স্কুলটা বাসার কাছে হওয়ায় রোজ হেঁটেই স্কুলে যায় ইবন। ওদের স্কুলের আর কেউ সম্ভবত এই পাড়ায় থাকে না। কারণ ইবন কখনো আর কাউকে এদিক থেকে স্কুলে যেতে দেখেনি। অবশ্য এমনও হতে পারে এক-দু’জন যাও আছে তারা গাড়িতে করেই যাওয়া আসা করে। স্কুলে যাওয়ার পথে খিলগাঁও বস্তি চোখে পড়ে। ঢাকার সব থেকে বড় বস্তি এটা। কত বিচিত্র মানুষ যে বাস করে তা ইবন কল্পনাও করতে পারে না। রোজ স্কুলে যাওয়া আসার পথে সে কত কিছু শেখে। আম্মু বাসা থেকে বের হওয়ার সময় স্কুলে খাওয়ার জন্য নাস্তা দিয়ে দেয়, সাথে প্রতিদিন ফ্ল্যাক্সে করে দুধও দেয়। আম্মুর যুক্তি হলো, তুমি যদি বেশি করে দুধ না খাও তবে মাথায় বুদ্ধি হবে কী করে? ইবনও তাই দুধ অনেক পছন্দ করে। আম্মু এক একদিন এক এক রকম নাস্তা তৈরি করে দেয় যা ইবনের খুব ভালো লাগে। ক্লাসের বন্ধুরা ইবনের টিফিন দেখে ঈর্ষা করে বলে, ‘এই তোর আম্মু এতো সুন্দর নাস্তা তৈরি করে কী করে রে?’ ইবন তখন হাসে আর বলে, ‘জানিস না যে আমার আম্মু পৃথিবীর সেরা আম্মু। আর সেরা আম্মুর তৈরি করা নাস্তাতো সেরা হবেই।’ বন্ধুরা তখন আরো বেশি ঈর্ষাকাতর হয়ে ওঠে। ইবন ক্লাস ফাইভে পড়ে। সে জানে সে পরীক্ষায় ভালো করবে তারপরও আম্মুর কথা মত খাবার থেকে শুরু করে সব কিছুতে নিয়ম মেনে চলে। তাকে ভাইয়ার চেয়েও ভালো রেজাল্ট করতে হবে। বেশ ভালোই চলছিলো, কিন্তু হঠাৎ করেই কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল।

এক সকালে ইবন যখন স্কুলে যাচ্ছে তখন খিলগাঁও তালতলার ওখানে যেতেই তিনটি ছেলে ওর পথ আগলে দাঁড়ালো। ইবন কিন্তু ভয় পায়নি কারণ সে খুব সাহসী ছেলে। সে বললো, তোমরা আমার পথ আটকাচ্ছ কেন? ছেলেগুলো কোন কথা বললো না। একটা ছেলে পিছনে লুকিয়ে রাখা হাত বের করলে ইবন চুপ করে গেল। ছেলেটার হাতে একটা চাকু। তিনটি ছেলের বয়সই ইবনের সমান। ইবন চাইলে মারপিট করতে পারতো। কারণ সে কিছুদিন হলো মার্শাল আর্ট শিখতে শুরু করেছে, কিন্তু তিনজনের সাথে চাকু দেখে সে আর মারপিটের ইচ্ছা করলো না। যে ছেলেটির নাম আলাল সে সম্ভবত অন্য দুজনের বড়। কারণ অন্যরা তাকে আলাল ভাই বলে ডাকছিলো। সে বাদল নামের ছেলেটিকে বললো, ‘দেখতো, হের ব্যাগে পাওন যায় কিনা? দেইখাতো বড়লোকের পুলা মনে অইতাছে।’ ইবন বুঝতে পারে না আলাল কিসের কথা বলছে। বাদল তখন ওর ব্যাগ খুঁজতে থাকে। এবং এক সময় দুধ ভর্তি ফ্লাক্সটি বের করে বলে, ‘আলাল বাই তুমি হাছাই কইছো। হেই বড়লোকের পুলাই অইবো। হের ব্যাগে হাছাই আছে।’ তারপর ইবন কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাদল ওর দুধের ফ্লাক্সটি খুলে তাদের সাথে আনা একটা পাতিলে দুধটুকু ঢেলে নিয়ে খালি ফ্ল্যাক্স ফিরিয়ে দিয়ে চলে গেল। ইবন কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। ছেলে তিনটা ওকে মারলো না বকলো না ওর ব্যাগের কোন খাবার নিলো না এবং অন্য কিছুও না নিয়ে শুধু দুধটুকু নিয়ে চলে গেল। কোন কিছু না ভেবে ইবন স্কুলে গেল। বাসায় ফিরে আব্বু আম্মুকে বলবে কিনা ভেবে পেলো না। সে চুপ করে থাকলো।

