রহস্যময় পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে নানান কৌতূহলী জিনিস। বিজ্ঞানীরা এসব রহস্যভেদে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। নানা তথ্য জানা যাচ্ছে তাদের আবিষ্কারের মাধ্যমে। তেমনি একটি অদ্ভুত আবিষ্কার ড্রপা পাথর। কী ধরনের রহস্য লুকিয়ে আছে এই পাথরের মাঝে!
১৯৩৮ সালে একদল প্রত্নতাত্ত্বিক কর্তৃক তিব্বতের গুহা থেকে উদ্ধার হয় বেশ কিছু অদ্ভুত পাথুরে চাকতি। বেশ কয়েক বছর গবেষণার পর এক অধ্যাপক এর বুকে খোদাই করা পাণ্ডুলিপির অর্থভেদ করতে সক্ষম হন বলে দাবি করেন। সেখানে তিনি জানতে পারেন ড্রপা নামক ভিনগ্রহীদের আগমনের কথা।
বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক চি পু তেই প্রায়ই তার ছাত্রদের নিয়ে ইতিহাসের সন্ধানে বের হতেন। বিভিনড়ব পর্বতের গুহা, ঐতিহাসিক স্থাপনা, মন্দির প্রভৃতি স্থানে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সন্ধান করতেন।
তেমনি ১৯৩৮ সালের শেষের দিকে তিনি একদল ছাত্রসহ তিব্বত সীমান্তে অভিযানে বের হন। তিব্বতের বায়ান কারা উলা পর্বতের বেশ কিছু গুহা পর্যবেক্ষণ করছিলেন তিনি। হঠাৎ কয়েকজন ছাত্র এক অদ্ভুত গুহার সন্ধান লাভ করে। গুহাটি বাইরে থেকে দেখতে বেশ অদ্ভুত লাগছিলো। গুহার দেয়াল বেশ মসৃণ ছিল। বসবাসের উপযোগী করে তুলতে কারা যেন ভারি যন্ত্রপাতি দিয়ে গুহার পাথর কেটে মসৃণ করে তুলেছে। তারা অধ্যাপককে গুহার ব্যাপারে অবগত করেন।
তিনি দলবল নিয়ে গুহার ভেতর প্রবেশ করেন। গুহার ভেতরটা বেশ উষ্ণ ছিল। অনুসন্ধানের একপর্যায়ে তারা বেশ কিছু সারিবদ্ধ কবরের সন্ধান লাভ করেন। প্রায় ৪ ফুট ৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যরে কবরগুলো খনন করতেই বেরিয়ে এলো মৃত মানুষের হাড়গোড়। কিন্তু কংকালের মাথার খুলিসহ বিভিন্ন হাড় স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় আকারে বেশ বড় ছিল।
কবরের বুকে কোনো নামফলক ছিল না। তাই এগুলো কাদের কবর হতে পারে, তা জানার কোনো সুযোগ ছিল না। অধ্যাপকের নির্দেশে ছাত্ররা গুহাটি আরও ভালো করে খুঁজে দেখতে লাগলো। একপর্যায়ে তারা এক ফুট ব্যাসার্ধের শত শত পাথুরে চাকতির সন্ধান লাভ করে। পাথরের গায়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিষয়বস্তু, যেমন- সূর্য, চন্দ্র, পাখি, ফল, বৃক্ষ প্রভৃতি বেশ যতড়ব করে খোদাই করা ছিল। অধ্যাপক চি পু তেই প্রায় কয়েক শ’ চাকতি নিয়ে বেইজিংয়ে ফেরত যান। তিনি অন্যান্য অধ্যাপকের নিকট এই অনুসন্ধান সম্পর্কে বিবৃতি প্রদান করেন। তার হিসাবানুযায়ী চাকতিগুলো প্রায় ১২ হাজার বছরের পুরান। ধীরে ধীরে চীন ছাড়িয়ে পুরো পৃথিবীতে এই পাথুরে চাকতির গল্প ছড়িয়ে পড়ে। গবেষকগণ এই পাথুরে চাকতির নাম দেন ‘ড্রপা পাথর’।
