রূপকথার মৃত্যু নেই। তাই রূপকথার গল্পেরও মৃত্যু নেই। রূপকথা ও রূপকথার গল্পের অমরত্বের কারণ হলো তার সর্বমানবিক আবেদন। পাশাপাশি মানুষের জীবনের স্বপ্ন-সম্ভাবনা এবং অভিজ্ঞতার সারসমর্মকেও উপস্থাপন করে।
মানুষের কল্পনা শক্তি, চেতনা শক্তি সর্বোপরি মানসিক শক্তিকে বিকশিত করে। মানবিক চেতনার বিকাশ সাধনের মাধ্যমে মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। মানুষের ভেতরে সকল ধরণের মানবিক গুণাবলীর সমন্বিত বিকাশ সাধন করে সফল, স্বার্থক ও অনুকরণীয় জীবনাদর্শ হিসেবে মানব সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হবার জন্যে মানুষকে তৈরী করে। তাই বলা চলে, রূপকথার গল্প ব্যক্তিচরিত্র গঠনে সবিশেষ ভূমিকা পালন করে। আর এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও বিকাশ সাধনের কাজটি সবচে’ বেশী করে শিশু-কিশোরদের বেলায়।
প্রকৃতপক্ষে, রূপকথার গল্প অধিকংশ ক্ষেত্রেই শিশু-কিশোরদের কথা মনে রেখে সৃজন করা হয় না, কিন্তু এসব গল্পের সরল কথকতা, সংক্ষিপ্ততা, নাটকীয়তা, নিপুণ বর্ণনাভঙ্গি, চরিত্রের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ, কাহিনীর চমৎকার বুনন-কৌশল সহজেই আকৃষ্ট করে শিশু-কিশোরদের। শিশু-কিশোর পাঠকেরা রূপকথার নাটকীয়তা উপভোগ করে দারুণভাবে। এসব গল্পের চরিত্রগুলো তাদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে শুধু তাই নয়, বরং এসব চরিত্রকে তারা নিজেদের জন্য অনুসরণীয়-অনুকরণীয় বলেও ভাবতে শুরু করে।
এসব চরিত্রের বিচিত্র ধরনের নাটকীয়, হাস্যরসাত্মক, ভয় জাগানিয়া কিংবা দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড তাদের মনোজগতকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। তারা নিজেদের মধ্যেও সে সব চরিত্রের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। কল্পনা বিলাসী শিশু-কিশোররা নিজেদেরকে একেক জন মাসুদ রানা বা আহমদ মুসা ভাবতে থাকে। আর এসব চরিত্র যেসব দুঃসাহসিক, বীরত্বপূর্ণ, বুদ্ধিদীপ্ত ও অতিমানবীয় কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে শিশু-কিশোররাও এসব কাজ করার চিন্তা করতে থাকে। এতে তাদের কল্পনা শক্তি, অনুভূতি প্রবণতা, আত্মবিশ্বাস, বড় লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হাসিলের পরিকল্পনা করার মতো যোগ্যতা, অন্তর্দৃষ্টি ও বহিঃদৃষ্টির সম্প্রসারণশীলতা ও গুণাবলীর বিকাশ ঘটে। তারা তখন পরিশ্রমী কষ্ট সহিষ্ণু, ত্যাগী ও নিজেদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে জীবনের সবকিছু ত্যাগ করার মানসিকতা সম্পনড়ব হয়ে গড়ে উঠতে থাকে। আর মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার মহান গুণাবলী (যেমন : উদারতা, নমনীয়তা, ক্ষমাশীলতা, সভ্যতা-ভব্যতা, সত্যপ্রিয়তা, সত্যনিষ্ঠা, পরোপকারিতা, হৃদয়-মনের প্রসারতা, বিশালতা, সুরুচিশীলতা ইত্যাদি) দিয়ে নিজেদের জীবনকে সমৃদ্ধ ও স্বার্থক করে গড়ে তোলার সুযোগ পায়।
