‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেলো শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।’

আল মাহমুদ। বাংলা কবিতার কিংবদন্তির নাম। বরেণ্য কবি। খ্যাতিমান কথাশিল্পী, প্রভাবশালী সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবি। জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক। আল মাহমুদ মানেই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রতিধ্বনি ও প্রতিচ্ছবি। ৮৩ বছর বয়সে অসংখ্য গুণমুগ্ধ স্বজন ও পাঠককে কাঁদিয়ে কবি পাড়ি জমালেন পরলোকের জগতে। তিনি আমাদের সকলের প্রিয় কবি আল মাহমুদ। বাংলা মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেলো অবশেষে।

আল মাহমুদের জন্ম ১১ জুলাই, ১৯৩৬ সালে; সাবেক কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মৌড়াইল গ্রামের মোল্লা বাড়িতে। সম্পূর্ণ নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ, ডাক নাম পিয়ারো। পিতা মীর আবদুর রব, মাতা রওশন আরা মীর, পিতামহ মীর আবদুল ওহাব, দাদি হাসিনা বানু।
কবির দাদা আবদুল ওহাব একজন লোককবি ছিলেন। তিনি জারিগান লিখতেন; আরবি ও ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন এবং সংস্কৃত জানতেন। লাঠিখেলা, তরবারি চালনা ও পশু-পাখি পোষা ছিলো তাঁর সখ। ধর্মপ্রাণ হলেও তিনি গান-বাজনা ভালোবাসতেন। কবির দাদি দীর্ঘাঙ্গি, রূপসী ও অত্যন্ত ব্যক্তিত্বশালী মহিলা ছিলেন। বাইরের জগতে দাদার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং বাড়ির ভেতরে দাদির মুখে শোনা কিচ্ছা-কাহিনীতে কবির শৈশব দারুণভাবে আলোড়িত হয়। দাদির স্নেহ-মমতা ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের গল্প তাঁর শিশুমনে প্রভাব বিস্তার করে।
আমার শৈশব তার উষ্ণ স্নেহের ক্রোড়ে অতিবাহিত হয়েছে। আমার অতি শৈশবের স্মৃতি বলে যদি কিছু থাকে তা হলো আমার দাদীর সেই পবিত্র মুখাবয়ব। পান খাওয়া লাল দুটি সুন্দর ঠোঁট ও তার মুখ নিঃসৃত অদ্ভুত সব রূপকথা। সিলেটে মুসলিম বীরদের আগমনকালের রোমাঞ্চকর কাহিনীর ভাণ্ডার যেন তার কাছে গচ্ছিত ছিলো। পরতে পরতে তিনি মেলে দিতেন ধর্মীয় আত্মত্যাগের সেই ইতিহাস।

[যেভাবে বেড়ে উঠি]
শৈশবেই মোল্লাবাড়ির সবচেয়ে উঁচু মজবুত ও কারুকার্যময় ঘরে কবির বসবাসের সুযোগ হয়। তাঁর শৈশবের সমস্ত স্বপ্ন ও কল্পনা প্রবণতাকে অধিকার করে ঘরটি। এই ঘরের জানালা দিয়ে কবি দাদির কোলে শুয়ে এ দেশের বিশাল বৈচিত্র্যময় আকাশ অবলোকন করেন। শিশুমনের স্বাপ্নিক অভিপ্রায় সেই আকাশের নীলিমায় উড়াল দিতো। দাদির মৃত্যু সেজন্যে তাকে প্রবলভাবে ধাক্কা দেয়। কবি শৈশবের অদৃশ্য খোলস ছাড়িয়ে কৈশোরে পদার্পণ করে। শৈশব-কৈশোরে কবির মানস গঠনে মহরম মাসে সংগঠিত বিভিন্ন খেলাধুলা ও গান-বাজনা প্রভাব বিস্তার করে। মুসলিম ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এতে জাগ্রত হয়।
