(গত সংখ্যার পর)

রেস্টুরেন্টে খেতে বসে আকুভাইদের নাম, পরিচিতি, বাড়িঘর কোথায় সব জেনে নিয়েছিল তিন্নি। ফেরার পথে তিনজন একটা সিএনজি অটোরিকশায় করে যাচ্ছিল। টুকটাক কথাও হচ্ছিল। মাঝখানে সবুজ বলল, আকুভাই কিন্তু ডিটেকটিভ!
– ডিটেকটিভ! অবাক হয়ে জানতে চাইল তিন্নি।
– হ্যাঁ, উনি বেশ কয়েকটি কেস সলভ করেছেন!
– কী বলো! আমার তো অনেকদিনের শখ কোনো এক ডিটেকটিভকে সামনাসামনি দেখা! এখন তো দেখছি, ডিটেকটিভের সাথে বসে লাঞ্চ করেছি, একসাথে একই গাড়িতে বসে আছি, কথা বলছি, বাহ!
আকুভাই এতক্ষণ চুপ ছিল। স্বভাবসুলভ তর্জনী দিয়ে মাথা চুলকে তিনি এবার বললেন, দেখো, তুমি যে সুইসাইড করতে চেয়েছিলে, সেটা করলে কি ডিটেকটিভের দেখা পেতে? এরকম আরো কত কত শখ তোমার ভেতরে লুকানো আছে, সেসব থেকেও বঞ্চিত হতে। আবার তোমাকে নিয়ে যারা স্বপ্ন দেখে তারাও বঞ্চিত হতো!
– আমি ভুল ডিসিশন নিয়েছিলাম, স্যরি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ধন্যবাদটা তখন দিতে পারিনি বলে এখন দিয়ে দিলাম।
– আর শোনো, আমি আহামরি কোনো ডিটেকটিভ নই। জাস্ট শখ থেকে করা। সবুজ বলল, আমরা কিন্তু একটা কেস হাতে পেয়ে এখানে এসেছি, মানে বইমেলায় যাচ্ছি! তাই! বইমেলায় কেস সলভ করবেন আপনারা?
– হ্যাঁ। দেখি কী করতে পারি। আকুভাই বলল।
– আমিও কি আপনাদের সাথে থাকতে পারি?
– পারো, তবে আগে বাসায় যাও, বাসা থেকে ফ্রেশ হয়ে আসো। কাছেই তো!
– অকে, তা-ই হবে।
সাড়ে তিনটার দিকে কাজীর দেউড়ী পৌঁছল তারা। তিন্নি চলে গেল তাদের বাসায় আর সবুজকে নিয়ে আকুভাই বইমেলার দিকে চলল। বইমেলা প্রাঙ্গণে ঢুকে কিছুটা অবাক হলো আকুভাই। ঢাকার মতো বিশাল না-হলেও বড়সড় আয়োজন হয়েছে চট্টগ্রামে। দারুণ ব্যাপার। খুব খুশি লাগছে তার। সবুজকে বলল, তুমি তো টুকটাক লেখালেখি করো, প্রস্তুতি থাকলে সামনের মেলায় একটা ছড়ার বই করে ফেলতে পারো!
– আপনি বলছেন! অবাক হয়ে বলল সবুজ।
– বলছি প্রস্তুতি থাকলে।
– না, এত তাড়াতাড়ি বই করব না। আগে আরেকটু শিখি, জানার পরিধি আরো বিস্তৃত হোক, তারপর না-হয় বই করার ব্যাপারে ভাববো!
– গুড। আমি দেখছিলাম তুমি কী বলো! পাস করেছো টুকরো এই পরীক্ষায়।
দুজনে মিলে পুরো বইমেলা একবার চক্কর দিয়ে এলো। কিছু স্টল ভেঙ্গে পড়েছে। গতকাল নাকি বাতাসের তা-বের মুখে পড়েছিল।
লম্বালম্বি চার সারি ও পাশাপাশি এক সারি বেশ চমৎকার আয়োজন। ঢাকা থেকে স্টল এসে বইমেলাটাকে পূর্ণতা দিয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ ধন্যবাদ পাবার মতো একটা কাজ করেছে, এখন সেটা জারি থাকলেই হলো। পুরো মেলা ঘুরে সুজনের স্টলে গেল তারা। তাদের দেখে সুজন স্টলে ঢুকালো। দুটো চেয়ারে বসতে দিলো। জোহেবের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিলো তাদের। কিছুক্ষণ বসে আকুভাই সুজনকে নিয়ে স্টল থেকে বের হলো, সাথে সবুজও। স্টলটা দুইদিকে খোলা, সামনে দুটো রাস্তা আর দুইপাশে অন্য দুটো স্টল। আকুভাই সুজনকে বলল, আপনি আপনার কাজ করেন আর স্টলের ভেতরে ঠিক মাঝখানে কোণায় আমার জন্য একটা চেয়ার রাখবেন। সুজন স্টলের ভেতরে চলে গেলে আকুভাই সবুজকে বলল, তুমি কী করবে?
