চোখ দু’টো আস্তে আস্তে টেনে তুললো নিবিতা। যেন রাজ্যের ঘুম চোখে। ভারী হয়ে আছে দু’টো চোখ। তবু আস্তে আস্তে খুললো সে। কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছে না নিবিতা। সব যেন আবছা আর ধূসর। চোখ দু’টো বন্ধ করে ফেললো সে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সে এখন কোথায়? মাথাটা এমন ঝিম ঝিম করছে কেন? কী করছিল সে? নাহ্ কিছু মনে করতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সে। চোখ খোলার চেষ্টা করল না।
কিছু মনে করারও না। বেশ কাজ হলো এতে। মনে পড়ছে, খেলছিল ওরা। ওদের বাড়ির পাশের আম বাগানে। তৌহিদ ভাইয়া বাড়ি এসেছেন। উনি এলে বাচ্চারা আনন্দে উথলিয়ে ওঠে। বাচ্চাদের নিয়ে মজার মজার খেলা খেলেন ভাইয়া। কোথা থেকে যে এত আইডিয়া আসে ভাইয়ার মাথায়, কে জানে? এক সপ্তাহ থাকবেন উনি। প্রতিটা দিনই আনন্দের খই ফুটবে বাচ্চাদের মনে। বিকেল হতে না হতেই ওরা ছুটে আসবে আম বাগানে। সেখানে অনেক আগেই হাজির হয়ে যান ওদের প্রিয় তৌহিদ ভাইয়া । ওরা সবাই উদগ্রীব থাকে ভাইয়া আজকে কোন নতুন খেলাটি খেলবেন সেই অপেক্ষায়। নিবিতা মনে করার চেষ্টা করছে। ও এখানে কেন? এটা কি হাসপাতাল? খেলতে খেলতে ও কি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে ছিল? নাহ্ পড়ে সে যায়নি, এটা নিশ্চিত। আবার ভাবে নিবিতা। কী খেলছিল ওরা? লুডু, ক্যারাম, দাবা? না, তৌহিদ ভাইয়া এলে এসব খেলে না ওরা। নতুন কিছু খেলে। একেবারে ভিন্ন রকম। হুম। মনে পড়ছেওরা খেলছিল ‘নেতা বলেছেন’ খেলাটি।
নেতা বলেছেন ‘হ্যান্ডস আপ’। ওরা সবাই হাত তুলছিল। ‘হাত নামাও’- আর্মিদের মত তৌহিদ ভাইয়ার দেয়া এই নির্দেশের সাথে সাথে অনেকেই হাত নামিয়ে ফেলে। যারা হাত নামায়নি তারা হো হো করে হেসে দিল। সেই সাথে যোগ দিয়েছিল যারা হাত নামিয়েছিল তারাও, কারণ এতক্ষণে তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। ‘হাত নামাও’ নির্দেশ দেয়ার সময় ‘নেতা বলেছেন’ কথাটুকু ছিল না। তাই ডিজকোয়ালিফাইড হয়েছে তারা। বেশ মজার খেলা। খুব মনোযোগী হয়ে খেলতে হয়। নিবিতা হাত নামায়নি। কিন্তু তারপর কী হয়েছিল? আবারও কিছুক্ষণ ভাবনা বাদ দেয় সে। মাথাটা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।
কোথায় আছে সে বুঝতে পারছে না। তাছাড়া এখানে এলো কী করে সেটাও মনে করতে পারছে না। শুধু এটুকু বুঝতে পারছে কিছু একটা হয়েছে ওর সাথে। নিজেকে বাঁচাতে হলে মাথা ঠাণ্ডা রাখাটাই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। হ্যাঁ, মনে পড়েছে এই খেলাটা ওরা খেলেছিল গতকাল বিকেলে। আজকে খেলছিল ‘প্রিয় পছন্দ’ খেলাটি। বুদ্ধির খেলা। তৌহিদ ভাই বলেছিলেন, পৃথিবীতে আছে এমন একটি জিনিষের নাম লিখতে হবে যেটি যার কাছে খুবই সুন্দর লাগে বা পছন্দ হয়।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে নিবিতার।
