মরাখালের এপারের সম্ভব সব জায়গায় সবুজকে খুঁজে দেখল হাপসা। হালিমুদ্দির-হারেজ হাজীর আম বাগানে, নূরে মাস্টারের পুকুরপাড়ে কোথাও সবুজ নেই। কলিমুদ্দিরা বাড়ি করার জন্য নতুন মাটি তুলেছে- সবুজ ইদানিং সেখানেই বেশি যায়। হাপসা সেখানেও দুইবার দেখে এসেছে। কিন্তু না, সেখানেও নেই। হাপসা শামা মুন্সির দ্বিতীয়পক্ষের ছোটো মেয়ে। অবশ্য প্রথম ও দ্বিতীয় কোনপক্ষেই হাপসার পরে শামা মুন্সির আর কোন সন্তান নেই। হাপসার বয়স সাত-সাড়ে সাত বছর। তবে তার শারীরিক শীর্ণতা- তার বয়সটাকে আড়াল করে রেখেছে। তাকে দেখলে, মলয় মুদিও তার বয়স পাঁচ অথবা সাড়ে পাঁচের বেশি আন্দাজ করতে পারবে না। সবুজ আর হাপসা পিঠাপীঠি ভাই-বোন। হাপসার পেরেশানি বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সবুজকে যদি না পাওয়া যায়! এরমধ্যে যদি পিয়ারি আর তার বোনের শয়তান ছেলেটি আমটাকে যদি দেখতে পায়, তাহলে ওরাই তো আমটাকে নামায়ে নিয়ে যাবেন। পিয়ারির বোনের ছেলেটি- খুবই একটা বড় শয়তান। হাজীর পুকুরপাড়ে একদিন সে হাপসার পিঠের উপর খুবই জোরে কিল মেরেছিল। সেও সবুজের সমান। গাছে ওঠার ওস্তাদ। এই পাড়াতে বোধহয় এমন কোন নারকেলগাছ নেই। যেটাতে সে উঠতে পারে না। তাহলে এই আমগাছটি আর কী? এসব কথাগুলো ভেবে হাপসার খুব খারাপ লাগছে। সবুজকে খুঁজতে মরাখালের ওপারে যাবে, নাকি কলিমুদ্দির ওখানে আর একবার, নাকি অন্য কোথাও খুঁজবে? সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
হাপসা ঘুরে ঘুরে আবারও ঐ আমগাছটির তলায় এসে দাঁড়াল। পাতাযুক্ত ছোটো ছোটো আমের ডাল আর সবুজ রঙের ঝরা পাতায় ভরে আছে গাছের তলটা। গাছের কাছ থেকে জোর-জবরদস্তি করে আমগুলোকে ছিঁড়ে নেয়ার সময় এগুলো ভেঙে পড়ে। পাতাগুলো কুড়ালে খুঁটিতে বাঁধা খাসি আর পাঠির বাচ্চাটার মুখের সামনে দেয়া যেত। কিন্তু এখন পাতা কুড়াতে তার ভাল লাগছে না। সে কী করবে? এতো বড় গাছে সে চড়তে পারবে না। এতোক্ষণে হয়তো ক্যারেটভর্তি আমের নছিমনগুলো সাঁকোও পার হয়ে গেছে। নছিমন যাওয়া দেখলে সবাই জেনে যাবে। এই বাগানে আম নামানো হয়েছে। হাপসার চিন্তা, যদি সাঁকোর দিকে ঐ শয়তানটা থাকে! পশ্চিমপাড়ার দিক থেকে খরগোশের গতিতে উড়ে আসছে সবুজ। তার সারা শরীর ভেজা। চুলের ডোগা থেকে এখনও গোসলের পানি গড়িয়ে পড়ছে। মাথার উপরিভাগে পানির ফোঁটাগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। তবে চিপ দুটির গোড়ার পানির ফোঁটাগুলো বড় বড় এবং ঝকঝকে। গায়ে সাদা রঙের একটা গেঞ্জি। যেটি তার শরীরের তুলনায় বেখাপ্পা বড়। আর দাগদুগালিতে পরিপূর্ণ। পরনে কালো রঙের একটা ফুলপ্যান্ট। ভেজা প্যান্ট পরে দৌঁড়ালে শপাত শপাত শব্দ হয়। সবুজের এ শব্দগুলো ভালই লাগে। কিন্তু প্যান্ট ছিঁড়ে যাওয়ার ভয় আছে। প্যান্ট ছিঁড়ে গেলে তার মা তাকে বেদম পেটাবে। আগে একটা