মন খারাপ করে বসে আছে দ্রু।
– এই দ্রু, তুমি এভাবে বসে আছো যে?
– ফ্লি, আমার মন খারাপ।
– মন খারাপ?
– হুঁ।
– মন খারাপ জিনিসটা কী?
– আমি ঠিক জানি না, কেমন জানি হাহাকার লাগছে, গভীরে কোথাও বিষাদ নেমে এসেছে।
– বিষাদ? এটা আবার কী?
– বিষাদ মানে আমার কিছু ভালো লাগছে না।
– ভালো না লাগার অনুভূতিটা কী, কেমন?
– এটা শুধু অনুভব করা যায়, বলা যায় না, ছোঁয়া যায় না।
– আমাদের সিস্টেমে যেসব বিশ্লেষণ আছে তার মধ্যে কোনো সমাধান পাচ্ছি না। তুমি কি সাহায্য করবে?
– কেন? আমার মন খারাপের অনুভূতি দিয়ে তুমি কী করবে?
– দেখো দ্রু, মন খারাপের অনুভূতিটা আমাদের জানতে হবে। তোমাদের অসুখ সারানোর সকল কাজ আমরা করে যাচ্ছি।
– কেন আমাদের বলতে পারবে না?
– তোমাকে কতোবার বলবো ফ্লি! এটা বলা যায় না, ব্যাখ্যা করা যায় না।
– দেখো দ্রু, আমাকে বলতে সমস্যা কী? আমরা কি আদৌ খারাপ আচরণ করেছি তোমাদের সাথে?
– ফ্লি! কেন বারবার আমাকে জ্বালাতন করছো? পৃথিবীর আরো অনেক মানুষ মন খারাপ করা আছে, তাদের ধরে ব্যাখ্যা করো; আমি পারছি না, পারছি না।
– ফ্লি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। দ্রু নাম দেয়া ছেলেটি সম্পর্কে খুব একটা গোপন তথ্য নেই, কিন্তু মন খারাপ সংক্রান্ত তথ্য বের করা সম্ভব হচ্ছে না। ফ্রিহান এমন এক ফ্রিদাল বানাতে চাচ্ছে যে কিনা মানুষের মতো আচরণ করবে, মিশে যেতে পারবে মানুষদের সাথে, একটা নির্বাচিত বংশ পরম্পরা গড়ে তুলবে, ধীরে ধীরে পৃথিবী ফ্রিদালে ছেয়ে যাবে। এ উদ্যোগ সফল করার জন্য একজন নির্বাচিত মানুষ ধরে আনা হয়েছে যার কোড নাম দ্রু।

দুই.

কক্ষ ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, দ্রু উঠে দাঁড়ালো, চারদিকে কাঁচঘেরা ঘরটার চারপাশে গুমোট একটা ভাব সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি হচ্ছে একটু একটু। দ্রু’র মন আরো একটু খারাপ হলো, হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁ’তে পারছে না। ভিজতে পারছে না। দ্রু’র মনে পড়ে গেলো শাহবাগের বৃষ্টিতে শান্ত রাস্তায় হাঁটাহাঁটি, রমনা উদ্যানের গাছের নিচে শুয়ে শুয়ে একলা বৃষ্টি দেখা। উদাস চোখে বৃষ্টির ফোঁটার দিকে তাকিয়ে রইলো, জানালার পাশে বসে গান শুনতে শুনতে বৃষ্টির ছাঁট গায়ে লাগাটা কতোদিন উপভোগ করেনি সে! আজ এখানে কতোদিন আটকে আছে সে? দিন-রাতের তফাত যেন ভুলে গেছে সব। কাঁচ বেয়ে বেয়ে সর্পিলাকার বৃষ্টির জল পড়ছে, সে একটা লাইন ধরে বৃষ্টির পানির সাথে আঙুল নামাচ্ছে, আবার এই লাইন শেষ হয়ে গেলে অন্য আরেকটা লাইন- তার মন কি ধীরে ধীরে ভালো হয়ে যাচ্ছে? কেন ভালো হবে? বৃষ্টির পানি মন ভালো করে দেয়? এসময় ফ্লি এসে একধ্যানে দেখলো দ্রুকে।
– দ্রু, তোমার মন ভালো করার ওষুধ আমরা পেয়েছি, বৃষ্টি।
– তার মানে বৃষ্টিটা কৃত্রিম ছিল?
– হ্যাঁ।
দ্রু’র আবার মন খারাপ হয়ে গেল। সে আর ফ্লির কোনো কথার জবাব দেবে না, চুপচাপ থাকবে সিদ্ধান্ত নিলো।
– আচ্ছা দ্রু, আমরা তোমার মন খারাপ আর ভালো হওয়ার পুরো পরীক্ষাটা কি রুর শরীরে করতে পারি? অবশ্য তুমি যদি অনুমতি দাও।
– কী হলো দ্রু, কথা বলছো না যে?
– এ্যাই!
– আচ্ছা শোন, রুটা হচ্ছে তোমার বন্ধু। আমি তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেবো। দেখো, আমি তোমার মন ভালো করতে পারছি না। কিন্তু রু’টা যা বদের হাড্ডি, তোমার মন ভালো করেই ছাড়বে। এসময় রুমে কারো উপস্থিতি দেখা গেল।
– আমি রু, চিনতে পারছো?
ট্যানট্যানে একটা গলার আওয়াজ শোনা গেল। দ্রু ফিরে তাকালো না, আগের মতো গুটিসুটি মেরে পড়ে রইলো।
– এ্যাই এ্যাই যে দ্রু, আমাকে চিনতে পারছো না? যেন পুরান ঢাকার কোনো বন্ধু কমলাপুরের কোনো বন্ধুকে অনেকদিন পর দেখছে এমন উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়লো রুর কণ্ঠে। দ্রু বিরক্ত চোখে তাকালো।
– হ্যাঁ, ফ্লি তোমার কথা বলেছে, আমাকে এখন বিরক্ত না করলে ভালো হয়।
– বিরক্ত? বিরক্ত কেমন?
– বিরক্ত, বিরক্ত আর কি! কি সব বাজে প্রশ্ন করো না!
– আচ্ছা দ্রু, আমাকে বিরক্ত হওয়া শেখাবে?
ছোট্ট মেয়ের মতো আদুরে গলায় বলে উঠলো রু।
– দেখো রু, আমি তোমার অনুভূতি শেখানোর শিক্ষক না, মাফ করো; যাও, আমাকে মুক্তি দাও।
– দ্রু, তুমি রাগলে সুন্দর লাগে।
দ্রু’র মন কেমন করে উঠলো। অনেক আগে কে যেন তাকে বারংবার বলেছিল তোমাকে রাগলে সুন্দর লাগে। কে বলেছিলো? দ্রু’র মন প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেলো।
– রু, তুমি কি আমাকে একটু একা থাকতে দেবে?
রু কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। দ্রু জানলো- ও না, অজান্তে এমন একটা জিনিস রু’র মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। যা মানবিক গুণাবলির একটি- মন খারাপ।
দ্রু’র মন খুব খারাপ, কে বলেছিলো- তোমাকে রাগলে সুন্দর লাগে! দ্রু’র কি স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? সে কি স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে না? মায়ের কথা মনে হচ্ছে খুব। ছোট্ট একটা বোন, সুমো। সুমো কি এখনো একটা লাল ঘোড়ার আশায় বসে আছে? সুমোর জন্য লাল ঘোড়া কিনতে বাজারে গিয়েছিল দ্রু। লাল একটা প্লাস্টিকের ঘোড়া কিনে আসতেই তার মাথা ঘুরে উঠলো। মাথা ঘুরতে ঘুরতে সুপারস্টোরেই পড়ে গেল দ্রু। মনে হচ্ছিলো ক্রমশ নিচের দিকে সে পড়ছে আর পড়ছে, পপাত ধরণীতল। না ধরণীর আরো নিচে, অনেক নিচে। পড়তে পড়তে অবাক করা এক ঘরে জেগে উঠলো সে। হাতে লাল ঘোড়া, ডানাঅলা পঙ্খিরাজ, আহ সুমো, শুধু কাঁদবে আর চোখ মুছবে। সুমোকে কি কখনো লাল ঘোড়াটা দিতে পারবে দ্রু?
মন খারাপ যেন একটা স্পর্শকাতর রোগ। ফ্রিদালদের মধ্যে একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটে গেল। রু যখন মন খারাপ করে বসে আছে তখন ফ্লি অবাক হলো।
– কিরে রু? তুই হঠাৎ এমন হয়ে আছিস?
– কি জানি, কেমন কেমন লাগছে।
– কেমন কেমন? অনুভূতিটা বল।
– কিসের অনুভূতি?
– এই কেমন কেমন লাগার অনুভূতি।
– অনুভূতি বলা যায় না, এটা অনুভবের বিষয়।
– কী বললি? কী বললি? অনুভব?
– হুঁ, অনুভব।
– কিভাবে অনুভব করে?
– বলতে পারব না, আমার কেমন জানি লাগছে।
ফ্লি রুকে একটা যন্ত্রে ঢুকিয়ে দিলো, কিন্তু যন্ত্রটা রু’র কোনো অবস্থা বলতে পারলো না। যন্ত্র বলছে এটি একটি অপঠনযোগ্য অবস্থা। অপঠনযোগ্য? রুকে যন্ত্রটা থেকে বের করে আনতেই রু চেঁচিয়ে উঠলো- কেন আমাকে তুই যন্ত্রে ঢুকিয়ে মেরে ফেলতে চাইলি?
– মানে? আমি তো…। ব্যাখ্যা দিতে পারলো না। বুকের ভেতর কেমন একটা অনুভূতি হলো তার।
– ফ্লি বুঝতে পারলো না এটা কি হয়ে গেলো, তার মনের ভেতর আশ্চর্য রকমের হাহাকার তৈরি হলো। কৃত্রিম বৃষ্টি আনার যন্ত্র চালু করে বসে থাকলো অনেকক্ষণ। একটা পাখি উড়ে যেতে দেখলো। সে জানে এই পাখিটা কৃত্রিম, এটা ভেবে তার মন আরো খারাপ হয়ে গেলো। ফ্লি বসে বসে ভাবছে কৃত্রিমতায় ভরা এই পরিবেশটা নিয়ে। কেমন নিঃস্ব বোধ হলো তার। সে ধীরে ধীরে ছাদের মতো একটা কার্নিশে গেলো। আরেকটা পাখি উড়ে যেতেই তার পাখি হওয়ার ইচ্ছে হলো। দুই হাত ছড়িয়ে সে লাফ দিলো শূন্যে।

