পুকুরপাড়ে মুখ গোমড়া করে একা বসে আছে রাকিব। কিছুক্ষণ পর পর পাথর ছুঁড়ে মারছে পানিতে আর ভাবছে আমি পরীক্ষায় ফেল করেছি বলেই কি আমার কোন দাম নেই? সবাই কেন আমাকে এত বকছে? এসব নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। রাকিব পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। এ বছর বার্ষিক পরীক্ষায় সে গণিতে ফেল করেছে ২ নম্বরের জন্য। রাকিবের খুব কান্না পাচ্ছে। মনে মনে ভাবছে সে আর বাড়িতে যাবে না।
পড়ালেখা ছেড়ে দেবে। দূরে কোথাও চলে যাবে। দুনিয়ার সব হতাশা আর দুঃখ যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। এমন সময় পুকুরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন রাকিবের স্কুল শিক্ষক জনাব কেরামত আলী। রাকিবকে একা বসে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ালেন কেরামত আলী। তিনি রাকিবদের ইংরেজি শিক্ষক। রাকিবের প্রিয় শিক্ষক এই কেরামত স্যার। কেরামত স্যারের কাছেও প্রিয় ছাত্র রাকিব।
– কি খবর বাবা রাকিব! এখানে একা বসে কেন তুমি? তোমার কি মন খারাপ একসাথেই প্রশ্ন দুটো করলেন রাকিবের প্রিয় কেরামত স্যার। কেরামত স্যারের কথা শুনে উঠে দাঁড়াল রাকিব। কাঁদতে শুরু করল হু হু করে। কেরামত স্যার রাকিবের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
– কেঁদো না বাবা। কী হয়েছে বল।
– স্যার, আমাকে কেউ ভালোবাসে না। আমি পরীক্ষায় ফেল করেছি তাই সবাই খুব বকেছে আমাকে। বাবা খুব রাগ করেছে আমার ওপর। আমার কিছুই ভালো লাগছে না স্যার।
– কেঁদো না বাবা, আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলব। আর বকবে না তোমাকে।
– স্যার, আমি বাড়ি যাবো না। আবার বকবে সবাই।
– আরে পাগল ছেলে! বকবে না। আচ্ছা চলো, আমি তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি। তোমার বাবা বাড়িতে আছেন?
– জি স্যার, বাবা বাড়িতেই আছেন।
– তাহলে তো ভালোই হলো, আমি কথা বলে আসতে পারব তোমার বাবার সাথে।
– ঠিক আছে স্যার, চলেন তাহলে। হেঁটে যাচ্ছে রাকিব ও কেরামত আলী।
– আচ্ছা বাবা, তুমি তো অন্য বিষয়গুলোতে ভালো নম্বর পেয়েছ। অংকে ফেল করলে কেন?
– স্যার, অংক আমার মাথায় ঢোকে না। আমি কিছুই বুঝি না অঙ্কের। যেটুকু নম্বর পেয়েছি, মুখস্থ করেছিলাম।
– বাবা তুমি এক কাজ কর।
– কি কাজ স্যার?
– তুমি যেহেতু ফেল করেছ সেহেতু তোমাকে তো আবারো পঞ্চম শ্রেণিতেই থাকতে হবে। আর এবার থেকে প্রাইমারিতে পিএসসি পরীক্ষা চালু হচ্ছে। পিএসসিতে যদি তুমি ভালো রেজাল্ট কর তাহলে তুমি পাবে বৃত্তি।বৃত্তি পেলে তোমার নাম ছড়িয়ে পড়বে চারিদিকে। মাসে মাসে টাকাও পাবে।
– কিন্তু স্যার, আমিতো অঙ্ক পারি না।
– পারবে পারবে! ভালো করে অন্য বিষয়গুলো পড়তে শুরু কর এখন থেকেই। আর আমি তোমাকে অঙ্ক পড়াব। রাকিব খুব খুশি হলো কেরামত স্যারের কথায়। খুশি মনে স্যারের সাথে বাড়িতে গেল রাকিব। সাথে তার স্যারকে দেখে বাড়ির কেউ কিছু বলল না রাকিবকে। কেরামত আলী রাকিবের বাবা-মাকে অনেক বুঝালেন। তারা আর রাকিবকে বকাবকি করল না। কেরামত স্যার রাকিবকে বিনা পয়সায় অংক পড়ানোর কথাও বললেন রাকিবের বাবাকে। কিন্তু অন্যকোন ছাত্রছাত্রীকে না বলতে অনুরোধ করল কেরামত আলী। পড়ালেখায় মনোযোগ বেড়ে গেল রাকিবের।
