ্দুস মোল্লাকে নিয়ে সাহেব মার্কেটে ঢুকলেন। তাকে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি কিনে দিলেন। তারপর পৌঁছে দিলেন হাতিরপুল বস্তির মুখে।
পরদিন মিসেস আবিদা মাহিরুনকে নিয়ে পার্লারে গেলেন। বড় মার্কেটে গিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের কাপড়, জুতা-স্যান্ডেল কিনলেন। তারপর হোটেলে গিয়ে ফলের জুস খেয়ে ফিরে এলেন বাসায়। সেদিন থেকে মাহিরুনের খাবারের মেনু পাল্টে গেলো। বুয়াকে বললেন, গোসলের সময় মাহিরুনকে সাহায্য করতে। সাত দিনে মাহিরুন অন্য এক মেয়ে হয়ে উঠলো। বাংলা স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ওকে ভর্তি করলেন। এখন সে প্রাইভেট কারে চড়ে স্কুলে যায়-আসে। ঠিক সাতদিন পর মিসেস আবিদা ওকে নিয়ে গেলেন হাতিরপুল বস্তিতে। মাহিরুনকে দেখে কেউ আর ওকে চিনতে পারে না। ছেলে-মেয়েরা এসে ভিড় করে ওকে দেখছে। মাহিরুন বললো, তোরা কি আমাকে ভুলে গেছিস। কেউ কোনো কথা বলছিস না কেনো? এখন আমি বড় স্কুলে ভর্তি হয়েছি। গাড়িতে যাওয়া-আসা করি। কুদ্দুস মোল্লা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি মুছলো সবার অলক্ষ্যে।
দেখতে-দেখতে তিন বছর কেটে গেলো। মাহিরুন এখন ক্লাস ফাইভের ফাস্ট গার্ল। এর মধ্যেই কেনো যেনো মিসেস আবিদার শরীর ভেঙে পড়তে লাগলো। তার কিচ্ছু ভালো লাগে না। মাহিরুন তাকে খালাম্মা বলে ডাকে। কিন্তু আবিদা ওর মুখে মা ডাক শুনতে চায়। অথচ নিজে মুখে সে কথা কিছুতেই বলতে পারে না- আর পারে না বলেই কখনো-কখনো চোখ ভরে ওঠে অশ্রুতে।
একদিন বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। মাহিরুন বললো, খালাম্মা তুমি নেটে দেখো না আমি কি বৃত্তি পেয়েছি? মিসেস আবিদা বললেন, গাড়ি নিয়ে স্কুলে গিয়ে রেজাল্ট জেনে আয়। আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। মাহিরুন আর কিছু না বলে ড্রাইভার আঙ্কেলের সাথে স্কুলে গেলো। ওকে দেখা মাত্রই অন্য বান্ধবীরা চিৎকার করে বললো, মাহিরুন তুই ‘এ’ গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছিস। মাহিরুন তবু হেড ম্যাডামের রুমে ঢুকলো, বললো ম্যাডাম আমি আমার রেজাল্ট জানতে এসেছি। ম্যাডাম হেসে বললেন, তুমি আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছো। তুমি ‘এ’ গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছো।
মাহিরুন আনন্দে গাড়ি থেকে নেমে লাফাতে-লাফাতে সিঁড়ি টপকে উপরে উঠে- হাঁফাতে-হাঁফাতে ছুটে গেলো মিসেস আবিদার ঘরে। চিৎকার করে বললো, মা আমি ‘এ’ গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছি, বলেই ঝাঁপিয়ে পড়লো মিসেস আবিদার কোলের ওপর। মিসেস আবিদা ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন।
– তুমি কাঁদছো কেন? তুমি খুশি হওনি।
– ওরে পাগল, আর কখনো খালাম্মা বলবি না। সব সময় মা বলে ডাকবি। তুই যে ‘এ’ গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছিস সে আমি আগেই জানি।
মিসেস আবিদার মাথার সকল যন্ত্রণা যেনো এক নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো।

Share.

মন্তব্য করুন