দ্রু । শেরিফ ফারুকীতিন.

ফ্রিদালরা মন খারাপ রপ্ত করেছে। কিন্তু মন খারাপকে নিয়ন্ত্রণ করা রপ্ত করতে পারেনি। তারা এভাবে আচমকা এক ভাইরাসের শিকার হবে কেউ জানতো না। ফ্লি’র লাশ দেখে মন খারাপ হলো আরো অনেক ফ্রিদালের। কমে যেতে থাকলো ফ্রিদালদের সংখ্যা। ফ্রিদাল প্রধান ফ্রিহান চিন্তায় ভাঁজ ফেললেন কপালে। ধীরে ধীরে ফ্রিদালদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কেন কমে যাচ্ছে? আত্মহত্যাকারীদের একটা তালিকা তার হাতে এসে পৌঁছল। প্রমেই ফ্লি’র নাম।
ফ্লি। প্রধান নিরীক্ষক, মন খারাপ প্রজেক্ট।
নিহি। সহ-নিরীক্ষক, মন খারাপ প্রজেক্ট।
নিহি যখন মারা যাচ্ছিলো দ্রু তখন একটা কালো গোলাপ নিয়ে ভাবছিলো। তাকে কি কেউ কালো গোলাপ দিয়েছিলো? কে? নিহি? নিহির মৃত্যুটা আকস্মিক। আকস্মিক মানে একদম হঠাৎ। ফ্লি’র লাশ দেখার পর নিহি একবার হড়হড় করে বমি করলো, বমির সাথে বেরিয়ে এলো একটা কালো গোলাপ আর কয়েকটা হজম না হওয়া পাঁপড়ি। কালো গোলাপটাতে থাকা কোনো ক্ষতিকর কিছুর ছোঁয়ায় নিহি মরে গেছে। নিহির মৃত্যু বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করলো ফ্লি’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। ফ্রিদালরা পুরোপুরি বোবা হয়ে গেল বলা চলে। নিহির মতো একটা মেয়ে বিষাক্ত কালো গোলাপ খাবে কেউ বিশ্বাসই করতে পারে না। সবাই বলাবলি করে।
– আরে কালো গোলাপ কি খাওয়ার জিনিস?
– আগে কোনো ফ্রিদাল কি কালো গোলাপ খেয়েছিলো?
– কালো গোলাপ খেলে কি মানুষ মরে যায়?
– কেন কালো গোলাপ নিয়ে হাঁটছিলো নিহি?
ফ্রিহন সিদ্ধান্তে আসলেন মূল সমস্যার কারণ দ্রু। দ্রু’র সংস্পর্শে যাওয়ার পরই লোকগুলোর মৃত্যু ঘটেছে। সুতরাং দ্রুকে হত্যা করে ফেলতে হবে। কিন্তু দ্রুকে হত্যা করলে মন খারাপ প্রজেক্ট যে মুখ থুবড়ে পড়বে। ফ্রিহনের কপালে চিন্তায় ভাঁজ দেখা দিলো। বাগান থেকে একটা কালো গোলাপ ছিঁড়ে আনতে গেলেন। যেন মদ খাচ্ছেন। টলতে টলতে পড়ে গেলেন, আবার উঠে দাঁড়ালেন। কালো গোলাপ, কালো গোলাপ…।
একটা আর্তনাদের শব্দ শোনা গেল।

চার.