ভিনগ্রহীদের মুদ্রাড্রপা পাথরের গায়ের সাংকেতিক ভাষা ভেদ করার লক্ষ্যে গবেষণা শুরু হয়। আর পৃথিবীবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। সবাই জানতে চায়, পাথরের গায়ে হাজারো সংকেতের মাঝে কোন অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে।
ড্রপা পাথরের ‘ড্রপা’ নামের আবিষ্কারক বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের রহস্যময় গবেষক সুমউম নেই। ড্রপা পাথর আবিষ্কারের প্রায় বিশ বছর পর তিনি গবেষণা শুরু করেন। প্রায় চার বছরের গবেষণা শেষে দুর্ভেদ্য ড্রপার রহস্য সমাধান করতে সক্ষম হন তিনি। তিনি এক জার্নালের মাধ্যমে দাবি করেন, পাথরের গায়ে হায়ারোগ্লিফিক বর্ণ দ্বারা ‘ড্রপা’ নামক এক ভিনগ্রহী জাতির সফরনামা লিখিত রয়েছে। ‘ভিনগ্রহী’ কিংবা ‘এলিয়েন’ শব্দটি শোনা মাত্রই সবার টনক নড়ে ওঠে। সবাই আগ্রহী হয়ে ওঠে এই পাথুরে চাকতির ব্যাপারে। সুম উম নেই এর মতে এটা ভিনগ্রহীদেরই কারসাজি। তিনি একটি চাকতি সম্পূর্ণ অনুবাদ করেন। তার অনুবাদের মর্মার্থ হচ্ছে, আমরা (ড্রপারা) মেঘের ওপর থেকে মহাকাশযানে চড়ে মাটিতে অবতরণ করি। আমরা, আমাদের সন্তানেরা এই গুহায় প্রায় দশ সূর্যোদয় পর্যন্ত লুকিয়ে থাকি। কয়েক দিন পর যখন আমরা স্থানীয়দের দেখা পাই, তখন তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। ইশারায় যোগাযোগ করতে সক্ষম হওয়ায় আমরা গুহা থেকে বেরিয়ে আসি।
এরপর থেকেই চাকতিগুলো ড্রপা পাথর নামে পরিচিতি লাভ করে। সুম উম নেই ১৯৬২ সালে তার গবেষণা নিয়ে সম্পূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। কিন্তু তার গবেষণার ফলাফল অন্যান্যরা মেনে নেননি। সুম উম নেইয়ের অনুবাদের যথেষ্ট অসঙ্গতি ধরা পড়ে। ইতিহাসবিদ এবং পুরা তত্ত্ববিদগণের ছুঁড়ে দেয়া বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হন তিনি। জানা যায়, তিনি ব্যর্থতার দায়ভার মাথায় নিয়ে জাপানে নির্বাসনে চলে যান। এর অল্প কিছুদিন পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আপাতদৃষ্টিতে সুম উম নেইয়ের করুণ পরিণতির কথা জেনে অনেকেই মর্মাহত হবেন। কিন্তু সুম উম নেই এর রহস্য এখনও শেষ হয়নি। বলতে গেলে শুরু হলো মাত্র!
১৯৬৮ সালে ড্রপা পাথর রুশ বিজ্ঞানী ভায়াস্লভ সাইজেভ এর গবেষণাগারে স্থানান্তরিত হয়। তিনি চাকতির বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা চালান। তার মতে, ড্রপা পাথরের গঠন অন্যান্য পাথরের চেয়ে আলাদা। পাথরগুলো মূলত এক ধরনের গ্রানাইট পাথর যার মাঝে কোবাল্টের পরিমাণ অনেক বেশি। কোবাল্টের উপস্থিতি পাথরটিকে স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্ত শক্ত করে তুলেছে। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, তৎকালীন অধিবাসীরা ঠিক কিভাবে এই শক্ত পাথরের মাঝে সাংকেতিক চিহ্ন খোদাই করেছেন? সাংকেতিক চিহ্নগুলো আকারে ছোট হওয়ায় এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। সাইজেভের মতে, প্রাচীনকালে এমন কোনো পদ্ধতি ছিল না যা দিয়ে এরূপ পাথরের মাঝে খোদাই করা সম্ভব!