পরদিনও সত্যি সত্যিই সেই ছেলে তিনটা এসে হাজির। সম্ভবত আগে থেকেই তারা ওর অপেক্ষায় ছিল। আগের দিনের মতই দুধের ফ্ল্যাক্স থেকে দুধটুকু নিয়ে খালি ফ্লাক্স ফিরিয়ে দিল। ইবনের স্কুলে যাওয়ার আর কোন পথ ছিল না বলে সে ওই পথটা এড়িয়ে যেতে পারছিলো না। এভাবে তিন চারদিন যাওয়ার পর ইবন ভাবলো আজকেও যদি ছেলেগুলো একইভাবে আমাকে আটকায় তবে স্কুল থেকে ফিরে আব্বুকে বিষয়টা জানাবো। ইবন এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বরাবরের মতো স্কুলের পথে রওনা হলো। তৃতীয় দিন থেকে ছেলেগুলো কিছু বলার আগেই ইবন দুধের ফ্লাক্সটা বের করে ওদের হাতে দিয়ে দিত। সেদিনও দেখলো ছেলে তিনটে পথেই বসে আছে। ইবন ওদের সামনে গিয়ে ব্যাগ থেকে ফ্ল্যাক্স বের করে ওদের পাশে রাখলো কিন্তু ছেলে তিনটের কেউ সেই ফ্লাক্স ছুঁয়ে দেখলো না। ওর সাথে কথাও বললো না। ইবন কী করবে ভেবে না পেয়ে ফ্ল্যাক্সটা নিয়েই স্কুলে রওনা হলো। পথে যেতে যেতে অনেক কিছু চিন্তা করলো কিন্তু কুলকিনারা পেলো না। সেদিন স্কুল থেকে ফিরে সে বাবা মাকে আগের মতই কিছুই বললো না। পরদিনও স্কুলে যাওয়ার পথে সেই ছেলে তিনটাকে সেখানে বসে থাকতে দেখলো। বরাবরের মতই ইবন তাদের সামনে দুধের ফ্লাক্সটা রাখতেই আলাল নামের ছেলেটি বললো, ‘বাদল, অরে ক আমগো আর দুধ লাগবো না।’ ইবন এটা শুনে খুবই আশ্চর্য হলো। মাত্র দুদিন আগেও যারা ছুরি দেখিয়ে ওর দুধের ফ্লাক্স থেকে দুধ ঢেলে নিয়েছে আজ তারাই বলছে দুধ লাগবে না। ইবন ওদের পাশে সেই রেল লাইনের উপর বসে পড়লো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আলালের কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘আলাল, কী হয়েছে বলো আমাকে।’ আলাল হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। তার দেখা দেখি বাদল আর অন্য ছেলেটিও কেঁদে ফেললো। ইবন ওদের কানড়বা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল। এই সেদিনও যারা ছুরি দেখিয়ে ওর থেকে দুধের ফ্লাক্স কেড়ে নিয়েছে আজ তারাই হাউমাউ করে কাঁদছে। ইবন ওদের সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করলো। আলাল কান্না থামিয়ে ওকে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল। ইবনের আজ আর স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না। সে আলালদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে একটা কবরস্থানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আলাল এবং অন্য তিনজন ওকে নিয়ে কবরস্থানে ঢুকলো। নতুন মাটির একটা ছোট্ট কবরের পাশে গিয়ে নিবার্ক হয়ে বসে পড়লো আলাল। বাদল তখন কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘ছোড বইনডারে কুনো বাবেই বাঁচাইতে পারলাম না। একবছর বয়স অইছিল। অসুখে পইড়া দুধ ছাড়া কিছুই খাইতে পারতো না। আমরা দুধ কিনুম ক্যামনে? তাই তুমার ফিলাক্স জোর কইরা নিয়া নিতাম। দুইদিন অইলো আমগো বইনডা মইরা গেছে।’ এটুকু বলেই আবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ওরা তিনজন। ইবন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। তার চোখেও তখন অবিরাম অশ্রু ঝরছে। সেও কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরে গেল। আব্বু আম্মু ওকে কাঁদতে দেখে অস্থির হয়ে উঠলেন। ইবন শুধু একটি মাত্র প্রশ্ন করলো, ‘বাবা, বলতে পারো মানুষের এতো দুঃখ কেন?’ বাবা মা বুঝতেই পারলেন না ছোট্ট ইবনের কিসের এতো দুঃখ। শুধু ইবন জানে অন্যের দুঃখ তাকে কাঁদায়। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় বড় হয়ে আজীবন মানুষের দুঃখ ঘোচাবে।

Share.

মন্তব্য করুন