তম্বি লিখেছিল, পুতুল। আকাশ লিখেছিল, বিড়ালের বাচ্চা। পুতুল লিখেছিল, ফুলগাছ। নিশাত লিখেছিল, চাঁদ। আবির এ্যাকুরিয়াম, আয়িশা আকাশ, নুহা নদী, দুলাল ফুটবল। আরও অনেক কিছু। মনে পড়ছে ওর। ফুল, পাখি, ঝর্ণা, প্রজাপতি, লাল ফড়িং কিছুই বাদ পড়েনি পছন্দের তালিকা থেকে। কিন্তু নিবিতা কী লিখেছিল? কচুরী ফুল? আমের মুকুল? এ গুলো ওর খুবই পছন্দের। কিন্তু এগুলো লিখেনি ও। তবে কী লিখেছিল সে? ওহ্, মনে পড়েছে। নিবিতা লিখেছিল ‘মানুষ’। স্মৃতি গুলো ডকুমেন্টারি ফিল্মের মতন একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠছে এখন।
তৌহিদ ভাই এক এক জনের পছন্দের নাম গুলো বলছিলেন আর জোর তালি দিয়ে যাচ্ছিলেন, সাথে সাথে বাচ্চারাও। ভাইয়া সবার পছন্দের তারিফ করছিলেন। এমন ভাবে বলছিলেন যেন সবার পছন্দই যথার্থ হয়েছে তাই সবাই বেশ উৎফুল্ল বোধ করছিল। এরপর ভাইয়া দশ মিনিট সময় দিয়েছিলেন কারণ লিখতে। সবাই যার যার কারণ গোপনে লিখছিল। নিবিতা গিয়েছিল আম গাছটার আড়ালে। ভাবছিল, কেন সে ‘মানুষ’ লিখল তার পক্ষের যুক্তিগুলো। আম্মু সব সময় বলেন,
পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর আর শ্রেষ্ঠ হলো মানুষ। কেন? এটাই যখন গুছিয়ে লিখতে যাবে ঠিক তখনই ওর ওপর স্নিগ্ধ সবুজ একটা আলো এসে পড়েছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই। নিবিতা এখন নিজেকে একটা অন্যরকম অবস্থায় খুঁজে পেয়েছে।
আবারো চোখ খুললো নিবিতা। এবার বেশ সচ্ছন্দেই খুলতে পারলো। উপরে তাকালো ও। হালকা গোলাপী রঙের মাঝে বেগুনির ছোপ ছোপ। ও কি সিলিং দেখছে? কপাল কুচকে গেলো ওর। ছোপ ছোপ বেগুনি রঙ গুলো নড়ছে। গোলাপী রঙের ভেতর। ঠিক যেমন নীলাকাশে ভাসে সাদা মেঘ। সারা শরীরের লোম কাঁটা দিয়ে ওঠলো ওর। চোখ দু’টো বড় বড় করে ও দেখতে লাগলো। সত্যিই অবাক হয়েছে ও। কারণ ও আকাশ দেখছে। গোলাপী রঙের আকাশ। নিজেকে চিমটি দিয়ে দেখতে চাইলো নিবিতা। ও বেঁচে আছে তো? হাত নাড়াতে পারলো না। হাত পা বাঁধা অবস্থায় আছে বুঝতে পারলো ও। সেই সাথে ওর কাছে এটাও পরিষ্কার হয়ে গেল ও কিডন্যাপ হয়েছে। পৃথিবীর কোন মানুষ নয় ওকে কিডন্যাপ করেছে ভিন গ্রহের কোনো প্রাণি। বুকটা ধক করে উঠলো ওর। পৃথিবীতে এখন কী হচ্ছে? তৌহিদ ভাইকে কী পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে? বাবা-মা নিশ্চয়ই ভীষণ কানড়বাকাটি করছেন? ও কী আর কখনও ফিরে যেতে পারবে না সুন্দর পৃথিবীতে? ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল ওর। ঝরঝর করে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই অদ্ভুত একটা শব্দ হতে থাকলো। সেই সাথে ওর চারপাশে জড়ো হয়ে গেল ভিন গ্রহের প্রাণিরা। সারা শরীরে মুখোশের মত পোষাক, এমন কি মুখটাও ঢাকা মুখোশে। এরা কি মুখোশ মানব? নাকি ওরা দেখতে আসলে এমনই? কী করে যেন ওর মনের কথা পড়তে পারলো ওরা। একজন মুখোশ মানব বলল-
: সু স্বাগতম। ছোট্ট মানুষ। তুমি ভালো আছো বুঝতে পেরে আমরা আনন্দিত।
: মনে মনে ভীষণ ক্ষুদ্ধ হলেও শান্ত ভাবে বলল, আমি ভালো আছি কে বলল আপনাকে?
