এরপর বড় তিস্তার মূল স্রোতধারা দার্জিলিং ও কালিম্পং শহরের প্রধান উপনদী রঙ্গিতের সঙ্গে মিলিত হয়ে দক্ষিণ দিকে শিলিগুড়ি শহর পেরিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান লালমনিরহাটের ওপর দিয়ে মিশেছে ব্রহ্মপুত্রে। আমাদের এই করতোয়া ও মরা তিস্তার মাঝে জেগে উঠে বিশাল এক চর। যে চরের মধ্যেই বর্তমান আমাদের টেপ্রীগঞ্জ ইউনিয়নের জন্ম। এর পরেও এই নদী অনেক বড় ছিল। এই যে বালির চরটা দেখতে পাচ্ছ এর এই মাথা থেকে শালডাঙ্গার পাশে বদেশ্বরী পর্যন্ত মাঝখানে ছিল কাশবন আর এলোবনের বিশাল জঙ্গল। বদেশ্বরী গড় পর্যন্ত কোন মানুষের বসবাস ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের আগে আগে লোকজন এ এলাকায় আসতে শুরু করে। এ জন্য এখান থেকে ৭ কিলোমিটার পূর্বে খারিজা ভাজনী ছাড়া অত্র এলাকায় এখন পর্যন্ত কোনো আদিম স্থানীয় লোকের বসবাস নেই।
“ভাইয়া এখানে যে জঙ্গল ছিল কোন জীবজন্তু বসবাস করতো না?” বলল সুমন।
এখানে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও ভয়ঙ্কর সব জীবজন্তুর আস্তানা ছিল। বিশেষ করে ছিল দাঁতালো শূকর, শেয়াল এবং বাঘের একটা বড় আস্তানা। এই করতোয়া নদীর পাড়ে লোকজন বাঘের ভয়ে আসতো না। গ্রামের ঘরগুলো বড় বড় কাঠের গুঁড়ির খুঁটি এবং মোটা তক্তা দিয়ে বানাতো। একটু ব্যতিক্রম হলেই জীবনটা হারাতে হতো তাদের। সন্ধ্যার পর পরই নিস্তব্ধ হয়ে যেত গোটা এলাকা। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়তো সবাই। রাতজুড়ে ছিল বাঘ শেয়ালদের হুঙ্কার গর্জন। বিশেষ করে যাদের গরু ছিল তারা থাকতো আতঙ্কে। সাবধানে রাখতে তারা মোটা মোটা বাঁশ দুইখ- করে বেড়া বানাতো আর মোটা মোটা কাঠের গুঁড়ি দিয়ে খুঁটির সাথে শক্ত করে তৈরি করতো গোয়ালঘর। এরপরও বাঘের থাবায় মানুষ বা গরুর প্রাণ হারাতো অনেক। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয় তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও ফলে এ অঞ্চলের হিন্দুদের সাথে জমিজমা বিনিময় করে ভারতের কিছু মুসলমান। অপর দিকে যুদ্ধের হাঙ্গামা থেকে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, বগুড়া, জয়পুরহাট, জামালপুর থেকে দলে দলে লোকজন ছুটে আসতে থাকে আমাদের এ অঞ্চলে। তারা বাড়িঘর তৈরির জন্য বিভিন্ন পতিত জমি বেছে নেয়। বাসা তৈরি করার তাগিদে জঙ্গল সাফ করতে থাকে এবং এই চর সাফ করা প্রয়োজন মনে করে। তারই ধারাবাহিকতায় এক সময় সংঘবদ্ধভাবে তীর-ধনুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জঙ্গলে। গ্রীষ্মকালে যখন এলোবন ও কাশবনগুলো শুকিয়ে খড়ি হয়েছিল তখন তারা আগুন লাগিয়ে দেয় চতুর্দিকে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে থাকে আগুন। বাঘ, শূকর, শেয়াল ও অন্যান্য প্রাণীগুলো তাদের জীবন বাঁচাতে বিভিনড়ব দিকে ছুটোছুটি করতে থাকে তাদের কতক পালিয়ে চলে যায় আর কত মানুষের হাতে মারা পড়ে।
এভাবেই এখানে প্রাণীদের অভয়ারণ্যটি ধ্বংস হয়ে যায়। কোন এক দাদীর মুখে শুনেছি বর্ষাকালে এই করতোয়ার আকৃতি প্রায় সাগরের মতো হয়ে যেত। আমাদের টেপ্রীগঞ্জ বাজারের পশ্চিমে পাইলাভাসার জলাধার থেকে বৈঠা বাঙ্গি দোলার মাঝামাঝি একটা বিশাল স্রোতধারা টেনে নিত করতোয়ার দিকে। ফলে খড়স্রোতা এক টানের সূত্রপাত হতো সেই থেকে রাব্বি হোসেন দেওয়ানির বাড়ি পর্যন্ত। এর সব জমি পানির নিচে তলিয়ে একাকার হয়ে যেত এবং আফসার আলী ফকিরের বাসার সামনে রাক্ষসের মতো রূপ ধারণ করতো। সেখানে বিশাল একটা গর্ত ছিল বলে জায়গাটা এখনো ভাঙারপাড় নামে পরিচিত। সেই ভাঙ্গারপাড়ে এক বন্যায় বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়া রজব আলী নামের এক লোকের জীবন বিসর্জনের কাহিনী লোকমুখে এখনো শোনা যায়। লোকটি কলার গাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে তার ওপর স্ত্রী-সন্তানসহ উঠেছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে তার লগিটি হারিয়ে ফেলে এরপর সে ভাঙারপাড়ে ভেসে আসে ক্রমে ক্রমে।
স্রোতের টান অনুভব করে বাঁচাও বাঁচাও বলে অনেক চিৎকার করেছিল তারা। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সেই ভয়াবহ পানির বেগে তাদের হাতে লগি তুলে দেয়ার মতো কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি তখন। চোখের সামনেই করতোয়ার স্রোতে হারিয়ে যায় একটি পরিবার। পরে তাদের কারো লাশেরও কোনো খোঁজ পায়নি কেউ। কালের আবহে আজ এত দূরে এসে ঠেকেছে এই করতোয়ার ইতিহাস। পঞ্চগড়ের ছোট ছোট নদীর বেশির ভাগই মিলিত হয়েছে এই করতোয়াতে।
