তুরস্কের বুকে অবস্থিত এক পরিত্যক্ত নগরী হাত্তুসা। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীতে হিট্টাইটদের রাজধানী ছিল। হাজার বছরের পরিত্যক্ত শহর হাত্তুসার বুকে রহস্য হয়ে টিকে আছে সবুজ রঙের রহস্যময় কিছু পাথর। তবে সবচেয়ে অবাক হতে হয় পাথরের বুকে বিদ্যমান সূক্ষ্ম ছিদ্রের দিকে তাকিয়ে। দেখে মনে হয় কোনো ড্রিল মেশিনের সাহায্যে বুঝি প্রাচীনকালের মানুষেরা পাথরের বুকে সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছে।
এরূপ শত শত রহস্যঘেরা প্রশেড়বর জন্ম দেয়া শহর হাত্তুসা।
প্রাচীন সভ্যতায় পৃথিবীজুড়ে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হওয়া জাতিগুলোর মাঝে হিট্টাইটরা অন্যতম। হাত্তুসার বিস্তৃত ভূমিকে কেন্দ্র করে তারা বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করে। ইতিহাসের ভাষ্যমতে, হিট্টাইটদের সাম্রাজ্য সুদূর বসফরাস পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল যার বর্তমান নাম সিরিয়া।
হিট্টাইটরা তৎকালীন অন্যান্য সাম্রাজ্যের সাথে বিভিন্ন কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখতো। তুরস্কের বিভিন্ন ঐতিহাসিক পাণ্ডু লিপি ঘেঁটে হিট্টাইটদের সাথে প্রাচীন ফারাওদের মিসরের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। হিট্টাইটদের শক্তিমত্তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
"হাত্তুসা" পৃথিবীর রহস্যময় স্থান । সিয়াম সায়েদহিট্টাইটদের প্রাণকেন্দ্র হাত্তুসার অবস্থান তুরস্কের নগরী বোয়াজকেলের অভ্যন্তরে। ব্রোঞ্জ যুগের শেষার্ধে হিট্টাইটরা একে নিজেদের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তখন হাত্তুসা সেই অঞ্চলের সবচেয়ে ছোট নগরী ছিল। ধ্বংস হওয়ার পূর্বে ঘন অরণ্য এবং উর্বর ভূমিসমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল এই হাত্তুসা। তবে হাত্তুসার বুক চিরে বয়ে চলা নদীগুলোর নাব্যতা ছিল না। যার ফলে নদীপথে হাত্তুসার যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত ছিল না। ইতিহাসের পাণ্ডুলিপিতে হাত্তুসার প্রথম অস্তিত্ব জানা যায়ত আসেরীয়দের পাণ্ডুলিপি থেকে। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তারা হাত্তুসার নিকটস্থ অঞ্চলে একটি উপনিবেশ স্থাপন করেছিলো। এক সময়ের প্রতাপশালী হিট্টাইটরা হঠাৎ করেই যেন হারিয়ে যায় পৃথিবীর ইতিহাস থেকে।
হাত্তুসার পতনের পরে তা কয়েক শতাব্দী ধ্বংসস্তূপ হিসেবে তুরস্কের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। শেষ পর্যন্ত১৯০৬ সালে একদল জার্মান জ্ঞানপিপাসু অভিযাত্রী হাত্তুসা পুনরুদ্ধার করতে অগ্রসর হন। গ্রীষ্মকালীন প্রতড়বতাত্ত্বিক অভিযানের আওতায় প্রায় একশত বছরেরওবেশি সময় ধরে সেই অঞ্চলে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন অভিযাত্রীগণ। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রহস্যের সম্মুখীন হচ্ছেন তারা।
শত শত মাটির তৈরি পাণ্ডুলিপি, বিভিন্ন ভাষায় লিপিবদ্ধ স্মারকলিপিসহ হিট্টাইট সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। উন্মুক্ত হয়েছে বহু অজানা ইতিহাস। হাত্তুসার রহস্যময় নিদর্শনসমূহ ইতিহাসবিদদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। একে ঘিরে তৈরি হয়েছে হাজারো প্রশ্ন, যাদের অধিকাংশের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছেন ইতিহাসবিদগণ। হাত্তুসার অধিকাংশ অঞ্চলে খননকাজ শেষ হয়ে গেলেও, গবেষকগণ আশা করছেন, অনাবিষ্কৃত হাত্তুসারগর্ভে লুকিয়ে আছে হাজারো বছরের অজানা রহস্য।
"হাত্তুসা" পৃথিবীর রহস্যময় স্থান । সিয়াম সায়েদহাত্তুসার ধ্বংসাবশেষ দেখে বোঝা যায় পাথর শিল্পে বেশ দক্ষ ছিল। এই শহরের প্রতিটি স্থাপনায় পাথরের বুকে লেগে আছে দক্ষ শ্রমিকদের সুনিপুণ ছোঁয়া। নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বিশাল মন্দিরের স্তম্ভগুলো আন্দেশীয় পাথরের ছাঁচ দিয়ে তৈরি। তবে হাত্তুসার পাথুরে শিল্পের সবচেয়ে বড় রহস্যের উদ্ভব হয়েছে স্থাপনাগুলোর পাথরের বুকে তৈরি হওয়া অসংখ্য গোলাকার ছিদ্রকে কেন্দ্র করে। এগুলো আকারে অত্যন্তনিখুঁত এবং মসৃণ। বর্তমান যুগে ড্রিল মেশিনের সাহায্যে এই ধরনের ছিদ্র তৈরি করা সম্ভব। এর পূর্বে পেরুর কোরিকাঞ্চা মন্দিরে এরূপ অসংখ্য ছিদ্র আবিষ্কৃত হয়েছিলো।
