অনেক অনেক দিন আগের কথা। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে তখন এক আধাসভ্য জাতি বাস করত। শাল পাতা আর বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি করা ছোট ছোট ঘরে থাকত তারা দলবদ্ধভাবে। যে সমস্ত অঞ্চলে তারা বাস করত সে অঞ্চলের প্রায় সবটাই হল ঘন নিবিড় বন-জঙ্গল আর হিংস্র জন্তু-জানোয়ারে পরিপূর্ণ। এ অঞ্চলের পাহাড়িদের পোশাক-আশাকের বালাই ছিল না। শুধু এক টুকরো চিতা বাঘের চামড়া কোমরে শক্ত করে পেঁচিয়ে রাখত তারা। আর তা উপর ছোট্ট একটা খরগোশের চামড়ার খাপে ঝুলিয়ে রাখত ঝকঝকে ইস্পাতের ছোরা। সামান্য কারণেই জংলিরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাঁটি করে এ ওর বুকে ঐসব তীক্ষ্ম ইস্পাতের টুকরোগুলো বসিয়ে দিত। তারা পশুদের মাংশ আগুনে ঝলসিয়ে খেত। আর পাহাড়ি ফুলের মধু পঁচিয়ে এক প্রকার উগ্র রস খেয় নাচতে খুব ভালবাসত।
এই সমস্ত পাহাড়িদের মধ্যে মিকা এবং মিমাই গোত্রই ছিল প্রধান। যদিও মিকা আর মিমাইরা একই অঞ্চলে পাশাপাশি বাস করত তবু তাদের এতটুকু মিল ছিল না। একটু সুযোগ পেলেই একদল আরেক দলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের লুটতরাজ করত। আজকাল কিন্তু এই পাহাড় অঞ্চলে মিকা আর মিমাই নামে আলাদা আলাদা কোনো পাহাড়ি জাত নেই। তার বদলে আছে নতুন এক পাহাড়ি জাত টিপরাই। মিকা আর মিমাইরা আজ এক হয়ে মিশে এই নতুন জাতের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু কি করে মিকা আর মিমাইরা তাদের বংশগত শত্রুতা ভুলে গিয়ে এক হয়ে গেল, এ সম্বন্ধে করুণ কাহিনী পাহাড়ি এলাকায় শুনতে পাওয়া যায়।
মিমাই গোত্রের সর্দারের একটি চমৎকার ফুটফুটে ছেলে ছিল। নাম ছিল তার ইয়ান। বয়স তের কি চৌদ্দ হবে। বয়সের তুলনায় তার স্বাস্থ্য ছিল আরও সুন্দর। কিন্তু মিমাই গোত্রের সমস্ত আদিম মেয়ে-পুরুষ তাকে ভালবাসত তার অদ্ভুত বীরত্বের জন্য। ইয়ান চমৎকার তীর ছুঁড়তে জানত। সে যে জিনিসটাকে লক্ষ্য করে তীর চালাত, তীরটা গিয়ে ঠিক সেই জিনিসটার ওপর খচ করে বিঁধে যেত। বাচ্চা হরিণ শিকারেও ইয়ান ছিল ভারি ওস্তাদ। বীরও ছিল সে তেমনি। ইয়ানের বীরত্বে মিমাইরা খুব গর্ব অনুভব করত। কারণ তারা ভাবত, ইয়ান যখন বড় হয়ে তাদের সর্দার হবে তখন মিমাইদের সাথে যুদ্ধে কেউ আর জিততে পারবে না। তাই তারা সর্বদাই তাকে আদর করত, চমৎকার তীর ধনুক আর ছোরা উপহার দিত।