অর্থাৎ যে সব যোগ্যতা ও গুণাবলীর বিকশিত হওয়ার মাধ্যমে মানুষ দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠিত ও বিজয়ী হয়, তার প্রায় সবকিছুই তারা ছোটবেলায় রূপকথার গল্প অধ্যয়ন করে, সে সব গল্পের চরিত্রগুলোর কাছ থেকে শিখতে পারে, অর্জন করতে পারে।
অন্যভাবে বলা যায়, রূপকথার গল্প শিশু-কিশোরদের ব্যক্তিচরিত্র গঠনের শক্তিশালী ও কার্যকর মাধ্যম হতে পারে। এ ব্যাপারে আমরা দু’একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করতে চাই। যেমন ধরা যাক, প্রাচীন গ্রীক গল্পকার ঈশপের রচিত গল্পগুলোর কথা। ঈশপের গল্পেই আমরা দেখতে পাই, লোভী কাঠুরে ও লোভী কৃষকের পরিশ্রমের কথা। লোভ যে মানুষের জীবনকে কিভাবে ধ্বংস করে তা তিনি রূপকথার গল্পচ্ছলে মানুষের সামনে- বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের সামনে তুলে ধরেছেন। আবার সততার পুরষ্কার যে কত বেশী হতে পারে এবং সততা মানুষের জীবনকে কত বেশী উন্নত করতে পারে তাও তিনি দেখিয়েছেন। ঈশপের সব গল্পই হাজারো নৈতিক শিক্ষায় ভরপুর।
আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী ও পাঠকনন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ। তিনিও রূপকথার গল্প রচনা করে শিশু-কিশোর পাঠকদের সামনে নৈতিক শিক্ষা উপস্থাপন করেছেন। এক গল্পে তাঁর তৈরী করা চরিত্র বোকা দৈত্য। এ দৈত্য অত্যন্ত সহজ-সরল ও পরোপকারী। অথচ স্বার্থপর মানুষ নিজের স্বার্থে বোকা দৈত্যকে চিরকালের জন্যে সমুদ্রের তলদেশে আটকে ফেলে। এ কাহিনির বর্ণনা ও চরিত্র সৃজনের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ বুঝিয়ে দিলেন, স্বার্থপরতা ও হিংস্রতার ব্যাপারে প্রত্যেক ব্যক্তি সম্পর্কেই আমাদের সবার সতর্ক থাকা উচিত। একই সাথে তিনি আমাদেরকে এটাও বলে দিলেন, কারো সরলতা, উদারতা ও পরোপকারী মানসিকতাকে কখনো দুর্বলতা মনে করা উচিত নয়। প্রত্যেকের অধিকার-মর্যাদার ব্যাপারে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা উচিত।
একই ভাবে আমীরুল ইসলাম সংকলিত ‘আকাশ ভরা রূপকথা’ গ্রন্থে একটি চীনা গল্প রয়েছে ‘মোরগের কেন শিং নেই’ শিরোনামে। এ গল্পে চালাক ড্রাগন কথার ফুলঝুরি দিয়ে আর ভনিতা দেখিয়ে মোরগের সহানুভূতি ও আস্থা অর্জন করে। তারপর মোরগের সুন্দর শিং দু’টো নিয়ে চলে যায়। একদিন পর ফেরত দেয়ার কথা বলে শিং দু’টো নিলেও চতুর ড্রাগন আর কখনো ফিরে আসেনি আর মোরগের শিং দু’টোও ফেরত দেয়নি।
গল্পের শিক্ষা হলো, দুষ্টু লোকদের মিষ্টি কথা শুনে কখনো ভুলে যাওয়া উচিত নয়। যারা অতিমাত্রায় অনুনয়-বিনয় প্রদর্শন করে তাদের ব্যাপারে অধিকতর সতর্ক থাকা উচিত। চতুর ও স্বার্থপর লোকদের চটকদার কথা শুনে কখনো ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। প্রতারণার শিকার হওয়া যাবে না।