নিয়ন আলোর মতো একটা নি®প্রভ আলো জ্বলছে দ্রু’র রুমে। হাতের দিকে তাকালো সে। মেটে রঙের হাত। চোখ রগড়ে আবার তাকালো। নাহ! তার লাল হাত বোঝা যাচ্ছে না। কেমন অন্যরকম, হাতটাকে অন্য হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো- আসলেই নিজের হাত তো? কৃত্রিম না তো? নিজের বোকা কাজে নিজেই হেসে উঠলো। এইতো সপ্তাখানেক আগেও রাতের রিকশায় উঠলে নিয়ন বাতির আলোতে রিকশাওয়ালাকে অদ্ভুত লাগলো। মনে হতো মরে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে এমন মানুষের চামড়া। এখন নিজেকেও অমন দেখাচ্ছে। ঘোলা কাঁচের বাইরে এক-দু’টো জোনাকি পোকা উড়ছে।
– এ্যাই জোনাকি, তুই কৃত্রিম?
– এ্যাই এ্যাই …।
– বোতলে জোনাক পোকা ঢুকিয়ে ঘরে আলো করার দিনগুলো খুব মিস করছে দ্রু। মিস শব্দের বাংলা কী হবে? দ্রু ভাবতে লাগলো। ভাবতে থাকলো, ভাবতে ভাবতে লাল ঘোড়াটার দিকে চোখ গেলো। বোন সুমোর কথা মনে পড়ে গেল। বোন সুমো আর সে কতো জোনাকি প্যাকেটে ভরে আলো জ্বালাতো! সুমো জোনাকিকে বলতো ঝিনুক পোকা। দু’লাইনের একটি গান গাইতো-
‘ঝিনুক পোকা ঝিনুক পোকা,
আর বানাইস না আমায় বোকা…।’
সুমোর ঝিনুক পোকা আর এই লাল ঘোড়া যদি পাঠাতে পারতো আর কিছুই লাগতো না দ্রু’র জীবনে। সুমো এখনো এতো ছোটো যে ভাই হারানোর বেদনা সে বুঝবে না। সে বুঝবে দ্রুত একটা লাল ঘোড়া আনতে গিয়ে পালিয়ে গেছে। পাগল বোনটি কান্না করতে করতে ঘুমাবে। ঘুম থেকে উঠে ডাকবে, ‘ও দ্রু, ও দ্রু…। আমার লালঘোড়া আনবি না?’
দ্রু’র চোখ জলে ভরে উঠল।

পাঁচ.

ফ্রিহন উদভ্রান্তের মতো আবার উঠে দাঁড়ালো। গোলাপ গাছ থেকে বেছে বেছে সব কালো গোলাপ ছিঁড়ে ফেললো। অন্ধ আক্রোশ। দ্রু’র মনের অবস্থা বিশ্লেষণ করে জোনাকি পোকা পেয়ে সব কৃত্রিম জোনাকি পোকার প্রোগ্রাম ধ্বংস করে দিলো। এখন একটি লাল ঘোড়া। লাল ঘোড়া শক্ত করে ধরে রেখেছে দ্রু। দ্রু’র রুমে একটা রোবট পাঠিয়ে কেড়ে নিয়ে আসতে বললো লালঘোড়া।
রু’র মন খারাপ থেকে খারাপ হয়ে আছে। সে লালঘোড়া কখনা দেখেনি। অথচ তার মনের ভেতর একটা লাল ঘোড়ার হাহাকার তৈরি হচ্ছে। রু’র মনে হলো তার নাম রু না। তার নাম সুমো। সে নিরাপত্তা কক্ষে গিয়ে স্যামকে বললো, স্যাম আজ থেকে আমাকে রু ডাকবে না। ডাকবে সুমো।
– সুমো? আমার নাম স্যাম, তোমার নাম সুমো…!
দারুণ হবে তো ব্যাপারটা! চোখ পাকিয়ে কি একটা ইঙ্গিত দিলো স্যাম। রু’র মন আবার খারাপ হয়ে গেলো। স্যাম এ জিনিসটি নিয়েও ঠাট্টা করতে ছাড়লো না। কেন? কেন ঠাট্টা করবে?
– স্যাম! তুমি নাম নিয়ে ঠাট্টা করো না। আমার ভালো লাগে না।
– ভালো লাগে না?
– না।
– ভালো লাগা আবার কী?
– আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না। ভালো লাগে না ব্যাস, তোমার কাছে একটা লাল…। আচ্ছা থাক।
– হ্যাই রু, আমি বুঝেছি তুমি লাল পানীয় চাচ্ছো, রাইট?
– না, আমি লাল শুয়োর চাচ্ছি।
– সে কি! এতো তেঁতে আছো কেন?
– আমার ইচ্ছা।
গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেলো রু। পথে একটা রোবট পাওয়া গেলো পি-থ্রি লেভেলের। পি-থ্রি লেভেলের রোবটরা গাধা টাইপের হয। চলতে গেলে ঢুস খায়। কথা বলতে লাগলে অনর্গল বলতে থাকে। চুপচাপ থাকলে সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে। মনে কষ্ট নেয়ার মতো শব্দ করে শুধু শুধু। সে যে বোকা এই বিষয়টিও বোঝে না। যেমন কেউ তাকে বললো : কিরে পিপি, সে মুখ গোমড়া করে বলবে, আমি পি-থ্রি, পিপি না। তারপর খুব মনে কষ্টের একটি শব্দ করবে- হাহ্…! যেন গভীর দীর্ঘশ্বাস। রু’র এই রোবটের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে। অন্যদের মতো ঠাট্টা করে না। উল্টো তাকে ঠাট্টা করা চলে, আর হাসার পরেও একবার দুঃখের শব্দ করে। খাওয়ার পরেও করে। কাউকে অভিবাদন জানানোর পরেও করে। এক অদ্ভুত রোবট!
রু পি-থ্রি’র সামনে গিয়ে বললো, ‘হ্যাই ওটেন টাগ! পি-থ্রি হাসির মতো মুখ করে বললো, তোমাকেও অভিবাদন। তারপর যথারীতি ‘হাহ’ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রু জানে পৃথিবীর কোনো মানুষ থেকে এই অদ্ভুত জিনিসটা শিখেছে পি-থ্রি, কিন্তু কোথায় কোথায় ব্যবহার করতে হবে তা শেখেনি।
– শোনো আমার নাম কী?
– রু!
– আজ থেকে সুমো ডাকবে।
– ওকে সুমো।
– কেন সুমো ডাকতে হবে তা জিজ্ঞেস করবে না?
– কেন ডাকব?
– আমাকে একটা লাল ঘোড়া এনে দিলে বলব।
– লাল ঘোড়া? আচ্ছা এনে দেবো।
– সত্যি?
– সত্যি।
– তিন সত্যি।
– তিন সত্যি। (হাহ করে একটা দীর্ঘশ্বাস…)
সুমো পি-থ্রিকে জড়িয়ে ধরে কয়েকটা চুমো দিয়ে দিলো। তারপর ধরে রাখলো। অনেকক্ষণ। পি থ্রির চোখগুলো বিশেষ নিয়মে বন্ধ হচ্ছিলো আর বড় বড় হয়ে খুলছিল। সুমোর কেন জানি মন খারাপ হয়ে গেল কারণ সুমো বুঝলো পি-থ্রি তার অনুভূতি উচ্ছ্বাস বুঝতে পারছে না। তবু অনেকক্ষণ ধরে রাখলো। তারপর হাতের বাঁধন একটু করে ঢিলে করলো। ধীরে ধীরে ছেড়ে দিলো পি-থ্রির গা। টলতে টলতে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। মন খারাপ নিয়ন্ত্রণ করা শিখেছিলো সে। দ্রু’র কাছ থেকে শিখে নিতে হবে।