এদিকে মিকাদের সর্দারেরও একটি চমৎকার ছেলে ছিল। তারও বয়স ছিল ইয়ানের মতই বার কি চৌদ্দ। তার মাথায় ঘাড় পর্যন্ত লম্বা রেশমী চিকন সুন্দর চুল ছিল। সে বাঘের চামড়ার বদলে কোমরে বেঁধে রাখত একখ- হরিণের চামড়া। মিকাদের এই সর্দারের ছেলেটির নাম ছিল তাসেন। কিন্তু হলে কী হবে, তাসেন কিন্তু ইয়ানের মত তীর ছুঁড়তে জানত না। চকচকে ছোরা দেখলে কেঁদে ফেলত। মোটকথা, যুদ্ধ-হানাহানি তাসেন মোটেই পছন্দ করত না। হঠাৎ যখন মিকাদের সাথে মিমাইদের লড়াই বাধত তাসেন দলছাড়া হয়ে পুবের পাহাড়ের দিকে চলে যেত- যেখানে ছিলো মিকা আর মিমাইদের নীল পাথরের দেবতা। বৎসরের একটা সময়ে মিকা আর মিমাইরা তাদের রক্তারক্তি ভুলে গিয়ে এই দেব-মূর্তির পায়ে পূজোর ফুল দিয়ে আসত। তখন কেউ অস্ত্র-শস্ত্র হাতে নিত না। সে জন্যই যখন লড়াই হাঙ্গামা হত সে সময় তাসেন এই দেবতার পাহাড়ের উপর চলে আসত। আর বিগ্রহের পায়ের কাছে পড়ে আকুলভাবে প্রার্থনা করত মিকা আর মিমাইদের যুদ্ধ বন্ধ করার সুমতি দেবার জন্যে। যখনই যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যেত তখনই তাসেন হাসিমুখে তার গোত্রে ফিরে আসত।
ইয়ানের মত তাসেনেরও একটা মস্ত গুণ ছিল। সে তীর ছুঁড়তে পারত না বটে, কিন্তু সে এক অদ্ভুত সুরে বাঁশি বাজাত যা শুনলে শত্রুরও হাত থেকে তীর খসে যেত। হিংস্র বাঘ একটা ছাগলের মত নিরীহ হয়ে যেত। তাসেন যখন ঝর্ণার কাছে একটা পাথরে ঢিবির ওপর বসে তার সুন্দর বাঁশিটিতে ফুঁ দিত, তখন ঝর্ণার আশে-পাশের ঝোঁপ-জঙ্গল থেকে হরিণ শিশুরা নির্ভয়ে বেরিয়ে এসে পাথরের ঢিবিটার চারদিকে নাচতে নাচতে খেলা শুরু করে দিত। তাসেনের এই অদ্ভুত গুণের জন্যে মিকারাও তাকে খুব ভালবাসত। কেমন করে মিমাই আর মিকারা সমস্ত শত্রুতা একদম ভুলে গেল, এবার সেই আসল কাহিনীটি বলছি:
তখন ছিল শীতকাল। গাছের পাতা ঝরে পড়ে সমস্ত পাহাড়ি অঞ্চলটা তখন শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে যেসব লতা-গুল্ম জন্মাত সেগুলোও আর নেই। সব শুকিয়ে গেছে। এমনি এক পূর্ণিমার রাতে মিকাদের ছেলে তাসেন একা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বাঁশি বাজাচ্ছিল। শাল পাতার ছাউনিতে মিকা গোত্রের সমস্ত মেয়ে-পুরুষ তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু তাসেন ছাড়া পাহাড়ের চূড়াটায় তখন আর কেউ ছিল না। তার বাঁশির মধুর সুরে সমস্ত পাহাড়টা যেন ভেসে যাচ্ছিল।
এখন ব্যাপার হল কি- তাসেন যে পাহাড় চূড়ায় বসে বাঁশি বাজাচ্ছিল ঠিক তার নিকটেই ছিল মিমাইদের বাস করবার ঘরগুলি। মিমাইরা সারা দিন বন্য পশু শিকার করে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে তাদের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাদের একটা গুহার ভেতরে ইয়ানও অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। হঠাৎ একটা পিঁপড়ের কামড়ে ইয়ানের ঘুম ভেঙে গেল। জেগেই সে শুনতে পেল একটা মিষ্টি বাঁশির সুর। অবাক হয়ে গেল সে। এমন মধুর বাঁশির সুর সে জীবনে কোনদিন শোনেনি। সে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল : কে বাজায় এমন মধুর সুরে বাঁশি! অবশেষে সে বুঝতে পারল, এ মিকা সর্দারের ছেলে তাসেন ছাড়া আর কেউ নয়। ইয়ান কিন্তু তাসেনকে কোনোদিন দেখেনি-  তবে সে যে চমৎকার মিষ্টি সুরে বাঁশি বাজাতে পারে তা কারো কারো মুখে শুনেছিল। এখন ইয়ান এই রাত্রির নিস্তব্ধতায় শুয়ে থেকে নিজের কানে তাসেনের অপূর্ব বাঁশির সুর শুনল। ভাবল, সত্যিই তো এমন মধুর সুরকারের সঙ্গে ভাব করে সেও তার কাছ থেকে অমন মিষ্টি সুরে বাঁশি বাজানোটা শিখে নেবে।
ইয়ান রাত্রির অন্ধকারে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তার বাপ, মা, আত্মীয-স্বজন এমনকি তাদের সারা মিমাই গোত্র অঘোরে ঘুমোচ্ছিল, তাই কেউ কিছু জানতে পারল না। ইয়ান দেখল, তার ছোরাটা চামড়ার খাপে ঠিকমতো কোমরে ঝোলানো আছে কি না।
যে দিক থেকে বাঁশির মিষ্টি সুর ভেসে আসছিল সেই দিক লক্ষ্য করে উঁচু পাহাড়টার ওপরে উঠতে লাগল ইয়ান। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে এসে পৌঁছল পাহাড়টার চূড়ায়। তাসেন তখন আপন মনে বাঁশি বাজাচ্ছিল। ইয়ান কখন যে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তাসেন মোটেই তা টের পায়নি। ইয়ান তখন তাসেনের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য একটা বিরাট পাথরের টুকরো পাহাড়ের চূড়া থেকে দু’হাতে তুলে নিয়ে ঢালুর দিকে ছেড়ে দিল। আর পাথরটাও তাসেনের পায়ের নিকট দিয়ে ভয়ানক শব্দ করতে করতে নিচের দিকে গড়াতে শুরু করে দিল। তাসেন বাঁশি বাজানো বন্ধ করে এক লাফে উঠে দাঁড়াল। ইয়ান তখন মিষ্টি মিষ্টি হাসছে। তাসেন মুখ ঘুরিয়েই দেখতে পেল ইয়ানকে। তার পরনে মিমাইদের মতো চিতে বাঘের পোশাক দেখে তাসেন ঘাবড়ে গেল। সে ইয়ানের একটু সামনে এগিয়ে এসে বলল : ‘ভাই তোমাকে দেখে তো মিমাইদের ছেলে বলে মনে হচ্ছে, মিকাদের এই পাহাড় চূড়ায় কোন সাহসে এসেছ তুমি? আমাদের গোত্রের লোকরা দেখতে পেলে এক্ষুণি তোমাকে তীর মেরে গেঁথে ফেলবে।’
ইয়ান তখন হাসতে হাসতে তাসেনের হাত ধরে বলল : ‘হ্যাঁ ভাই আমি মিমাইদের ছেলে। আমার নাম ইয়ান। আমি তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে এসেছি। তুমি আমাকে বাঁশি বাজানো শিখিয়ে দাও।’
ইয়ানের নাম শুনেই তাসেন তাকে জড়িয়ে ধরে বলল : ‘তোমার নামই ইয়ান। তোমার প্রশংসা প্রায়ই আমাদের যোদ্ধারা করে থাকে। তুমি নাকি চমৎকার তীর চালাতে জানো। হরিণ শিকারেও তোমার জুড়ি নেই বলে শুনেছি।’
ইয়ান বলল : ‘তীর চালাতে জানি সত্য, কিন্তু ওসব আমার মোটেই ভালো লাগে না। রক্তারক্তি আমার খুব খারাপ লাগে। শুধু আমাদের গোত্রের লোকেরা অনর্থক আমাকে খুনোখুনি করতে ক্ষেপিয়ে তোলে। আমি এবার থেকে আর কোনোদিনই তীর ছুঁড়তে চাই না। তুমি আমাকে বাঁশি বাজানো শিখিয়ে দাও। আমি শুধু বনে বনে বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে ঘুরে বেড়াব।’