রূপকথার কিশোর দুনিয়া । মাহবুব মোর্শেদ মজুমদারএকইভাবে উক্ত সংকলনের ‘যেমন রাজা তেমন মন্ত্রী’ শিরোনামের গল্পের মূল চরিত্র হলো একজন জেলে। এই ছেলেটি তার রাজ্যের রাজা ও মন্ত্রীর অনেক অসম্ভব ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপায়িত করেও কোনো পুরষ্কার লাভ করতে পারেনি। বরং পেয়েছে হত্যার হুমকি অপমান আর লাঞ্ছনা। কিন্তু জেলে ছেলেটি আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণায় মনোবল সঞ্চয় করলো সে হতাশ হলো না। বরং তার মহান লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো। এভাবে নানা নাটকীয় ঘটনা শেষে সেই বিজয়ী হলো। জেলে থেকে হয়ে গেল রাজা। আমরা এ গল্পের শিক্ষা থেকে বুঝতে পারি, মানুষের উদ্দেশ্য যদি হয় সৎ, আর সেই সদিচ্ছাকে বাস্তবে রূপায়িত করার মতো যথেষ্ট মনোবল, আত্মত্যাগ, পরিশ্রমপ্রিয়তা এবং সঠিক কর্মকৌশল ও কর্মপদ্ধতি যদি থাকে তবে মানুষ সফল হবেই।
এভাবে রূপকথার গল্প রোমাঞ্চকতা, অভিনবত্ব, কথকতার ঢং ও নাটকীয়তার মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের সামনে জীবনের মৌলিক সত্যগুলোকেই উপস্থাপন করে। দুনিয়ার সকল দেশেই রূপকথা জীবনকে সমৃদ্ধকরণের শিক্ষা শিশু-কিশোরদের দিয়ে থাকে।
আর সে কারণেই দুনিয়ার প্রায় প্রতিটি জাতিই তাদের শিশু-কিশোরদের চরিত্র ও যোগ্যতার বিকাশ সাধনের জন্যে তাদের নিজেদের পরিমণ্ডলে ও নিজস্ব ভাষায় রূপকথার গল্পের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। তাইতো আমরা দেখতে পাই, যে জাতির রূপকথার গল্পের ভা-ার যত বেশী সমৃদ্ধ সে জাতি ততা বেশি উন্নত। রূপকথার গল্পের মাধ্যমে প্রতিটি জাতিই নিজেদের গৌরবময় অতীত-গাঁথাকে তাদের শিশু-কিশোরদের সামনে তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছে। ফলে আগামী দিনের নেতা ও জাতির কাণ্ডারী আজকের শিশু-কিশোররা তাদের পূর্বপুরুষদের অতীত কর্মকাণ্ড ও বীরত্ব নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং নিজেদের সভ্যতা-কৃষ্টির সাথে অন্যান্য সভ্যতা-কৃষ্টির পার্থক্য সম্পর্কে অবগত হতে পারছে; বুঝতে ও হৃদয়ঙ্গম করার সুযোগ পাচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা অর্জন করতে পারছে ধর্মবোধ, জাতীয়তাবোধ এবং নিজেদের নিজস্ব জীবনধারা প্রক্রিয়া। অন্যকথায় বলা যায়, রূপকথার গল্পের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে প্রতিটি জাতিই তাদের শিশু-কিশোরদের মধ্যে ধার্মিকতা, দেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ, স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র ও মৌলিকত্ব সৃষ্টি করে চলেছে।
আমরা জানি, প্রাচীন সভ্যতার অনুসারী জাতিগুলোর মধ্যেই রূপকথার গল্পের চর্চা তুলনামূলক বেশী। আর এসব জাতিই নিজেদের শিশু-কিশোরদেরকে নিজস্ব ধর্ম-সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা-মৌলিকত্বে সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলে আগামী দিনের বিশ্বনেতৃত্ব দেয়ার প্রয়াস-প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য জাতিগুলো হলো ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী, চীন, জাপান, ভারতবর্ষ ইত্যাদি। অর্থাৎ আমরা দেখতে পাই, দুনিয়াতে বিজয়ী হবার ক্ষেত্রে এবং নেতৃত্ব দেবার ক্ষেত্রে রূপকথার গল্পের মতো শিল্প-সাহিত্যও বিরাট কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই আমরা যারা নেতৃত্বের অভিলাষী তাদের উচিত হবে জীবনের অন্যান্য দিক ও বিভাগের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যের