কূটনীতির জগতে হিট্টাইটরা এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীতে হিট্টইটদের সাথে পরাক্রমশীল মিসর সাম্রাজ্য এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসের পাতায় এটি কাদেশ যুদ্ধ নামে পরিচিত। শক্তিশালী ফারাওরা এই যুদ্ধে পরাজিত হয়। যুদ্ধ শেষে হিট্টাইটরা ফারাওকে অবাক করে এক অদ্ভুত প্রস্তাবনা নিয়ে হাজির হয়। সুদূরপ্রসারী হিট্টাইটরা যুদ্ধ থেকে স্থায়ী মুক্তি হিসেবে ফারাওয়ের সাথে তাদেও রাজকন্যার বিয়ে দেয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এই ঘটনা প্রথম শান্তি চুক্তির মর্যাদা লাভ করেছে।
তুরস্কের বুকে একখ- সভ্যতার অধিকারী হিট্টাইটরা ধাতুশিল্পে অন্যান্য সভ্যতার তুলনায় কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিল। এর প্রমাণ মেলে বিভিন্ন যুদ্ধে ব্যবহৃত যানবাহন এবং অস্ত্র-সরঞ্জামে ব্যবহৃত ধাতুর মাধ্যমে।
হিট্টাইট কামারদের শৈল্পিক স্পর্শে গড়ে উঠতে থাকে যুগান্তকারী সব সরঞ্জাম। ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধারকৃত বিভিন্ন অস্ত্র পরীক্ষার মাধ্যমে ইতিহাসবিদগণ বেশ রোমাঞ্চকর সব তথ্য আবিষ্কার করেছেন। এগুলোর মাঝে সবচেয়ে সাড়া জাগানো আবিষ্কার ছিল ইস্পাতের তৈরি রাজকীয় রথের ব্যবহার! এর ফলে যারপরনাই অবাক হয়েছেন গবেষকগণ।
কারণ হাত্তুসা নগরীর উদ্ধারকৃত ইস্পাতের সরঞ্জামগুলোর উৎপাদনের সময়ে পৃথিবীতে ব্রোঞ্জ যুগ বিরাজ করছিলো। পৃথিবীর প্রতাপশালী সাম্রাজ্যগুলো যুদ্ধেক্ষেত্রে ব্রোঞ্জের তৈরি বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করতো।
কিন্তু হাত্তুসার সৈনিকরা ব্রোঞ্জের পাশাপাশি অধিক নমনীয় ইস্পাতের বিভিন্ন যানবাহন এবং অস্ত্র ব্যবহা শুরু করে। ফলে হিট্টাইটদের রথগুলো সমসাময়িক যেকোনো যানবাহনের তুলনায় দ্রুতগামী ছিল। এই তথ্য উদ্ঘাটনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধাতু ব্যবহারের ইতিহাস নিয়ে বিশেষজ্ঞরা নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেছেন।
রুক্ষনগরী হাত্তুসার বুকে স্থাপিত হয়েছে বিভিন্ন নান্দনিক ভাস্কর্য এবং নিদর্শন। এদের গঠন এবং নির্মাণকালের সাথে ঐতিহাসিক তথ্যাবলির অসামঞ্জস্যতার ফলে উত্থাপিত হয়েছে নানা প্রশ্ন। কিন্তু এতসব রহস্যের ভিড়ে বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তুলেছে হাত্তুসার ধ্বংসাবশেষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন পাথর। যে কেউ প্রথম দেখাতেই পাথরগুলো প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে। গাঢ় সবুজ রঙের নানা গড়নের পাথরগুলো আবিষ্কার পর থেকেই গবেষকদের এক জটিল ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে।
"হাত্তুসা" পৃথিবীর রহস্যময় স্থান । সিয়াম সায়েদপ্রথমত, পাথরগুলোর পৃষ্ঠ সুনিপুণ কায়দায় মসৃণভাবে পালিশ করা। কথিত আছে, খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করলে নাকি পাথরের গায়ে ব্যক্তির প্রতিবিম্বফুটে ওঠে! তাই এই আশ্চর্য পাথর নিয়ে জ্ঞানপিপাসুদের প্রশ্নের অন্ত নেই। দ্বিতীয়ত, দর্শনার্থীদের অনেকেই দাবি করেছেন, এই পাথর স্পর্শ করলে দেহের ভেতর দিয়ে এক অদ্ভুত শক্তিপ্রবাহিত হয়। কিন্তু বিতর্কিত এবং অবৈজ্ঞানিক এই দাবি গবেষকগণ কখনো আমলে নেননি।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পরেও বিজ্ঞানীগণ এই পাথরের উৎপত্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেননি। তবে ইতিহাসবিদগণ এই পাথরের উদ্দেশ্য নিয়ে বেশ কিছু তত্ত্ব উত্থাপন করেছেন। পাথরগুলো হাত্তুসার কেন্দ্রীয় মন্দির থেকে উদ্ধার করা হয়েছিলো। এর ফলে ধারণা করা হয়, এই পাথরগুলো হয়তো ধর্মীয় উপাসনার কাজে ব্যবহৃত হতো। তবে অনেকেই ধারণা করেন, ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস কাদেশ যুদ্ধ সন্ধিচুক্তির ফলে উপহারস্বরূপ হিট্টাইটদের এই পাথরগুলো প্রদান করেছিলেন। কিন্তু এই তত্ত্বের পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।
এভাবে হিট্টাইটদের রহস্যঘেরা নগরী হাত্তুসা যুগের পর যুগ ধরে নানা প্রশ্ন নিয়ে আমাদের তাড়া করে ফিরছে। বর্তমানে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে এই স্থানটি। এই সভ্যতা আবিষ্কারের প্রায় ১০০ বছর পরেও সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে।

Share.

মন্তব্য করুন