– বাহির থেকে নজর রাখি?
– হ্যাঁ, তবে কাছ থেকে নয়, দূর থেকে নজর রাখবে। বাইরের কেউ যেন বুঝতে না-পারে যে তুমি স্টল পাহারা দিচ্ছো!
– অকে, কেউ বুঝবে না।
সবুজের সাথে কথা শেষ করে আকুভাই স্টলের ভেতরে গিয়ে চেয়ারে বসল। সন্ধ্যা হতে হতে বহু লেখক স্টলে এলো, যাদের বই বের হয়েছে এই প্রকাশন থেকে। আকুভাইয়ের দিকে দেখিয়ে কেউ কেউ পরিচয় জানতে চাইলে সুজন তার আত্মীয় বলে পরিচয় দিলো। আকুভাই চুপচাপ বসে আছে আর স্টলের ভেতরে-বাইরে গভীর মনযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। আজ ঠাণ্ডা আবহাওয়া থাকায় লোকজন খুব কম এসেছে।
মেলাপ্রাঙ্গণ খালি খালি লাগছে। ফাগুনে যেখানে আগুন ঝরার কথা সেখানে ঝরছে বৃষ্টি! ঠাণ্ডা বাতাসে মনে হচ্ছে শীত যেন কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে এসেছে!
সন্ধ্যার দিকে পাঠক-দর্শক-ক্রেতাদের ভিড় বেড়েছে মেলায়। তার ছাপ পড়েছে সুজনের স্টলেও। ভেতরে চারজন লেখক বসে আছে, পাশে আকুভাইও। দুইজন সেলসম্যান ক্রেতাদের বই দেখাচ্ছে, দাম বলছে, পছন্দের বই প্যাকেট করে দিচ্ছে। কোনো কোনো লেখক তার নিজের বইটা ক্রেতাদের সামনে এগিয়ে দিচ্ছে, আর কেউ কেউ বলছে, এটা আমার লেখা বই, চাইলে নিতে পারেন। লেখক নিজের মুখে নিজের বই এভাবে ক্রেতাদের সামনে তুলে ধরাটা আকুভাইয়ের কাছে কেমন দৃষ্টিকটু ঠেকেছে। তবুও তিনি কিছু বললেন না, চুপ থাকলেন। এসব নিয়ে কথা বলার মানে হয় না, যার-যার রুচি মতে সে যা ইচ্ছে করুক!
স্টলে ভিড় বাড়ার সাথে-সাথে সবুজ বাহির থেকে কড়া নজর রাখছে। এদিকে আকু ভাইও স্টলের ভেতরে এমন জায়গায় বসেছে যেখান থেকে প্রতিটি ক্রেতার আগমন-গমন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। স্টলের ডানপাশে রাস্তার ঠিক মাঝখানে একদল টোকাই হৈ-হুল্লোড় করছে, কী একটা প্যাকেট নিয়ে নিজেরা নিজেরা বাড়াবাড়ি ও কাড়াকাড়ি করছে। সবুজ তাদের কা- দেখছে! এদের মা কোথায়, বাবা কোথায় তার ঠিক নেই। রাতে হয়তো কোনো একটা ঝুপড়িতে গিয়ে সবাই একসাথে ঘুমিয়ে পড়ে! দেখতে দেখতে মেলার সময় প্রায় শেষ হয়ে এলো, রাত তখন নয়টা বাজছে। অন্য অনেক স্টল গুছিয়ে ফেলেছে। সুজনের স্টলের লোকজনও ধীরে-ধীরে স্টল গোছানো শুরু করেছে। এদিকে সুজন টুলে বিক্রির হিসাব নিয়ে বসেছে। বই গোছাতে-গোছাতে সুজন হিসাব মিলাচ্ছে। বিক্রিত বই ও স্টকের অবশিষ্ট বইয়ের হিসাব মিলাতে গিয়ে আজকেও এক কপির হিসাব মেলেনি! তার মানে আজকেও আগের দিনের মতো বই চুরি হয়েছে! হিসাব শেষে স্টল বন্ধ করে আকুভাই ও সবুজকে নিয়ে বের হয়ে গেল সুজন। সাথে জোহেবও ছিল। সে বলল, সুজন ভাই, আজকেও বই চুরি হয়েছে?
– হ্যাঁ। সুজন বলল।
সুজন ‘হ্যাঁ’ বলাতে একটু বিব্রত হলো আকুভাই। সবুজও তখন আকুভাইয়ের দিকে এক পলক তাকালো। সুজন ওখানে আর কথা বলেনি। তার বাইকের পেছনে করে আকুভাই ও সবুজকে নিয়ে সোজা বাসায় চলে এলো।
রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে একই রুমে বসল তারা তিনজন। সুজন বলল, আকুভাই, চোর তো আজকেও ধরা গেল না, অথচ ঠিকই বই চুরি করে নিয়ে গেল!
– একদিনেই তো চোর ধরা সম্ভব না, কাল দেখি কী করা যায়!