‘আচ্ছা পঞ্চগড়ে আর কী কী নদী আছে স্যার?’ জামালের প্রশ্ন।
অনেক নদী আছে যেমন- তালমা নদী, চাওয়াই নদী, পাঙ্গা নদী, পাম নদী, মরা তিস্তা নদী, ভুল্লী নদী, ঘোড়ামারা নদী, পাথরাজ নদী, নাগর নদী, সিংগিয়া নদী, বহু নদী, রসেয়া নদী, টাঙ্গন নদী, মহানন্দা নদী, ডাহুক নদী, তীরনই নদী, রনচন্ডি নদী, বেরং নদী, জোড়াপানি নদী, সাও নদী। এ ছাড়াও কুরুম ও কালিদহ নামের আরো দু’টি নদী দেবীগঞ্জ উপজেলায় টেপ্রীগঞ্জ হয়ে একসাথে করতোয়ায় মিলিত হয়েছে চতুরাডাঙ্গী নামক গ্রামের কিনারায়। এখানে তিনটি নদীর মোহনার মাঝে বিশা একটি চর আছে এবং চরটির বিভিন্ন অংশ চা বাগান দিয়ে সুসজ্জিত। কোথাও কোথাও আবার ধুধু বালুচর। সব মিলে প্রায় শতভাগ বিশুদ্ধ আবহাওয়ার বিশাল এক অভয়ারণ্য সেই চর যেখানে বসে আছি আমরা।
সবাই একসাথে হো হো করে হেসে উঠলো।
কনকরা যেখানে বসে আছে সেখান থেকে দুইশত গজ দূরে হুক্কা হুয়া করে সম্মিলিত স্বরে ডেকে উঠলো সাত থেকে আটটি শিয়াল। ভয় পেয়ে কনককে জড়িয়ে ধরলো লিখন। লিখন একটু আদুরে পরিবেশে বড় হয়েছে বলে বাইরে কোনদিন এমন অভিজ্ঞতার শিকার হয়নি।
আকাশ, রাতুল আর বাকিরা কেউই ভয় পেল না। কারণ ওরা নদীপাড়েরই সন্তান। এ রকম অনেক দুঃসাহসিকতা পাড়ি দিয়ে এতবড় হতে হয়েছে। “চল আমরা দৌড়ানি দিয়ে আসি শেয়ালগুলোকে” বলেই সঙ্গে আনা লাঠি নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলো হৃদয়, সুমন, ইমরান ও নাঈম। ওদের পিছে পিছে একযোগে দৌড় দিল সবাই। সবার ধাওয়া খেয়ে শেয়ালগুলো এক নিমিষেই উধাও হয়ে গেল যেন। বিশাল বালির চর দৌড়ে এসেছে তারা। নদীর ধারে চলে এলো সবাই। পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নেয়। সুবিমল স্বচ্ছ পানি দেখে হৃদয়টা জুড়িয়ে গেল কনকের।সবার উদ্দেশে বললো-
তোমরা ঢাকার বুড়িগঙ্গা আর হাতিরঝিলের কথা শুনে থাকবে হয়তো। যার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নাকে রুমাল চেপে
হাঁটতে হয়। আস্ত নর্দমা বললে ভুল হবে না। অথচ সেখানে শত শত মানুষ ভ্রমণ-বিনোদনের জন্য প্রতিদিন জড়ো হয়। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা কারো থাকলে করতোয়ার পানিকে ডাবের পানি মনে হতো। আমরা আসলেই অনেক সৌভাগ্যবান যে এমন পরিচ্ছন্ন পানির একটি নদী পেয়েছি। এমন নদী সিলেট বাদে বাংলাদেশের আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল সবাই। আগামীকাল দুপুরে এখানে গোসল ও ফটোসেশন করলে কেমন হয়? প্রস্তাব শেষ হওয়ার সাথে সাথে হাততালি দিয়ে আনন্দে নেচে উঠলো রাতুলরা। সবাই মিলে দুপুর ১২টায় এসে উপস্থিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। অতঃপর খানিকটা সরে এসে দেখলো বয়ে যাওয়া পানির পাশেই উঁচু ঢিবি শুরু হয়েছে। সেখান থেকে বালির মাঠ শেষ হয়ে ঘাসের মাঠ শুরু হয়েছে। সরাসরি পানি থেকে উপরের এ মাঠের তীরকে খাড়া কাছার বলা হয়। সবাই বসে পড়ল ঘাসের ওপরে। দূর থেকে সুরেলা এক বাঁশির আওয়াজ ভেসে এলো। মূলত এরকম জ্যোৎস্না রাতে শখের বশে কেউ কেউ শ্মশানঘাটের পাশে গিয়ে বাঁশি বাজায় এর মধ্যে বকুল মিয়া নামে এক মুরব্বি অন্যতম। খানিক পরে আর শোনা যাচ্ছিল না বাঁশির সুর। এবার হৃদয়কে গান পরিবেশনের নির্দেশ দিল। এলাকায় সে একজন ভালো মানের কণ্ঠশিল্পী বলেই সবার কাছে পরিচিত।
মায়াবীকণ্ঠে গেয়ে উঠলো হৃদয়
‘আল্লাহ তুমি কত সুন্দর

জানে জানে এই অন্তর
তোমার দয়া
তোমার মায়া
ছড়িয়ে আছে সারা প্রান্তর-
রঙে রঙে ফুলগুলো কত
অপরূপ
সুবাস ছড়ায় বনে বনে
প্রজাপতি ডানা মেলে উড়ে উড়ে
জিকির করে মন ও প্রাণে
তাই তো আমি তব গুণগান
গাইছি সারাদিন ভর-
আল্লাহ তুমি কত সুন্দর……
ঝর ঝর ঝরনানাটা ঝরে ঝরে যায়
তোমার ভয়ে কেঁদে কেঁদে
সাগরের ঢেউগুলো নেচে নেচে
ঝিকিমিকি করে জল রোদে-
তাইতো প্রভু তোমার ভয়ে
বুকটা কাঁপে থর থর–
আল্লাহ তুমি কত সুন্দর……
সুললিত কণ্ঠে মুগ্ধতা ছুঁয়ে গেল সবার প্রাণে।
আরেকটা হবে, আরেকটা হবে বলে হৈ চৈ করতে লাগলো অনেকে। তাদের দাবির মুখে বাধ্য হয়ে আরেকটা গানের সুর ধরলো হৃদয়-
‘একবার যেতে দেনা আমায় ছোট্ট সোনার গাঁয়
যেথায় কোকিল ডাকে কুহু কুহু
দোয়েল ডাকে মুহু মুহু
নদী যেথায় ছুটে চলে আপন ঠিকানায়…..