মহরম মাসটা আমার শিশুমনে দারুণ প্রভাব বিস্তার করতো। বাড়ির মুরুব্বীরা আশুরার দিন পর্যন্ত দশ দিন রোজা রাখতেন। বিশেষ করে বাড়ির মেয়েরা বাড়িতে মার্সিয়া গাইয়েদের ডেকে এনে শোকগাথা শুনতো সবাই। জারি গান শুনাতে আসতেন কাউতলী, ভাদুগড় আর সিমরাইলকান্দি গ্রামের লোকেরা। সব গানই আমার দাদার লেখা। গানের ধুয়ার লাইনগুলো মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। এই পারিবারিক আবহাওয়া, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও পরিবেশের মাঝে বেড়ে ওঠা কবির মানসগঠনে সহায়তা করেছে। আল মাহমুদের কবিতার একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে নদী, নদীতীর ও নদীনির্ভর মানুষ ও প্রাণীকূল। শৈশবের নদী তিতাস তাঁর সারা জীবনের কাব্যযাত্রার সঙ্গী। এই তিতাসের সঙ্গে তাঁর মনপ্রাণের এবং নদীকেন্দ্রিক লোকঐতিহ্যের সংযোগ ঘটে শৈশবেই। এই নদীর সঙ্গে সখ্যতা কবির গড়ে ওঠে অগ্রজ কবি-শিল্পীদের কথা স্মরণে ও অনুপ্রেরণায়। তিনি নদীর স্রোতে নৌবিহারে গিয়ে ভাটি বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অবগাহন করেন। আমি ঠায় বসে ভাটি বাংলার এই রূপগন্ধময় দৃশ্যপট নিশ্বাসের সাথে টানতে টানতে আমার হৃদপিণ্ডে, রক্তে ও মস্তিস্কের স্মরণ কোষে চিরকালের মত জমা করে নিতে লাগলাম।
তাঁর কাব্যে প্রকৃতির যে বিপুল উপস্থিতি তা মূলত নদীকেন্দ্রিক এবং এই প্রকৃতি তিনি পেয়েছেন শৈশব-কৈশোরের ভ্রাম্যমাণ দিনগুলোতে। কবি নিজ গ্রামে প্রকৃতি ও গ্রামের সাধারণ মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছেন যথেষ্ট। তিনি আরো গভীরভাবে প্রকৃতি ও প্রাকৃতজনের কাছাকাছি আসেন, যখন চাচা-চাচির সাথে দাউদকান্দির জগতপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন। তাঁর কবিতায় পশু-পাখি, নিসর্গ, ফুল-পতঙ্গ, সাপ প্রভৃতির যে বর্ণাঢ্য উপস্থিতি ও লিপ্ততা সেটা এই গ্রামীণ পরিবেশ থেকেই তিনি পেয়েছেন।
প্রকৃতি ও প্রকৃতিলগ্ন জীবনের সঙ্গে কবি ঘনিষ্ঠভাবে মিশে গিয়েছিলেন। অসংখ্য নদী ও বিল-হাওড়ে মানুষের আহার্যের সন্ধান সম্পর্কে তিনি জেনেছিলেন। নৌকা বাইতে, দাঁড় টানতে, জাল ছড়াতে, বড়শি বাইতে, কুচ বা চল দিয়ে ধাবমান মাছ গেঁথে ফেলতে অর্থাৎ মাছ শিকারের যাবতীয় পদ্ধতি শিখেছিলেন। গ্রামের হাটে হাটে ঘুরে কিষাণ জীবনের প্রয়োজনীয় সবকিছুর সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে নিমড়ববিত্ত মানুষ; যেমন: জেলে, জোলা, কিষাণ, তাঁতি, কামার-কুমার, প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষের মাঝে অবাধে তাঁর মেলামেশার সুযোগ হয়েছে। সীতাকুণ্ডে এসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে অভিভূত এবং তাঁর একাকীত্ব অধিকার করে। শম্ভুনাথ পাহাড় বা চন্দ্রনাথ পাহাড়ের গা বেয়ে তিনি উপরে উঠে যেতেন। এক কথায়, প্রকৃতি ও প্রাকৃতজনের সঙ্গে