– কালই কিন্তু বইমেলার শেষদিন, কাল না-পারলে আর কিন্তু
ধরা যাবে না!
– হ্যাঁ, টেনশন নিয়েন না। আমি বিকল্প একটা চিন্তা করছি, কাল
সেটা এপ্লাই করব।
– কী সেটা?
– সেটা কালই দেখবেন।
রাতে আর তেমন কথাবার্তা হয়নি, ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই। সকালে ঘুম ভাঙল কবুতরের বাকবাকুম ডাকে। রাতভর এই কবুতরগুলো খুব ডানা ঝাপটিয়েছে। মাঝেমাঝেই ঘুম ভাঙছিল এদের ডানা ঝাপটানোর শব্দে। গতকাল সুজনের ভাগিনার সাথে দেখা হয়নি, আজ হলো। আকুভাইদের কথাবার্তা শুনে সে তাদের রুমে এসে সালাম দিলো। আকুভাই তার নাম জিজ্ঞেস করলে সে বলল, আরাফাত আহমেদ।
– কোন ক্লাসে পড়ো? সবুজ বলল।
– সিক্সে এবার। তোমরা নাকি ডিটেকটিভ?
– কে বলল?
– সুজন মামা!
– হ্যাঁ, আমরা পিচ্চি ডিটেকটিভ, অত বড়সড় ডিটেকটিভ নই!
– আমিও বড় হয়ে ডিটেকটিভ হবো, বড় বড় কেস সলভ করব! ওর কথা শুনে আকুভাই ও সবুজ সজোরে হেসে দিলো। আকুভাই বলল, বাহ, তাহলে তো ভালোই হলো, আমরা তিনজনই গোয়েন্দাগিরি করে জীবন কাটিয়ে দিতে পারব!
– কিন্তু তোমরা তো পিচ্চি ডিটেকটিভ, আমি হবো বড় ডিটেকটিভ। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও কেস সলভ করতে নিয়ে যাবে আমাকে।
– বেশ তো! তুমি কাজ পেলে আমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যেও, তোমার মাধ্যমে বিদেশও দেখা হয়ে উঠবে আমাদের।
– কিন্তু তোমরা তার আগে আমার একটা কেস সলভ করে দাও!
কথা শেষ করার আগে আরাফাতকে তার মা ডাক দিলে সে ভেতরে চলে গেল। আর আসেনি রুমে। সকালের নাস্তা করে সুজন তার প্রকাশনা অফিসে চলে গেল। আরাফাতও চলে গেল স্কুলে। আকুভাই ও সবুজের হাতে অফুরন্ত সময়। তিনটা পর্যন্ত একপ্রকার ফ্রি-ই। তিনটার পরে স্টল খুলবে, এর আগে আপাতত বলতে গেলে কাজ নেই। বই চুরির ব্যাপারটা নিয়ে মনে-মনে ভাবলেও মুখে কিছু বলছে না আকুভাই। সবুজ বলল, ভাই, আমরা কি সারাদিন বাসায় বসে থাকবো?
– কী করা যায়?
– আশেপাশে কি দেখার মতো কিছু নেই?
– সে তো অনেককিছু আছে। এই ধরো আগ্রাবাদ শিশুপার্ক, সদ্য সাজিয়ে তোলা জাম্বুরি পার্ক, জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘর। এগুলো আগ্রাবাদেই আছে, একেবারে হেঁটে যাওয়া দূরত্বে। কিন্তু শিশুপার্ক ও জাম্বুরি পার্কে সকাল সকাল গিয়ে আনন্দ নেই, বিকেলেই এদের সৌন্দর্য বাড়তে থাকে।
– তাহলে জাদুঘরটা দেখে আসি।
– সেটাই ভালো হয়। ওখানে এমন অনেককিছু দেখবে যা আগে কখনো দেখোনি।
– তাহলে চলেন, সেটা দেখে আসি।
বাসা থেকে বের হয়ে তারা দুজন পুরো কলোনিটা একবার চক্কর দিয়ে এলো। বিশাল একটা কলোনি, পুরোটা ঘুরে দেখতে প্রায় পঁচিশ মিনিট লেগেছে! চট্টগ্রামে এত বড় কলোনি আর আছে কিনা কে জানে! সেখান থেকে বাদামতলী মোড় যেতে লেগেছে দশ মিনিট, তারপর রাস্তা পার হয়ে হোটেল আগ্রাবাদের রাস্তা ধরে দুই থেকে তিন মিনিট যেতেই রাস্তার বামে ‘জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘর’। জাদুঘরে ঢুকতেই হাতের বামে টিকেট কাউন্টার। আর ডানে-বামে দুইপাশে সাজানো বাগান।
কাউন্টার থেকে দুটো টিকেট কেটে জাদুঘরের দিকে চলল দুজন। ঢুকতেই হাতের বামে একটাত রিসিপশন ডেস্ক। রিসিপশন ডেস্কের বামদিক থেকে শুরু প্রথম গ্যালারি। এভাবে মোট চারটা গ্যালারি রয়েছে। আকুভাই আগে দেখেছেন। সবুজের জন্য অনেকটা নতুন এই জাদুঘর। ধীরে-ধীরে সময় নিয়ে বিভিনড়ব জাতিগোষ্ঠীর জীবনাচরণ, ব্যবহার্য তৈজসপত্র, পোষাপ্রাণী ঘরবাড়ি, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ডামি চিত্রাদি দেখতে লাগল। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের উপজাতিদের যেন এই একটা ভবনেই দেখে নেয়ার সুযোগ!
