উত্তরবঙ্গের ছোট মফস্বল শহর সাহেবগঞ্জ। জেলা শহর হলেও এখনও শহরের অনেক কিছুই অসম্পূর্ণ। লোডশোডিং যেন এই শহরের একটা অংশ। সন্ধ্যা সাতটা বাজলেই চারদিকে নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শহরের লোকমুখে প্রচলিত আছে নানা ভৌতিক কাহিনী। হয়ত অনেকে সেগুলো প্রত্যক্ষ করেও থাকতে পারে। শহর থেকে একটু দূরে ৫ কিলোমিটার গেলে চোখে পড়বে হিজলতলী বাজার। বাজার বললে ভুল হবে বাজার নিয়ে একটি ছোট গ্রাম হিজলতলী। পাশ দিয়ে বয়ে গেলে নর্ত নদী। নদীর দু’পাড়ে শুধু শালবাগান। একটু পর পর গেলে চোখে পড়বে মানুষের বাড়িঘর। এই গ্রামেরই মেয়ে মিলু ও তার ভাই দিপু। সমবয়সী দুই ভাইবোন। বাবা হিজলতলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শফিক চৌধুরী। তাদের বাড়িটা নদীর ধারে শালবনের কাছে। শহর থেকে যেতে তাদের ১০ মিনিট লাগে। এই শালবন আর নদী নিয়ে অনেক কথা প্রচলিত থাকলেও শফিক চৌধুরীর পরিবারে এর ওপর বিশেষ প্রভাব পড়েনি। তারা শিক্ষিত মানুষ। এসব বিশ্বাস করেন না। যদিও মিলু ও দিপুর মা পাশের বাড়ির দামিমার কাছে অনেক কথাই জানতে পারেন। মিলু সেভেন আর দিপু এইটে পড়ে। সারাদিন স্কুল আর বিকালে নদীর পাড়ে ঘুরতে যাওয়া তাদের দৈনিক একটা রুটিনে পরিণত হয়েছে। নদীতে অনেক ডিঙি ও জেলে নৌকা চলে। ওরা চুপি চুপি একটা ডিঙি নৌকা নিয়ে নদীর অনেক কাছে চলে যায়। বাবা বার বার নিষেধ করো সত্ত্বেত্ত তারা কাজটি করে। অবশ্য মা টাকা দিলে তারা নদীতে যায় জেলেদের কাছে টাটকা মাছ কিনতে। মাছ কেনাও হয় আবার ঘুরাও হয়। মা অবশ্য বলে দেন, সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরতে।

দুই.
সময়টা বর্ষাকাল। সকাল থেকে রাত অব্দি ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। যেন থামবার কোন যো নেই। চারপাশ অন্ধকার করে কখন যে সন্ধ্যা নামে সেটা বুঝা মুশকিল। মা রানড়বা ঘরে রাতের খাবারের তোড়জোড় করছেন। বাবা রুমে ইইঈ এর খবর শুনছেন। মিলু ও দিপু ঘরে বই পড়ছে। আগামীকাল শুক্রবার স্কুল বন্ধ থাকবে। তাই তাদের আনন্দের শেষে নেই। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে। বাবা মাকে ডাকলেন, ‘রাবেয়া শুনছ, বিদ্যুৎ চলে গেল। হারিকেন জ্বালাও। ছেলেমেয়েরা পড়ছে।’ মা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন, ‘যাচ্ছি রে বাবা, রান্না প্রায় শেষের দিকে। কি যে হয়েছে আজকাল খালি বিদ্যুৎ চলে যায়।’ মা হারিকেন নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। একটা তাদের ঘরে দিলেন আর একটা নিয়ে মিলুদের ঘরে গেলেন। মাকে দেখে মিলু আর দিপু প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল। মা বললেন, ‘কিরে, ভয় পেয়েছিস। কী হয়েছে?’ মিলু বললো, ‘না মা এমনি ভয় লাগছিল।’ মা গিয়ে জানালাগুলো বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলেন। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড় শুরু হলো। শোঁ শোঁ বাতাসে ঘরের জানালাগুলো খুলে গেল। মিলু ও দিপু ভয়ে জড়োসড়ো। দিপু জানালার দিকে তাকালো, বাইরে জমাট অন্ধকার। তাদের বাড়ি থেকে একটু দূরেই কবরস্থান। ওদের রুমে থেকে জানালা দিয়ে তাকালে চোখে পড়ে একটা বাঁশঝাড় ও কবরস্থানটা। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে দিপু আঁতকে উঠলো। করবস্থানটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দিপু চেঁচিয়ে বললো, ‘মিলু দেখ, দেখ। কবরস্থানে একটা লোক।’ মিলু সাহস করে তাকালো জানালার দিকে। সত্যিই তো। সাদা কাপড় পরা একটা লোক কবরের পাশে বসে কি যে বিড় বিড় করে পড়ছে। মিলু একটু সাহসী ছিল। ও বললো, ‘বাদ দে দাদা ভাই। কী দরকার আমাদের এসব ভেজালে জড়ানোর। তার চেয়ে বরং জানালাগুলো বন্ধ করে দেই।’ ‘ওরে বাবা, আমার ভয় করেছে রে মিলু। আমি পারবো না।’ দিপু প্রায় চেঁচিয়ে কথাগুলো বললো। মিলু বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তুই হারিকেন দেখা আমি বন্ধ করছি।’ দিপু হারিকেন দেখালো। মিলু জানালাগুলো ভালো করে লাগিয়ে দিলেও ভয়ে ওর হাতগুলো কাঁপছিল। দু’ভাই বোন আবার পড়া শুরু করলো। বাইরে ঝড় হতেই লাগলো। কিছুক্ষণ পর ঝড় ও বৃষ্টি দুটোই থেমে গেলে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে এলো। মা ওদের ভাত খেতে ডাকলেন। ওরা বাবার পাশে বসে নিঃশব্দে ভাত খেয়ে উঠে গেলো। রাতে ওরা ভয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। সারারাত দুঃস্বপ্ন ও আতঙ্কে পার করলো। মাঝে মাঝে পাশের শালবন থেকে শিয়ালের ডাক, কুকুরের কান্না শুনতে পেল। একটা নিশাচর পেঁচা ডেকেই যাচ্ছিল। লোকে বলে, পেঁচার ডাক নাকি অশুভ কিছুর ইঙ্গিত। আর পাশের বাড়ির সালেহা দাদী বলেছিলেন যে, কুকুর ও প্রাণী খারাপ জিনিস যেমন জিন, শয়তানকে দেখতে পায়। তাই ভয়ানক ডেকে কাঁদতে থাকে। ভয়ে দু’ই ভাই-বোন রাতটা কাটালো।

তিন.
