আম্মু সব সময়ই বলে, হাতের পাঁচটি আঙুল কি সমান হয় রে? সে তো হয় না। একথা বুলু জানে, টুলুও জানে। বুলু ধীর-স্থির, বই-খাতা-পত্তর ব্যাগে গুছিয়ে রাখে। কক্ষনো রাবার-পেনসিল হারায় না। স্কুল খোলা থাকলে সকাল বেলা পড়ার সময় হয় না, কিন্তু সন্ধ্যায় নিয়ম করে বুলু পড়তে বসে। হোমটাস্ক কখনো করেনি- এমন কখনই হয় না।
টুলু বড় ভাইয়ের একেবারে উল্টো। বই স্কুলে ফেলে আসে, খাতা-পত্তর এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখে, যখন-তখন রাবার-পেনসিল ওর হারিয়ে যায়। হোমটাস্ক করেনি বলে স্কুলে ম্যাম এর বকুনি খায়। এরপরও দাঁত বের করে হাসে।
নাফিসা ম্যাম রেগে বলেন, লজ্জা করে না হাসতে? শেম অন ইয়ু!
গার্জেন কল হয়। মাথা নিচু করে মেহনাজ আসেন। টিচারদের কাছ থেকে ছেলের কুকীর্তির কথা শোনে, মন খারাপ করে বাড়িতে ফিরে এলে দাদী জিজ্ঞেস করেন, ‘টুলু পড়াশোনা করে না, মনোযোগ নেই, অংকে বিশ পেয়েছে এসব বলল তো বউ মা?’ ‘হ্যাঁ মা।
দাদী বলেন, ‘তুমিই তো বলো- হাতের পাঁচটি আঙুল সমান হয় না, তাহলে মন খারাপ করে আছো কেন?’
মেহনাজ মুখভরে হেসে বলেন, ‘না মা, মন খারাপ করছি না। তবে স্যার-ম্যামরা সবসময় বুলুর সঙ্গে তুলনা করেন তো- খুব খারাপ লাগে তখন। আপনিই বলুন তো মা- সবাই কি একরকম হয়?’
সে তো হয় না ঠিক আছে। পড়াশোনায় মনোযোগ নেই তাও মেহনাজ মেনে নেয়, তবে ঘুম থেকে ভোরবেলা উঠে- ‘আম্মু, আমার ছোলা ভিজিয়েছ? আখরোট কিসমিস বাদাম ভিজিয়েছ? ফলও দিয়ো আম্মু, দেশী ফল।’
কথাগুলো শুনলেই মায়ের মেজাজ চড়ে যায়। সকালবেলা বাড়ির সবার নাশতা নিয়ে জেরবার হয় মেহনাজ, বানু রুটি বেলে, নাজ ভাজিতে খুন্তি নাড়ে।
বুলু-টুলুর আব্বুর লেবু দিয়ে লিকার চা, কেউ ডিমের পোচ, কেউ ওমলেট খায়। বুলু খায় পাউরুটি, মাখন, দুধ। এ ছেলে তো কোনো কিছুতে জ্বালায় না। চুপচাপ খেয়ে উঠে গিয়ে ব্যাগ গোছায়। এ তো মানতেই হবে। প্যাঁকাটির মতো চেহারা নিয়ে টুলু এসে বলে, ‘আম্মু, আমার ডায়েট!’
ছেলের দু’গালে চড় কষাতে তখন ইচ্ছে হয় নাজের। ছোলা-বাদাম-কিসমিস ভেজানো। নানারকম ফল গুছিয়ে দেয়া, ফুল বয়েল ডিম।
গ্রিল স্যার বলেছেন, ‘কামরাঙা-টমেটো-আমলকি-কুল, এগুলো কিন্তু আঙুরের চেয়ে খারাপ নয়।
প্লেটের দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে বলে, ‘টমেটো এত কম দিলে আম্মু!’
মা বলে, ‘শোনো টুলু, বাড়িতে আর কারো মুখ নেই? দুপুরে সবাইকে স্যালাড দিতে হবে না? শুধু তুমি খেলে হবে?