তাসেন ইয়ানের কথা শুনে খুব খুশি হল। সে তার কোমরের হরিণ চামড়ার পকেট থেকে চমৎকার গন্ধযুক্ত কস্তুরী ইয়ানকে দিল। পাহাড়ীদের মধ্যে একটা প্রা প্রচলিত আছে, পরস্পর বিরুদ্ধ দলের দুজন লোক যদি হঠাৎ কোনো কারণে বন্ধু হতে চায় তা হলে একে অপরকে গন্ধযুক্ত মৃগনাভ উপহার দেয়। তারপর তারা আর কোনোদিন একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেয় না। ইয়ান তাসেনও এভাবেই চিরদিন বন্ধু থাকবে বলে প্রতিজ্ঞা করল।
এদিকে ব্যাপার হয়েছে কি- তাসেন আর ইয়ান যখন পাহাড়টার চূড়ায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল ঠিক সেই সময়ে মিমাইদের এলাকা থেকে যুদ্ধের বাজনা বেজে উঠল। বাজনাটা শুনেই ইয়ান হকচকিয়ে গেল। ভয়ে তখন তাসেনের মুখটাও রক্তহীন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
ইয়ান তাকে অভয় দিয়ে বলল : ‘ভয় নেই তাসেন। এটা যুদ্ধের বাজনা না হয়ে নাচের বাজনাও হতে পারে। দাঁড়াও, আমি ভালো করে বাজনার শব্দটা শুনছি।’ ইয়ান উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগল বাজনার শব্দটা মনোযোগ দিয়ে। একটু শোনার পরই শব্দটা ইয়ানের কানে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ল। দ্রিমি-দ্রিমি-দ্রিমি, অর্থাৎ মারো-কাটো-মারো। বাজনার শব্দের অর্থ বুঝতে পেরে ইয়ানের চোখে পানি এসে গেল। কেঁদেই ফেলল সে। তাসেন ইয়ানকে ইতস্তত করতে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার কি বন্ধু? আমার মনে হচ্ছে এ তো লড়াই এর বাজনা বন্ধু।’ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল ইয়ান।
তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছো, হঠাৎ অমন গভীর রাতে মিমাইদের লড়াই করবার শখ হল কেন? আসল ব্যাপারটা হল, ইয়ান যখন পাহাড়টার চূড়ায় উঠেই প্রথমেই তাসেনকে তন্ময় হয়ে বাঁশি বাজাতে দেখে,ত তার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য যে ভারী পাথরটা নিচের দিকে ফেলেছিল সেটাই গড়াতে গড়াতে মিমাইদের এলাকায় গিয়ে এই গোলমাল বাধিয়েছে। পাথরটা যখন ভয়ঙ্কর শব্দ করে মিমাইদের ঘুমন্ত এলাকায় গিয়ে পড়ল তৎক্ষণাৎ সমস্ত পাহাড়ি পল্লীটার ঘুম ভেঙে গেছে। তারা সবাই তাদের শাল পাতার বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল ব্যাপারটা কি জানতে। মিমাইরা যখন পাথর পড়ার কারণ অনুসন্ধানে ব্যস্ত, তখুনি তাদের দলের একজন লোক বলে উঠল আমাদের ইয়ানকে তো দেখছিনে! সবাই ভাবল : তাই তো! আমাদের ইয়ান কোথায়! তৎক্ষণাৎ কয়েকজন পাহাড়ি ছেলে ইয়ানের খোঁজে বেরিয় গেল। সমস্ত মিমাই পল্লীটা তারা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ইয়ানকে