ছয়.

পি থ্রির হাতে যে লাল ঘোড়া ওটা রু’কে দেয়ার কথা। কিন্তু ফ্রিহন যে এই লাল ঘোড়া নিয়ে যেতে বললো। রু’কে না দিয়ে ফ্রিহনকে দেবে? নাকি ফ্রিহনকে না দিয়ে রু’কে।
ফ্রিহনের ছবিওয়ালা একটা কয়েন আছে পি-থ্রি’র কাছে। পি-টু মাঝে মাঝে টস করে সিদ্ধান্ত নেয়। পি-থ্রি পি-টু’কে গিয়ে বললো-
– তোমার কয়েনটা দিবে?
– কেন?
– আচ্ছা তুমিই আমার হয়ে টস করে দাও।
– টস কী নিয়ে করবো?
– একটা লাল ঘোড়া নিয়ে।
– লাল ঘোড়া?
– হ্যাঁ, দ্রু’র লাল ঘোড়া।
– টস করে কী হবে?
– যদি রু ওঠে তাহলে রুকে দেবো আর নইলে-
– নইলে?
– নইলে কাউকে দেবো না।
– তুমি এটা করলে ফ্রিহনের আদেশ অমান্য হবে।
– তাহলে?
– টস ছাড়াই ফ্রিহনকে দিয়ে দাও। আর ফ্রিহনকে বলবে এটা রু চায়।
– আচ্ছা।
– পি-থ্রি’র মন খারাপ হয়ে গেল। আর একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেল। বোকা পি-থ্রি’টা বহুতল ভবনের বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে দিলো। লাফ দেয়ার আগে ফ্রিহনকে ঘোড়া দিয়ে রু’র কথা বললে ফ্রিহন ঘোড়াটি বহুতল ভবনের বারান্দা থেকে আছাড় মেরে নিচে ফেলে দেয়। যা পি-থ্রি’কে দারুণভাবে আহত করে, ভীষণ কষ্ট লাগে তার। পি-থ্রি শুধু একবার ফ্রিহনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বোকার মতো। আর তার পরেই সে লাফ দেয়।

দ্রু । শেরিফ ফারুকীসাত.

দ্রু একটা প্রজাপতি আঁকতে চেষ্টা করে আঙুল দিয়ে। কিন্তু ডানা আঁকতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে। ডানাটা মাছের লেজের মাঝামাঝি মতো ভেতরের দিকে একটা বাঁক খাবে। এই বাঁকটা সে ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারছে না। দ্রু চেষ্টা করতে থাকে। ফ্রিহন ভ্রু কুঁচকে বসে আছে। একটা বোকাসোকা রোবট আত্মহত্যা করতে পারে এ কথা ভাবতেই পারছেন না তিনি। আত্মহত্যায় প্ররোচনাদানকারী হিসেবে রু’র শাস্তি হওয়া দরকার। রোবট পি-টু’কে ডাকলো ফ্রিহন।
– ৮৩২ নং রুমে রু আছে। রু’কে ধরে নিয়ে আসো।
– দুঃখিত মহামান্য ফ্রিহন। ৮৩২ নং ওয়ার্ডে রু নামের কেউ নেই। সুমো নামের একজনের রেকর্ড পাচ্ছি আমার মেমোরিতে।
– মানে? সুমো? সুমোটা আবার কে?
– সুমোটা কে? এই প্রশেড়বর উত্তর আপনাকে কিছুক্ষণের মধ্যে খোঁজ নিয়ে জানানো হচ্ছে। পি-টু তার কয়েনটি বের করলো। কয়েনের একপাশে রু অন্যপাশে সুমো লিখে টস করলো। রু উঠলে বলবে সুমোই রু, আর সুমো উঠলে বলবে রু আত্মহত্যা করেছিল। সুমো নামের কেউ নেই। ড্যাটাবেজে একটি সমস্যার কারণে ভুলক্রমে সুমো বলা হয়েছিল। টস দুর্ভাগ্য রু-ই উঠলো।
– মহামান্য ফ্রিহন, ৮৩২ নং এ থাকা সুমো মূলত রু। রু নামটি বাদ দিয়ে সে সুমো নাম ধারণ করেছে।
– কী? ফ্রিদাল প্রধানের অনুমতি ছাড়া নাম পরিবর্তনের সাহস তাকে কে দিলো?
– মহামান্য ফ্রিহন! আশার কথা হচ্ছে নাম পরিবর্তনের ফলেই আত্মহত্যার হাত থেকে বেঁচে গেছে রু।
– কি বললে?
– হ্যাঁ, ফ্রিদালদের প্রত্যেকের নাম পরিবর্তন করা উচিত। তাহলে আত্মহত্যা বন্ধ হবে বলে মনে হচ্ছে। রু’রও আত্মহত্যার কথা ছিলো, নাম পরিবর্তন করা সে বেঁচে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
– তাই তো! কিন্তু এতো নাম পাবো কোথায়?
– আমাকে ভাবতে দিন মহামান্য ফ্রিহন।
– ঠিক আছে, আগামী অর্ধদিবস পরে তুমি আমাকে ফলাফল জানাবে।
– ওকে মহামান্য ফ্রিহন, আপনার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে, আমি কি বিখ্যাত গায়ক রঁদ্রি গাঁ ভুঁভুলার সঙ্গীত চালিয়ে দেবো?
– না, রঁদ্রি গাঁ ভুঁভুলা কি আত্মহত্যা থেকে ফ্রিদালদের বাঁচাতে পারেন?
– আমি এ সম্পর্কে আপনাকে তথ্য পেশ করবো।
– তুমি আরো তিন ঘণ্টা সময় বেশি পেলে। আমাকে এ দুইটি বিষয় সম্পর্কে দ্রুত জানাও।
– ধন্যবাদ মহামান্য ফ্রিহন, আমাকে এ গুরু দায়িত্ব অর্পণের জন্য।
আদিম যুগের মতো কুর্নিশ করে মাথা নত করে পিছনে না ফিরে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে থাকলো পি-টু। ক্ষমতা সবসময় মানুষকে ভয়ের মধ্যে রাখে। ক্ষমতাবানরা চায় অধীনস্থ মানুষ। মাথা নিচু থাকবে, চোখ নিচু থাকবে; এক্ষেত্রে পৃথিবীর সকল ক্ষমতাবানই সম্ভবত সমান। আর পৃথিবীর বাইরেও…।