পিদিম জ্বালা সাঁঝের বেলা
শানবাঁধানো ঘাটে
গল্পকথার পানসি ভিড়ে
রূপ কাহিনীর বাটে
মধুর মধুর মায়ের কথায়
প্রাণ জুড়িয়ে যায়….
ফসল ভরা স্বপ্নঘেরা
পথ হারানো ক্ষেতে
মৌ মৌ মৌ গন্ধে যেথায়
বাতাস থাকে মেতে
মমতারই শিশিরগুলো
জড়িয়ে থাকে পায়
একবার যেতে দেনা আমায় ছোট্ট সোনার
গাঁয়…
কান পেতে শুনছিল সবাই হৃদয়ের কণ্ঠে হৃদয়ছোঁয়ানো গান। কেউ কিছু বলার আগেই হৃদয়ই বলে উঠলো ‘এবার বাংলাদেশের জন্মকথা নিয়ে গল্প শুনতে চাই। গান পরেও শোনা যাবে।’ আবার শুরু করে কনক বাংলাদেশ কিন্তু আগে ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের অন্তর্ভুক্ত অন্যতম একটি দেশ। ভারত ও বাংলাদেশ আলাদা কোনো অংশ হিসেবে প্রথমে পরিগণিত হয়নি। তবে ভারতের যেখানেত সেখানে লোকবসতি থাকলেও এ অঞ্চলে ছিল না। কারণ তখন এদেশের মাটি ছিল অধিকাংশ নদীর পেটের ভেতর। তবে নদীর মাঝে মাঝে জেগে উঠছিল চর। সেই চরে বসবাসের জন্য অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, আলাপীয় আর্য এবং মঙ্গল জাতিরা এ অঞ্চলেত সর্বপ্রথম আসতে শুরু করে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের অস্ট্রিক নামে ডাকা হয়। দক্ষিণ ভারতের জনগোষ্ঠী দ্রাবিড় নামে অভিহিত। মূলত অস্ট্রিক বা দ্রাবিড়রা ভূমধ্যসাগরীয় জনগোষ্ঠী ছিল। সেখান থেকেই তারা জলপথ বা উপকূলীয় স্থলপথে ভারতে প্রবেশ করেছিল। এরপর দাক্ষিণাত্যতে আর বাংলায় বসবাস শুরু করে। এখানে তারা এসেছে বিভিন্ন সময়ে। আবার হিমালয় মালভূমি অঞ্চল থেকে এবং লুসাই পর্বত বেয়ে এসেছে মঙ্গলরা। অস্ট্রিক দ্রাবিড়ের পরে যারা এসেছে তারা আলপাইনি বা আলাপাইনি আর্যভাষী। এরা এসেছিল মূলত সমুদ্রপথে। চরগুলোকে তারা বসবাসের উপযোগী করে তুলে এবং ঘরবাড়ি তৈরি করে। প্রাচীন বাংলার এসব আদিবাসী এক চরের বাসিন্দা আরেক চরের বাসিন্দাদের সাথে নৌকা ছাড়া যোগাযোগ করতে পারতো না। তাদের বাজারঘাট ও ব্যবসা বাণিজ্য কিন্তু নৌকার ওপরেই চলতো। চারদিকে শুধু পানি আর পানির জন্য মাছ এবং ব্যাঙ ছিল পর্যাপ্ত। সন্ধ্যার পর কোন আওয়াজ না থাকলেও কিন্তু ব্যাঙের গান শুনা যেত হরদম। এই থেকে বাহিরের লোকেরা এদেশকে ব্যাঙের দেশ বলে ডাকতো। এ পর্যন্ত শোনার পর সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
সুমন বলল, “এই ইতিহাস প্রথম শুনতে পেলাম।”
মজার কথা হলো এই ‘ব্যাঙ’ শব্দটিকে এ অঞ্চলের লোকজন উন্নত শব্দে রূপায়ণ করে নাম রাখে বঙ্গ। এভাবে চলতে থাকে দিন-মাস-বছর। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে চরের সংখ্যা। বাড়তে থাকে লোকজনও। এরপর কোন কোন স্থানে কিছু অঞ্চলের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। এসব অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে নদী ও বিলের পানি কমে আসে। লোকজন এক চরের সাথে আরেক চরের সংযোগ স্থাপন করতে বড় বড় আল তৈরি করে। তারা বঙ্গ-এর সাথে আল যোগ এ অঞ্চলের নাম দেয় বঙ্গআল। তারপর বঙ্গআল থেকে কিছুদিন পর একে বঙ্গাল নামে ডাকতে শুরু করে। তারও কিছুদিন পরে কেউ কেউ বাঙালা নামে ডাকতে থাকে। এই বাঙালা শব্দ থেকেই বর্তমান বাংলা এবং বাংলাদেশ।
নৃতাত্ত্বিকদের মতে আলাপাইনি আর্যভাষী বহিরাগত গোষ্ঠীই বাংলা, বিহার, উড়িষ্যাতে উন্নত মনন ও হাতিয়ার প্রয়োগে প্রাধান্য লাভ করে। পরে এই বহিরাগত আর্যরাই সমাজে পেশা অনুসারে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, ও কায়স্থ নামে পরিচিত হয়। দ্রাবিড় ও অস্ট্রিকরা হয়ে গেল নাপিত, ধোপা, কামার, কুমার, মুচি, মেথর, চড়াল, ডোম। এভাবে তারা আর্যদের সেবাদাসে পরিণত হলো। আর্যদের ধর্ম ছিল সনাতন যা বর্তমানে হিন্দুধর্ম নামে পরিচিত। এই ধর্মের ভয়াবহ অভিশপ্ত দিকটি হলো বর্ণপ্রথা, যা মানুষকে উঁচুস্তর এবং নিম্নস্তরে বিভক্ত করেছিল। অর্থাৎ হিন্দু ধর্ম অনুসারে সব মানুষ সমান নয়। এটি একটি জাতধর্ম অর্থাৎ জন্মের সময় যে যেই অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে তার বর্ণ পরিচয়ও তাই হবে। এই বর্ণপ্রথা মূলত বিভক্ত করা হয়েছে কর্মের ভিত্তিতে। আধুনিক সংস্কারক হিন্দুরা যদিও এখন এসব জাত-পাত মানেন না, কিন্তু মধ্যবিত্ত ও মধ্য-শিক্ষিত সমাজে এর প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িকতাই এ ধর্মে বর্ণভেদের একমাত্র কারণ। আচরণ, গায়ের রঙ ও পেশার ভিত্তিতে এই প্রথা নির্ণয় করে তারা।