প্যান্ট ছিঁড়ে যাওয়াতে সে তার মায়ের হাতে পেটানি খেয়েছিল। তবে দৌড় দেওয়ার মুহূর্তে, পেটানির কথা তার একটুও মনে পড়ে না। হঠাৎ করে থামলে মনে পড়ে। তার এখনকার এ দৌড় কতদূর গিয়ে থামত, তা আন্দাজ করা কঠিন। হাপসাকে দেখে, যেন হুমড়ি খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সবুজকে দেখে হাপসাও পূর্ণতা পেল। হাপসার ভেতরে জমা রাগের পরিমাণ কোন ভাষাতেই হয়তো এখন তাকে বোঝানো যাবে না। দাঁতের সাথে দাঁতগুলো ঘষে সে বলল, ‘কোতি গেছিলি রে সেজো ভাই? কোতু তোক খুঁজি পাছি নি খো! আর ইকটু হলেই তো পিয়ারি আর ঐ শয়তানটা চলি আসত। তাহলেই তো সব শেষ হই যাইত। আমি কতখুন থাকি আমটাকে দেখিদেখি রাখছি।’ হাপসার ভেতরকে পোড়ানো সেই আগুন হয়তো এখন সবুজকেও পোড়াচ্ছে। সে মুখে কিছু বলছে না। সবুজ তার প্যান্টের পকেট হাত বের করল, তার হাতের মুঠোয় তিনটি তরতাজা জামরুল।
জামরুলগুলোর মধ্যে দুটির অবস্থা একটু খারাপ। খারাপ মানে দৌড়ানোর সময় একটা জামরুলের বোটার দিকে আর আরেকটার মাথার দিকে সামান্য করে ক্ষয়ে গেছে।
হাপসা কিন্তু তাতেও বেজার নয়, খুব খুশি। সে ছো মেরে জামরুল তিনটিকে তার হাতে নিয়ে বলল, ‘কোথায় পেলি রে, সেজো ভাই?’ একটাতে কামড় দিয়ে আরেকটা সবুজের দিকে এগিয়ে দিল। সবুজ মাথা ঝাঁকাল। আর হাপসাকে বলল, ‘তুই খা। আমি ম্যালাগুলা খাইছি। খতিবের গাছের। খতিব তো মসজিদে ওয়াজ করছে। তাই আমরা কয়জন গেছুন।’
হাপসার পাল্টা জিজ্ঞাসা, কিন্তু বাড়ির ম্যাগিন সব কোতি গেছিল? ছিল না। সবুজ ঠোঁট পাকিয়ে বলল, কি জানি? জানিনি। হাপসাও তখন তার অন্য হাতের মুঠোয় থাকা একটা লিচু সবুজের হাতে ধরিয়ে দিল। এবার কিন্তু সবুজ না বলল না। লিচুটির বোঁটার দিক থেকে অনেকখানি জায়গা জুড়ে লাল হয়ে উঠেছে। তবে লাল রঙের এই গৌরবকে অনেকটা ম্লান করে দিয়েছে পাখির ধারালো ঠোঁটের আঘাত চিহ্ন। তবুও সবুজ তৃপ্তির নিঃশ্বাস ভেতরের দিকে টেনে হাপসাকে জিজ্ঞাসা করল, কার গাছের রে, পেটমোটার? হাপসা মাথা নাড়িয়ে তার কথা স্বীকার করল। সঙ্গে সঙ্গে সে একথা বলতেও ছাড়ল না, ‘দুইডি পাছুন। একদম গড়ি পুখেরের পানির কাছে আসি পড়িছিল। একটা আমি খাছি। আর একটা কখুন থাকি তোর লাগি হাতে করি লি বেড়াছি। তোক পাছিই নি। একবার মুনে করনু খাই লিই।’ এ জায়গাটা মূলত মণ্ডলদের পরিবারের গোরস্থান। গোরস্থানের বাঁশঝাড়গুলো খুব সমৃদ্ধ, ঘন বাঁশে ঠাসা।
তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে বহাল তবিয়তে টিকে আছে বিশাল আঁঠি আমের গাছ। মোড়ের বট-পাকুড় দুজনে মিলে যতখানি জায়গা নিয়ে আছে। এই আমগাছটি একা হয়েও তাদের চেয়ে বেশি জায়গা এখানে দখল করে রেখেছে। গাছের গোড়াটি বেপাল্লা মোটা। দুজন পরিপূর্ণ যুবক মিলেও তার গোড়াকে ব্যাড় দিতে পারে না। তাছাড়াও গোড়াটি যেমনি মোটা ঠিক সেরকমি লম্বাও। তাই গাছের গোড়া বেয়ে গাছে উঠার কোন উপায় নেই।