: তোমাদের পৃথিবীতে শিশু জন্মের পর চিৎকার করতে থাকে। তোমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা তখন তাকে সুস্থ বলে ধরে নেয়। তুমিও কাঁদছো তাই আমরা বুঝলাম তুমি সুস্থ আছো। নিবিতা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পাররো না। এই মুখোশ মানবেরা শিশু আর বড়দের কানড়বার মাঝে পার্থক্য বোঝে না। হাসিই পেলো নিবিতার। কিন্তু হাসলে যদি ওরা আবার তাকে অসুস্থ ভাবে তাই হাসলো না শুধু বলল-
: বড়রা কষ্ট পেলে কাঁদে আর আনন্দে হাসে।
: ওহ্ তাই? তাহলে তুমি কষ্ট পাচ্ছো? আমরা তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না ছোট্ট মানুষ।
: তাহলে আমাকে ধরে এনে বেঁধে রেখেছেন কেনো?
: তোমার কাছ থেকে একটা তথ্য নেবার জন্য। তার আগে তোমার কষ্ট দূর করে তোমাকে হাসাতে চাই। কষ্ট পেলে তো তোমরা আবার সব কিছু গুলিয়ে ফেল, তাই না?
: তাহলে আমার বাঁধন খুলে দিন।
: দিচ্ছি। মুখোশ মানব তার বুকের ভেতর একটা বোতামের মত জিনিসে চাপ দিতেই নিবিতার সব বাঁধন খুলে গেল। নিবিতা উঠে বসল।
: ছোট্ট মানুষ তোমার এখন খাদ্য গ্রহন প্রয়োজন। চলো আমাদের সাথে। নিবিতা নিচে পা রাখতেই পা গেঁথে যেতে লাগল তুলার মত গোলাপী মাটিতে। দু’পাশ থেকে দু’জন মুখোশ মানব এসে ওকে ধরে ফেলল । নিবিতা লক্ষ করলো ওরা গোলাপী মাটির একটু ওপর দিয়ে ভাসছে। ভেসে ভেসেই চলল ওরা। নিবিতা বুঝতে পারলো না ওকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাই জানতে চাইলো-
: আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?
: বাগানে।
কথা বলতে বলতে ওরা বাগানে এসে পৌঁছালো। নিবিতা অবাক দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। রূপালী রঙ্গের পাতাহীন গাছের মত দেখতে অবয়বের সাথে ঝুলছে নানা আকৃতির নানান রঙের জিনিস। মুখোশ মানব বলল-
: আমাদের গাছ গুলো পৃথিবীর মত নয়। ওরা স্বয়ংক্রিয়। ঐ যে নানা রঙের জিনিস গুলো দেখছো তোমাদের পৃথিবীর ভাষায় ও গুলো হলো ফল। তুমি যেটি খাবার ইচ্ছা করবে সেটি নিজ থেকেই তোমার কাছে পৌঁছে যাবে।
: এগুলো কি পৃথিবীর মানুষেরা খেতে পারবে?
: নিশ্চয়ই, ছোট মানুষ।
: আমি শুধু ছোট মানুষ নই। আমার একটা নাম আছে। আমার নাম নিবিতা।
: ও আচ্ছা! নিবিতা মানুষ, তুমি এখন দয়া করে কোন ফলটি খাবে তার ইচ্ছা পোষণ করো। নিবিতা একটা ফলের দিকে তাকাতেই গাছটি তার কাছে এসে নুয়ে পড়লো। নিবিতা তৃপ্তির সাথে ফল খাওয়া শেষ করল। ফলগুলো খুবই সুস্বাদু।
: নিবিতা মানুষ, আমরা বুঝতে পারছি তুমি তৃপ্ত হয়েছো।
: হ্যাঁ আমি এখন আর ক্ষুধার্ত নেই। আমার কষ্ট দূর হয়েছে। এবার আমাকে বলুন কী জানতে চান আপনারা? যদি আমার তা জানা থাকে বলবো আপনাদের। দয়া করে আমাকে পৃথিবীতে পৌঁছে দিন। ওখানে নিশ্চয়ই আমার জন্য সবার খুব কষ্ট হচ্ছে।

নিয়ন্ত্রণ । মোরশেদা হক পাপিয়া: নিবিতা মানুষ, চিন্তা করো না আমরা তোমাকে সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি, যেখানে তোমার কাছ থেকে তথ্য নেয়া হবে।