উঁচুবর্ণের হিন্দুরা তাদের দৃষ্টিতে যারা নিচুবর্ণ তাদেরকে নিয়ে সবসময় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, হাসি-তামাশা করতো এবং নিমড়ববর্ণদের বিভিন্ন নামে সম্বোধন করে। নিম্নবর্ণের হিন্দুর হাতের রান্না কিংবা একসাথে কখনও খাওয়া তারা করতো না। কাপড় পরার নিয়মেও ছিল বর্ণবাদী আচরণ; ব্রাহ্মণদের জন্য সাদা, ক্ষত্রিয়দের জন্য লাল, বৈশ্যদের জন্য হলুদ আর শুদ্রদের জন্য কালো রঙের কাপড় নির্ধারিত ছিল। ধর্মীয় নেতৃত্ব দিত ব্রাহ্মণরা। রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিত ক্ষত্রিরা আর বৈশ্যরা ক্ষমতায় একেবার হীন আর শুদ্ররা ছিল তাদের সকলের সেবক।
ব্রাহ্মণরা আরো প্রচার করতো যে, ব্রাহ্মণরা সৃষ্টি হয়েছে ভগবানের মস্তক থেকে, ক্ষত্রিয়রা সৃষ্টি হয়েছে ভগবানের বুক থেকে, বৈশ্যেরা সৃষ্টি হয়েছে ভগবানের পেট থেকে আর শুদ্ররা সৃষ্টি হয়েছে ভগবানের পা থেকে। সুতরাং ব্রাহ্মণরা উঁচু জাতি আর শুদ্র সবচেয়ে নিচু জাতি। সমাজে বর্ণভেদের কারণে নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়ে আসছিল বৈশ্য ও শুদ্র সম্প্রদায়।
অন্যদিকে নানা রকম ধর্মীয় গোড়ামি ও কুসংস্কারের বলি হত সাধারণ মানুষ। তারা বিভিন্ন পূজা-পার্বণে ও মানতের জন্য তাজা মানুষকে দেবতার নামে বলি দিত। আবার সতীদাহ প্রা নামে এক ভয়াবহ কুসংস্কারে লোকজন থাকতো আরো আতঙ্কে। কোন পুরুষ লোক মারা গেলে জীবিত স্ত্রী লোককে আগুনের মধ্যে পুড়ে মরতে হতো। এ অবস্থা থেকে তারা মুক্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল। এরপর আরবের ব্যবসায়ীরা এদেশে বাণিজ্য করার জন্য আসতো। পাশাপাশি তারা ইসলামের সুমহান আদর্শের কথা লোকজনের কাছে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে। উঁচু-নিচু সব ভেদাভেদ দূর করে ইসলাম যে সাম্যের পথে সকলকে আহ্বান করে সে কথা তারা দেদারছে প্রচার করে।
অন্য দিকে হযরত শাহজালাল (র), হযরত শাহ পরান (র), খান জাহান আলী (র), শাহ মাখদুম (র)সহ বিভিন্ন সুফি সাধকগ ইসলাম প্রচারের জন্য সারা বিশ্বের মতো ভারত বর্ষেও আসতে থাকে। তাদের কথায় ও কাজে মুগ্ধ হয়ে লোকজন দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। ১২০৩ সালে হযরত ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি (র) বাংলা জয় করে ইসলামের ব্যাপক প্রসার লাভ করান। কালের পরিক্রমায় এদেশ মুসলিম শাসকদের দ্বারা শাসিত হতে থাকে। দেশের মানুষ পরম শান্তিতে বসবাস করতে থাকে তখন। কোনোরকম রাসায়নিক সার ছাড়াই তখন মাঠভরা ফসল, গোলাভরা ধান আর পুকুরভরা মাছ ছিল। চোর-ডাকাতের কোনো পাত্তাই ছিল না। মানুষের রোগ-ব্যাধিও তেমন একটা দেখা যেতো না। বাংলার আয়তন ছিল বর্তমান বাংলাদেশের চেয়ে ৬ গুণ বড়। এভাবে কিছুদিন চলার পর বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে নেমে আসে কালো মেঘের ছায়া। তখন থেকে শুরু হলো অশান্তির যুগ।
“কিভাবে এমন সোনালি দিনগুলো হারালাম আমরা?” প্রশ্ন করে ইমরান।
২৩ জুন ১৭৫৭ সালে কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধ নামের প্রহসনে পাল্টে গেল বাংলার এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভাগ্য। সকাল ৯টায় যুদ্ধ শুরু হয়ে বিকেল ৪টার মধ্যেই শেষ! এতো অল্প সময়ে পলাশীতে যুদ্ধ হয়নি বললেই চলে। যা হয়েছে, তার নাম ষড়যন্ত্র ও রাজনীতি। ব্রিটিশরা সিরাজদ্দৌলাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। টাকা ও ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে তারা এদেশীয় কিছু মুনাফিককে হাত করে। মূলত নবাব সুজাউদ্দিনের সময় থেকেই এই ষড়যন্ত্রকারীরা নানা অপকর্মে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। পরবর্তীতে নবাব আলীবর্দী তাদেরকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখেন বটে, কিন্তু শেঠরা ঘাপটি মেরে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চলাতে থাকে এবং রাষ্ট্রের সংহতির শিকড় কাটতে থাকে। শেঠরা নবাব পরিবারের মধ্যে অর্থ, ঘুষ ও কুমন্ত্রণা দিয়ে নানা উপদল তৈরি করে এবং একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে।