করলা-উচ্ছে-ঢ্যাঁড়স খেতে চাও না, স্যার বলেছে বলে কাঁচা আম কচকচ করে খাও। বলি কী শুরু করেছিস?’
কাঁদো কাঁদো সুরে টুলু বলে, ‘আমাকে সবাই তেজপাতা বলে, পাটকাঠি ডাকে, ব্যায়াম করে খেয়েদেয়ে আমি শক্তিশালী হবো না?’
বাইসেপ একটুখানি হলেও সুপারির মতো ফুলে উঠেছে, কই সে কথা তো আম্মু একবার বলে না। আব্বু বলেন, ‘পৌনে আটটা তো বেজে গেছে কখন রেডি হবি কখন স্কুলে যাবে টুলু?’
মাহি চাচু বলল, ‘দ্যাখ দ্যাখ, তাকিয়ে দেখ বুলু তৈরি হয়ে বসে আছে। তোর তো সতেরো দিনে পরশু।’
আবার তুলনা? উফ্- বুলু ভাইয়া পড়াশোনায় একটু খারাপ হতে পারল না? অংকে ওর সবসময় ফুল মার্কস পেতে হবে। সব সাবজেক্টে নাইনটি পার্সেন্ট মার্কস ওর পাওয়া চাই-ই চাই। আমার জন্য তো একটু খারাপ হতে পারিস ভাইয়া।
আমি যে ফুটবল খেলি, স্কুলের মাঠে বোলিং করি, ব্যাটসম্যান হই, রান করতে পারি দারুন, সে কথা কেউ বলে না।
রঙিন এক সন্ধ্যায় টুলু । ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থখালা-ফুফু-মামু যে আসে সবাই জিজ্ঞেস করে, ‘কী খবর টুলু, প্লেস আছে তো? ফার্স্ট সেকেন্ড না থার্ড?’
যেন প্রথম তিনজনের মধ্যে থাকতেই হবে। বুলু পারে- তুমিত পারবে না কেন!
এই রোগাপটকা ছেলেটির কথা কেউ ভাবে না। ক্ল্যাসে র‌্যাঙ্ক করতে না পারুক, নানা পছন্দের জিনিসে ও বিভোর হয়ে থাকে।
ঘুম ভেঙে টুলু যদি দেখে সবুজ ঘাসের ওপর অগুনতি কমলা রং বোঁটার শিউলি ঝরে পড়ে আছে, তবে ওর চোখ আটকে যাবে না? আবার কখনো কখনো বাদলা হাওয়ায় গাছের পাতাগুলো সড়সড় করে কেঁপে ওঠে, রাস্তায় ধূলো ওড়ে, ঝড়ের সাথে আচমকা নামে ঝুম বৃষ্টি- এমন দিনে টুলু জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে। ওর এই ছোট ছোট ভালোলাগাটুকু বড়রা বুঝতে পারে না কেন? বুলু ভাইয়া এমন করে না বলেই সবাই ওকে ভালোবাসে, পরীক্ষায় র‌্যাঙ্ক করে। বইয়ের ওপর চোখ রেখে গুনগুন করে পড়েই চলে। বিদ্যুৎ চলে গেলে মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়া চালিয়ে যেতে থাকে। পড়ো পড়ো, সবাইকে পেছনে ফেলে তোমার এগিয়ে যেতে হবে।
টুলুর যে আনন্দে গা ভাসিয়ে দিতে ভালো লাগে। জন্মদিন এলে তো কথাই নেই। সারাটা দিন সন্ধ্যার কথা ভেবে ভেবেই সে কাটিয়ে দেয়। বরং আজকের রাতটা পড়তে হবে না বলে খুশিতে বুক ভরে যায়।
সন্ধ্যাবেলা জমাট পার্টি হয়। ক্লাসের বন্ধুরা আসে, ওদের মা বাবারা সঙ্গে আসেন। আত্মীয়-স্বজনরা তো আসেনই। জম্পেশ খাওয়া দাওয়া হয়। হাসি-ঠাট্টা, ছুটোছুটি আর সুরে-বেসুরে গান তো আছেই। ক্যান্ডি, ক্যাডবেরি, চিপস আর আইসক্রিম সাজানো থাকে টেবিলে। আজ টুলুর জন্মদিন, সেই খুশিতে ও বিভোর।