পেল না। তারা এসে তাড়াতাড়ি মিমাই যোদ্ধাদের কাছে খবরটা দিল। ইয়ানকে না পেয়ে মিমাইরা ভয়ানক ক্ষেপে গেল। কারণ, তারা ভাবল, এটা মিকাদের চালাকি। তারাই তাদের বীর সন্তানকে চুরি করে নিয়ে গেছে। রাগে, দুঃখে, অপমানে মিমাই সর্দারের চোখে পানি এল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে হুকুম করল, ‘যুদ্ধের বাজনা বাজাও। আজ মিকা গোত্রের সমস্ত মেয়ে-পুরুষদের হত্যা করতে চাই।’
তারপর পুবের পাহাড়টার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘আমরা আগে মিকাদের ওই পাহাড় চূড়াটা দখল করে নেব। তারপর ওটার উপর থেকে তীর আর পাথর মেরে থেতলে দেব সমস্ত মিকা গোত্রকে।’ তার কথার সাথে সাথেই মিমাইদের যুদ্ধের ঢোলগুলো একসঙ্গে বেজে উঠল, দ্রিমি-দ্রিমি-দ্রিমি, দ্রিমি-দ্রিমি-দ্রিমি। মারো-কাটো-মারো। মৃত্যুর ইঙ্গিতে সমস্ত পাহাড়ি অঞ্চলটা হঠাৎ আঁতকে উঠল যেন। নিদারুণ ভয়ে গাছের পাতাগুলো পর্যন্ত কাঁপতে লাগল। ঢোলের আওয়াজের সাথে সাথে মিমাই যোদ্ধাদের বুকের ভেতর রক্ত নেচে উঠল। বীভৎস চিৎকার করতে করতে তারা ইয়ান আর তাসে যে পাহাড় চূড়াটায় ছিল সেটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
এদিকে মিমাইদের লড়াইয়ের দামামা শুনে তখন মিকাদেরও ঘুম ভেঙে গেছে। তারাও মিকাইদের মতো দারুণ ভুল করে বসল। মিকারা যখন তাদের তাসেনকে নিজেদের দলের মধ্যে কিংবা সারাটা মিকা পল্লীতে খুঁজে পেলে না, তখন ভাবল মিকাইরাই তাদের তাসেনকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে এখন যুদ্ধের বাজনা বাজিয়ে মিকাদের আহবান করছে। মিকা যোদ্ধারাও রেগে আগুন হয়ে গেল। মিকাদের সর্দারও চিৎকার করে হুকুম দিল : ‘বাজাও লড়াইয়ের ঢোল। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার ছেলেকে জীবিত অবস্থায় মুক্ত করে আনতে না পারি, ততক্ষণ আমরা ওদের সাথে লড়ব। যদি ওরা তাসেনকে হত্যা করে, তবে আমরাও মিমাইদের সমস্ত লোকজনকে কেটে টুকরো টুকরো করে তাদের মাংসগুলো সমস্ত পাহাড়টায় ছড়িয়ে দেব।’
এভাবে মিকা আর মিমাইরা আসল ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে নিজেদের হিংস্র মনেবৃত্তি নিয়ে পাহাড়টা দিকে অগ্রসর হতে লাগল। ওদিকে তাসেন আর ইয়ান একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপছে। চাঁদের আলোয় তারা স্পষ্ট দেখতে পেল মিকা আর মিমাইরা লড়াই করার জন্য ছুটে আসছে। তারা শুধু শুনল ঢোলের আওয়াজ। একদিকের ঢোলগুলো বলছে-