এটা বাংলাদেশের একমাত্র জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘর যা মূলত বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনপ্রণালী এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহকর্মী-অনুভূতি লালনের জন্য প্রতিষ্ঠিত। জাদুঘরে বাংলাদেশের উপজাতীয় মানুষের ইতিহাস-জীবন সমন্বিত উপকরণের প্রদর্শন করা হয়েছে।
এশিয়া মহাদেশের দুটি জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘরের মধ্য চট্টগ্রামের জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘর অন্যতম, অন্যটি রয়েছে জাপানে। এটি গবেষণা কাজেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই জাদুঘর প্রতিদিন দেশি-বিদেশি গবেষকসহ প্রায় ২০০-৩০০ জন দর্শনার্থী পরিদর্শন করেন।
বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠা হয় এটা। ১৯৭৪ সালে সর্বসাধারণের জন্য জাদুঘরটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। পরে ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে জাদুঘরে দুটি কক্ষ অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৭৪ সালের ৯ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারেরত প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী এই জাদুঘর উদ্বোধন করেন। জাদুঘরে ঢোকার মুখে ফলকে এসব লেখা আছে।
বিশ টাকা দিয়ে একটা সুভ্যেনির পাওয়া যায়, সেখানে এই তথ্যগুলো আছে। তথ্য মতে, জাদুঘরটি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত যেখানে ৪টি গ্যালারি ও ১টি হলে ২৯টি বিভিন্ন নৃতাত্বিক গোষ্ঠীর জীবনধারা তুলে আনা হয়েছে এর মধ্যে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলসহ ভারত উপমহাদেশের অন্যান্য নৃতাত্বিক গোষ্ঠী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, চাক, তঞ্চৈঙ্গ্যা, মুরাং, খুমি, গারো, বম, পাঙ্খো, লুসাই, খেয়ঙ, মণিপুরী, খাসিয়া, ওরাও, হাজং, মান্দাই, ঢালু, হোদি, বনা, পালিয়া, কোচ, রাজবংশী, সাঁওতাল, টিপরা এবং সিমুজী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ৩টি গ্যালারিতে ২৫টি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর নানা রকমের সামগ্রী (যেমন- অস্ত্র, ফুলদানী, কাপড়, নৌকা, কাচি, অলঙ্কার, বাঁশের পাইপ ইত্যাদি) এবং বাকি গ্যালারিতে ভারত, পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ার কিছু সম্প্রদায়ের জীবনপ্রণালী চিত্র মডেল আকারে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা আছে।
পাকিস্তানের পাঠান, সোয়াতি, সিন্ধি, কাফির এবং পাঞ্জাবি এই পাঁচটি গোষ্ঠির ভগড়বাবশেষ সংরক্ষণ করা হয়েছে। ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে আদি, মুরযিয়া, মিজো এবং ফুতোয়া অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যেগুলো সবুজ নিজ চোখে দেখেছে। এসব দেখে সবুজ হতবাক হলো। উপজাতিদের জীবনাচরণকে নিজের সাথে মেলাতে পারল না। এখানে এসে বুঝতে পারল যে, তার পূর্ববর্তী বংশধরেরা কীভাবে জীবনযাপন করত! সবুজের সাথে সাথে আকুভাইও দেখছেন আর সবুজকে বোঝাচ্ছেন।
এছাড়াও পুরো হলরুমে মানচিত্র এবং দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে উপজাতিদের বিভিন্ন উৎসব ও সংস্কৃতি সম্পর্কেও ধারণা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে রয়েছে ১৯৮৯ সালে ভেঙে ফেলা জার্মানির বার্লিন প্রাচীরের টুকরো অংশ। একটা পিতলের তৈরী হাতি দেখে সবুজ খুব অবাক হলো। নিশ্চয় খুব দামি হবে ওটা। জাদুঘরে বহু লোক এসেছে দেখতে, প্রতিদিনই নাকি আসে এরকম। একটা ব্যাপার ভালো লাগল যে, পুরো হলরুম সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত। এত এত দামি ও পুরনো স্মৃতি সম্বলিত জিনিসপত্র- যে কোনোকিছু চুরি যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
জাদুঘরে প্রায় দেড়ঘণ্টার মতো ছিল। সেখান থেকে যখন বের হচ্ছে তখন মসজিদগুলো থেকে একযোগে যোহরের আযান শোনা যাচ্ছিল। দ্রুত বের হয়ে বাসার দিকে চলে এলো দুজন। গোসল সেরে নামাজে চলে গেল। নামাজ শেষে বাসায় এসে দেখে যে, সুজন অফিস থেকে ফিরেছে। সুজনও ফ্রেশ-ট্রেশ হয়ে সবাই একসাথে খেতে বসল। খাবারের মেন্যুতে আস্ত কবুতর দেখে ভালোই লাগল সবুজের। কবুতরের গোশত তার খুব পছন্দের। একটু নারকেল ও বাদাম পিষে দিলে না-জবাব। রাতের খাবার খেয়ে বুঝেছিল সুজনের বোনের হাতের রান্না বেশ দারুণ। গরুর গোশত নয়- এ-যেন ছিল অমৃত! জিহবায় যেন এখনো স্বাদ লেগে আছে! কবুতরের গোশতও হয়েছে সেই। আকুভাই সুজনের বোনের রান্নার খুব প্রশংসা করল। খাওয়া শেষ করে সুজন বলল, তোমরা সাড়ে তিনটার দিকে চলে এসো। আজ চোরটাকে ধরতেই হবে, বইমেলা কিন্তু আজই শেষ।
আকুভাই বললেন, চিন্তা করবেন না, চোর ধরা পড়বেই। আজ বৃহস্পতিবার বিধায় স্কুল ছুটি হয়েছে দুইটায়। স্কুল থেকে ফিরেই আরাফাত চলে এলো আকুভাইদের রুমে। এসেই সে বলল, আমার একটা কেস সলভ করে দিতে হবে!