মেহনাজ বলে, আজ যা খুশি খাও, আনন্দ করো। জন্মদিন বছরে তো একদিনই আসে।
এত হৈ-হুল্লোড়, তার মাঝে ভাইয়া হোমটাস্ক সেরে নেয়। পারেও বটে ছেলেটা। আম্মু ঠিকই বলে, দুজন একেবারেই দুরকম।
নানাজান খুব একটা বাইরেবের হন না, তবে দু’নাতির জন্মদিনে ঠিকই আসেন।
ওর বন্ধু দীপু বলে, নানাজান, ও নানাজান- একটা গান ধরো না।
রিন্টু বলে, ইস, নানা গান গাইলে জন্মদিনটা জমে ক্ষীর হয়ে যাবে।
তাতান বলে ওঠে, নানাজান ব্যান্ডের গান করুক- ‘গাড়ি চলে না চলে না, চলে না রে…।’
নাতির বন্ধুদের সঙ্গে গপ্পোসপ্পো করে করে গান গেয়ে উঠেন নানাজান-
‘সবাই বলে বয়স বাড়ে
আমি বলি কমে রে…।’
কী অদ্ভুত গান! টুলুর বন্ধুরা হেসে গড়িয়ে পড়ে। টুলুর হাসি আসে না, বুকের ভেতর ওর কেমন কষ্ট হতে থাকে। এমন হাসিখুশির রাতে বেছে বেছে এ গানটি গাইল কেন দাদু?
এমন ঘটেছিল গেল বছর। টুলুর সাত বছরে পা রাখার জন্মদিনে। এবার আটে পা রেখেছে সে। জমাট পার্টি হচ্ছে বাড়িতে। বুলু ভাইয়ার সব কিছুই অন্যরকম। নাহয় পড়াশোনায় ভালো, তা বলে কি জন্মদিনে আনন্দ করতে নেই?
বনানী থেকে আসা দাদাজান বলেন, স্কুল থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে স্কুল, হোমটাস্ক, অংক কষা- এসব করতে করতে ভালো লাগে না তো, তাই উৎসব আসে। সে জন্মদিন হোক, পূজো হোক, ঈদ হোক- আনন্দ করো সবাই মিলে।
মাহীচাচু-রুদ্রচাচু বিশাল এক চকলেট কেক নিয়ে এসেছে। গোলাপ আর সবুজ রঙ ক্রিম দিয়ে লতাপাতা আর ফুল আঁকা রয়েছে ওপরে। বুলু ভাইয়া একবার এস ঢুঁ মেরে যায়। চোখে হেরি পটারের মতো লটরপটর চশমা। কেকের দিকে চোরা চোখে তাকিয়ে এক ফাঁকে জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে নেয়।
নানাজান বলেন, তোমাদের মাথায় শুধু জন্মদিনের ভাবনা, তাই না?
টুলুর বন্ধু তুতুল বলে, শুধু কি আমরা দাদু?
রবীন্দ্রনাথ-নজরুলেরও তো জন্মদিন হয়। রুদ্রচাচু বলেন, ওরা আমাদের এত দিয়েছেন, ওদের জন্মদিন করি আমরা।
কাচুমাচু মুখে টুলু বলে, আমাদের জন্মদিন কে করবে বলো। বাড়িতে আব্বু-আম্মু-চাচুরা বার্থডে পার্টি এ্যারেঞ্জ না করলে আমাদের জন্মদিন তো কেউ করবে না রুদ্রচাচু। মাহীচাচু, তুমি কি বলো! নানাজান আদুরে গলায় বলেন, তোমরাও দেশের জন্য, মানুষের জন্য এমন কাজ করো যাতে মানুষ তোমাদেরও মনে রাখে।
দাদী এসে বলেন, আমাদের বুলুর কথাই ধরো না। ও আছে শুধু ওর পড়াশোনা নিয়ে। খাবার-দাবারে ওর কোনো মন নেই। টুলু মনে মনে খুব হাসে।
ওর কথা বলো না দাদী। এক ফাঁকে এসে ভাইয়া চকলেট কেকটি দেখে গেছে। মুখ ওর পানিতে ভরে গেছে। নইলে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটবে কেন বলো তো!