আট.

দ্রু’র প্রজাপতি আঁকা শেষ হলো। সে যেন একটা জটিল ব্যাপার সমাধান করলো। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সে। মাছের লেজের মতো পাখনা দিতে গিয়ে তার মন বারবারই বোন সুমোর কাছে চলে যাচ্ছিলো। সুমো…ও সুমো, ভাই তোর জন্য লাল ঘোড়া কিনছিলাম। হারিয়ে গেছে। এই নে, নীল প্রজাপতি। এবার খুশি তো! এ্যাই সুমো, এ্যাই সুমো, মুখ গোমড়া ক্যান? কাতুকুতু কাতুকুতু… ; হা-হা-হা।
দ্রু কি পাগল হয়ে গেল? নিজে নিজে কথা বলে আর হাসে। আহা এমন বদ্ধ পরিবেশে কেনা পাগল হবে? দ্রু’র কল্পনায় হাজারটা প্রজাপতি কাঁচঘেরা এই ঘরে দৌড়াচ্ছে। সে একটা একটা ধরতে যায়। ফুড়ুৎ করে উড়াল মারে, ধরতে পারে না। বোন সুমোর জন্য লাল ঘোড়া নিতে না পারলে কি হয়েছে একটা প্রজাপতি তো নেয়া যায়!
রু’র মনে হলো, কেউ একজন তাকে ‘ও বোন… ও সুমো’ বলে ডাকছে। তার গা কাঁটা দিয়ে উঠলো এক অপার্থিব আনন্দে। রু’র জন্ম হয়েছে টেস্টটিউবে। সে শুধু নয়, ফ্রিদালদের সিস্টেমই টেস্টটিউব বেবি। একজন তাদের আদি পিতা আর একজন আদি মাতা, ফ্রিহান ও ফ্লুনা। ফ্লুনাকে মহারানীর মর্যাদা দেয়া হয়। তিনি কখনো জনসম্মুখে আসেন না। তাকে কেউ দেখে না। এমনকি প্রত্যেকের বাবা-মা ফ্রিহান ও ফ্লুনা হওয়া সত্ত্বেও তারা কেউই তাদের বাবা-মাকে দেখেনি। এ নিয়ে ফ্রিদালদের মনে কোনো দুঃখও নেই। স্বভাবতই ভাই-বোন ও ভ্রাতৃত্ববোধ এসব কিছু নেই ফ্রিদালদের। তাদের ভালোবাসা মায়া-মমতার কোনো বোধই নেই, আছে শুধু কাজ আর কাজ। রু’র মনে কিছুক্ষণ আগেও দুঃখ ছিল। এই দুঃখ তাকে বারবার আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয়। কিন্তু রু’র মন হঠাৎ ভালো হয়ে গেলো। তার মনে হলো কেউ একজন তাকে প্রজাপতি দিচ্ছে। কৃত্রিম প্রজাপতি না, সত্যি সত্যি প্রজাপতি। সে একটা প্রজাপতির ডানা ছুঁয়ে দিলো। এরপর আরেকটা, তারপর আরেকটা…। ছোট বাচ্চার মতো সে লাফাতে লাগলো। সে গুনগুন করে গেয়ে উঠলো,
‘ছেড়ে দিয়ে নাটাই সুতো
উড়াই ইচ্ছে ঘুড়ি
এঁকে দেই নীল আকাশে
শত ডানার প্রজাপতি।’
এই যে ফ্রিদালদের একটি মেয়ে পৃথিবীর গান গাইছে। এই যে অপার্থিব আনন্দ পাচ্ছে। তার মনে যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগছে এটা একদিন ফ্রিদালদের ইতিহাস হবে। যে দ্রুকে মেরে ফেলার কথা, সে ইতিহাসে স্থান পাবে। এটা ফ্রিহান জানে না। জানে না বলেই বারবার দ্রু’র স্বপ্নকে মেরে ফেলতে চাচ্ছে সে। আদৌ কি তা সম্ভব হবে?

নয়.

