রাতুলরা ঢাকায় একটি সরকারি কলোনির ফ্ল্যাট বাসায় থাকে। রাতুলের বাবা দীর্ঘদিন ধরে সরকারি চাকরি করেন বিধায় সরকার থেকে রাতুলদেরকে গত ৩ মাস আগে ঢাকায় সরকারি কলোনিতে ফ্ল্যাটটি দেয়া হয়। এর আগে ওরা গ্রামে থাকতো, আর ওর বাবা ঢাকায় মেসে থেকে চাকরি করতেন। কলোনিতে রাতুলরা নতুন। মাত্র ১ মাস হলো কলোনিতে গ্রাম থেকে এসেছে। ওর মা গৃহিণী।
কলোনিতে আসার পর ওর মায়ের সাথে কলোনির অন্যান্য আন্টিদের ভালোই মেলবন্ধনের সৃষ্টি হয়। প্রায় সময় সংসারের কাজ কর্ম শেষ হলে রাতুলের মা পাশের ফ্ল্যাটের আন্টিদের সাথে গল্প গুজবেই সময় কাটায়। আবার অনেক সময় শখের বশে আন্টিদের সাথে নানান রকমের সুতার মাধ্যমে হাতের কাজও করে থাকে। রাতুলের এক ছোট বোন রয়েছে। রাতুল এবার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। আর ওর ছোট বোন ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ে। ওরা ভাইবোন কলোনির ভেতরে অবস্থিত বেসরকারি স্কুলে লেখাপড়া করে। এই ৩ মাসে কলোনির ভেতরে ওদের অনেক বন্ধু-বান্ধব তৈরি হয়েছে। ওর বোন বান্ধবীদের সাথে বেশির ভাগ সময় ছাদে ও বারান্দাতে খেলাধুলা করে থাকে। আর রাতুল কলোনির ভেতরের খেলার মাঠেই ওর বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করে থাকে। এক কথায় বলতে গেলে ওদের খেলাধুলা করার জন্য কলোনির বাইরে যেতে হয় না। তা ছাড়া ওদের কলোনির ভেতরে একটি পার্কও রয়েছে। পার্কটি খোলা থাকে শুধুমাত্র বিকেল বেলায়।
তাই বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝে বিকেলের সময়টা পার্কে কাটায়। রাতুল স্কুলের মর্নিং শিফটে পড়ে। স্কুল ছুটি হয় বেলা ১টার দিকে। এই সময়ে দুপুরের সূর্য খারা মাথার ওপরে থাকে। আকাশে মেঘ না থাকলে প্রচন্ড তাপের সৃষ্টি হয়। একদিন এমনই প্রচন্ড তাপের দুপুরে রাতুল স্কুল থেকে বাসায় ফিরে আসার সময় ওদের বাসার সামনের আমগাছ তলার নিচে দূর থেকে দেখতে পায় একজন বুড়ো লোক বসে হাঁপাচ্ছে। কিছুটা সামনের দিকে এসে বুঝতে পারে লোকটি একজন বুড়ো বয়স্ক ফেরিওয়ালা। রাতুল বুড়ো ফেরিওয়ালার একদম সামনে যেতেই তিনি বেশ অনুরোধ সূচক বাক্যে রাতুলের কাছে এক গ্লাস পানির আবেদন করে। তারপর রাতুল দ্রুত গতিতে সিঁড়ি বেয়ে বাসায় গিয়ে কাঁধ থেকে ব্যাগ না রেখেই সোজা ফ্রিজ থেকে গ্লাস ভরে ঠান্ডা পানি নিয়ে বুড়ো ফেরিওয়ালাকে দেয়। ঠান্ডা পানি পান করে অনেক শান্তি উপভোগ করে। তারপর বুড়ো ফেরিওয়ালা রাতুলকে বুকে টেনে নেয়। রাতুল তখন তাকে বলে,
– আমি তোমাকে চাচা বলে ডাকতে পারি? আমারতো কোনো চাচা নেই।
তারপর তিনি বলেন,
– অবশ্যই ডাকতে পারো।
এতে করে রাতুল তখন খুব গর্ববোধ করে। রাতুল বুড়ো ফেরিওয়ালা চাচাকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কথা জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথেই তিনি কেঁদে দেন।
তারপর রাতুল বলে,
– তুমি কাঁদছো কেন?
উত্তরে কান্নার স্বরে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয় বলেন,
– আমার আর কেউ নেই।
রাতুল জানতে চায়,
– কেন?
তিনি বলেন,
– গত ৪ বছর আগে এক দুর্ঘটনায় আমি ছাড়া আমার পরিবারের সবাই মারা যায়। আমাদের আর্থিক অবস্থা কখনোই ভালো ছিলো না। দরিদ্রতার সংস্পর্শে ছোট থেকে বড় হয়েছি। ঐ দুর্ঘটনার পর থেকেই পেটের দায়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ফেরিওয়ালার কাজ করি। কথাগুলো শোনে ওর মনটা ভেঙে যায়। কিছুক্ষণ পর বুড়ো ফেরিওয়ালা চাচাকে বাসার কথা জিজ্ঞাসা করলে বলেন,
– আমি কলোনির গেটের বাইরের উত্তর পাশের একটি বস্তিতেই থাকি।
রাতুল জিজ্ঞাসা করে,
– তুমিকি প্রতিদিনই কলোনিতে ফেরি নিয়ে আসো?
তিনি বলেন,
– না, মাঝে মাঝে আসি।
রাতুল বলে,
– এর জন্যই হয়তো তোমাকে আগে কখনো কলোনিতে দেখিনি।
– আচ্ছা তুমি এখন থেকে প্রতিদিন এই সময়ে এখানে গাছের নিচে আসতে পারবে?
তিনি বলেন,
– কেন?
রাতুল বলে,
– আমি তোমাকে প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে পানি পান করাবো।
ওর এই কথা শোনে বুড়ো ফেরিওয়ালা চাচা চোখের দুফোঁটা জল ফেলে এক অন্যরকম আনন্দ মাখা হাসি দিয়ে বলেন,
– ঠিক আছে আমি প্রতিদিনই আসবো। এই কথা শুনে রাতুল অত্যন্ত খুশি হয়।

Share.

মন্তব্য করুন