আজ শুক্রবার। স্কুল বন্ধ। বাবা নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়লেন শহরের উদ্দেশে। বাবার কিছু কাজ ছিল শহরে। মিসেস রাবেয়া চৌধুরী অবাক হয়ে গেলেন। কী লোক রে বাবা। কোন কথা শুনতে চান না। বলেন, এগুলো গুজব আর কুসংস্কার। এসবে কান না দিতে। আর বলে যান, ওরা যেন যেখানে সেখানে না যায়। বাবা চলে গেলেন। হঠাৎ করেই সালেহা চাচী বাড়িতে এসেই চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন, ‘বউমা, তুমি বাড়িতে? এদিকে পাড়ায় সর্বনাশ হয়ে গেছে।’ বলেই সালেহা বেগম মোড়ায় বসলেন। ‘কী হয়েছে চাচী? সমস্যা?’ মা একটু আর্তনাদ করে বললেন। এবার সালেহা বেগম বলতে শুরু করলেন, ‘জানোনা বুঝি। কয়দিন আগে রহিমের বাবাকে যেখানে কবর দেয়া হয়েছিল আজ সকালে সেখানে তার আধা খাওয়া লাশটা পড়ে আছে। কারা যেন কবর খুঁড়ে লাশটা তুলে ফেলেছে। কবর স্থানে প্রচুর লোকের ভিড়।’ দিপু ও মিলু কথাগুলো শুনে আঁতকে উঠল। কারণ তারা রাতে যেটা দেখেছে সেটা ভুল নয়। সালেহা বেগম খবরটা দিয়েই চলে গেলেন। মা খুব চিন্তিত হয়ে গেলেন। ছেলে- মেয়েদের সাবধান করে দিয়ে বললেন, ‘যা শুনেছ ভালো কথা। এসব বাবাকে বলতে যেও না। শুনলে আমার আর রক্ষা থাকবে না।’ মিলু ও দিপু মাথা নাড়লো। তারা সেখানে যেতে চাইলে মা নিষেধ করলেন। পরে অনেক জেদা জেদিতে রাজি হলেন তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হবে। মা খাওয়ার আগে ওদের আয়াতুল কুরসি পড়ে শরীর বন্ধ করে দিলেন। বাড়ির পাশে বাঁশঝাড়। তার পরে কবরস্থানটা। দিনের বেলায়ও ভয়ে গা ছমছম করে। গোরস্থানে প্রচুর লোক। একজন ওঝা টাইপের একটা লোক লাশটা পরীক্ষা করে বললেন, ‘এটা কোন মানুষের কাজ না। বরং কোন পিশাচ এটা করছে। সবাই সাবধান। মিলু ও দিপু ভিড় ঠেলে উঁকি দিতেই আঁতকে উঠলো। গলা পোঁছা, কাফনে মোড়ানো লাশটাকে প্রায় খুবলে খাওয়া হয়েছে। লাশটা মুখ হা করে ভেংচি কেটে তাকিয়ে আছে। একটা পচা বোটকা গন্ধ বাতাসকে ভারি করে ফেলেছে। তারা কবরটা দেখল। এত সুন্দর করে বাঁশগুলো একসাইট করে কবরটা খুঁড়েছে। কোনো প্রাণী বা শিয়াল-কুকুরের পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। ওঝা বললেন, ‘এই লাশ এমনি এমনি কবর দেয়া যাবে না। এটার ওপর কালো জাদুর প্রভাব আছে। একে আমি আমার মন্ত্র দিয়ে প্রভাব মুক্ত করেছি। দুপুরের পরে গোসল দিয়ে আবার জানাজা করে কবর দিবেন। নাহলে ঐ পিশাচ আবারও এটা তুলে নিয়ে যাবে।’ ওঝা কিছু জিনিস ব্যাগ থেকে বের করে বিড় বিড় করে কি যেন পড়তে লাগলো। প্রায় আধা ঘণ্টা পর তিনি থামলেন। বললেন, ‘যান এটাকে গোসল দিয়ে জানাযা করে কবর দিন। কিন্তু সাবধান সবাই। ঐ পিশাচ আশপাশে কোথাও আছে। ও নতুন করে অন্য কবরগুলোতেও আক্রমণ করবে। লোকজনের মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হলো। লাশের লোকজন লাশ বাড়ি নিয়ে গেলো। মিলুরা সেখান থেকে দ্রুত বাড়ি চলে আসলো। তারা মাকে সব খুলে বললো। মা কিছুটা ভয় পেলেন। তবে কী হিজলতলী গ্রামে কোন অশুভ ছায়ার কুপ্রভাব পড়লো নাকি?

অন্ধকারের আতঙ্ক । আহমেদ কিবরিয়াচার.
