কামাল।
বেশ তাগড়া। মোটা-সোটা।
চেহারাটা একটু কালো হলেও দেখতে দারুণ!
পেশায়-সিএনজি ড্রাইভার।
সেদিন সকালেই শুরু হলো বৃষ্টি।
অফিসে আসার সময়।
মহা বিপত্তি!
আমি ছাতা নিয়ে বাসার উল্টো দিকে তালতলা মার্কেটে গেলাম। অনেক সিএনজি।
কেউ আসতে চায় না।
আবার কারো সাথে ভাড়ায় বনে না।
এ সময় তাগড়া ধরনের একটি লোক পাশ থেকেই বললো,
– চলেন স্যার, আমি যাবো।
ভাড়া ঠিক করে আমি সিএনজিতে উঠে বসেছি।
তার মুখে পান। হাতে চুন।
ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল।
বৃষ্টির মধ্যে চলছি।
রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম।
পনেরো মিনিটের পথ আসতে লেগে গেল দেড় ঘণ্টা! ঢাকা শহর বলে কথা!
কামালের সাথে টুকটাক কথা বলে সময় কাটাচ্ছি যখনই জ্যামে পড়ি তখনই দু’একটা প্রশ্ন করি।
সে প্রশ্নের উত্তরের সাথে ব্যাখ্যা টেনে লম্বা করে। কামালকে জিজ্ঞেস করলাম, মোবাইল আছে কিনা। আমার উদ্দেশ্য, যদি তার মোবাইল থাকে, তার নম্বর নেয়া এবং আমারটা দেয়া।
যাতে করে প্রয়োজনে তাকে পেতে পারি।
কামাল বললো, তার পকেটে মোবাইল আছে। কিন্তু নম্বর জানে না।
আমি একটু হোঁচট খেলাম। এখনকার ছেলে-মেয়ে এমনকি ছোটরাও মোবাইল নম্বর ঠোঁটস্থ রাখে।
যে লেখাপড়া জানে না, সেও।
ব্যতিক্রমী পেলাম কেবল কামালকে।
সে পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে আমার হাতে দিল।
বললো, এইটা আমার নম্বর।
আমি তার মোবাইল নম্বরটি আমার সেটে সেফ করার সময় জিজ্ঞেস করলাম- এটা কে লিখে দিয়েছে? কামাল হেসে জবাব দিল, আমার মাইয়া!
– সে স্কুলে যায়?
– হ।
– কোন্ ক্লাসে পড়ে?
– তা জানি না। তয় কলেজে যায়।
– ও!
– ওর লগে আমার পোলাই-ও যায়।
– কলেজে?
– হ!
– সংসার, লেখাপড়ার খরচ- সব মিলে তো!…
– হ, মেলা খরচ।
– চলে কিভাবে?
কামাল হাসলো। বললো, আল্লাহ চালাইয়া ন্যায়। এই যে গতর খান আছে, এইডা শুধু আমি কামে লাগাই। ওরা মানুষ হইলেই আমার শান্তি। অরা লেহাপড়া করে, এইটা ভাবতেই আমার খুউব ভালা লাগে। অদের লাইগ্যা দোয়া কইরেন স্যার! আমি তো মুখ্য মানুষ! বড় কষ্ট লাগে!…
আমার বিস্ময়ের আর সীমা থাকে না।
কামাল বলে কী!-
সে তার মোবাইল নম্বর জানে না, ছেলে-মেয়ে কোন্ ক্লাসে পড়ে, তাও বোঝে না- অথচ তার চোখে-মুখে স্বপ্ন আর তৃপ্তির হাসি!
আমি আমার অফিসের সামনে নেমে তাকে নির্ধারিত ভাড়াটা প্রথমে দিলাম। পরে একটা একশো টাকার নোট তার হাতের দিকে বাড়িয়ে বললাম, এটা নাও।-
– এইটা কী সার!
– তোমার ছেলে-মেয়েকে মিষ্টি কিংবা ফল কিনে দিও। কামাল যেন আগুনের গোলা দেখলো। হাত গুটিয়ে নিয়ে আবেগ ভরা কণ্ঠে বললো, না! নেবো না!
– কেন? আমি তো খুশি হয়ে দিচ্ছি।
– না, এই ট্যাহা আমি নেবো না।
– আরে, ধরতো!
কামাল যেন ছিটকে পড়লো একশো হাত দূরে। বলরো, স্যার! এইটা আমি নেবো না। তাইলে স্বভাব খারাপ হয়ে যাইবো। পরে শুধু নিতেই ইচ্ছা করবো। চাইতেও ইচ্ছা করবো। আমার পোলাপানের লগে এরহমটা কত্তি পারুম না।
কামাল টাকাটা নিলো না।
সত্যিই নিলো না। কোনও ভাবেই তাকে দেয়া গেল না। আমি সিএনজি ছেড়ে অফিসে এলাম। চেয়ারে বসেছি। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। তবুও যেন মাথাটা কেমন চক্কর দিচ্ছে। কে বলেছে কামাল অশিক্ষিত, মূর্খ।
আমার কাছে সে হাজারো মানুষের চেয়ে উত্তম। ঘুষখোর এবং অসৎ শিক্ষিত মানুষের চেয়েও মহৎ আছে। এ রকম পিতা আছে। মানুষ আছে। আছে বটে, কিন্তু বড্ড কম। বলতে গেলে হাতেগোনা। এ ধরনের কামাল সার্থক।
কষ্ট করে ছেলে-মেয়েকে লেখা-পড়া শেখাচ্ছে।
তাদের মানুষ হবার স্বপ্ন দেখছে।
চেয়ারে বসেই আমার দৃষ্টি চলে গেল পাঁচতলার ছাদে।
মনে হচ্ছে, হ্যাঁ- ঐতো কামাল তার ছেলে-মেয়ের হাতে তুলে দিচ্ছে স্বপেড়বর লাটাই-ঘুড়ি। আর তারাও লুফে নিলো সেটা। এরপর তো কেবল স্বপ্নের লাটাই-ঘুড়ি নিয়ে তাদের কেবল সামনে এগোনোর পালা। পারবে।
আমার মনে হলো কামাল পারবে দৌড়ে বিজয়ী হতে। পারবে তার সন্তানরাও।
যাদের এমন স্বপ্ন আছে, সাহস আছে- তারা কি কখনো পিছে পড়ে থাকে?
না, থাকতে পারে না।

Share.

মন্তব্য করুন