দ্রিমি-দ্রিমি-দ্রিমি, মারো-কাটো-মারো, আর অন্যদিকের ঢোলগুলো বলছে- দ্রাম-দ্রাই-দ্রাম অর্থাৎ রক্ত চাই, রক্ত! তাসেন আর ইয়ান কা- দেখে অস্থির হয়ে উঠল। কিন্তু পালাবার আর কোনো পথ দেখতে পেল না। যে দুটো পথ নিচের দিকে নামা যায় ঠিক সেই দুটো পথ দিয়েই এগিয়ে আসছে দুই দল। তাসেন আর ইয়ান শুধু অবুঝের মতো তাকিয়ে রইল। ওরা তখন পাহাড়ের চূড়ার বেশ কাছে এসে পড়েছে। তখন তারা চাঁদের আলোয় ইয়ান ও তাসেনকে দেখতে পেল। কিন্তু দুঃখের বিষয় অস্পষ্ট ঠাণ্ডা আলোয় তারা তাদের নিজেদের সন্তানকে চিনতে পারল না। বরং উল্টো সাংঘাতিক বোকামি করে বসল। মিকারা ভাবল সর্বনাশ! মিমাইরাই পাহাড় চূড়া দখল করে নিয়েছে। আর মিমাইরাও মনে করল, মিকারা পাহাড় চূড়ায় উঠে এসেছে। আর উপায় নেই! যেই না ভাবা অমনি উভয় দলই ঝাঁকে ঝাঁকে বিষাক্ত তীর ছুঁড়তে লাগল পাহাড়টার উপর দিকে। ইয়ান আর তাসেন কিছু বুঝবার আগেই কয়েকটা বিষাক্ত তীর এসে তাদের দুজনেরই বুকে পিঠে গেঁথে গেল। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে সেখানেই শান্তির ঘুমে ঘুমিয়ে গেল। আর তারা নড়ল না। দু’বন্ধুর রক্তে পাহাড় চূড়ার কঠিন পাথর লাল হয়ে গেল। মিকারা জানতে পারল না যে তাদের হাতের তীর গিয়ে বিদ্ধ হয়েছে তাদেরই প্রাণপ্রিয় তাসেনের বুকে। আর মিমাইরাও বুঝল না তারাই ইয়ানকে হত্যা করেছে। মিকা আর মিমাইরা শুধু অনবরত তীর চালাতে লাগল পাহাড়টার শীর্ষ দেশে। কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না ব্যাপারটা। কারণ তখন ভোর হয়ে এসেছে। হঠাৎ পুবের পাহাড় দুভাগ করে সূর্য উঠে এল। রাঙা আলো ছড়িয়ে পড়লো গাছের পাতায় পাতায়, পাহাড়ের চূড়ায় আর অসভ্য পাহাড়ি জাতি মিকা আর মিমাইদের চোখের ওপর। মিষ্টি ভোরের আলোয় যখন তারা পাহাড় চূড়ার দিকে তাকাল তখনই দেখতে পেল রাতের অন্ধকারে তারা কি মারাত্মক ভুল করে বসেছে। পাহাড় চূড়া থেকে তারা খুব বেশি দূরে ছিল না। ইয়ান-তাসেনের তীরবিদ্ধ মৃতদেহ দুটো চিনতে কষ্ট হল না জংলীদের। অস্ত্র-শস্ত্র হাতে তারা যখন পরস্পরকে আক্রমণ করতে পাহাড় চূড়ায় উঠে এল তখনই তারা বাধা পেল ইয়ান আর তাসেনের তীরবিদ্ধ মৃতদেহ দুটোয়। তারা আরও দেখল, ইয়ান আর তাসেনের বুকের রক্তের ক্ষীণ ধারা এক হয়ে শুকিয়ে গেছে। আর তাদের রক্তধারা যেখানে মিশেছে ঠিক সেখানেই লাল রক্তের উপর পড়ে রয়েছে একটি গন্ধযুক্ত কস্তুরী। এই বন্ধুত্বের প্রতীক দেখেই মিকা আর মিমাইদের হাত থেকে তীর ধনুক খসে পড়ল। আসল ভুলটা বুঝতে পেরে মিকা আর মিমাইদের সর্দাররা সেখানে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল। এরপর আর কোনো দিন মিকা আর মিমাইরা পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেনি, এখন সেই পাহাড় চূড়াটা জংলীদের কাছে পবিত্র তীর্থস্থান। জংলীরা বলে : ‘গভীর রাতে সে পাহাড় চূড়ায় গেলে, একটা মিষ্টি গন্ধ বাতাসের সাথে নাকে এসে লাগে। গন্ধটা নাকি ঠিক কস্তুরীর গন্ধের মতো।’

Share.

মন্তব্য করুন