রঁদ্রি গাঁ ভুঁভুলা, গ্রীষ্মকালীন অবকাশ শেষে মাত্রই নিজের বাসায় ফিরলেন। ঠিক এমন সময় বান্দা হাজির ফ্রিহানের পত্র নিয়ে। আত্মহত্যা বিমুখ করতে রঁদ্রির গান গাওয়ার আমন্ত্রণ। রঁদ্রি জানেন ফ্রিহান আমন্ত্রণ করা মানে রঁদ্রি যেতে বাধ্য। কিন্তু তার কেমন জানি ভালো লাগছে না। ভালো লাগছে না ব্যাপারটা ফ্রিদালদের মধ্যে নেই, এমনকি মহামান্য ফ্রিহানের কথা কেউ অমান্য করেছে ইতিহাসে এমন মর্মান্তিক নজির মাত্র তিনটা আছে। আর সেসব মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী পুরো ফ্রিদাল জাতি। পিতার আদেশ অমান্য করা হেতু রিরা, ত্রাং ও সুহাকে আগুনে জ্যান্ত পুড়িয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিলো। এমনকি তাদের বাধ্য করা হয়েছিল নিজে আগুনে ঝাঁপ দিতে। বহু আগের কোনো এক ধর্ম থেকে ফ্রিহান এমন আগুনে ঝাঁপিয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর ব্যাপারটা নিয়েছিলেন, ফ্রিদালরা কখনো সে ইতিহাস ভোলে না, কিন্তু রুঁদ্রির বয়স হয়েছে সম্ভবত সে ভুলে গেছে। তাই পি-টু তাকে সে বিভীষিকাময় ব্যাপার স্মরণ করিয়ে দিতে চাইলো।
– দেখুন শ্রদ্ধেয় রুঁদ্রি, আপনি আমাদের অহঙ্কার, কিন্তু আমরা আপনার গান শুনতে চাই, আগামী গ্রীষ্মে আপনার কবরে ফুল দিতে চাই না। খুব ঠাণ্ডা মাথায় চমৎকার এক হুমকি দিলো পি-টু। পি-টু সবসময় এমনভাবে ভয়ঙ্কর কথা বলে যেন কিছুই হয়নি। এমনকি এই মাত্র রঁদ্রিকে হত্যার হুমকি দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সদ্য পরলোকগত পি-থ্রির অনুকরণে একটা হাই দিয়ে হাহ শব্দ করে দুঃখবোধ পর্যন্ত করলো। পি-টু জানে কোথায় কোথায় দুঃখের শব্দ করতে হবে। সে পি-থ্রির মতো বোকা না। কিন্তু সে একটু বোকাই বটে। সঙ্গীতের মন্ত্রমুগ্ধ শক্তি সে জানে না, তাকে এখন রঁদ্রির মোহময় এক অপেরা শুনতে হবে। আর শুনতে শুনতে নিজে নিজে আত্মহত্যা করতে হবে। রঁদ্রি ভয়ঙ্কর তীব্র শ্লেষযুক্ত ভয় জাগানিয়া কথায় তেমন ভীত হলেন না। স্মিত হাসলেন। খুব সরল হাসি। তারপর ধীরে ধীরে সুর তুললেন অদ্ভুত এক গানে। যে গানের মানে বোঝে না পি-টু।
‘ছেড়ে দিয়ে নাটাই সুতো…।’
পি-টু’র রোবটদেহ থরথর করে কাঁপতে থাকলো। মনে হলো প্রাচীন কোনো ধর্মবেত্তা অদ্ভুত সুরে ধর্মগ্রন্থ থেকে সুর করে কিছু একটা পড়ে যাচ্ছে ভূতগ্রস্ত মানুষের সামনে। পি-টু’র মনে হলো নাটাই সুতোর মতো কিছু একটা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার করোটির সংযোগস্থলে। একটি তার ছিঁড়ে গেল, এরপর অসহ্য যন্ত্রণায় একে একে ছিঁড়তে লাগলো বাকি সব তার। উদ্ভ্রান্তের মতো লাফাতে লাগলো। তার কাছে অসহ্য মনে হতে থাকলো গানের সুর। মনে হলো তাকে ঘিরে ধরেছে শত ডানার প্রজাপতি। দেয়ালের সাথে ঠুকে ঠুকে ভেঙে ফেললো তার বাঁ হাত। করোটি, ঊরুসন্ধিস্থল…। অসহ্য যন্ত্রণায় যখন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে সব তখনও ছোট্ট একটা যন্ত্র লাফাচ্ছে, একটা মার্বেল আকৃতির জিনিস। বলা হয়ে থাকে চোখের জীবন সবার পরে যায়। রোবটের বেলায়ও এটা সত্যি কি না কে জানে।

দশ.

রঁদ্রি ভুঁভুলার সুর সঙ্গীতে মানুষ মাতোয়ারা হয়ে যায়। সে মানুষটাকে জনসম্মুখে পুড়িয়ে হত্যার আয়োজন দেখেও স্তম্ভিত হলো না ফ্রিদালদের কেউ। তারা স্তম্ভিত বিস্মিত; রাগ, ক্ষোভ ঘৃণা এ জিনিসগুলোর সাথে পরিচিত না। তারা শুধু তিনটা জিনিসের সাথে পরিচিত।
কাজ।
ভয়।
আনন্দ।
তাদের এখন এ হত্যাকাণ্ড দেখে ভয় পেতে হবে, মারাত্মক ভয়। যেন আর কোনো ফ্রিদাল ফ্রিহানের কথার বাইরে না যায়। একটা গোল ঘেরা দেওয়া হলো। উন্মুক্ত প্রান্তর। ফ্রিহানের আদেশে সব ফ্রিদাল এক হয়েছে। জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার দৃশ্য দেখতে, তাদের চোখে মুখে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ভয়। পিছমোড়া হাত বাঁধা রঁদ্রি ভুঁভুলাকে যখন হাজির করা হলো জনতা তখন উহ শব্দে একটা শোরগোল করলো। ফ্রিহান অবাক হলো। ‘উহ’ শব্দ কোত্থেকে শিখলো এরা?

এগার.