আজ হোমটাস্ক নেই, পড়াশোনা নেই- জন্মদিন বলে বেস্টফ্রেন্ডরা এসেছে, এ খুশি তো রয়েছেই। এছাড়া অন্য আর একটি সারপ্রাইজ রয়েছে ওর জন্য।
রুদ্রচাচু বলেছে, আজ তোকে একটা সারপ্রাইজ দেব। কী সে সারপ্রাইজ তা আঁচ করতে পারছে না বুলু। অনেক ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়ে রাহী, তুতুল, সাকিব, দীপু- ওরা। সবার সঙ্গে মেতে আছে ও। কেক কাটা হয়ে গেছে, সুরে-বেসুরে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইয়ু’ গান গাওয়াও শেষ। ছুটোছুটি খেলতে গিয়ে ড্রয়িংরুমে টুলু যার সাথে বড়সড় একটা ধাক্কা খেল- চোখ তুলে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় সে। রুদ্রচাচুর সঙ্গে ইংরেজির ইলিয়াস স্যার, অংকের হাসান স্যার। ওরা দুজনেই স্কুলে চাচুর সঙ্গে পড়েছেন। বাইরে দেখা হয় ওদের, বাড়িতে কখনোই আসেনি।
‘স্যরি স্যার, দেখিনি স্যার, মাফ করে দেন স্যার- বলতে থাকে টুলু।’
সত্যি দারুন সারপ্রাইজ! জন্মদিনে আর কী চাই বুলুর? কিছু চাই না।
চাচুর সঙ্গে স্যারেরাও ঠা-ঠা করে হাসলেন। স্যার বাড়িতে এলে যে মাখনের মতো নরম আর সিলকি হয়ে যান- এই প্রথম বুঝতে পারেত টুলু আর ওর বন্ধুরা।
স্যার দুজনকে ঘিরে জমজমাট আসর বসে। কেক-কলা-সন্দেশ-স্যান্ডউইচ খাবার পর বুলু নিয়ে আসে পেস্তা-কিসমিস-কাজুকুচো আর জাফরান দেয়া স্পেশাল ফিরনী। আম্মুকে ইলিয়াস স্যার বলেন, ব্রিলিয়ান্ট ছেলে আপনার। মেহনাজ বলেন, ছোট ছেলেটা একেবারেই পড়াশোনা করতে চায় না। অংকের হাসান স্যার এখন চোখ পাকিয়ে একদম কথা বলছেন না। উনার মুখ ভরা হাসি। আড্ডার মেজাজে বলেন, এ নিয়ে একদম ভাববেন না। বৈজ্ঞানিক আলভা এডিসনের নাম শুনেছ তো তোমরা।
‘হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার।’ একসাথে চেঁচিয়ে বলে ছেলেরা।
‘তিনি কী কী আবিষ্কার করেছেন বলো তো।’
সবাই চুপ। বুলু হাসিমুখে বলে, তিনি তো ফটোগ্রাফি, বৈদ্যুতিক বাতি, মুভি ক্যামেরা আবিষ্কার করেছেন স্যার।
‘দ্যাটস গুড। কিন্তু তোমরা কি জানো ছেলেবেলায় আলভা এডিসনকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো অলস বলে! অথচ দ্যাখো, তিনি কত কিছু আবিষ্কার করেছেন। তার মানে জীবনে কে কি করবে, কে হঠাৎ করে স্পার্ক করবে আমরা কেউই বলতে পারি না। টুলু, মানে আরমানকে নিয়ে আপনারা একদম ভাববেন না। রুদ্রচাচু বলেন, তোমরাই তো বলো হাসান, অমুক ছেলে পারবে, তমুক ছেলে পারবে না। পড়া না পারলে নীলডাউন করাও, পানিশমেন্ট দাও। দাও না বলো?