– সে তো সকালেই বলেছিলে, কিন্তু কী কেস তা তো জানালে না! আকুভাই বলল।
– আম্মুর ডাকে চলে গিয়েছিলাম বলে আর বলতে পারিনি।
– ঠিক আছে, এখন বলো।
আরাফাত চেহারাটা কেমন করে বলল, ‘জানো, আমার না অনেকগুলো কবুতর। আমার বন্ধু অনিকেরও অনেকগুলো কবুতর। আমাদের দুজনেরই ঠিক একই রকম দুটো কবুতর আছে। কিন্তু আমারটা দেখতে সুন্দর বেশি, ও আমাকে খুব পছন্দ করে!’
তো!
শোনো না, একদিন তার কবুতরটা আমার কবুতরের সাথে বদলে ফেলেছে! প্রমে বুঝতে পারিনি। পরে যখন তাদের বাসায় গেলাম আমার কবুতরটি আমাকে দেখে আমার কাঁধে চলে এলো। তার ওজন, বসার স্টাইল দেখেই বুঝেছি ওটা আমারই কবুতর!
– বলো কী! ওজন দিয়েই বোঝা যায় নাকি কোনটা কার
কবুতর?
– কেন বোঝা যাবে না? এতদিন ধরে যাকে আমি বড় করেছি তার সবকিছু আমি বুঝব না তো কে বুঝবে! তাছাড়া ওর চোখ দেখেও বুঝতে পেরেছি, সে এতদিন ধরে আমাকে খুঁজতেছে!
– বাহ, দারুণ তো।
সবুজ বলল, তোমার বন্ধু কেন তোমার কবুতর চুরি করতে যাবে? সে না তোমার বন্ধু!
– কবুতরের প্রেমে পড়লে ফ্রেন্ডশিপ আর থাকে না!
– তাই?
– হ্যাঁ, তোমার কবুতর থাকলে তুমি বুঝতে।
– আচ্ছা। তো, এখন কী করতে হবে আমাদের?
– তোমরা আমার কবুতরটি আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।
– একটা কবুতর না-হয় তোমার বন্ধুকে দিয়ে দিলে!
– ওটার দাম কত জানেন?
– কত?
– চল্লিশ হাজার টাকা!
– বলো কী! এত্তো দাম? সবুজ বলল।
– না-হলে বলছি কী! তোমরা আমার কবুতরটি উদ্ধার করে দাও।
– ও আচ্ছা। তাহলে তো উদ্ধার করেই দিতে হয়। কিন্তু তোমার বন্ধু অনিকের বাসা কোথায়?
– ঐ যে তোমরা নামাজে গেলে না, তার উত্তর পাশে। তোমাদেরকে নিয়ে যাবো।
– কিন্তু আমরা তো এখন বের হবো!
– তাহলে কাল সকালে করো। কাল তো শুক্রবার আছে।
– আমরা তো কাল সকালেই চলে যাবার প্ল্যান করেছি। কিন্তু তুমি যখন বলছো, তোমার কবুতর উদ্ধার করেই তবে যাবো।
– সত্যি উদ্ধার করে দেবে? তোমরা অনেক ভালো ডিটেকটিভ। খুশি মনে আরাফাত ভেতরের রুমে চলে গেল। আকুভাই কবুতর কীভাবে উদ্ধার করবে জানে না, তবুও আরাফাতের মুখে হাসি দেখে তার ভালো লাগল। তারা মাত্র কবুতর উদ্ধার করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে, তাতেই ছেলেটি কবুতর হাতে পাওয়ার মতো খুশি হয়ে গেল।

বইচোরের সন্ধানে । আরকানুল ইসলাম৪.