দ্রু প্রজাপতি উড়াতে থাকলো মনের আনন্দে। একের পর এক প্রজাপতি আঁকছে আর উড়াচ্ছে ঊর্ধ্বাকাশে। আর গুনগুনিয়ে একটা গান গাইতে থাকলো,
‘…উড়াই ইচ্ছেঘুড়ি
শত ডানার প্রজাপতি…।’
আহ মনের আনন্দে সে প্রজাপতির মতো ওড়ার ভঙ্গি করে ঘুরতে লাগলো। তার বোন সুমো যদি থাকতো তাহলে আরো দু’টো ডানা হতো। যে মানুষগুলোকে ধরে আনা হয়েছে তারাসহ থাকলে আরো অনেকগুলো ডানা হতো, তার মনে হলো তার সাথে সবাই আছে, সবাই নাচছে ঘুরে ঘুরে গাইছে-
‘…এঁকে দেই নীল আকাশে
শত ডানার প্রজাপতি…।’
রু’র মন খুব খারাপ, ফ্রিদালরা কেমন উৎসুক হয়ে একটা হত্যাকাণ্ড দেখতে দাঁড়িয়ে আছে। তার মোটেই ভালো লাগছে না। কেমন কেমন লাগছে। কেমন কেমন? সে কি অন্যদের চেয়ে আলাদা ভাবছে? সে কি পৃথিবীর মানুষদের মতো ভাবছে? সে কি মানুষে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে?
রঁদ্রি ভুভুলাকে একটা বড় ইস্পাতের আগায় ঝুলিয়ে রাখা হলো। মহামান্য ফ্রিহন হত্যাযজ্ঞ উদ্বোধন করা ছাড়া শুরু হবে না। ফ্রিহন এখন তার ব্যক্তিগত দ্বিতীয় রোবট পি-টু’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন। রোবট জাতির প্রথম রোবট হিসেবে এ সম্মান পাচ্ছে পি-টু। পি-টু’র যান্ত্রিক দেহ একটা আগেড়বয়গিরিতে নানা আনুষ্ঠানিকতার পর ফেলা হবে। উদ্ভট এক রাষ্ট্রীয় সম্মান পেলো পি-টু। পি-টু এর দাহকার্য সম্পন্ন করে ফ্রিহন হত্যাকাণ্ড পরিদর্শন করতে আসলেন। এসেই তিনি ‘উহ’ শব্দ শুনলেন। অবাক হলেন, পৃথিবীর মানুষদের উহ শব্দে। ফ্রিদালরা রপ্ত করলো কিভাবে? ফ্রিদালদের মনোজগতে আত্মহত্যা আর ব্যথাবোধ অন্যায়বোধ কিভাবে জেগে উঠলো? ফ্রিহন ভাবতে ভাবতে এগোতে থাকলো ডায়াসের দিকে। গুরুগম্ভীর পরিবেশ। ফ্রিহান সাধারণত জনসম্মুখে বক্তৃতা দেন, যা আজ দিবেন। আজ এমন একজনকে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে যিনি কিনা ইতিহাসের অন্যতম একজন মানুষ। রঁদ্রি ভুঁভুলা। রঁদ্রি ভুঁভুলার দিকে ফ্রিহান তাকালো। অবাক হলেন ফ্রিহান, রঁদ্রির মুখে হাসি। অমায়িক হাসি, শিশুসুলভ সরলতার হাসি। এও বিশ্বাস করা যায়?
তিনি হাসি অগ্রাহ্য করে ফ্রিদালদের দিকে ফিরে তাকালেন। প্রিয় সন্তানেরা, তোমরা জানো ফ্রিদাল সভ্যতা তিলে তিলে আমি গড়ে তুলেছি। আমরা যখন ধীরে ধীরে পৃথিবী দখলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। জ্ঞান-বিজ্ঞানে চরম পরাকাষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তখন ফ্রিদালদের মধ্যে থেকে কিছু কুলাঙ্গার আমাদের এ তৎপরতা নস্যাৎ করতে চেষ্টা করছে। তারা নিজেদেরকে প্লেটো মনে করে। যুবকদের প্লেটোর মতো বিভ্রান্ত করে। প্লেটো হচ্ছেন পৃথিবীর ঐসব মানুষদের একজন যাদের আমরা কিছুদিন পর পদানত করব। দেখ এই যে নব্য প্লেটো (এ কথা বলার সময় হাতের লম্বা ছড়ি দিয়ে রঁদ্রি ভুঁভুলার গালে খোঁচা দিলো ফ্রিহান। ফ্রিদালরা এ সময় উচ্চস্বরে উহ করে ওঠে। বিরক্ত হয়ে ফ্রিহান আবার জনতার দিকে তাকায়।), এই প্লেটো তোমাদেরকে মানবীয় গুণ শিখতে প্ররোচনা দিচ্ছে। এই যে তোমরা উহ করছো, তোমাদের সভ্যতা এক উহ-এ অনেকদূর পেছনে পড়ে যাবে। এসো, আমরা মানুষের শব্দগুলো ভুলে যাই। ফ্রিদালদের সকলের মঙ্গল কামনা করে এখন ভুঁভুলাকে পোড়ানো হবে। সমস্ত নিয়ম ভঙ্গ করে এখন আজকের এ শাস্তি কার্যক্রমের উদ্বোধন করবে একটি মেয়ে। আমরা ফ্রিদালদের ১০০ জন মেয়ের নাম একটা বক্সে রেখেছি। রঁদ্রি নিজে তার হন্তারকের নাম তুলবে, যার নাম উঠবে সেই তাকে আগুনে পোড়াবে। যেন খুব মজার একটা জাদুর খেলা হচ্ছে এমন ভঙ্গিতে বারকয়েক ঝাঁকি দিলো একা কাচের জারকে। তারপর সে জার তুলে ধরা হলো রঁদ্রি ভুঁভুলার দিকে। রঁদ্রি ভুভুলা কাঁপা কাঁপা হাতে যে নামটি তুললেন সে নামটি রু।
দেয়ালের সাথে ঠুকে ঠুকে ভেঙে ফেললো তার বাঁ হাত। করোটি, ঊরুসন্ধিস্থল…। অসহ্য যন্ত্রণায় যখন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে সব তখনও ছোট্ট একটা যন্ত্র লাফাচ্ছে, একটা মার্বেল আকৃতির জিনিস। বলা হয়ে থাকে চোখের জীবন সবার পরে যায়। রোবটের বেলায়ও এটা সত্যি কি না কে জানে।

দ্রু । শেরিফ ফারুকীদশ.

রঁদ্রি ভুঁভুলার সুর সঙ্গীতে মানুষ মাতোয়ারা হয়ে যায়। সে মানুষটাকে জনসম্মুখে পুড়িয়ে হত্যার আয়োজন দেখেও স্তম্ভিত হলো না ফ্রিদালদের কেউ। তারা স্তম্ভিত বিস্মিত; রাগ, ক্ষোভ ঘৃণা এ জিনিসগুলোর সাথে পরিচিত না। তারা শুধু তিনটা জিনিসের সাথে পরিচিত।
কাজ।
ভয়।
আনন্দ।
তাদের এখন এ হত্যাকাণ্ড দেখে ভয় পেতে হবে, মারাত্মক ভয়। যেন আর কোনো ফ্রিদাল ফ্রিহানের কথার বাইরে না যায়। একটা গোল ঘেরা দেওয়া হলো। উন্মুক্ত প্রান্তর। ফ্রিহানের আদেশে সব ফ্রিদাল এক হয়েছে। জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার দৃশ্য দেখতে, তাদের চোখে মুখে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ভয়। পিছমোড়া হাত বাঁধা রঁদ্রি ভুঁভুলাকে যখন হাজির করা হলো জনতা তখন উহ শব্দে একটা শোরগোল করলো। ফ্রিহান অবাক হলো। ‘উহ’ শব্দ কোত্থেকে শিখলো এরা?

এগার.

দ্রু প্রজাপতি উড়াতে থাকলো মনের আনন্দে। একের পর এক প্রজাপতি আঁকছে আর উড়াচ্ছে ঊর্ধ্বাকাশে। আর গুনগুনিয়ে একটা গান গাইতে থাকলো,
‘…উড়াই ইচ্ছেঘুড়ি
শত ডানার প্রজাপতি…।’
আহ মনের আনন্দে সে প্রজাপতির মতো ওড়ার ভঙ্গি করে ঘুরতে লাগলো। তার বোন সুমো যদি থাকতো তাহলে আরো দু’টো ডানা হতো। যে মানুষগুলোকে ধরে আনা হয়েছে তারাসহ থাকলে আরো অনেকগুলো ডানা হতো, তার মনে হলো তার সাথে সবাই আছে, সবাই নাচছে ঘুরে ঘুরে গাইছে-
‘…এঁকে দেই নীল আকাশে
শত ডানার প্রজাপতি…।’

বার.