যে বিভক্তির চোরাপথে তারা ইংরেজদেরকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে সমর্থ হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন এমন একজন নবাব যিনি তরুণ বয়সেই নবাব হন। নবাবের বয়স হয়েছিল মাত্র ২৪ বছর। ১৭৫৬ সালের ১৫ এপ্রিল নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলার মসনদে আসীন হন। সিংহাসনে আরোহণ করেই সিরাজ বুঝতে পারেন, বাইরের শত্রুর আগে তাকে ঘরের শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। এদের মধ্যে ছিলেন খালা ঘসেটি বেগম, খালা মোমেনা বেগমের ছেলে পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জঙ ও আলীবর্দী খাঁর বৈমাত্রেয় বোনের স্বামী মীর জাফর আলী খান। রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ কম বয়সী সিরাজের দেশপ্রেমে কোনো ঘাটতি ছিল না। সিংহাসনে আরোহণ করার পর তাঁর নানা আলীবর্দী খাঁ মৃত্যুশয্যায় তাকে যেসব নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন তা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে কিছু নির্দেশনা তার বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একমাত্র নানার নির্দেশনার জন্যই সিরাজ তার নিজ পরিবারের বিশ্বাসঘাতক সদস্যদের বিরুদ্ধে সঠিক সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হন। বাংলার মোগল সুবেদার শাহ সুজার কাছ থেকে কৌশলে ইংরেজরা ১৬৫১ সালে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি আদায় করার পর থেকে তারা বাংলা একচেটিয়া বাণিজ্য করতে থাকে। এ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময় বাংলার সুবেদারদের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ তৈরি হয়। অন্য দিকে সিরাজউদ্দৌলা মসনদে বসেই প্রশাসনে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসেন। মীর জাফরকে সেনাবাহিনীর প্রধান পদ থেকে সরিয়ে মীর মদনকে সেখানে নিয়োগ দেন। এ ছাড়া মোহনলালকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেন। এরপর কলকাতায় অবস্থিত ইংরেজদের কাশিমবাজার কুঠির ব্যাপারে মনোযোগী হন। কারণ সিরাজউদ্দৌলা তাদের এ দেশে শুধু বণিক ছাড়া আর কিছু ভাবেননি। এরই মধ্যে ইংরেজরা নবাবপরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্ব সম্পর্কে পুরোপুরি জেনে ফেলে। এ ষড়যন্ত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন জগৎশেঠ। ইংরেজরা জগৎশেঠের মাধ্যমে মীর জাফরকে মসনদে বসানোর চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে ফেলে।
পরিকল্পনায় আরও যোগ দেন ঘসেটি বেগম, মীর জাফরের ছেলে মীরন, মীর জাফরের জামাতা মীর কাশিম, রাজা দুর্লভ রায়, উমিচাঁদ, রাজা রাজবল্লভ, মীর খোদা ইয়ার খান লতিফ। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ১৭৫৭ সালের ৫ জুন মীর জাফরের বাংলার স্বাধীনতা-বিনাশী একটি গোপন চুক্তি হয়। ইংরেজদের সঙ্গে গোপন চুক্তির বিষয়ে সিরাজউদ্দৌলা জানলেও মীর জাফরের অনুগত সেনাদের সংখ্যা ও অস্ত্রের পরিমাণ বিবেচনা করে তার বিরুদ্ধে তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি। এর ফলে সবচেয়ে মূল্যবান মুহূর্তে সিরাজউদ্দৌলা সাহসিকতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হন। পলাশী যুদ্ধের সময় ঘনিয়ে আসে। রবার্ট ক্লাইভ ৩ হাজার সেনাসহ পলাশীতে এগিয়ে আসে। অন্যদিকে নবাব সিরাজউদ্দৌলা প্রায় ৫০ হাজারত সেনাসহ অগ্রসর হন। কিন্তু সংঘর্ষের প্রথম পর্যায়েই বিশ্বস্ত সেনাপতি মীর মদনের মৃত্যু সিরাজউদ্দৌলাকে হতভম্ব করে দেয়। তিনি বার বার অনুরোধ, অনুনয় ও শেষে নিজের পাগড়ি মীর জাফরের পায়ের কাছে সমর্পণ করেও মীর জাফরকে যুদ্ধে নামাতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়ে যুদ্ধ স্থগিতের নির্দেশ দেন। যার কারণে ইংরেজদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টিকারী বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহনলাল যুদ্ধশিবিরে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এতে সিরাজউদ্দৌলার সেনাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ সুযোগ ইংরেজ সেনারা গ্রহণ করে। তারা নবাবের ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায় এবং তারা মোহনলালসহ নবাবের অনেক সৈন্যকে হত্যা করে। এভাবে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটে। আর এভাবেই ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ-নাটকের মাধ্যমে চিরদিনের জন্য পদদলিত হয় বাংলার স্বাধীনতা।