বয়স্ক একজন আংকেল বলেন, ক্রিয়েটিভ আর ভালো ছাত্র- এ দুয়ের যদি তফাৎ আপনারা বুঝতে পারেন, তাতে আপনাদেরই ভালো হবে।
ইংরেজি স্যার ইলিয়াস ক্রিম সরিয়ে কেক-এর পিস মুখে দিয়ে বলেন, ‘শুধু পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে ছেলেদের জাজ করা যায় না। দুঃখের বিষয়, আমরা তাই করে থাকি।’
রুদ্রচাচু বলেন, ‘স্বীকার করছ?’
‘হ্যাঁ নির্দ্বিধায় করছি।’
স্যার নিজের দোষ স্বীকার করেন, চুটিয়ে গল্প করেন- এ দারুণ ব্যাপার টুলু আর ওর বন্ধুদের কাছে। হাসান স্যার এবার ফিরনির বাটি থেকে এক চামচ জমানো ফিরনি মুখে দিয়ে বলেন, ‘আহ, দারুণ।’
‘তোমরা জানো- লিউন ইফরিস নামে ইংরেজ এক লেখক ছিলেন, তোমরা ভাবছ ছেলেবেলা থেকেই ইংরেজিতে উনি দারুণ ছিলেন, তাই না?’
‘তাই তো স্যার।’
‘মোটেও তা নয়। স্কুলে পড়ার সময় তিনবার তিনি ইংরেজিতে ফেল করেছিলেন।’
‘কেয়া বাৎ।’ খলখলিয়ে হেসে ওঠে টুলু। নানাজানও আসরে এসে যোগ দেন। বলেন, ‘আমাদের বাঙালিদের স্বভাব আছে, যেখানটাতে ভিড় সেদিকেই যাবার ইচ্ছা। কী হয়েছে, কিছু হলো নাকি- বলতে বলতে ভিড় বাড়িয়ে দেয়া। এই যেমন আমি করেছি।’
হাসান স্যার হেসে বলেন, ‘ওয়েল সেইড।’
নানাজান বলেন, ‘স্যারদের পারমিশন পেলে আমি একটি গল্প বলতে পারি।’
‘অফ কোর্স, অবশ্যই বলবেন।’
নানাজান বলেন, ‘হারা আর জেতা নিয়েই তো জীবন। শুধু জিততে হবে তা তো হয় না। আমার বড় নাতি ইমরান, বুলুর কথা বলছি ও ব্রিলিয়ান্ট, ছোট নাতি টুলু- আরমান বললে চিনবেন আপনারা; ও একেবারে রেস্টলেস। এরপরও আমি আর ওর আম্মু হোপলেস নই। ওর জন্মদিনে আমি ওকে একটা গল্প উপহার দিতে চাই।’
উৎসুক হয়ে ওঠে সবাই। গল্প শুনতে কে না ভালোবাসে! ছোটরা তো গল্প শুনতেই চায়। বড়রাও গল্প শুনতে ভালোবাসেন। কিন্তু সময় কই ওদের? সবাই ব্যস্ত। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছুটোছুটি চলে সবার। আজকের এই রঙিন রাতটি সবাইকে অন্য রকম করে দিয়েছে। টুলুর জন্মদিনের আসরে সবাই খোশ মেজাজে আছেন।
নানাজান বলেন, ‘গ্রেন মাকগ্রাথের নাম শুনেছ?’
ওর নাম কে না জানে! এক বড় ক্রিকেটার। তুতুল ফিসফিস করে বলে, তোর নানাজানটা না ভারী বোকা রে টুলু। টুলু কনুই দিয়ে তুতুলের পেটে গুঁতো মেরে বলে, মোটেও নয়।
নানাজান বলেন, ‘ওর ছেলেবেলায় ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন কি বলেছিলেন – জানো?’
টুলু বলে, ‘না বললে জানব কি করে নানাজান?’