শনিবার সবাই স্কুলে গেল। সবাই মাঠে গোল করে বসেছে। সবার মুখে মুখে একটাই কথা গ্রামে পিশাচ ঢুকেছে। প্রথমে মৌমিতা শুরু করল, ‘কিরে তোরা সবাই চুপ যে? কিছুই জানিস না?’ মিলু উত্তরে বলল, ‘কী বলবো বল? সবাই তো কম বেশি জানিস ব্যাপারটা। তাছাড়া আমরা কি-বা করতে পারি?’ দীপু বললো, ‘কি বলবো ভাই। এতদিন এগুলো লোকের মুখে শুনতাম। এখন দেখি সত্যি এগুলো ঘটে যাচ্ছে।’ মৌমিতা বললো, ‘ঠিক বলেছিস দিপু। সবাই এই বিষয়গুলোকে হাসিয়ে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু যখন তার সাথে ঘটে তখন সে বুঝতে পারে।’ রাজু বললো, ‘শোন, বিষয়টি আমরা আমাদের বিজ্ঞান স্যার জনাব রফিক সাহেবকে বলি। উনি অনেক জ্ঞানী আর ভালো মানুষ। অবশ্যই তিনি আমাদের বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করবেন।’ সবাই রাজুর কথায় সায় দিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ, ছুটির পর আমরা স্যারের সাথে কথা বলবো।’ ক্লাসের ঘণ্টা বেজে উঠলো। সবাই ক্লাসে গেল। ক্লাস হতে লাগলো একটার পর একটা। বিকাল ৪টায় স্কুল ছুটি হলো। সবাই অফিস রুমে গেল স্যারের সাথে দেখা করতে। স্যার সবাইকে দেখে মুচকি হেসে বললেন, ‘কি খবর তোমাদের? কিছু বলবে?’ সবার পক্ষে থেকে মিলু সব খুলে বললো স্যারকে। স্যার সবাইকে আশ্বাস দিলেন, তিনি বিষয়টি দেখবেন এবং আগামী শুক্রবার স্কুল মাঠে সবাইকে নিয়ে বসবেন। স্যারের কথা শুনে সবাই খুশি। সবার মধ্যে একটা অস্থিরতা। কবে আসবে শুক্রবার।

পাঁচ.
শুক্রবার নামাজের পর সবাই স্কুলের মাঠে বসে আছে। রফিক স্যার লাল বাইকে করে এলেন। সবাই স্যারকে সালাম দিল। স্যার মুচকি হেসে সালামের উত্তর দিয়ে বসলেন। বললেন, ‘সবাই কেমন আছো? আমি জানি, তোমরা অনেক ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে দিন পার করছো। আমিও বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছি। আর আমিও চাই তোমরা আমাকে সাহায্য করো। তাই নয়কি?’ স্যার সবার দিকে তাকালেন। সবাই বললো, ‘হ্যাঁ স্যার, অবশ্যই। তবে…’ স্যার বললেন, তবে কী? শোন, আমি বিষয়গুলোর যুক্তিসঙ্গত, বিজ্ঞানভিত্তিক আবার প্যারানরমাল সাইকোলজির ব্যাখ্যা দেবো। একটা কথা মনে রাখবে, ভৌতিক বা এ জাতীয় বিষয়গুলোর কোন বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা থাকে না। তবে গবেষকরা বা ডাক্তাররা এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন। আর প্যারানরমাল সাইকোলজির বাংলা কি জানো কেউ? বলো তো একজন। মৌমিতা চট করে উত্তর দিলো, ‘অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞান। তাই না স্যার?’ স্যার বললেন, হ্যাঁ ঠিক বলেছ। তোমরা মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে জানো। মনোবিজ্ঞান হলো বিজ্ঞান। অপরদিকে অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞান কোন বিজ্ঞান নয়। তবে অনেক গবেষক একে বিজ্ঞান বলে দাবি করেন। মজার বিষয় পৃথিবীর অনেক দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সাবজেকটি পড়ানো হয়। একটি বিষয় লক্ষণীয় আর সেটা হলো, ভৌতিক গল্প, উপন্যাস, হরর মভি, মানুষের এসব জিনিস প্রত্যক্ষণ ও প্রচলিত ভৌতিক কাহিনীগুলোর মূল বিষয় পৃথিবীর সব দেশে একই। যেমন- উপমহাদেশে ভৌতিক ব্যাপারে যেসব মিথ (Mythology) চালু রয়েছে তার সাথে দেখো ইউরোপের মিথগুলোর মিল আছে। ভারতে আমরা যাকে শাকচুন্নী বা পিশাচিনী বলি আয়ারল্যান্ডের লোকমুখে বা Iris (Mythology)) তে এটাকে পার্সি বলে। এই মহিলা কালো কাপরের আলখাল্লা পরে ঝাড়ুর ওপরে ভর করে উড়ে বেড়ায়। আবার বাংলাদেশে আমরা যেটাকে পিশাচ বলি ইউরোপে সেটা Vampire বা ড্রাকুলা। অনেকে বলেন, অমুক লেখক বা তমুক মুভিতে এটা দেখেছি এটা আবার আরেক লেখক নকল করে তার লেখায় লিখেছে বা তার মুভিতে দেখানো হয়েছে। আসলে এটা ভুল ধারণা। কারণ ভৌতিক বিষয়গুলো যেখানেই ঘটুক এগুলোর মিল আছে। তাই এগুলো যেমন নকল নয় তেমনি গুজবও নয়। তবে আমাদের অবশ্যই কুসংস্কার বর্জন করতে হবে। স্যার এবার থামলেন। সবাই স্যারের দিকে তাকালো। এবার স্যার বললেন, ‘আমি এতো কথা বলছি কেন? বুঝতে পেরেছো কি তোমরা?’ সবাই বললো, ‘না স্যার।’ এবার স্যার বললেন, ‘আমার উদ্দেশ্য মূল বিষয়টিতে যাওয়ার আগে কিছু প্রাথমিক ধারণা দেয়া। না হলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। কথা হলো, পৃথিবীতে ভয় বা ভূত বলে কিছু নেই। মনোবিজ্ঞান বলছে, এটা ভুল প্রত্যক্ষণ। মেডিক্যালে এই টার্মটির নাম ‘হ্যালুসিনেশন’। আবার আমরা ‘নার্ভাস ব্রেকডাউন’ করে ভয় পাই। কথা হলো, ‘হ্যালুসিনেশন’ বা ‘নার্ভাস ব্রেকডাউন’ কী? তোমরা জানো আমাদের শরীরে ইলেকট্রোলাইট রয়েছে। যখন আমরা বাস্তব জগতের সাথে আমাদের মস্তিষ্কের সংযোগ ঘটাতে ব্যর্থ হই তখন আমাদের শরীরের ইলেকট্রোলাইটগুলো ইমব্যালেন্স হয়। একে কেমিক্যাল ইমব্যালেন্স বলে। তখন আমরা ভয় পাই। এটা তো গেল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। কিন্তু এসব ছাড়াও তো ভয় ক্রিয়াটি সংঘটিত হয়। এবং এগুলোর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। আমরা বিশ্বাস করি, জিন ও শয়তান আছে। আসলে ভূত, বিশ্বাস, ড্রাকুলা, আত্মা এগুলো আলাদা কিছু নয় বরং একশ্রেণীর খারাপ জিন বা শয়তান এসবের রূপ নিয়ে মানুষের ক্ষতি করে ও ভয় দেখায়। হিজলতলী গোরস্থানে যে ঘটনা ঘটেছে তাও একশ্রেণীর খারাপ জিন ও শয়তানের কাজ। পবিত্র কুরআনে জাদু সম্পর্কে আয়াত আছে। জিনদের জন্য সূরা জিন নাজিল হয়েছে। তাই আমাদের প্যারানরমাল সাইকোলজি পুরো বিশ্বাস না করলেও কুরআন ও হাদিসের সাথে সাথে যেগুলো সাংঘর্ষিক নয় সেগুলো বিশ্বাস করা যাবে। এবার দিপু বললো, আচ্ছা স্যার, ‘অনেকে বলে আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির আত্মা নাকি ক্ষতি করে। কথাটা কি ঠিক?’ স্যার বললেন, ‘শোন তবে। প্রথম কথা হলো, মৃত্যুর পরে মানুষের আত্মার কোন ক্ষমতা থাকে না। সকল আত্মাকে মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর ফেরেশতারা একটি বিশেষ জায়গায় আটকে রাখেন। কিন্তু কোন খারাপ জিন বা শয়তান হয়ত অমুক মৃত ব্যক্তির রূপ নিয়ে এসে ভয় দেখায় বলে লোক সেটাই মনে করে। অনেক কথা বললাম। তোমাদের এতটুকু জানলেই হবে। এর বেশি জানার কোন দরকার নেই, তবে ভয় পাওয়া যাবে না। মনে রাখবে যত খারাপ শক্তি হোক না কেন মহান আল্লাহর শক্তির কাছে এগুলো কিছুই না। তবে, ঐ খারাপ লোকটার ব্যাপারে খবর নিতে হবে। তবে খুব সাবধানে, ও যেনো বুঝতে না পারে আমরা ওর পিছু নিয়েছি। আর হ্যাঁ, একজন ভালো বুজুর্গ আলেমের সাহায্য লাগবে আমাদের। যত বড় খারাপ জিনিস হোক না কেন আল্লাহর কালামের কাছে এগুলো তুচ্ছ।’ এবার স্যার চুপ হলেন। মিলু বললো, ‘আমরা কি আজ রাতেই অভিযান শুরু করবো নাকি স্যার?’ স্যার বললেন, ‘না। আজ আমরা টিম গঠন, কার্যপদ্ধতি প্রণয়ন করবো। তার পর মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলবো। তাছাড়া গোরস্থানের সিকিউরিটি গার্ডকে হাত করতে হবে। সবাই মিলে ইনশাআল্লাহ ঐ খারাপ পিশাচটাকে ধ্বংস করবো। ও একটা ভয়ানক মুর্দামোর। মরা মানুষের মাংস ওর প্রিয় খাবার। হায় আল্লাহ। না জানি কতো পবিত্র লাশের মাংস খেয়েছে অশরীরীটা।’ এবার স্যার টিম গঠন করে প্রত্যেককে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। সবাই বিকেলের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে গেল। স্যারও চলে গেলেন।

ছয়.
রাত ১২ বেজে ৪০ মিনিট। ১টা বাজতে আর মাত্র ২০ মিনিট। লোকে বলে রাতের এটাই উপযুক্ত সময়। এ সময় অশরীরী খারাপ জিনিসরা জেগে ওঠে। সবাই স্কুলের পিছনে লিচু গাছ তলায় বসেছে। সবার হাতে টর্চ লাইট, মোবাইল ফোন, বিশেষ ধরনের লাঠি। গলায় সবার আল্লাহর নামখচিত বিশেষ ধরনের সুরক্ষাকারী লকেট। স্যারের হাতে বিশেষ ধরনের ক্যামেরা, ভাইব্রেটর ও উচ্চ তরঙ্গ মাপার বিশেষ যন্ত্র। কোন খারাপ কিছুর উপস্থিতি হলে এই ভাইব্রেটর কাঁপতে থাকে। আর স্বাভাবিক তরঙ্গ যখন খারাপ কিছুর উপস্থিতিতে যে পরিবর্তন সাধিত হয় তা এই যন্ত্র মেপে লাল ও সবুজ সিগন্যাল দেয়। লাল বিপদের চিহ্ন আর সবুজ নিরাপদ। মৌমিতার হাতে