দুপুরের কড়া রোদ, ফকফকা আকাশ। হঠাৎ করে রোদের তেজ বেড়ে গেল। মাঝেমাঝে এরকম হয়। এমন রোদের তেজে ঘাড় যেন জ্বলতে থাকে। সূর্যের দিকে তাকানো দুষ্কর হয়ে পড়ে। আকুভাইয়েরা যখন বাসা থেকে বের হচ্ছিল তখন ঠিক এরকমই রোদ ছিল। তারা বইমেলার দিকে চলে গেল।
বইমেলার শেষদিন আজ। স্টলগুলোর কোনো কোনোটা খুলেছে, আবার কোনোটা খুলছে, বই ভাঁজ করে স্টলে তুলছে। লোকজনের আনাগোনা, ভিড় কম থাকায় ঘুরে ঘুরে কিছু বই কিনল আকুভাই। কয়েকটা কিশোর থ্রিলার কিনল সবুজ। তার গোয়েন্দা-থ্রিলার কাহিনি পড়তে বেশ ভালোই লাগে।
একটা স্টলে যেতেই সেখানে দেখা হয়ে গেল তিন্নির সাথে। আকুভাইদের দেখে তিন্নি নিজেই এগিয়ে এসে স্যরি করে নিল গতকাল আসবে বলেও না-আসার কারণে। সে বলল, ‘ভাইয়া, সন্ধ্যার দিকে আসতে চেয়েছিলাম, মা বারণ করাতে আর আসিনি, তাছাড়া একটু টায়ার্ডও লাগছিল।’
– আসোনি ভালো করেছো!
– তো, ভাইয়া কিছু করতে পেরেছেন?
– কোন ব্যাপারে?
– ঐ যে বইচুরির ব্যাপারটা নিয়ে, যার জন্য আপনারা এখানে এসেছেন!
– না, কিছুই হয়নি, অথচ চোরব্যাটা গতকালও বইচুরি করেছে!
– ব্যাটা নাকি বেটি সেটা বুঝলেন কীভাবে? বেটিও তো হতে পারে!
– তা পারে, কথার কথা আরকী!
– তো সবুজ, তোমার কী খবর? ভালো তো!
– হ্যাঁ আপু, ভালোই আছি।
হাঁটতে-হাঁটতে তারা সুজনের স্টলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তিন্নির সাথে সুজনকে পরিচয় করিয়ে দিলো। কিন্তু কীভাবে তিন্নির সাথে পরিচয় হলো তার কিছুই বলল না। আকুভাই বলল, তিন্নিও আজ আমাদের সাথে স্টলে থাকবে।
সুজন বলল, অকে, সমস্যা নেই। তোমার যা যা দরকার সব করো।
তিন্নিকে স্টলে বসিয়ে সবুজকে নিয়ে আকুভাই বের হলো। বের হওয়া মানে কাছেই। গতকাল কিছু টোকাইকে দেখেছিল। এরা লোকজনের কাছে টাকা চেয়ে হাত পাতে, সুযোগ বুঝে চুরিও করে। আকুভাই চিন্তা করল, তাদের সাথে কথা বলবে। তবে এরা সহজে ধরা দেবে না। এরা প্রচুর মিথ্যা বলে, নিজের দোষ দ্রুত তাদের সাথে যে কারো ওপর চাপিয়ে দিতে ওস্তাদ। আকুভাই মেলা থেকে বের হয়ে কয়েকটা প্যাকেট কেক নিয়ে এলো। কারণ, টোকাইদের ডাকলে তারা সহজে আসবে না, টাকা কিংবা খাবারের লোভ দেখিয়ে আনতে হবে এদের। যেই ভাবা সেই কাজ। বইমেলার একেবারে দক্ষিণ পাশে বিরাট স্টেজ। স্টেজের পশ্চিম পাশটা একেবারে খালি। এখানে লোকজন তেমন আসে না। যখন প্রোগ্রাম চলে তখনো এদিকটায় তেমন দর্শক থাকে না, কারণ দর্শকের জন্য স্টেজের সামনে চেয়ার পাতা আছে, সেখানে বসে সবাই।
আকুভাই টোকাইদের একটার কাছে গিয়ে বলল, কেক খাবি?
– হ, খামু।
– আয় তাহলে আমার সাথে!
– কোথায়?
– ওদিকে। ওদিকে বলে স্টেজের দিকে দেখালো।
– ওদিকে কেন?
– এত কথা বললে তো কেক পাবি না।
ছেলেটা আকুভাইদের পিছু-পিছু গেল। স্টেজের পাশের খালি জায়গাটায় গিয়ে প্যাকেট থেকে একটা কেক বের করে দিয়ে বলল, তোদের সাথে আর কে কে আছে?
– আরো অনেক আছে!
– ওদেরকে ডেকে নিয়ে আসতে পারবি?
– ওদেরও দেবেন?