‘ওর ক্যাপ্টেন বলেছিলেন, তোমাকে দিয়ে সব হতে পারে কিন্তু বোলিং কখনোই হবে না। তোমার যা টিঙটিঙে শরীর তুমি সুইমিং করগে যাও। সুইমিংয়ে কিছু করতে পারলেও পারো, ক্রিকেটে নয়।’
বুলু বলে, ‘ক্রিকেটে উনি রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়েছেন।’
ইলিয়াস স্যার বলেন, ‘ডেনিস লিলিকে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে সবচেয়ে সফল বোলার বলে। গ্রেন ম্যাকগ্রাথ কিন্তু তাকেও ছাড়িয়ে গেছেন।’
‘আমার ছোট নাতি টুলুভাইয়াও এমনই কিছু হবে। ওর বার্থ-ডেতে ওর জন্য শুভ ইচ্ছা রাখলাম। হঠাৎ করে ও জ্বলে উঠবে।’
‘কী দারুণ। থ্যাংক ইয়ু নানাজান।’
হাসান স্যার হেসে ওঠেন, ‘ক্যাপ্টেনের কথাতো সত্যি হলো না।’
গল্পটি শোনার পর টুলুর বন্ধুদের মায়েরা খুশি হয়ে ওঠেন। ছোটবেলা থেকে সব কিছুতে ভালো না হলেও আমাদের বোকা বুদ্ধু, মাথা মোটা ছেলেদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারব আমরা।
মিরাজ মামু এলো সব শেষে। অফিস কলিগ রুথ আর আইভিকে নিয়ে।
একেবারে সত্যি সত্যি আকাশ থেকে দু’জন পরী এসে নামল যেন টুলুর জন্মদিনের সন্ধ্যায়। শুধু সারপ্রাইজ আর অবাক করা কাণ্ড ঘটছে যেন!
ভিডিও গেম, কার্টুন চ্যানেল-এর কথা একেবারে ভুলে যায় সে।
ভ্যানিলা আইসক্রিম, ইগলু, ক্যাডবেরি, ক্যান্ডির কথাও বেমালুম ভুলে যায়। দুচোখ ভরে সবাইকে শুধু দেখতে ইচ্ছে করছে। আব্বু এগিয়ে এসে বলেন, ‘তুমি বরাবর লেটকামার মিরাজ। মেহনাজ হাসিমুখে বলে, ওয়েলকাম আওয়ার ফেয়ারি কুইন।’
খুব খুশি রুথ আর আইভি হাতে ওদের ফিরনির বাটি। ‘অসম অসম’ -মিষ্টি করে ওরা বলতে থাকে। টুলুর হাতে ওরা গুঁজে দেয় এক বক্স সিডি।
ধবধবে গায়ের রঙ দু’জনের। গোলাপি আর আকাশ-নীল রঙ স্কার্টে কী দারুণ মানিয়েছদ দু’জকে! স্নিগ্ধ আলো পিছলে পড়ে জামাগুলো দারুণ দেখাচ্ছে।
ধুত্তুরি ছাই, আমাদের অমন হয় না কেন?
ফিরনি খেতে খেতে দু’জনেই বলে, ওহ ডিলিসাস, সো সুইট অসম।
ছোটদের লুকোচুরি খেলা, বড়দের গল্পের আসর সব কিছুই ওদের ভালো লাগে।
ও হোয়াইট অ্যা বিউটিফুল সিন।
রুথের হিল তোলা জুতো টুলুর পায়ে লাগতেই বলে ওঠেন, ‘ওহ বেবি, আই অ্যাম স্যরি, অফুলি স্যরি।’
কথা এত মিষ্টি হয়, যেন কোকিল ডেকে উঠল।
রাত বাড়ছে। এক সময় ইলিয়াস স্যার, হাসান স্যার ওঠে বলেন,
‘এবার চলি। ভালো থেকো, আরমান। খুব এনজয় করলাম। অনেক দোয়া তোমার জন্য।’
হ্যাঁ পৌনে এগারোটা বাজে। এবার যেতে হবে। আজই প্রথম অনুভব করে দুষ্টু ছেলে টুলু। স্যাররা দূরের কোনো মানুষ নয়। কাছে এসে আদরে মমতায় ভরিয়ে দিতে পারেন ছাত্রদের। কতো গল্প শুনল, কত কিছু জানল, রুথ আর আইভি আন্টির সাথে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলে বেশ লাগল। নানাজান, মিরাজ মামু, বড় মামী আগেই চলে গেছেন। বনানীতে যেতে অনেকটা পথ। মা-বাবাদের হাত ধরে বন্ধুরাও চলে গেছে। বুলু ভাইয়াকে অনেকক্ষণ থেকে দেখতে পাচ্ছে না টুলু। ও নিশ্চয়ই গুনগুন করে পড়ছে।