“তখন থেকেই কী বাংলাদেশের স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছিলাম আমরা?” রিয়াদের প্রশ্ন।
হ্যাঁ, সেদিন থেকে শুধু বাংলার স্বাধীনতাই নয়। এর ফলে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার মানুষও স্বাধীনতা হারায়। এরপর সমগ্র ভারতবর্ষই স্বাধীনতা হারায়। ক্ষমতার লোভে এ দেশীয় মীর জাফর, রাজবল্লভ, রায় দুর্লভ, উমিচরচাঁদ, জগৎশেঠেরা প্রতারণা করে সিরাজের পরাজয় ত্বরান্বিত করেছিল। আর নিষ্ঠুর ইংরেজদের নির্দেশে এবং মীরণের আদেশে মোহম্মদী বেগ, বাংলার মহানায়ক সিরাজকে শহীদ করেছিল ২ জুলাই ১৭৫৭। সিরাজকে শহীদ করেই ক্ষান্ত হয়নি শুধু। তারা সিরাজ পরিবারটিকেই তছনছ করে ফেলে। সিরাজকে হারিয়ে লর্ড ক্লাইভ মীরজাফরের আগেই মুর্শিদাবাদ পৌঁছে এবং নবাবের সমুদয় ধন-দৌতল লুট করে। ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধের শর্তানুযায়ী মীরজাফরকে চাপ দিয়ে টাকা আদায় ও অন্যবিধ লুটতরাজে ক্লাইভ ও তার বাহিনী বাংলায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
তবে ইতিহাসের এক নির্মম পরিণতি হলো ক্লাইভ ষড়যন্ত্রমূলক জীবন কাটিয়ে শেষ জীবনে ব্যর্থতা ও জনমানুষের ঘৃণার শিকার হয়। নানা অভিযোগ ও অপমানে বেচারা আত্মহত্যা করে। মীরজাফর, জগৎশেঠ, ঘসেটি বেগম সকলেই অপঘাতে অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু ব্রিটিশরা তখনও বাংলার শাসন ক্ষমতায় থেকে যায়। শুরু হয় তাদের অবাধ শোষণ, নির্যাতন ও লুটপাট। অল্প সময়ের ভেতরে তারা পুরো ভারতবর্ষ দখল করে নেয়। এদেশের মানুষের কাছ থেকে আদায় করা খাজনা তারা নিজেদের দেশে পাচার করতে থাকে।
তোমরা বইয়ে পড়ে থাকবে যে, ওরা মুসলমান সৈন্যদেরকে দেয় শূকরের চর্বি থেকে তৈরি কার্তুজ আর হিন্দু সৈন্যদেরকে দেয় গরুর চর্বি থেকে তৈরি কার্তুজ। রাইফেলে লোড করার আগে দাঁত দিয়ে কামড়ে এগুলি খুলতে হতো। বিষয়টি জানার পর জ্বলে উঠেছিল উভয় ধর্মের সৈন্যরা। শুরু হয় ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ। জনগণের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল এটি। কিন্তু আবারো এদেশীয় দালালদের সাহায্য নিয়ে জয়ী হয়ে যায় ব্রিটিশরা। এরপর তারা সৈন্যদের ও সাধারণ মানুষদেরকেও পাইকারি হারে হত্যা করে। ধর্মকে অপমান করে এবং হাজার হাজার আলেমকে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়। ভীতি সৃষ্টি করার জন্য রাস্তার পাশে তাদের লাশ লটকিয়ে রাখে। তখন দাড়ি রাখলে, টুপি পরলে এবং মসজিদে আজান দিলেও খাজনা দিতে হতো। মসজিদে জামায়াতে নামাজ আদায় করাও কষ্টকর ছিল। ফলে প্রায় সকল মসজিদেই পাঁচওয়াক্ত নামাজের পরিবর্তে শুধুমাত্র জুমার দিনেই নামাজ আদায় করা হতো। দেশের বিভিন্ন স্থানে জুমার নামাজও আদায় করা হতো ট্যাক্স দিয়ে। ফলে মসজিদগুলো নামাজশূন্য হয়ে পড়ে। আর শুধুমাত্র জুমার নামাজ আদায় করা হতো বলে মসজিদকে জুমাঘর বলে এখনও বিভিন্ জায়গায় মসজিদকে জুমাঘর নামেই ডাকা হয়। মুসলমান ঘরে সন্তানদের আকিকা দিয়ে মুসলমানি নাম রাখতেও খাজনা দিতে হতো। খাজনা না দিলে মুসলিম ছেলেমেয়েদে বিয়ে-শাদিও দেয়ার অনুমতি ছিল না।
“আচ্ছা মামা! ঐ সময় সব মানুষ একজোট হয়ে ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধ করে তাড়িয়ে দিতে পারতো না?” লিখনের প্রশ্ন।
কেউ কেউ প্রতিবাদ করতেন। তবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী যেসব লোক প্রতিবাদী হতেন তাদেরকে ওরা নির্যাত করতো বিভিন্ন অমানবিক কায়দায়। কৃষকেরা খাদ্যদ্রব্যের পরিবর্তে তামাক জাতীয় নেশা দ্রব্য নীল চাষ করতে চাননি। ব্রিটিশরা তখন নির্যাতন করে অসহায় কৃষকদের দিয়ে জোরপূর্বক নীল চাষ করিয়েছে। যেসব কৃষক নীল বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন ব্রিটিশরা তাদেরকে গুলি করে মেরেছে। আমাদের পাশের জেলা নীলফামারী সেই জন্যই এ নাম ধারণ করেছে। সেখানে শহরের প্রাণকেন্দ্রে এখনো নীলকুঠিটি পড়ে আছে। ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’ এ প্রবাদের জন্ম হয়েছিল সেই ব্রিটিশ আমলে। তখন পুলিশের গায়ের গন্ধ পেলে নির্দোষ মানুষেরাও গ্রাম ছেড়ে পালাতো। পুলিশের ঘুষ গ্রহণ, রিমান্ডের নামে নির্যাতন, হয়রানিমূলক তদন্ত, বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার, বিনা বিচারে আটকে রাখা ইত্যাদির পথপ্রদর্শক ব্রিটিশরাই। দীর্ঘ দুইশত বছর তারা এদেশকে জাহান্নামের শিখায় পরিণত করেছিল। তবে এর মধ্যেই বিভিন্ন সময়ে নানা রকম আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে।