– হ্যাঁ, সবাইকে দেবো। তবে তোকে দুইটা দেবো। আগে এটা খেয়ে নে, তারপর ওদের ডেকে নিয়ে এলে আরেকটা দেবো।
আরেকটার লোভে ‘আচ্ছা’ বলে দৌড় মেরে চলে গেল সে এবং মিনিটপাঁচেকের মধ্যে দশ-বারোজন টোকাইসহ ফিরে এলো।
সবুজ টোকাইদের দেখছে। আকুভাই প্রথমে সবার নাম জিজ্ঞেস করলে সবাই নিজের নাম বলতে লাগল। এরপর আকুভাই বলল, তোদেরকে সবাইকে কেক দেবো!
কথাটা শেষ করার আগেই হাত বাড়িয়ে একযোগে সবাই এগিয়ে এলে আকুভাই কেকের প্যাকেটটা উঁচু করে ধরে বলল, এখন দেবো না, আগে আমার কথার জবাব দিতে হবে!
– কী কথা, কন! দুয়েকটা টোকাই বলল। আগে যে কেক খেয়েছে তার নাম সাব্বির। সেও বলল, কী কথা, কন!
– আচ্ছা, তোদের এখানে কে কে চুরি করে? প্রশ্ন শুনে সবাই এবার চুপসে গিয়ে পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল।
আকুভাই বলল, তার মানে সবাই চুরি করিস!
– আমি করি না, নোবেইল্যা করে। নোবেল নামের এক টোকাইর দিকে দেখিয়ে বলল সাব্বির।
টোকাই হলেও এদের নামগুলো সুন্দর। ওদের কথাবার্তায় জেনেছে, এদের মধ্যে সাব্বির, নোবেল, রাশেদ, লিমা, সোনিয়াসহ আরো কয়েকটি নাম। একেবারে পিচ্চি কতগুলো আছে, বয়স তিন-চার বছর মতোন হবে। এদের নাম কেউ বলছে না। নোবেলের দোষ দেওয়াতে সে স্বীকার করে বলল, রাশিদ্যাও তো করে!
এবার রাশেদ নামের ছেলেটা যেন কিছুটা লজ্জা পেল। সে চুরির অপবাদ ঠেকাতে গিয়ে বলল, সাব্বির‌্যা তো সিগ্রেট খায়! সাব্বির এতক্ষণ উৎফুল্ল থাকলেও এবার সে চুপসে গিয়ে বলল, একবারই তো খাইছি!
– মিছা কথা, অনেকবার খাইছত তুই! আকুভাই ওদেরকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোরা কে সিগারেট খাস আর কে কী চুরি করিস সেটা তোদের ইচ্ছে। কিন্তু আমাকে বল, তোদের মধ্যে কে বই চুরি করেছিস?
– আমরা বই চুরি করিনি। একযোগে বলল সবাই।
– মিথ্যা বলবি না, আমি কিন্তু ভিডিও করে রেখেছি! ভিডিও করে রাখার কথা শুনে ওদের একজন বলল, আমি একটা বই চুরি করছিলাম। মটো-পাতলুর বই।
– কোথা থেকে? সবুজ বলল।
– ঐ যে বইয়ের দোকান আছে না, ওখানে নিচে পইড়া আছিল, আমি তুলে নিছিলাম ছবিগুলো দেখার জন্য!
– আর কে কে চুরি করেছিস?
কেউ আর জবাব দেয় না। সবাই চুপ মেরে গেল। আকুভাই বুঝতে পারল এরা আসলে বই চুরি করেনি, যেটা করেছে সেটা কুড়িয়ে পেয়ে তুলে নিয়ে গেছে। তবুও তাদেরকে একটা হুমকি দিয়ে বলল, তাহলে কেউ কেক পাবি না!
নোবেল বলল, অই সাব্যির‌্যা, কেক না-দিলে আমাদের ডাকছত কীল্লাইগ্যা! চল, যাইগা!
তার সাথে বাকিরাও চলে যেতে উদ্যত হলে আকুভাই তাদের থামতে বলে বলল, তোদের প্রত্যকেকে কেক দিচ্ছি বটে, বই চুরি ধরা পড়লে কিন্তু খবর আছে, সোজা পুলিশের হাতে তুলে দেবো।
পুলিশের হাতে দেবে না কোথায় দেবে সেটা নিয়ে আর ভাবেনি, তারা কেক নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। তাদের প্রত্যেককে একটা করে দেবার পরও একটা কেক বেচে গেলে আকুভাই বলল, সবুজ, তুমি খাবে এটা?
সবুজ হেসে দিয়ে বলল, আমাকেও টোকাই বানিয়ে ফেলবেন! দিন, খেয়ে চৌদ্দ নম্বর টোকাই হয়ে উঠি! টোকাইগুলো যখন বিদায় নিচ্ছিল তখন মাগরিব নামাজের আযান পড়ল। সবুজকে নিয়ে আকুভাই সুজনের স্টলে চলে গেল। স্টলে গতকালের মতো কয়েকজন লেখক এসে বসে আছে। সুজনকে ডেকে নিয়ে আকুভাই বলল, আপনার মোবাইলে মেমোরি স্পেস খালি আছে?
