আসরের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে প্রবেশ করেই মসজিদের ভেতরে ছোট্ট একটা জটলা চোখে পড়ল জিহাদের। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে মেঝেতে শোয়া একজন বয়স্ক মানুষকে অসুস্থতার যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখল। লোকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারল যে, লোকটি বেশ কিছু সময় ধরে মসজিদে শুয়ে কাতরাচ্ছে। নামাজের সময় আর এক মিনিটের মত বাকি। সবাই লোকটিকে ধরাধরি করে মসজিদের বাইরে দারোয়ানের রুমের পাশে জায়নামাজ বিছিয়ে শুইয়ে দিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল।
জিহাদ বেশ কিছুদিন হল, গ্রাম ছেড়ে এই শহরে পা রাখলেও শহরের সবকিছু ঠিকমত চেনে না। শহরের মানুষ মনে হয় খুব ব্যস্ত তাদের কাজে। সারাদিন শুধু ছোটাছুটি। যেন কেউ কারো দিকে তাকানোর কোন সময় নেই। মসজিদটি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভেতরে অবস্থিত। নামাজের সময় সাধারণ মুসল্লিরা নামাজের জন্য শুধু প্রবেশের অনুমতি পায়। নামাজ শেষ করে সবাই যে যার মত চলে যাচ্ছে। দু-একজন হয়ত লোকটার পাশে এসে দেখে যাচ্ছে। ও বলা তো হয়নি, লোকটার পকেট খুঁজে তার কাছে কোনো ঠিকানা বা মোবাইল পাওয়া যায়নি যার মাধ্যমে তার নিকট আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করা যাবে। অসুস্থতার মাত্রাটা বেশি হওয়ার কারণে মুখ দিয়ে গড় গড় শব্দ করা ছাড়া কিছুই বলতে পারছে না লোকটি। নামাজ শেষে জিহাদ লোকটির কাছে গেল, সাথে তার বন্ধু মেরাজ। জিহাদ বলল, মেরাজ চল লোকটিকে কাছাকাছি হসপিটালে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করি।
‘ব্যবস্থা করবি মানে? তুই কি এখানকার সব চিনিস নাকি?’
‘না, চিনি না। তবুও চেষ্টা করা উচিত। লোকটার অবস্থা তো বেশি ভালো না। কখন কী হয়ে যায়।’
‘হুম, ভালো না। এটি গ্রাম নয় বন্ধু। দেখছিস না অসুস্থ মানুষটাকে মসজিদ থেকে বাইরে বের করে রেখে সবাই দায় মুক্তি চাইল। এখানে কি এমন কেউ ছিল না, যে লোকটাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে?’
‘হুম, ছিল হয়ত।’
‘হয়ত মানে কি? একজন না, খুঁজলে এমন পঞ্চাশ জন পাওয়া যেত। কিন্তু কেন নিয়ে যায়নি জানিস?’
‘কেন আবার? হয়ত ব্যস্ত সবাই।’
‘কিসের ব্যস্ত এ্যাঁ? আসলে, এই শহরে কোন মানবতা নেই। এখানে আসলে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যেখানে একই দালানের ওপরে কেউ মারা গেলে নিচের লোকজন দেখতে যায়, সেই সংখ্যাটাও খুবই কম।’
‘তা ঠিক বলেছিস। আর গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে মনটা কেমন করে? মারা গেলে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এসে শামিল হয় জানাজায়। বলল, জিহাদ।’
‘হুম। এই শহরে এত চিটার-বাটপাড়ে ভরা যে সাহায্যের আবেদন করে সাহায্যকারীকে বিপদে ফেলেছে এরকম ঘটনার অসংখ্য উদাহরণ এখানে বিদ্যমান। তাই কেউ কাউকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না।’
‘হোক, তবুও।’
‘এত দরদ বাদ দে, চল। কয়দিন হলো তোর এখানে আসার। এখানকার ভাবসাব বুঝবি না। বলে, জিহাদের হাত টান দিয়ে মসজিদ সীমানার বাইরে নিয়ে গেল মেরাজ।’
‘আরে আস্তে আস্তে…! সত্যি এই শহরে আসলে মানুষজন মানবতা হারিয়ে ফেলেছে। অথচ তারাও কোন না কোন গ্রাম থেকেই এসেছে।’
‘কাউকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজে কোন বিপদে পড়ে কি না সেই চিন্তায় কেউ কারো সাহায্য এগোতে চায় না। কেউ অ্যাকসিডেন্ট করে রাস্তায় পড়ে থাকলে মানুষ ছবি তুলবে কিন্তু হাত দিয়ে ধরতে যায় না।’
‘হুম, তাই। সেই মানবতাহীন মানুষের কাতারে আমরাও আজ নাম লিখালাম।’
‘হইছে বাদ দে। মানবতা দেখাতে হবে না। সাহায্য করতে গিয়ে ঠ্যালায় পড়লে বুঝতি…।’

Share.

মন্তব্য করুন