নিবিতাকে নিয়ে মুখোশ মানবেরা পৌঁছলো একটা সুন্দর স্বচ্ছ কাঁচের ঘরে। ও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো চারপাশ। খুব সুন্দর করে গোছানো কক্ষটি। ঝকঝকে কাঁচের দেয়াল যেন হীরের স্ফটিক। আসনগুলো রূপালী, হয়ত ওদের গাছের তৈরী। সবাই বুকের বোতামে চাপ দিয়ে যার যার আসনে গিয়ে বসল।
নিবিতাকে বসানো হলো একটি সোনালী রঙের আসনে। (এটাই কী ময়ূর সিংহাসন? ভাবলো সে।) ঠিক সিংহাসনের মত। নিবিতা বসতেই একজন মুখোশ মানব দেয়ালে বসানো রত্ন পাথরের মত দেখতে একটা পাথরে চাপ দিল। এতে ওর সামনে এসে পৌঁছলো সুগন্ধ যুক্ত অসম্ভব রকমের সুন্দর একগুচ্ছ ফুল। এ সময় কথা বলে উঠলো একজন মুখোশ মানব।
: নিবিতা মানুষ, আমরা জানি তুমি তোমার গ্রহে ফিরে যাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছো। সাময়িক এ কষ্টের জন্য আমরা দুঃখিত। সবাই একসাথে বুকের বোতামে চাপ দিয়ে এক ধরনের শব্দ করলো। সম্ভবত এটি ওদের দুঃখ প্রকাশের ভাষা।
: কিন্তু আমাকে কেনো এখানে আনা হয়েছে সেটি এখনও বলেননি।
: নিবিতা মানুষ, তুমি তোমার গ্যালাক্সি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছ। তোমরা যেমন ‘মানুষ’ তেমনি আমরা হলাম ‘মুকুম্বা’। তোমাদের মতো আমাদের মন আছে। আমরাও ভালবাসি। তোমাদের সাথে আমাদের বেশ মিল রয়েছে। তোমরা সৌন্দর্য পিয়াসী, তবে আমরা তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি সৌন্দর্য পিয়াসী। এ সময় আবারও বুকের বোতাম চেপে সবাই আগের মত শব্দ করল, তবে আগের চেয়ে একটু বেশী সময় ধরে। নিবিতা একটু অবাক হলো। কিন্তু বুঝতে পারল না কেন ওরা এ কথার সাথে এত দুঃখ প্রকাশ করল। তাই জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকালো।
: নিবিতা মানুষ, তুমি বুঝতে পারছ না, তাই না? আমি বলছিলাম আমাদের সৌন্দর্য পিপাসা তোমাদের চেয়ে অনেকগুন বেশী। আর এটাই এখন আমাদের কাল হয়েছে।
: ঠিক বুঝলাম না, দয়া করে বুঝিয়ে বলুন।
: তোমরা অন্য মানুষ, যে তোমার চেয়ে দেখতে সুন্দর তার মত হুবহু হয়ে যেতে পার কি?
: সেটা কি করে সম্ভব!
: আমরা পারি, আমাদের পূর্ব পুরুষেরা এ ক্ষমতা চেয়ে নিয়েছিল। নিজের চেয়ে সুন্দর কাউকে দেখলে আমরা বাসনা করলে তার মত হয়ে যেতে পারি।
: ইন্টারেস্টিং!
এ সময় আবারও বোতাম চাপা শব্দ হলো। নিবিতা চুপ করে রইল।
: নিবিতা মানুষ, কিন্তু আমাদেরকে এ ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল একটি শর্তের বিনিময়ে।
: কী সেটা?
: প্রতিবার চেহারা বদলানোর সময় আমাদের চেহারায় একটি করে দাগ পড়বে। আমাদের লাগামহীন মন সেটাই মেনে নিয়েছিল।
: চমকে উঠল নিবিতা। মুখোশ গুলো তাহলে ওদের আসল চেহারা নয়। দুঃখের শব্দ ভেসে এলো ওদের বুকের বোতাম থেকে।
: নিবিতা মানুষ, আমরা আজকে এর মতো কালকে তার মতো হতে হতে এখন সবচেয়ে কুৎসিত হয়ে গেছি। আমাদের অবয়ব জুড়ে এখন শুধুই কাটাকুটির দাগ।
: নিবিতার ছোট্ট মনটা চিন চিন করে উঠলো। তবু নিজেকে সামলে জানতে চাইলো, সেই জন্যই কি তোমরা মুখোশ পড়ে আছো? আমি কি তোমাদের আসল চেহারা দেখতে পারি?