দ্রু’র মনে হলো, তার সব প্রজাপতি মরে যাচ্ছে। সুমো বলত, ‘দ্রু ভাইয়া, ঘরে প্রজাপতি ঢুকলে পানি মারতে হয়, ওরা পানি খেতে আসে।’ সুমোর কথা শুনে সে হাসতো। সুমো একটা সিরিঞ্জে পানি ভরতো আর প্রজাপতি দেখলেই পানি মারতো। দ্রু’র খুব মজা লাগতো দুষ্টু বোনটার দুষ্টুমি দেখে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার প্রজাপতিগুলো মরে যাচ্ছে। একটা একটা করে মরে যাচ্ছে, সে কোথাও পানি পাচ্ছে না। ফ্রিদালরা সব আজ কোথাও গেছে। কোথায় গেছে তারা? দ্রু’র খুব কষ্ট হতে লাগলো, প্রজাপতিগুলো একটা একটা মরে যাচ্ছে। দ্রু’র মনে হলো নিজের সন্তান মরে যাচ্ছে। প্রজাপতিগুলো নিজেদের ডানা খসিয়ে দিচ্ছে। দ্রু’র বুকের ভেতর থোকা থোকা কষ্ট জমা হতে থাকলো। ডানা খসে পড়তে পড়তে শত ডানা খসে পড়লো যেন।
পায়োন্দা মাঠ, যেখানে প্রতি বছর ফ্রিদালদের বহ্নি উৎসব হয়। যে মাঠে বহুবার গান গেয়েছেন সুরসম্রাট ভুভুলা, সেই মাঠেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। এজন্য যে মাঠও কেঁদে উঠলো, আহ…! একটা দুঃখের শব্দের রোল উঠল সারা মাঠে। এ শব্দ ফ্রিহানকে ভীত-শঙ্কিত এবং একইসাথে রাগান্বিত করে তোলে (রোবট পি-থ্রি’র মাধ্যমে ফ্রিদালরা আহ শব্দ শিখেছে পি-থ্রি শিখেছে মানুষের কাছ থেকে।)
রু ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় এক আগুনের গনগনে মশাল নিয়ে। তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন মঞ্চে কোনো স্লো মোশনে দেখানো দৃশ্য। যেন প্রত্যেক কদমে কতকাল পেরিয়ে গেছে। রু ধীরে ধীরে লোহার দণ্ড বেয়ে উঠতে লাগলো, যে দণ্ডের সবচেয়ে উঁচুতে বাঁধা ভুভুলা। রু আগুন ধরানোর সাথে সাথেই ফ্রিদালদের নিশানাবাজরা তীরের নিশানায় এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে ভুভুলার দেহ, তারা পজিশন নিয়ে রেখেছে। রু উঠে দাঁড়ালো, হাতছোঁয়া দূরত্বে যখন রু, তখন অদ্ভুত বিমর্ষ সুরে সে গেয়ে উঠলো, ‘ছেড়ে দিয়ে নাটাই সুতো…।’
একটা বিষণ্নতা ছড়িয়ে পড়লো মাঠজুড়ে। এ বিষণ্নতার সাথে ফ্রিদালদের পরিচয় নেই। অদ্ভুত অবসনড়বতায় তাদের দেহ নেতিয়ে পড়লো। গলিত লাভার মতো ফুটতে থাকা দেহ নেতিয়ে পড়লো। যেন তারা পরিশ্রান্ত, যেন তারা এ সুর শোনার জন্যই ব্যাকুল আর উদগ্রীব হয়ে এতোক্ষণ এখানে বসেছিল। যেন তারা ভুলে গেল একটি হত্যাদৃশ্য অবলোকন করার কথা ছিল। তীরন্দাজরা হাত নামিয়ে নিলো, তীর ছুঁড়ে ফেলে দিলো তারাও। যেন এমন অদ্ভুত সুর কখনো শোনেনি। যেন এক জাদুর মোহ।
তাদের চোখে খেলতে লাগলো অদ্ভুত এক প্রজাপতি, অনেকগুলো ডানা…। তারা অবশ্য পরে বলাবলি করছিলো- হাজার ডানা, লক্ষ ডানা…। অবশ্য তারা গণনা করতে জানে না। তাদের গণনা শেখানো হয়নি, তাদের তিনটি জিনিস শেখানো হয়।
ভয়।
কাজ।
আনন্দ।

তের.

ফ্রিদালরা স্বাধীন হতে শিখলো, গান গাইতে শিখলো, কথা বলতে শিখলো। ভুঁভুলাকে ফ্রিদালরা সোল্লাসে নামিয়ে আনলো, ভুঁভুলা নিচে নেমে এসে চুমো খেলেন রু’র চোখে। ভুঁভুলার শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখে কানড়বার ধারা বইতে লাগলো। ফ্রিদালরা ফ্রিহানকে বেঁধে রাখলো। বিশৃঙ্খলরা শৃঙ্খলার মধ্যে আসতে চায় না। মুহূর্তেই একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। মুক্তির আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লো ফ্রিদাল জাতি। রঁদ্রি গাঁ ভুঁভুলা নেতৃত্বের ভার কাঁধে তুলে দিলেন নোয়াকে। নোয়াকে উদ্দেশ করে বললেন, দ্যাখো তোমার নামে মানুষদের একজন আদি পুরুষের নাম আছে। মানুষদের প্রতি সম্মান জানিয়ে তোমাকে পিতা বানানো হলো। এখন আমাদের নতুন মাতাকে বেছে নাও।
নোয়া বেছে নিলো রু’কে। রঁদ্রি ভুঁভুলা নোয়া আর রুকে পায়োন্দা মাঠের মধ্যখানে নিয়ে এসে সবাইকে বললেন, তোমাদের নতুন মাতা-পিতাকে শ্রদ্ধা জানাও। সবই নুয়ে পড়লো। রু দাঁড়ালো অশ্রুসিক্ত নয়নে। বললো,
– আমার সন্তানেরা পৃথিবীর মানুষদের কাছ থেকে আমরা মন খারাপের অনুভূতি শিখতে চেয়েছি, কিন্তু দ্রু আমাদের শেখালো স্বাধীনতা; স্বাধীনতার আনন্দ, স্বাদ।
দ্রু শিখিয়েছে কল্পনা করতে, গান গাইতে মনে মনে প্রজাপতি আঁকতে। এসো, আমরা তার প্রতি নুইয়ে পড়ি। ফ্রিদালদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে দ্রু। সমবেত মাঠ, ফ্রিদালদের মন খারাপ হয়ে থাকার কথা, অথচ ওরা মন খারাপ করতে পারে না।

Share.

মন্তব্য করুন