চায়ের ফ্লাস্ক ও শুকনো জলখাবার। ইমাম সাহেবের হাতে আল্লাহর কালামখচিত লোহার বিশেষ ধরনের রড। খারাপ পরিস্থিতিতে তিনি এটা দ্বারা সবাইকে রক্ষা করবেন ও খারাপ পিশাচটার হাত থেকে থেকেও রক্ষা পাবে। সবাই চা-নাস্তা খেলো। ইমাম সাহেব প্রত্যেকের দেহ বন্ধ করে দিলেন। স্যার সবাইকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। গোরস্থানের সিকিউরিটি গার্ড নুরু মিয়া ও তমিজ মিয়া তাদের সবরকম হেল্পের জন্য রেডি হলো। ইমাম সাহেব তাদের শরীর বন্ধ করে দিলেন ও গলায় দুটো লকেট পরিয়ে দিলেন। স্যার কাউকে একা ছেড়ে দিলেন না। প্রত্যেক গ্রুপে দু’জন করে থাকলো । সবাই আস্তে আস্তে গোরস্থানের ভিতরে প্রবেশ করে দক্ষিণ দিকের ঝোপ যেখানে কোন কবর নেই সেখানে লুকালো। স্যার ও ইমাম সাহেব গোরস্থানের মাঝখানে কামেরাটা স্থাপন করলেন। তার সাথে কিছু দূরে দূরে তার নিয়ে ঝোপের ভিতরে ভাইব্রেটর ও তরঙ্গ মাপক যন্ত্র বসালেন এবং সেখানে ল্যাপটপ সংযোগ দিলেন যাতে গোটা গোরস্থানটা দেখা যায়। ইমাম সাহেব ঝোপের চারপাশে কিছু বিশেষ ধরনের লোহার শিক গাড়লেন। এবার সবাই নিরাপদ। সিকিউরিটি নুরু মিয়া ও তমিজ মিয়া গেটে লক্ষ করতে লাগলো। পিশাচ ঢুকলেই তারা মোবাইলে মিসকল দিবে। ঝোপে প্রচুর মশা তাই কয়েল জ্বালানো হলো। সবাই ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। গোটা গোরস্থানটা দেখা যাচ্ছে। চারপাশে সারি সারি নতুন পুরাতন কবর। হঠাৎ স্যারের কেন জানি মনে হলো, বিজ্ঞানের কাছে ভৌতিক বিষয় আজ অসহায়। তারা প্রযুক্তির কল্যাণে জঙ্গলেও নিরাপদ। যদিও ইমাম সাহেবকে রাখা হয়েছে। তিনিও আল্লাহর কালাম দিয়ে খারাপ শক্তিকে প্রতিরোধ করবেন। বিজ্ঞান ও আল্লাহর কালামের শক্তিতেই আজ পিশাচটা ধ্বংস হবে। হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো। মিসকল মানে সঙ্কেত। পিশাচটা গোরস্থানে ঢুকে পড়েছে। পিশাচটা যতই ভিতরে ঢুকছে ততই ভাইব্রেটরটা কাঁপছে। স্ক্রিনে সবুজ আলো নিভে গেলো। লাল আলো জ্বলে উঠলো আর ক্যামেরা বার বার পিশাচটার দিকে ফোকাস করছে। তরঙ্গ মাপক যন্ত্রের মিটারের কাঁটা ০ থেকে ১৬০ তে উঠছে আর বিপ বিপ শব্দ করছে। স্যার বললেন, ‘সবাই প্রস্তুত হও।’ সবাই মাথা নাড়ালো। পিশাচটা চারপাশে তাকাতে লাগলো। তার মানে সে কী বুঝে ফেলেছে নাকি? বাতাসে গন্ধ শুঁকতে লাগলো। পিশাচটার ভয়ানক দুটো লাল চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগলো। তার চারপাশে একদল তরুণ শিশু-কিশোর দলের সমন্বয়ে গঠিত রর ও আল্লাহর কালামের শক্তি। পিশাচটার সন্দেহ কেটে গেল। সে একটা নতুন কবরের কাছে গেলো। বসে পড়ে কি যেনো বিড় বিড় করে পড়তে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। এবার