খুব কাছাকাছি থেকে তাঁর উপভোগ, উপলব্ধি ও পরিচয় ঘটে। ঢাকায় বসবাসের পর থেকে আর কোনদিনই তিনি এই সুযোগ পাননি। কৈশোরিক কালে কবিজীবনের অর্জিত এই অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞান তাঁর কাব্যের মৌলিক ও প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। কবির কৈশোরেই সঙ্গীতের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী খাঁ পরিবারের ওস্তাদদের সুর ও সঙ্গীতর তরঙ্গ তাঁর কিশোর মনে প্রভাব ফেলে।
আল মাহমুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন নানা ঘাত-প্রতিঘাতে মাধ্যমিক স্তরের বেশি এগোয়নি।ত স্থানীয় মসজিদে ইমামের কাছে তাঁর ধর্মীয় শিক্ষা, দাদির কাছে প্রথম বর্ণ পরিচয় এবং গৃহশিক্ষক শফিউদ্দিন আহমদের কাছে পড়ালেখার সূচনা। গৃহশিক্ষকের কাছেই তিনি প্রথম বাংলার আদিত রূপকথার জগত ‘ঠাকুর মার ঝুলি’তে প্রবেশ করেন। লোককাহিনীর যে রঙিন ভুবনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটেছিলো শৈশবে, তা পরবর্তী কাব্যজীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘এম. ই. স্কুলে’ত তাকে প্রথম ভর্তি করা হয়। এখানে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর ভর্তি করা হয় সপ্তম শ্রেণীতে ‘জর্জ সিক্সথ হাই স্কুলে’; এরপর কুমিল্লার দাউদকান্দির ‘সাধনা হাইস্কুল’; চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ‘সীতাকুণ্ড হাইস্কুল’ এবং শেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘নিয়াজ মোহাম্মদ হাইস্কুলে’ লেখাপড়া করেন।
শুরু থেকেই স্কুলের পড়াশুনা তাঁর মোটেই আকৃষ্ট করেনি। পাঠ্য বইয়ের বাইরের জগৎ ও অপাঠ্য বইপত্র তাকে প্রবলভাবে হাতছানি দেয়। আমার স্বাধীনতার কোনো সীমা নেই। স্কুলে ঠিকমত গেলেও সবগুলো ক্লাস ঠিকমত করি না। এর মধ্যে আমার এক নতুন বিষয়ের দিকে ঝোঁক পড়লো, নেশার মত পেয়ে বসলো রোমাঞ্চকর বই পড়ার অভ্যাস। আর ছুটির দিনে গুলতি নিয়ে পাখি শিকারের সখ।
স্কুল পালিয়ে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা আর এ্যাডভেঞ্চারের গালগল্পতে কবির দিন কেটে যায়। কবি ও তাঁর বন্ধুদের একমাত্র পাঠ্য বিষয় হয়ে ওঠে দুঃসাহসিকতাপূর্ণ উপন্যাস, গোয়েন্দা গল্প ও ভ্রমণ কাহিনী। তাদের স্বপড়ব ছিলো বাড়ি থেকে দেশ-দেশান্তরে পাড়ি জমানো, যে স্বপ্ন স্কুলের পাঠ্য বইয়ে তারা খুঁজে পায়নি। সঙ্গে সঙ্গে কবি অর্জন করেন ভাষাজ্ঞান ও শব্দের অন্তর্গত অর্থ। অপাঠ্য বই-ই কবিকে বন্ধুত্ব ও স্বাভাবিক পরিবেশ থেকে পৃক করে দেয়। কৈশোরিক খেলাধুলা ও আনন্দ-ফূর্তির মুহূর্ত থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে কবি আশ্রয় নেন ‘চাঁদের পাহাড়’, মার্কোপলোর ভ্রমণ বৃত্তান্ত, পৃথিবীর মানচিত্র, জাতিবর্ণের পরিচয়, ভাষা, পোশাক, প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং রহস্যময় ভৌগোলিক বিবরণের জগতে। ব্যতিক্রম আচরণের কারণে সমাজে-বন্ধুমহলে তাঁর উপাধি হয়ে যা ‘কবি’।