সোভিয়েত ম্যাগাজিন ‘স্পুটনিক’ এর এক বিশেষ সংস্করণে এই পাথর সম্পর্কে আরও অনেক অদ্ভুত তথ্য জানা যায়। রুশ বিজ্ঞানীরা অসিলোগ্রাফের মাধ্যমে এই পাথর পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন যে, কোনো একসময়ে এই পাথরকে বৈদ্যুতিক বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু কখন বা কিভাবে? এর উত্তর তারা দিতে পারেননি।
পরবর্তী ঘটনার সময়কাল ১৯৭৪ সাল। অস্ট্রীয় প্রকৌশলী আর্নেস্ট ওয়েগারার সেবার চীনের বানপোজাদুঘর পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ড্রপা পাথরের দুটো চাকতি দেখতে পান। তিনি কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে চাকতি দুটোকে ক্যামেরাবন্দী করেন। পরবর্তীতে তিনি অস্ট্রিয়া ফিরে যাওয়ার পরে ক্যামেরার ছবিগুলো পরীক্ষা করছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকের কারণে চাকতির হায়ারোগ্লিফিক লিপিগুলো পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েনি।
ভিনগ্রহীদের মুদ্রাকিন্তু এই ঘটনার কিছুদিন পরেই তৎকালীন জাদুঘরের মহাব্যবস্থাপককে বিনা কারণে বরখাস্ত করা হয় এবং চাকতি দুটো ধ্বংস করে ফেলা হয়। ১৯৯৪ সালে জার্মান বিজ্ঞানী হার্টউইগ হসডরফ বানপো জাদুঘর পরিদর্শনকালে সেই চাকতি সম্পর্কে জানতে চান। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাকে এই ব্যাপারে কোনো তথ্যপ্রদান করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি চীনা সরকারি নথিপত্র খতিয়ে দেখেন। হসডরফ চীনা সরকারের নথিপত্র ঘেঁটে কোথাও ড্রপা জাতির কোনো নামগন্ধের খোঁজ পাননি!
এই রহস্যময় ঘটনার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ড্রপা পাথর গবেষণার প্রবাদ পুরুষ ধরা হয় রহস্যময় ‘সুম উম নেই’-কে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সুম উম নেইয়ের সাথে পরিচিত হন ১৯৬২ সালে প্রকাশিত একটি জার্নালের মাধ্যমে। তাকে জনসম্মুখে কখনও দেখা যায়নি। এমনকি ড্রপা পাথর ব্যতীত আর কোথাও সুম উম নেইয়ের নাম নেই।
একটা সময় গুঞ্জন উঠলো, সুম উম নেই কোনো চীনা নাম নয়। খুব সম্ভবত এটি একটি জাপানিজ নাম। এভাবে সুম উম নেইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ ওঠায় তার অনুবাদ নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। শুরু থেকেই রহস্যের জন্ম দেয়া সুম উম নেই শেষ পর্যন্ত নিজেই এক রহস্য হিসেবে বিদায় নিলেন।
কিন্তু ধীরে ধীরে ড্রপার রহস্য আরও ঘনীভূত হতে থাকে। একটা সময় দেখা গেলো, অধ্যাপক চি পু তেই, ভায়াস্লভ সাইজেভ, আর্নেস্ট ওয়েগারার প্রমুখ ব্যক্তিত্বের গবেষণা এবং অস্তিত্ব নিয়েও পুরাতত্ত্ববিদগণ সন্দিহান হয়ে পড়েন। ড্রপা পাথর আবিষ্কারের সময় তিব্বত সীমান্তে ‘ড্রকপা’ এবং ‘হাম’ নামক দুই উপজাতির বসবাস ছিল। কিন্তু তাদের ইতিহাসের কোথাও এরূপ ভিনগ্রহী আগ্রাসনের ঘটনা উল্লেখ করা নেই। আর ড্রকপারা নিঃসন্দেহে মানুষ, ভিনগ্রহী কোনো প্রজাতি নয়! ড্রপা পাথর নিয়ে বহু গবেষণা হলেও নানা বিতর্কের কারণে গবেষণার অগ্রগতি একদম শূন্যই বলা যায়। ড্রপা পাথর নিয়ে রহস্যের কোনো সমাধান না হলে হয়তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যই অজানা থেকে যাবে।

Share.

মন্তব্য করুন