সে রেগে গিয়ে ভয়ানক গর্জন করতে লাগলো। গোটা টিম তাকে ঘিরে ধরলো। ছোট শিশুদের দেখে সে বিশ্রী করে হাসতে লাগলো। সে চোখ লাল করে বলতে লাগলো। ‘কী খবর ছোট্ট খোকা খুকিরা? আমার পিছনে লেগেছো? ভালো আজ তবে আমি তোমাদের রক্ত পান করবো। কেউ ভয় পেলো না। সবাই বিশেষ ধরনের লাঠি দ্বারা আঘাত করতে লাগলো পিশাচটার গায়ে। ধীরে ধীরে পিশাচটা মানুষ থেকে বড় একটা দানবে রূপ নিলো। ইমাম সাহেব উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করতে করতে এগিয়ে এলেন। ইমাম সাহেব সবাইকে সরে যেতে বললেন। সবাই একপাশে সাইট হয়ে পড়লো। এবার পিশাচের মুখোমুখি ইমাম সাহেব। হঠাৎ তিনি খেয়াল করলেন তার হাতে লোহার দণ্ডটা নেই। তার মানে তিনি বিপদে পড়েছেন। পিশাচটা হাসতে লাগলো। সে ধীরে ধীরে ইমাম সাহেবের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। সবাই চেঁচিয়ে বললো, ‘স্যার হজুরকে লোহার দণ্ডটা ছুঁড়ে দিন।’ স্যার সাথে সাথে লোহার দণ্ডটা ছুড়ে দিলেন ইমাম সাহেবের দিকে। ইমাম সাহেব সেটা ধরে ফেললেন। হঠাৎ পিশাচটা উল্টো পথে পালানোর জন্য ছুট দিলো। সিকিউরিটি গার্ড নুরুমিয়া ও তমিজ মিয়া পথ আগলে ধরলো। এদিকে গোটা টিম গোরস্থান ঘিরে ফেললো। পিশাচটা রাগে স্যারকে তুলে নিয়ে শূন্যে উড়াল দিলো। কিন্তু ততক্ষণে ইমাম সাহেব আল্লাহু আকবার বলে লোহার দণ্ডটা পিশাচটার গায়ে বিঁধিয়ে দিলেন। সাথে সাথে ওটা বিকট শব্দ করে স্যারকে ছেড়ে দিয়ে নিচে গড়িয়ে পড়লো। পিশাচটা ভয়ানকভাবে গোঙ্গাতে শুরু ধরলো। ধীরে ধীরে তার শরীরটা গলতে শুরু করলো। ভয়ানক একটা পচা গন্ধে গোরস্থানটা ভরে গেলে। আস্তে আস্তে সেটা মাটির সাথে মিশে গেলো। গোটা পরিবেশে শান্ত হলো হঠাৎ ওঝা টাইপ লোকটা দৌড়াতে দৌড়াতে এগিয়ে এলো। স্যার বললেন, ‘তার আর দরকার হবে না কবিরাজ মহাশয়। ওটা ধ্বংস হয়ে গেছে।’ স্যারের কাছে শুনে কবিরাজ অনেক খুশি হলো। কারণ সেও আজ ৫ বছর যাবৎ ঐটার পিছনে লেগেছে কিন্তু পারছে না। সবাই গোরস্থান ত্যাগ করে মসজিদে এসে আশ্রয় নিলো। আর সব জিনিসপত্র সিকিউরিটি গার্ডরা সকালে নিয়ে আসবে। ভোর হলো। সবাই ফজরের নামাজের সাথে ২ রাকাত শুকরিয়া নামাজ আদায় করলো। অবশেষে হিজলতলী গ্রাম বিপদমুক্ত হলো। আজও মিলু ও দিপুরা স্কুলে গল্প করে নানা ভৌতিক বিষয় নিয়ে। রাত হলেই দিপু ও মিলু জানালা দিয়ে খেয়াল করে গোরস্থানটার দিকে। কিন্তু কিছু দেখে না। হঠাৎ করেই দু’একটা শেয়াল হুক্কাহুয়া করে ডেকে রাতের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে দেয়। এভাবেই যুগ যুগ ধরে ভৌতিক গল্পগুলো মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত থাকে।

Share.

মন্তব্য করুন