বইয়ের টানেই বিচিত্র মানুষজনের সাথে কবির পরিচয় ঘটে। পরিচয়ের সূত্র ধরে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বনফুল প্রমুখের সাহিত্যে প্রবেশ করেন। ডিটেকটিভ উপন্যাস ও এ্যাডভেঞ্চারের গল্পের সীমা ছাড়িয়ে তিনি ধীরে ধীরে মননশীল ও উঁচু স্তরের সৃজনশীল সাহিত্যের পাঠ শুরু করেন। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় ‘লালমোহন স্মৃতি পাঠাগার’ অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
এই গ্রন্থাগারের কারণেই তিনি রবীন্দ্র-নজরুল পেরিয়ে তিরিশোত্তর কবি-লেখকদের জগতে প্রবেশ করেন। কাজী নজরুল ইলামের ‘অগ্নিবীণা’র বিদ্রোহাত্মক এবং জীবনানন্দ দাশের ‘মহাপৃথিবী’র সময়চেতন কবিতাগুচ্ছ তাঁর কৈশোরিক কবিমনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
কবি কৈশোরে ‘লালমোহন পাঠাগারে’ ব্যাপক ও গভীরভাবে অধ্যয়নের সুযোগ সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগান। অধ্যয়নের সেই ধারাবাহিকতা ঢাকার জীবনে এসে আর থাকেনি। জীবিকার সংগ্রাম, কবি-আড্ডা, অস্থায়ী আবাস এবং উত্তাল রাজনৈতিক তরঙ্গে কর্মস্থল ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ বারবার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কবি নিরচ্ছিন্নভাবে পাঠচর্চা করতে পারেননি। তবে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান দমনের অংশ হিসেবে তৎকালীন সরকার ইত্তেফাক পত্রিকা বন্ধ করে দিলে কবি চট্টগ্রামে ‘বইঘরে’র প্রকাশনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রামে থাকাবস্থায় কবির পড়াশোনার বিস্তৃতি ঘটে এবং ব্যাপকভাবে বইপত্রের জগতে প্রবেশ করেন।
চট্টগ্রামে প্রকৃতি ও বই পাঠে কবি গভীর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। বিশেষভাবে বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাম্যবাদ, সমাজতত্ত্ব, রাজনৈতিক অভিজ্ঞান এবং প্রেমকামের তাৎপর্য মন ও মননে ধারণ করেন। অধ্যয়ন ও অর্জনের প্রেক্ষিতেই তিনি চট্টগ্রামে থাকাবস্থায় রচনা করেন ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছ।
বিচিত্র পাঠ অভিজ্ঞতা তাঁর চিন্তাচেতনায় বারবার যেমন পরিবর্তন এনেছে, তেমনি কবিতায় বৈচিত্র্যময়তাও ঘটেছে। মার্কসবাদ, ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ এবং পৌরাণিক-লৌকিক বিষয়াদির বইপত্র কবিকে মেধা-মনন-প্রজ্ঞায় ঋদ্ধ করেছে; সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন। এক কথায়, অধ্যয়নেই বারবার কবি জীবন ও চিন্তাস্রোতের বাঁকবদল ঘটেছে। রাজনৈতিক সচেতনতা থেকেই কবি বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলনে যোগ দেন ও কর্মতৎপরতা চালাতে থাকেন।
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?
