বাংলা সনের প্রম দিনটিকে আমরা বাংলা নববর্ষ হিসেব উদযাপন করি। এই রীতি অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। কিন্তু তোমরা কি জানো, কিভাবে আমরা বাংলা সন বা বাংলা নববর্ষ পেলাম? হয়তো অনেকে জানো আবার অনেকেই জানো না। বাংলা নববর্ষ হচ্ছে বাঙালিদের একটি সর্বজনীন উৎসব। বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তের বাঙালি এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেন, ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে অতীত বছরের সব দুঃখ-গ্লানি। মহান রবের কাছে সবার কামনা থাকে নতুন বছরটি যেন সমৃদ্ধ ও সুখময় হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ পালিত হয়। এদিন বাংলাদেশের সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।
তোমাদের একটি কথা জানিয়ে রাখি, বাংলা দিনপঞ্জির সঙ্গে হিজরি ও খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। আর তা হলো হিজরি সন চাঁদের হিসেবে এবং খ্রিস্টীয় সন ঘড়ির হিসেবে চলে। এ কারণে হিজরি সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে। ইংরেজি দিন শুরু হয় মধ্যরাতে। বেশ মজার তাই না?
কিন্তু পহেলা বৈশাখ রাত ১২টা থেকে শুরু নাকি সূর্যোদয় থেকে শুরু এটা নিয়ে অনেকের দ্বিধা আছে।
ঐতিহ্যগতভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমি এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২টায় দিন গণনা শুরু নিয়ম চালু করে, যা এখনও চলমান।
এবার তোমাদের অনেকের পেছনের কিছু তথ্য জানাবো। যেটা আমাদের সবার জেনে রাখা খুব জরুরি। ইতিহাস বইয়ে নিশ্চয়ই মুঘল সাম্রাজ্যের কথা শুনেছ। তখন বাংলাদেশ নামে দেশ ছিল না। সব মিলিয়ে তখন এই অঞ্চলকে বলা হতো ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করতেন। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে হতো। বিষয়টা সম্রাট আকবরকে খুব ভাবাতো। তিনি এই সমস্যার সমাধান চাইলেন। তখন তিনি খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা আনতে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে।ত প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলাবর্ষ নামে পরিচিত হয়। আর এ কারণে সম্রাট আকবরকে বাংলা সনের প্রবর্তক বলা হয়। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতো। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো।

শুভ নববর্ষ
পরে এ উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সব স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রাটি এখনো কিছু কিছু এলাকায় প্রচলিত রয়েছে। বাংলাদেশে নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। এদিন গ্রামের মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পরে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটামুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোনো খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার।
মেলাতে থাকে নানা রকম কুঠির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানা রকম পিঠা পুলির আয়োজন। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে থাকে নৌকা বাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে। এটি জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত।
বন্ধুরা, তোমরাও বাংলা নববর্ষ উদযাপন করবে। তোমরা এ দিনে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারো। গরিব ছেলেটির হাতে তুলে দিতে পারো একটি নতুন জামা বা অন্য কিছু। দেখবে তাহলে তোমার নববর্ষ হয়ে উঠবে আনন্দময়। তথাকথিত উদযাপনের বাইরে এসব হতে পারে একদম ভিন্ন। আল্লাহ তোমাদের ভালো কাজের তাওফিক দান করুন। নতুন বছরটি সবার অনেক ভালো কাটুক সে দোয়া সবসময় থাকবে।

Share.

মন্তব্য করুন