কত বছর থেকে মানুষ ওচেষ্টা ছেড়ে দিয়েছে হিসাব হয়তো এ পাড়ার কারো কাছেই নেই। তবে অন্য একটি রাস্তা আছে। গাছটির পূর্ব ও দক্ষিণ দিকের ডালগুলো নেমে এসে-মাটি ছুঁয়েছে প্রায়। এই ডালগুলো বেয়ে গাছটির একটা স্তর পর্যন্ত অনায়াসে ওঠা যায়। সবুজ সাথে থাকলে হাপসা এদিকে আসে। ঐ ডালগুলোতে উঠে দোল খায়। একা একা সে কখনোই এদিকে আসে না। এমন কি তার সকাল-বিকেলের খেলার সাথী ফুরকি-সোহাগি-স্বজনী-ময়নারা কেউ ডাকলেও সে সহজে এদিকে আসে না। বাঁশঝাড়ের ভেতর পুরোনো কবরগুলোতে কিংবা অন্য কোন গর্তে বড় বড় শেয়াল থাকে। একদিন তাদের খেলার সময় তিনটা শেয়াল বের হয়েছিল ঐ বাঁশঝাড়গুলোর ভেতর থেকে। সেদিন দৌঁড় দিয়ে তারা প্রাণে বেঁচেছে। সেই থেকে তারা কেউই আর এদিকে আসতে চায় না। আম নামানো ঐসব লোকের চোখগুলো একেবারে শকুনের চোখের মতোন। পাতার পেটের মধ্যে লুকানো আম তারা কিভাবে দেখতে পায়? আল্লা জানে। তবু একটি আম আজ ওদের ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে আছে। আমটিকে এখান থেকে দেখতে ছোটো মনে হলেও আসলে আমটি কিন্তু বড়ই। উপরে থাকতে ছোটোই লাগে। ঐ আমটি আজ হাপসাকে কোথাও দাঁড়াতে দিচ্ছে না।
একবার ঐ শেয়ালগুলোর কথা ভেবে তার বুকটা ধড়পড় করে উঠেছিল। তবে আশেপাশে দেখে পরে সে নিজেকে সামলে নিয়েছে। আমগাছটির পুবের আলে আমজেদের আম বাগান; সেখানে খেজুরপাতার পাটি বিছিয়ে শুয়ে আছে আমজেদ আর আলাদ্দিন। তারা দুজনেই যদিও দুদিকে মুখ দিয়ে অচেতন ঘুমে। তবু তারাই আজ হাপসাকে সাহস যুগিয়েছে। এ গাছের আমগুলো গোল গোল আর গাঢ় সবুজ রঙের। দেখতে ভারী সুন্দর-ওজনদারও। কোন কোনটার ওজন এক কেজিও পার হয়ে যায়। কিন্তু না পাকলে খাওয়ার উপায় নেই। এতো টক। আবার পাকলে কিন্তু ভীষণ মিষ্টি আর রসে ভরা। চোচা ছিলে হাত দিয়ে চিপে নিলে রসে আর দরাতে থালি ভরে যায়। রুটি দিয়ে মাখিয়ে খেতে খুব মজা লাগে তখন। এই গাছের বড় একটা আম হলে দুইটা রুটির সাথে হাপসা একা খেয়ে উঠতে পারে না। মণ্ডলদের কেউ এখন এই বাড়িতে থাকে না। বুড়ো মণ্ডল আর তার বৌটা মরে গেছে কবে? হাপসা তা দেখেনি।
সবুজও হয়তো দেখেনি। তার পাঁচ ছেলের কথা হাপসা শুনেছে। কিন্তু একসাথে তাদের পাঁচজনকে হাপসা কখনো দেখেনি। তারা সবাই বিভিনড়ব জায়গাতে চাকরি করে। সবাই বড় বড় চাকরি। বছরে একবার-দুইবার এই বাড়িতে আসে। তাও ঐ ঈদের সময়। তবে তারা কেউ এখানে ঈদ করে না। আসে পাড়ার লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলে। পাড়ার কাউকে কাউকে কাপড়-চোপড় কিনে দেয়। কাউকে অন্যকিছুও কিনে দেয়। আবার চলে যায়। তাদের এই বাড়িঘর-এইসব বাগান-পুকুর সব এখন সেরাজুল দেখাশোনা করে। সেরাজুল তার বৌ- ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে মণ্ডলদের বাড়িতেই থাকে। এই গাছের আম মণ্ডলেরা কেউ খায় না। আবার দাদার হাতের গাছ তাদের বাবা-মায়ের কবরের উপরের ছায়া করে আছে। তাই একে কাটেও না। সেরাজুল পুকুরপাড়ের ল্যাংড়া-খিরসা-গোপালভোগ আর ফজলি এরকম ভাল জাতের কয়েকটা আমগাছ রেখে বাকিগুলো টেন্ডারে দিয়েছে। টেন্ডারে দেওয়ার আগে ঝড়ের দিন পাড়ার সবাই এই গাছের আম কুড়াতে পারত। কিন্তু টেন্ডারের পর কোনোমতে আকাশ লাল হলে সাথে সাথে তাদের লোকগুলো আসে। ঘিরে দাঁড়ায় গাছের চারদিক। ঝড়ে আম পড়ে পড়ে জড়ো হয়। কাউকে সে আম ছুঁতেও দেয় না।
আরেকটি লুকানো আম । মনির বেলালহাপসা-স্বজনী-ময়না-সবুজেরা প্রথম প্রথম ঝড় শেষ হওয়া পর্যন্ত আলের উপর দাঁড়িয়ে থেকেছে। কিন্তু তাদের একজনও আলকে অতিক্রম করতে পারেনি। তারা ফিরে গেছে। অন্য কোন গাছের দিকে। ঝড় থামলে আমগুলোকে ধীরেসুস্থে বস্তায় তুলে বাজারে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে কাঁচা আম কেনার পার্টিরা হা-করে বসে থাকে। বস্তাবন্দি আমগুলো হাপসাদের কাঁদিয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশময়। অথবা বন্দি হয় আচারের বয়েমে বয়েমে।
জাতের আমগুলো পাকা লাগতে এখনও দেরি আছে। আরো কম করে হলেও পনের-বিশ দিন। আঁঠি আম পুরোদমে পাকা শুরু হয়েছে। এই পাড়াতে মণ্ডলদের এই গাছে আর হারেজ হাজীর লড়ি আমের গাছে পাকা ধরেছে। হারেজ হাজীর ঐ গাছের আম এখনও নামায়নি। তবে যেই হারে পাকা ধরেছে তাতে আর দুই-তিনের বেশি রাখবে না। হাপসা আজ সকালে একটা লড়ি আম কুড়িয়ে পেয়েছে। কিন্তু এ আম পাকলেও খেতে সেরম মিষ্টি না। ভেতরে আঁশে ভরা আর টকটক লাগে।
সবুজ গাছের ডাল বেয়ে প্রথমে খানিকটা উপরে উঠেছে। সে তার মাথার উপরের একটা করে ডাল ধরছে। আর ঝুল দিয়ে উঠে যাচ্ছে উপরের দিকের আরেকটা ডালে। ডালগুলো সব লাগালাগি। এখনও সবুজের হাতের আয়ত্তের মধ্যেই আছে। পুরোনো আর নতুন পাতাতে গোটা গাছ একেবারে ভরাভর্তি। একটুআধটু রোদ-বৃষ্টি কিছু হলে তা গাছের ভেতরে ঢুকতে পারে না। বৃষ্টিকে ভেতরে ঢুকতে হলে তাকে অবশ্যই দমকা বাতাসের সাহায্য নিতে হয়। এদিক বিচারে রোদ বেচারা এখানে সত্যিই অসহায়। এই সুবিধার কারণে পাড়ার অনেক গরমকালে এই গাছের নিচে পাটি বিছিয়ে ঘুমায়। মেয়েরা ঘন ছায়া দেখে জটলা পাকিয়ে বসে। গল্পগুজব করে। তালপাতা-খেজুরপাতার হাতপাখা বোনায়। কেউ কেউ বুনে বাহারি রঙের সুতার হাতপাখা। কোন কোন মেয়ে আবার ফুল তোলে নকশীকাঁথার বুক জুড়ে। আজকেও তারা আসবে পুরুষেরা সব মাঠ থেকে ফিরলে আর মেয়েরা ঘরের কাজকাম শেষ করে। মোটা ডালগুলোয় শ্যাওলা জমেছে। সেগুলোতে পা দেয়া মুশকিল। তাই সবুজ এখন তার পায়ের উপর খুব একটা ভরসা করছে না। তার মাথার উপরের সরু সরু ডালগুলোকে সে জানপরাণ দিয়ে ধরছে। আগেও সে এই গাছে উঠেছে। কিন্তু এতো উপরে না। এটা গাছের সবচেয়ে খাঁড়া ডাল। হাপসা নিচে দাঁড়িয়ে হাঁকাচ্ছে, ‘এই সেজ ভাই, এইবার পুবে দিকে আসেক, তোর সামনের দুইডি ডাল বাদে।’ হাপসার বুক ফাটানো চিৎকার সবুজের কাছে পৌঁছাচ্ছে কিন্তু ভেঙ্গে ভেঙ্গে। সবুজের এখান থেকে তাদের পাড়ার অর্ধেকটা পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। পুবের দিকে তাকিয়ে সে দেখল, তাদের বাবা লাঙ্গল কাঁধে ফিরছেন। তাদের সাদা রঙের বল্ডার গরু জোড়া তার বাবার আগে আগে হাঁটছে। ওরা অনেক দিন তাদের বাড়িতে আছে। তাই মাঠের যেখানেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হোক। তাদের বাড়ি চিনে ফিরতে কোন অসুবিধা হয় না। মাঠে গরুর লাঙলের তেমন চাহিদা নেই। সবাই ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করে নেয়। কেউ কেউ আছে যারা ফসল কাটারত পর, প্রথম চাষটা গরুর লাঙলের দিয়ে নেয়। তাদের ভরসাতেই এখনও সবুজদের পরিবারটা টিকে আছে। দক্ষিণে ঘনপাতার কারণে ওদিকে কিছু দেখা যাচ্ছে না।
পশ্চিমে বাঁশঝাড়। কবরগুলোর দিকে তাকিয়ে সবুজের বুক ধক করে উঠল। বড় একটা নিশ্বাস ফেলে সে তার বুকটাকে কিছুটা হালকা করে নিল। তার বর্তমান অবস্থান থেকে উত্তরের দিকটা সবচে বেশি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। পাড়ার কার টিনের ছাপড়ার উপর কতগুলো ইটের চাপা দেয়া আছে। ইটের চাপার সাথে আরো কত কী ছাপড়ার উপর পড়ে আছে, তার ইয়াত্তা নেই। নূরে মাস্টারের পুকুরের ভেতর বয়স্ক মেহগনিগাছটির ছায়ায় পাঁচ-ছয়জন রোদপোড়া মানুষ মোষের মতোন গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে, কী সব গল্পে মজে আছে। হাপসা নিচ থেকে আবারও চেঁচিয়ে উঠল, কী ভাই। তুই আইলে গেছিস নাকি? সত্যিই সবুজ ক্লান্ত হয়ে গেছে। তবে হাপসার প্রশ্নটি যেন তার শরীরে প্রাণ সঞ্চার করে দিল। তাকে সেখান থেকে পুবদিকে সামান্য এগিয়ে যেতে হল। তার পায়ের নিচের বর্তমান ডালটি খুব সরু নয়। তবু তার মাথার উপরের ডালটিকে দুই হাতে কামড়ে ধরে তার পায়ের নিচের ডালটিকে আস্তে করে একবার নাড়া দিল। অমনি নিচ থেকে হাপসা চেঁচিয়ে উঠল, হ্যাঁ, সেজো ভাই, ঐ ডালেই। সবুজ কিন্তু এখনও আমটিকে দেখতে পায়নি। দেখার উদ্দেশ্যে সে ডালটিকে দ্বিতীয়বার নাড়া দিল। আর নাড়া দিতেই আমটি বোটা খসে একেবারে হাপসার সামনে গিয়ে পড়ল। কাঁচা আম অতোদূর থেকে নিচে পড়লে থাকে? ফেটে গেছে। হাপসা মন ভারী করে আমটিকে হাতে তুলে নিল। রস গড়িয়ে পড়ছে। কিছুটা ধুলোও লেগে গেছে- গড়ানো সেই রসের সাথে। দেখে হাপসার বুক ভেঙ্গে গেল। সে ভেবেছিল, আমটিকে সে ভূসির ঘরে লুকিয়ে রাখবে আর পাকলে সবুজকে সাথে নিয়ে রুটি দিয়ে মাখিয়ে খাবে। কিন্তু একি হলো! এ আম তো মরিচের গুড়া আর নুন দিয়ে মাখিয়েও খাওয়া যায় না। এতো টক।
সবুজ বুঝতে পারছে- হাপসা নিচে কেন এতো চুপচাপ। সে খুঁজে বেড়াচ্ছে অন্য একটি আম। যেটি হয়তো লুকিয়ে আছে অন্য কোন ডালে, ঘন এ পাতার আড়ালে।

Share.

মন্তব্য করুন