: না না, নিবিতা মানুষ। আমাদের আসল চেহারা দেখলে তুমি ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। এমনকি আমরাও এখন একজন আর একজনকে দেখে ভয় পাই, আমাদের জীবনটা এখন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে।
: সম্মানিত মুকুম্বা, আপনি এখনও বলেননি আমাকে কেন এনেছেন।নিয়ন্ত্রণ । মোরশেদা হক পাপিয়া
: আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এই ভয়ংকর অবস্থা থেকে বাঁচাতে চাই। তোমরা সৌন্দর্য প্রেমিক হয়েও কেন একজন সুন্দর মানুষের মত হতে চাও না কী ভাবে তোমরা বিভিন্ন অবয়বের মানুষ মিলে মিশে আছো? আমরা সেটা জানতে চাই। নিবিতার তৌহিদ ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। যেদিন ছোট্ট দুলাল ভাইয়ার কোলে বসে বলছিল,
‘ভাইয়া, আমি আপনাল (আপনার) মত সুন্দল (সুন্দর) হতে চাই।’ ভাইয়া হেসে বলেছিলেন, ‘ছোট্ট সোনা, তুমি সুন্দর হও; সুন্দর মনের মানুষের মত।’
নিবিতাকে চুপ করে থাকতে দেখে মুখোশ মানব বলল-
: নিবিতা মানুষ, তুমি চুপ করে আছো কেন? তবে কী তোমার উত্তর জানা নেই?
: আছে, সম্মানিত মুকুম্বা, আমাদের পৃথিবীর মানুষেরাও সুন্দর হতে চায়, এটা সত্য। তবে ইচ্ছা করলেই অন্যের মত হয়ে যাবার ক্ষমতা আমাদের দেয়া হয়নি। আমাদের গুরুজনেরা বলেন, যে মানুষের মন সুন্দর সেই-ই সুন্দর। তাঁরা আমাদেরকে ভালো মানুষদের অনুসরণ করতে বলেন। আর আমরা যখন যা ইচ্ছা হয় তাই করি না। এটা আমাদের করতে দেয়া হয় না। এরকম যারা করে আমাদের পৃথিবীতে তাকে স্বেচ্ছাচারী বলা হয়। তাকে অপচ্ছন্দ করা হয়। এইটুকু বলে নিবিতা শেষ করল। সেই সাথে লক্ষ করল তিনজন মুখোশ মানব তাদের বুকের বোতাম গুলো অবিরাম চেপে যাচ্ছে। সম্ভবত তারা নিবিতার কথা গুলো নোট করছে। নিবিতার বলা শেষ হলে তারা উঠে কাঁচের দেয়ালের এক পাশে দিয়ে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে কাঁচের দেয়ালে একটা কিছু ভেসে উঠল। নিবিতার সাথে কথা বলছিলেন যে মুখোশ মানব তিনি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বার বার বলতে থাকলেন-
: মন সুন্দর মানুষ সুন্দর, ইচ্ছার নিয়ন্ত্রণ। এরপর নিবিতাকে ঘিরে দাঁড়ালো সকল মুকুম্বা। আর তাদের বুকের বোতাম চাপ দিয়ে এক অদ্ভুদ শব্দ সৃষ্টি করল। সেই শব্দকে নিবিতা পৃথিবীর অনেক কিছুর শব্দের সাথে মিলাতে চাইল। ঝর্ণার শব্দ, পাখির গান, নদীর কলতান, নাহ্ কিছুর সাথেই মেলাতে পারল না সে। এ যেন সব কিছু ছাড়িয়ে এক মধুর ভালো লাগার ছন্দ। সম্ভবত এটি মুকুম্বাদের আনন্দ প্রকাশের গান। ছন্দের তালে তালে নিবিতা কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না। যখন জাগল তখন ও শুনতে পেল তৌহিদ ভাইয়ের কণ্ঠ। উনি বলছেন, নিবিতা এত দেরী হচ্ছে কেন? তাড়াতাড়ি আসো। তোমাদেরকে ১০ মিনিট টাইম দেয়া হয়েছে। নিবিতা বুঝে উঠতে পারল না ও এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল কি না। কিন্তু ওর হাতে তখনও ছিল সেই একগুচ্ছ ফুল আর একটি রূপালী ফল।

Share.

মন্তব্য করুন