– হ্যাঁ, আছে তো খালি। কী করতে হবে?
– কত জিবি খালি আছে?
– পাঁচ জিবিরও বেশি খালি আছে!
– অকে, চলবে। এককাজ করেন, মোবাইলের ভিডিও অপশনটা চালু করে দিন।
সুজন ভিডিও চালু করে দিলে আকুভাই সেটা নিয়ে স্টলের ভেতরে বইয়ের তাকের মাঝে এমনভাবে সেট করে রাখলো যেন পুরো স্টলে সবদিক পর্যন্ত ক্যাপচার হয়। ব্যাপারটা সুজন ও সবুজ ছাড়া বাকি কেউ জানল না। সুজন বলল, এটা কী? সিসি ক্যামেরা বসিয়েছো? অনেকটা সেরকমই বলতে পারেন। তবে আমাদের তিনজোড়া চোখই আজ সিসি ক্যামেরার কাজ করবে। ক্যামেরাটা সতর্কতার জন্য বসিয়েছি।
গতকালের মতো আকুভাই ভেতরে বসেছেন, সাথে আছে তিন্নি, সেও নজর রাখছে খুব। এদিকে সবুজ যথারীতি বাহির থেকে নজরদারি করছে। সন্ধ্যার পরপরই পাঠক-লেখকের আনাগোনা বাড়ছে! কিছুক্ষণ পর সুজন স্টলের সবার জন্য চিকেন ও পরোটা নিয়ে এলে সবাই খুব আনন্দ করে খেলো। সবুজ তখনো বাইরে, তাকে ডাকলেও সে আসেনি। আজকের মধ্যে চোরটাকে ধরতে না-পারলে মান-ইজ্জত শেষ। সে নজরদারিতে ব্যস্ত ছিল। নাস্তা শেষ করে সুজন স্টলের বাইরে গিয়ে খবর নিয়ে এলো বইমেলার সময় বাড়াচ্ছে কি না। কারণ, গত দু’দিন ঢাকা-চট্টগ্রামে বৃষ্টির কবলে পড়েছে বইমেলা। তাই লেখক-পাঠক-প্রকাশকেরা দাবি জানিয়েছিল যে, আটাশ ফেব্রুয়ারির পরের দু’দিন যেহেতু শুক্র ও শনিবার, সরকারি ছুটি হিসেবে বইমেলার মেয়াদ বাড়ানো হোক। কর্তৃপক্ষ রাজি হচ্ছিল না। বইমেলা অফিস থেকে শেষ খবর জানতেই সুজন সেখানে ছুটে গেল। তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা। অনেকে স্টল গোছাতে শুরু করে দিয়েছিল। সুজন সুখবরই নিয়ে এলো। ঢাকা ও চট্টগ্রামে মেলার মেয়াদ দু’দিন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই খবর শুনে স্বস্থির একটা নিশ্বাস ফেলল আকুভাই, সাথে সবুজও। কারণ, আজকে সাড়ে আটটার মধ্যেও চোর ধরা পড়ল না! তখন লোকজন অনেক কমে এসেছে। সুজনও স্টলের লোকদের বলল, যেন বইটই সব গোছানো শুরু করে।
আজকেও চোর ধরতে না-পারায় সুজন বলল, আকুভাই, চোরের হদিস তো পেলাম না!
– আজ কি বই চুরি হয়েছে?
– দেখিনি এখনো, জোহেব হিসাব করতে বসেছে।
কিছুক্ষণ পর জোহেব হিসাব নিয়ে এলো। সে বলল, আজ সব বইয়ের হিসাব ঠিক আছে, কোনো বই চুরি হয়নি!
আকুভাই বলল, সুজন ভাই, চোরই যদি না-আসে তো চোর ধরব কেমন করে!
সুজন হেসে বলল, যাক, মেলা অরো দু’দিন বেড়েছে।
তোমাদেরও চোর ধরার সুযোগ বেড়েছে! আকুভাই বলল, কাল কিছু ফ্রুট রাখবেন স্টলে!
– ফ্রুট কেন?
– চোরটার আজ হয়তো অসুখ করেছে বলে আসতে পারেনি, কাল যদি আসে, ব্যাটা তো ধরা খাবেই! তার জন্য ফ্রুটের ব্যবস্থা করতে বললাম!
আকুভাইয়ের এমন হাস্যরসে সুজনসহ তিন্নি ও সবুজ হো হো করে হেসে উঠল। সুজন বলল, তুমি ভাই খুব মজার মানুষ ভাই, টেনশনের সময়ও মানুষকে হাসাতে পারো!
স্টল ততক্ষণে বন্ধ করে ফেলেছে। তিন্নিকে বিদায় দিয়ে সুজন তার বাইকে করে আকুভাই ও সবুজকে নিয়ে বাসার দিকে চলল।

(চলবে)

Share.

মন্তব্য করুন