ফকির বিদ্রোহ, তিতুমীরের আন্দোলন, ফরায়েজী আন্দোলন, সিপাহি বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, চাকমা বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ এসময়ে ব্যর্থ হয়। এতো জুলুম নির্যাতনের ভয়াবহ সময় অতিবাহিত হতে ২০০ বছর লেগে যায় বাংলার। এরপর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ ভারত ভেঙে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন হয়। পাকিস্তান অধিরাজ্য পরবর্তীকালে আবার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নামে দু’টি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তখন একে বাংলাদেশত না বলে পূর্ব পাকিস্তান নামেই ডাকা হতো।
প্রথম দিকে পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর তেমন জুলুম নির্যাতন না করলেও কিছুদিন পর তারা নানাভাবে আমাদের অধিকার কেড়ে নেয়। যেমন তোমরা আমাদের মাতৃভাষা নিয়ে তাদের বাড়াবাড়ির কথা পাঠ্যবইয়ে পড়েছ। আমাদের ভাষার ইতিহাসে ওদের নগ্ন থাবা যেন ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে চিরকালের জন্য। আজ তোমাদের সাথে আমি আমার মায়ের ভাষায় যে কথা বলছি এর জন্য রক্ত ঝরাতে আমাদের এক প্রজন্মকে! কী অবাক লাগছে না? আরও উপরের ক্লাসে উঠলে তোমরা পাকিস্তানিদের নির্যাতনের কথা বিস্তারিত জানতে পারবে। তাদের শোষণ নিপীড়নের কারণে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক সময় বাংলার জনগণ দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে আমাদের গৌরবদীপ্ত বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। সে গল্প অনেক বড় আমরা আরেকদিন সময় করে শুনে নেবো। কেমন? এখন অন্য প্রসঙ্গে আসি।
ইমরান এবার প্রশ্ন শুরু করলো, “ভাইয়া রাতের বেলা এখানে আসতে আমাকে নিষেধ করেছিল আমার বড় ভাবি। আমাদের পাশের ঐ শ্মশানঘাটে নাকি জিন-ভূতের আস্তানা। এই কথা কতটুকু সত্য?”
ভূত বলতে আসলে কিছু নেই। শয়তান জিনদেরকে আমরা ভূত বলে থাকি। একজন মুসলিমকে অবশ্যই জিনের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে। যদি সে জিনের অস্তিত্ব অস্বীকার করে, তাহলে সে মুমিন থাকবে না।
জিনের অস্তিত্ব স্বীকার ঈমান বিল গাইব বা অদৃশ্যের প্রতি ঈমান আনার অন্তর্ভুক্ত। আর জিন হলো আল্লাহ তাআলার একটি অন্যতম সৃষ্টি। তিনি যেমন ফেরেশতা ও মানুষ সৃষ্টি করেছেন তেমনি সৃষ্টি করেছেন জিন। তাদেরও মানুষের মতো বিবেক, বুদ্ধি, অনুভূতি শক্তি রয়েছে। তাদের আছে ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা। তাদের মধ্যে আছে ভালো জিন ও মন্দ জিন। ইবলিস শয়তান কিন্তু জিনের অন্তর্ভুক্ত, নবী সুলাইমান আলাহিস সালামের আমলে জিনদের কাজ-কর্ম করা, তাদের মধ্যে রাজমিস্ত্রি ও ডুবুরি থাকার কথা জানা যায়। তারা নানা রকম রূপ ধারণ করতে পারে বলে হাদিসে এসেছে। এমনিভাবে দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারে বলে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে।
আসমানি কিতাবে বিশ্বাসী আমাদের নবীর পূর্ববর্তী উম্মত যারা বর্তমানে ইহুদি ও খ্রিষ্টান তারাও জিনের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। বিচার দিবসে মানুষের যেমন বিচার হবে তেমনি জিন জাতিকেও বিচার ও জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানে এখনো জিন ও ফেরেস্তার অস্তিত্ব আবিষ্কার হয়নি।
পবিত্র কুরআনে জিনদের নামে একটি সূরা আছে আর তাদের বক্তব্যই আল্লাহ তায়ালা উল্লেখ করেছেন- “আর নিশ্চয় আমাদের কতিপয় সৎকর্মশীল এবং কতিপয় এর ব্যতিক্রম। আমরা ছিলাম বিভিন্ন মত ও পথে বিভক্ত। (সূরা আল জিন : ১১)