রাকিবের চোখের সামনে ভাসছে বৃত্তি। সে বৃত্তি পাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগল। প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে পড়তে বসে। নিয়মিত পড়ালেখা করে। সন্ধ্যায় কেরামত স্যারের বাসায় যায় অংক শিখতে। এসে আবার পড়তে বসে। অংকের সব সূত্র মুখস্থ করে ফেলেছে রাকিব। এভাবে ভালোই দিন যাচ্ছে রাকিবের। একে একে ঘনিয়ে আসছে পিএসসি পরীক্ষা। ভীষণ উদ্বেগ উৎকণ্ঠা কাজ করছে তার মনে। তবে অংকের প্রস্তুতিতে সন্তুষ্ট সে।
আজ থেকে রাকিবের পিএসসি পরীক্ষা শুরু। রাকিবের মা রাকিবকে সাজিয়ে গুজিয়ে পরীক্ষার সেন্টারে নিয়ে যাচ্ছে। রাকিব তার মাকে বলল, মা পরীক্ষার হলে যাওয়ার আগে কেরামত স্যারের সাথে একটু দেখা করে যাই! রাকিব ও তার মা গেল কেরামত স্যারের বাসায়। কেরামত স্যার রাকিবের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন রাকিবকে।
– বাবা, কোন ভয় করবে না। আমি জানি তুমি পারবে।
– জি স্যার, এখন আসি তাহলে। দোয়া করবেন।
– ঠিক আছে বাবা যাও।
ঠাণ্ডা মাথায় পরীক্ষা দিল রাকিব। এবার গণিত পরীক্ষাও অনেক ভালো হয়েছে। পরীক্ষা শেষ হলো রাকিবের। আগামীকাল রাকিবের পিএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট। খুব ভয় কাজ করছে রাকিবের মনে। কী যে হয় রেজাল্ট! দুশ্চিন্তা কাজ করছে রাকিবের ছোট্ট মাথায়। সেদিন ঘুমাতে পারল না রাকিব। পরের দিন নাস্তা সেরেই বেরিয়ে পড়ল। রেজাল্ট হবে দুপুর ১২টায়। রাকিব ছোট্ট মানুষ, রেজাল্ট কিভাবে নিতে হয় জানে না। তার বাবাও মূর্খ মানুষ। অনলাইন থেকে রেজাল্ট দেখবেন প্রিয় কেরামত স্যার। রেজাল্ট হতে আর এক ঘণ্টা বাকি। চিন্তায় মরে যাচ্ছে ছোট্ট রাকিব। বাড়ি চলে গেল সে। সব চিন্তা দূর করতে গোসল করার জন্য বাথরুমে গেল। ওখানে একটু সময় কাটালো। তারপর টিভি দেখতে লাগল। কার্টুন দেখছে রাকিব।
কখন যে ১২টা বেজেছে টেরই পায়নি সে। ১২টা ৩৫ মিনিটে তাদের বাসায় এলেন কেরামত স্যার। এসে চিল্লাতে লাগলেন- ভাবী! ভাবী! কোথায় আপনি? ছুটে এলেন রাকিবের মা।
– কী হয়েছে ভাই?
– রাকিব তো দেখিয়ে দিয়েছে ভাবী! সে উপজেলায় তৃতীয় হয়েছে। আর অংকেও অনেক বেশি নম্বর পেয়েছে।
বলেই রাকিবের কাছে ছুটে গেলেন কেরামত স্যার। রাকিবকে কোলে তুলে নিয়ে কপালে চুমু খেতে লাগলেন। বাবা, তুমি দেখিয়ে দিয়েছ তুমিও পারো। তুমি অংকে দুর্বল না সেটাও দেখিয়ে দিয়েছ।
রাকিব আজ খুব খুশি। তার বাবা-মাও। সবচেয়ে বেশি খুশি তার প্রিয় কেরামত স্যার। রাকিব পেরেছে ঘুরে দাঁড়াতে। আজ রাকিবদেরকে তাদের স্কুলের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। তাদের স্কুল থেকে ১১ জন বৃত্তি পেয়েছে। যাদের মধ্যে রাকিব ১ নম্বর। জমকালো অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা দেয়া হচ্ছে রাকিব ও তার ১০ বন্ধুকে। রাকিব আজ খুব খুশি। কেরামত স্যার বসে আছেন স্টেজে। রাকিবকে যখন পুরস্কার দেয়া হলো তখন কেঁদে ফেলল রাকিব। কেরামত স্যার আবারো কোলে নিলেন রাকিবকে।
– স্যার, আজ আপনার জন্যই আমি এই পুরস্কার পাচ্ছি। আপনাকে আমি কোনদিন ভুলব না।
– দোয়া করি তুমি একদিন অনেক বড় হবে। দেশ ও দশের সেবা করবে।

Share.

মন্তব্য করুন