উন্নয়ন সাধনের জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা-সাধনা চালিয়ে যাওয়া। শিল্প-সাহিত্যের অপরিহার্য মৌলিক শাখা রূপকথার গল্পের ভাণ্ডার সকল দিক থেকে সমৃদ্ধ করা। এবং এ মাধ্যমটিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের আগামী দিনের কাণ্ডারী আজকের শিশু-কিশোরদের চরিত্র, নৈতিকতা ও যোগ্যতার চূড়ান্ত বিকাশ সাধনের জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো।
রূপকথার গল্পে শিশু-কিশোরদেরকে কেবলমাত্র নিজস্ব ধর্ম-সংস্কৃতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ করে মৌলিকত্ব ও স্বকীয়তা সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করে শুধু তাই নয়; বরং তাদেরকে সর্বমানবিক চেতনাসম্পন্ন বিশ্বনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতেও বিরাট ভূমিকা পালন করে। রূপকথার গল্প তাদেরকে গোটা মানব জাতি, মানব সভ্যতা ও মানবেতিহাসের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে নিয়ে আসে। তারা দেখতে পায় জাতি-ধর্ম, দেশ-কাল ও পাত্র নির্বিশেষে সত্য ও সুন্দরের বিজয় আর অসত্য ও অসুন্দরের পরাজয়।
সার্বজনীন ও চিরকালীন আস্বাদে ভরপুর রূপকথার গল্প দুনিয়ার যেকোনো দেশে, যে কোনো জনগোষ্ঠীতে বা যেকোনো সংস্কৃতিতেই সৃজন করা হোক না কেন শিশু-কিশোররা সেখানে খুঁজে পায় সাধারণ মানুষের সংস্কার তাদের মূল্যবোধ, তাদের জীবন-যাপন পদ্ধতি, তাদের স্বপ্ন। এবং তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সভ্যতা-কৃষ্টি। তাই বিভিন্ন দেশের রূপকথা পড়লে তারা সহজেই সন্ধান পায় উন্নত মানবিক গুণের। পরিচয় পায় বিশ্ব-মানবের।
উপলব্ধি করতে পারে দুনিয়ার সকল মানুষই তাদের পরিচিত, সকলেই তাদের আত্মীয়-পরিজন। আরো উপলব্ধি করে যে, তারা এক বৃহৎ মানব পরিবারের সদস্য। গোটা বিশ্ব মানবতা একটা বৃহৎ পরিবার। আর তারা এই পরিবারেরই একজন। এভাবে তাদের মধ্যে বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবতাবোধ গড়ে ওঠে। হিংসা-বিদ্বেষ, রেষারেষি ও হানাহানির পরিবর্তে গোটা বিশ্ব মানবতার সুখ-সমৃদ্ধি, শান্তি-স্বস্তি ও নিরাপত্তা এবং সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন ও প্রগতির স্বপ্নই তারা দেখে। আর সে মহান সুন্দর স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্যে তারা নানা রকম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়। নানা রকম আন্দোলন-সংগঠনের ভবিষ্যত নেতৃত্ব হিসেবে নিজেদেরকে তারা গড়ে তোলে। নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জনের এই শিক্ষা শিশু-কিশোররা পেতে পারে রূপকথার গল্প থেকে।