এ গোষ্ঠীর নাম জিন রাখার কারণ হচ্ছে ওরা গোপনে তথা আমাদের দৃষ্টির অগোচরে থাকে। আর জিন শব্দের অর্থই হচ্ছে গোপন। কুরআনে সূরা আল আরাফের ২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন- “নিশ্চয় সে ও তার দলবল তোমাদেরকে দেখে যেখানে তোমরা তাদেরকে দেখ না।”
সূরা আল হিজরের ২৭ নম্বর আয়াত থেকে জানা যায় জিনদের সৃষ্টি করা হয়েছে আগুন দিয়ে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষ সৃষ্টি করার আগেই জিন সৃষ্টি করেছিলেন। যে উদ্দেশ্যে তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন সে-ই উদ্দেশ্যেই জিনকে সৃষ্টি করেছিলেন।
সূরা আয যারিয়াতের ৫৬ নম্বর আয়াতে তিনি বলেন“আর জিন ও মানুষকে কেবল এ জন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদাত করবে।”
‘আচ্ছা কোন কোন মানুষকে যে ভূতে ধরেছে বলা হয় সেটা আবার কী?’ বলল রিয়াদ।
আমি আগেই বলেছি শয়তান ও ভালো দুই রকমের জিন আছে। আর জিনদের স্বাভাবিক ক্ষমতা হচ্ছে ওরা মানুষকে আছর করতে পারে। স্পর্শ দিয়ে পাগল করতে পারে। মানুষের ওপর ভর করতে পারে। তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তার জীবনের স্বাভাবিক কাজ-কর্ম ব্যাহত করতে পারে। এটা বিশ্বাস করতে হয়। তবে জিনের চেয়ে মানুষকে আল্লাহ অনেক বেশি শক্তি দিয়েছেন। আমাদের মতো নিরীহ মানুষকে জিন ধরতে আসলে আয়াতুল কুরছি পড়লেই ওদের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। আগেকার দিনে বেশির ভাগ মানুষ অশিক্ষিত ও অসচেতন ছিল বলে জিনের ডিস্টার্ব ছিল বেশি। এখন আমরা বিজ্ঞানের কল্যাণে নিত্য নতুন আবিষ্কার পেয়েছি যেমন ধরো হাতে হাতে ভিডিও মোবাইল। এ সময় কোন জিন আমাদের ডিস্টার্ব করতে আসবে না। কারণ ওরা তো গোপনে থাকতে ভালোবাসে আমাদের কাছে আসলেই তো ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে নেবো। এ কথা শুনে সবাই হাসতে লাগলো।
সেদিনের জোছনা মাখা ঐ আঙিনাতে সারারাত ধরে গল্পের এক হাট বসেছিল। এখন ফাইনাল পরীক্ষার জন্য নবীনদের পড়াশোনার চাপ অনেক। ঢাকা শহরের অলি-গলি দিয়ে একটি চাকরির জন্য কতদিন ঘুরে বেড়াচ্ছে ব্যাচেলর কনক আব্দুল্লাহ। সারাদিন ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে হতাশার ধোঁয়াজালে রুমে ফিরে আসে সন্ধ্যায়।
একটু বিশ্রাম নেয়ার আগেই টিউশনিতে চলে যায় আবার। এই টিউশনিটাও যদি না থাকতো তবে ঢাকা শহরে অবস্থান করার সাধ্যটুকুও হয়তো তার হয়ে উঠতো না। শত টেনশনের বোঝা মাথায় নিয়ে ছাত্রকে বুঝাতে হয়। সালমান মাহমুদ এখন তার প্রাইভেট স্টুডেন্ট।
একটু ফাঁকফোকর পেলেই প্রশ্নের কোনো লিমিট থাকে না তার। নেগেটিভ কোন উত্তর দিলেই শত প্রশ্নের অবতারণা হয় ওর মুখে। নিজের ভালো-মন্দ না দেখে এখন সালমানকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হয় কনকের। তাই নিজে কেমন আছে না আছে দুষ্টুটাকে বুঝতে দেয় না কোনোভাবেই। ওর প্রশ্নমুখর চাহনির মাঝে নিজের অতীতকে মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে মাঝে মাঝে। একজন শিক্ষিত মা এবং প্রাইভেট টিউটরের সহযোগিতায় আজকালকের বাচ্চারা অনেক কিছু জানে। কিন্তু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এক মায়ের সন্তান কতটুকুইবা জানতে পারতো আগেকার দিনে? ভাবনার আকাশে হারিয়ে গিয়ে প্রকৃত সত্যের সমীকরণটা তাৎক্ষণিক মেলাতে চেষ্টা করে কনক। মিলে না সম্পূর্ণ। তবে ঝাপসা হয়ে ভেসে আসে কিছু এলোমেলো দুশ্চিন্তা। আধুনিক শিক্ষার সাথে সেকালের শিক্ষা খানিকটা মিলাতে গিয়ে দেখা যায় হতাশার চিত্র। পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণে বর্তমান শিক্ষায় শিক্ষিত যারা তাদের আচার ব্যবহার ও রুচিতে যেন কেমন কেমন অভদ্রতার ছাপ।
এরা কী ভুলেই গেলো তাদের শেকড়ের টান? মার্জিত আচার ব্যবহারের সেই প্রকৃতির গল্প ভাণ্ডার থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে লুকিয়ে রেখে টমের মতো দুষ্ট; জেরির মতো ফাজিল; গোপাল ভাঁড়ের মতো বাটপাড় বানাতে বসেছে সন্তানদের। শেকড়ের এর অভ্যাস এবং সভ্যতা ছেলেমেয়েকে না শেখানোর ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে হারিয়ে গেছে। এ জন্য তাদের সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ চরম হুমকির সম্মুখীন।

Share.

মন্তব্য করুন