বাড়িটা এখন ভাঙা হাটের মতো। নেই নেই, কেউ নেই। শুধু নেতিয়ে থাকা রাশি রাশি ফুল, রঙবেরঙের বেলুন, সুগন্ধি কেক-এর চিকন গন্ধ ছড়িয়ে আছে সারা বাড়ি।
মাহীচাচু- রুদ্রচাচুও বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়েছে। রাত বেড়েছে, আজ পড়া হলো না। আসছে কাল থেকে টুলু নিয়ম করে নানাজানের দেয়া বইগুলো পড়তে শুরু করবে। পড়ে পড়েই তো সবাই অনেক কিছু জানতে পারে। তাকে যে অনেক বড় হতে হবে। বাংলা ক্লাসে ঝুমঝুম ম্যাম প্রায়ই বলেন, মনে রেখো, বই ছাড়া মানুষ বিকশিত হতে পারে না।
টুলু মানুষের মতো মানুষ হলে অন্যরাই ওর জন্মদিন করবে। দারুণ হবে ব্যাপারটি। এ ভাবনাটি নানাজান ওর ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
আব্বু বললেন, ‘যাও এবারে ঘুমিয়ে পড়ো, টুলু। তুমি কি করছ বুলু?’ ‘অংক কষছি আব্বু।’
আব্বু বলেন, ‘সে তো তুমি রোজই করো। আজ সবার সাথে কথাবার্তা বলে আনন্দ করতে পারতে। সবার সাথে মেলামেশা করাও একটি গুণ। কতো শিক্ষণীয় গল্প বলেছেন তোমার নানাজান আর স্যার। এগুলো শুনতে পারতে।’ বুলু ভাইয়া এখন চিৎপটাং হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। দাঁত ব্রাশ করতে করতে টুলু শুনতে পায় আব্বুর কথা।
‘বড় ছেলেটা কি বুকওয়ার্ম হয়ে গেল নাজ? শুধু পড়াশোনায় প্রথম-দ্বিতীয় হওয়াই কি শেষ কথা? তা তো নয়। সব ব্যাপারেই চৌকস হতে হয়। টুলু রুথ আর আইভির সঙ্গে একটু একটু ইংরেজি বলল, স্যারের সঙ্গে সহজভাবে কথা বলল। আই লাইক দিজ স্পিরিট।’
মেহনাজের গলা শোনা যায়।
‘হাতের পাঁচটি আঙুল কি সমান হয়? সবই তো এক রকম হয় না। বুলু বুলুর মতো, টুলু টুলুর মতোই।’
চারপাশটা যেন ওর হঠাৎ করেই অচেনা হয়ে যায়।
একেবারেই অন্যরকম। ঠিক স্বপড়ব দেখা রূপকথার দেশের মতো। ময়ূরপঙ্খীর নৌকায় চড়ে দুধসাগরে ভাসার মতো। আব্বুর কথায় ওর জন্য মমতা যেন ছুঁয়ে আছে- যে টুলু পড়াশোনায় র‌্যাংক করতে পারে না, সেই ছেলেটিকে ভালোবেসে আব্বু বলেছে, আই লাইক দিজ স্পিরিট। অপূর্ব এক টাইমমেশিনে চড়ে টুলু যেন চমৎকার এক পৃথিবীতে চলে এসেছে। ওর চেনা পৃথিবী নয়, স্বপ্নের এক মধুর জগৎ।
শুধু নানাজানকে ফোনে বলবে সে, ‘সবাই বলে বয়স বাড়ে আমি বলি কমে’ -গানটি তুমি গেয়ো না নানাজান, আমার খুব কান্না পায়। বিছানায় শুয়ে টুলু বিড়বিড় করে বলে, খুব চমৎকার রঙিন এক জন্মদিনের সন্ধ্যা কাটালাম।

Share.

মন্তব্য করুন