রূপকথার কিশোর দুনিয়া । মাহবুব মোর্শেদ মজুমদাররূপকথার গল্প শিশু-কিশোর পাঠকদের সামনে কিভাবে নেতৃত্বের গুণাবলী ও যোগ্যতাকে তুলে ধরে তা দু’একটি উদাহরণ দিলেই তোমরা বুঝতে পারবে। আমীরুল ইসলাম কর্তৃক সংকলিত ‘আকাশ ভরা রূপকথা’ শীর্ষক গ্রন্থের একটি গল্প হলো ‘দৈত্য ও মলির গল্প’। এই গল্পের মূল চরিত্র হলো দরিদ্র চাষিকন্যা মলি। হতদরিদ্র পরিবারের এই ছোট্ট মেয়েটি অসীম সাহসী, তীক্ষ্ণ, বুদ্ধিমতী, সহৎ লক্ষ্যাভিসারী এবং সময়ের দাবী অনুযায়ী কাজ করার যোগ্যতার অধিকারী। তার এসব যোগ্যতা ও গুণাবলীর কারণেই সে ভয়ংকর অত্যাচারী ও পাপিষ্ঠ দৈত্যকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছে। যে দৈত্যকে পরাস্ত করতে মহাশক্তিধর রাজার পক্ষেও সম্ভব হচ্ছিলো না, সেই দৈত্য পরাস্ত হলো ছোট্ট চাষিকন্যা মলির কাছে। তা সম্ভব হয়েছে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সততা ও অবিচলতা, সাহস ও বীরত্ব, উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা, সময়ের চাহিদা বুঝে কাজ করতে পারা ইত্যাদি গুণাবলীর কারণে। আর এই শিক্ষা শিশু-কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সকলের জন্যেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই সংগ্রামের শিক্ষা পাই ছোট্ট মেয়ে মলির কাছ থেকে।
এছাড়াও আমরা সবাই বানরের রুটি ভাগের গল্প এবং লেজকাটা শিয়ালের ষড়যন্ত্র পাকানোর গল্পের সাথেও পরিচিত। নেতৃত্ব প্রত্যাশীদের উচিত হবে এসব গল্পের কাহিনী ও চরিত্র থেকে সততা, সত্যবাদিতা, সুবিচার, সময়োপযোগিতা, সময়কে ধারণ করাসহ বিভিন্ন মানবিক ও নৈতিক গুণাবলী অর্জনের জন্যে চেষ্টা করা।
একইভাবে ভালুকের আগমন ও সেই প্রক্ষিতে দু’বন্ধুর কৌশল অবলম্বনের গল্প, সিংহ ও ইঁদুরের পারস্পরিক সহযোগিতার গল্প, পাথর ফেলে কাকের পানি পান করার গল্প ইত্যাদি সব কিছুতেই লুকিয়ে আছে অসীম তাৎপর্য, নৈতিক শিক্ষা আর মহৎ মানবীয় চরিত্র গঠনের প্রয়োজনীয় উপাদান। তাই আগামী দিনের বিশ্বজনীন মানবতাবাদী ও শান্তির প্রতিষ্ঠাকামী নেতা ও কর্মী হিসেবে আজকের শিশু-কিশোরদেরকে তৈরী করতে চাইলে সাহিত্যের মৌলিক শাখা রূপকথার গল্পকে একটি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ ও উন্নয়ন সাধন করা আমাদের অপরিহার্য কর্তব্য।
আমরা এতক্ষণ আলোচনা করেছি, শিশু-কিশোরদের মূল্যবোধ, চেতনা, জীবনদৃষ্টি, জীবনদর্শন এবং সার্বিক জীবনধারা বিনির্মাণে রূপকথার গল্পের শিক্ষা বিরাট ভূমিকা পালন করে। তার স্বপ্ন ও কল্পনার জগতকে বিস্তৃত করে। আর সেই সাথে তৈরী করে ভালোবাসার শক্তি; যে শক্তির বলে তাকে অতিক্রম করতে হয় জীবনের দীর্ঘ দুর্গম পথ। রূপকথার গল্প শিশু-কিশোরদের ভেতরে যাবতীয় সকল ধরনের মানবীয় ও নৈতিক গুণাবলীর বিকাশ সাধন করে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে ভূমিকা পালন করে। তাই নেতৃত্ব প্রত্যাশী ও উন্নয়ন প্রত্যাশী প্রত্যেক ব্যক্তি, দল, দেশ, জাতি কিংবা জনগোষ্ঠীর একান্ত উচিত হলো নিজেদের শিশু-কিশোরদেরকে ধর্ম, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং শিল্প-সাহিত্যে ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আলোকে আলোকমন্ডিত করে গড়ে তোলা। আর এই কাজটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে রূপকথার গল্প যেহেতু বিপুল ভূমিকা পালন করতে সক্ষম; তাই সাহিত্যের এই শাখাটিকে সর্বান্তকরণে উন্নত করে আপন মহৎ লক্ষ্য হাসিলে কাজে লাগানো সময়ের দাবী।

মডেল: তাওহিদ, জাহিদ ও তন্ময়
ছবি: শাহরিয়ার সকাল

Share.

মন্তব্য করুন