বরকতের রক্ত।
ভাষা-আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির জন্য চাঁদা সংগ্রহ, রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কবির কৈশোরেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভাষা-আন্দোলন কমিটির লিফলেটে চার লাইনের একটি কবিতা ছাপা হলে তাকে ধরতে বাড়িতে পুলিশ হানা দেয়। ভাষা ও দেশের প্রতি দায় ও প্রেম থেকে কবির রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা আসে। পরবর্তীকালে ঢাকার জীবনে গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বামধারার রাজনীতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
একটি ঐতিহ্যবাহী, সম্ভ্রান্ত ও সচ্ছল পরিবারে কবির জন্ম হলেও কৈশোরেই পিতার ‘ব্যবসায় ক্রমাগত অসাফল্য ও ব্যর্থতা’ তাদের পরিবারকে দারিদ্র্যে নিমজ্জিত করে। তাদের কাপড়ের দোকান বন্ধ হলে এবং ফায়ার সার্ভিসে চাকরি নিয়ে পিতা চলে গেলে কবি অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে যান। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় আর কখনোই মনোযোগী হতে পারেননি। বাউণ্ডুলেপনা, কবিতাচর্চা, সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মকা-, ব্যাপকভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন তাকে প্রচলিত পথে অগ্রসর হতে দেয়নি। তবে জীবন বাস্তবতার জন্যে ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকায় আসেন স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যে, জীবন-জীবিকার প্রয়োজনেই; তবে কবি হওয়ার স্বপ্ন ছিলো তাঁর চোখে ও মনে।
পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে আমি একটা টিনের সুটকেস নিয়ে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে এসে নামলাম। সম্ভবত সেটা ছিল শীতকাল। সন্দেহ নেই আমি কবি হওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এ প্রাচীন মোগলাই শহরে পা রেখেছিলাম। একদিকে কবি হবার ‘প্রতিজ্ঞা’; অন্যদিকে জীবনধারণের প্রয়োজনেই কবি ঢাকা এসে ওঠেন এক সময়ে দাদার বাড়ির গৃহশিক্ষক ও স্বল্পখ্যাত লেখক লুৎফর রহমানের কাছে, নবাবপুরের দিনমজুরের হোটেলে। সেখানে থেকে লুৎফর রহমানের মাধ্যমে ‘দৈনিক মিল্লাতে’ প্রুফ রিডার হিসেবে কাজে যোগদান করেন। নজমুল হক সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক কাফেলা’য় লেখালেখির সূত্রে যাতায়াত শুরু করেন এবং এক সময় সহযোগী সম্পাদক কবি আবদুর রশীদ ওয়াসেক পুরী এই পত্রিকা ছেড়ে চলে গেলে আল মাহমুদ সম্পাদনার দায়িত্ব পান। ১৯৫৭-তে বিয়ে করার পর ‘কাফেলা’ ও ‘মিল্লাতে’র সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে যান। ঘুঙ্গুর-শালদা নদী স্কীমের অধীনে নবীনগর থেকে সিদ্ধেশ্বরী পর্যন্ত খাল খননরত ড্রেজার বালেশ্বরে ‘গেজ রিডার’ হিসেবে কাজ করেছেন বৎসরাধিক। জীবিকার প্রয়োজনে এ সময় তিনি লাইফবয় সাবান সাইকেলে করে ফেরিও করেন।
আবার পিতার নির্দেশে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন (১৯৬৩) এবং ‘দৈনিক ইত্তেফাকে’ প্রুফরিডার হিসেবে যোগদান করেন। এ সময় তাঁর আর্থিক সচ্ছলতা কিছুটা ফিরে আসে। ৬৯-এর উত্তাল গণঅভ্যুত্থানের ফলে সরকার আবার ইত্তেফাক বন্ধ করে দেয়। কবি আবারো অনিশ্চয়তার মাঝে পড়ে যান; কিন্তু বাংলা একাডেমীর পুরস্কার (১৯৬৯) তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দয়। প্রাপ্ত অর্থ সেই দুঃসময়ে অত্যন্ত সাহায্য করেছে তাকে।
কবি ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’ নামে অসামান্য ছড়াগ্রন্থ লিখেন। শিশু-কিশোরদের জন্য স্মরণীয় সব ছড়া লিখেন:
আম্মা বলেন, পড়রে সোনা
আব্বা বলেন, মন দে;
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
অথবা
তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য
আমি না হয় পাখিই হবো
পাখির মতো বন্য।
কবি শিশুর কল্পনা, স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, সংকল্প সম্ভাবনা নিয়ে লিখেছেন আপন ভঙ্গিতে। পরে লিখেন : ‘একটি পাখি লেজ ঝোলা’ ও ‘ মোল্লাবাড়ির ছড়া’।
বাংলাদেশের মানুষ, প্রকৃতি, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিশ্বাস নিয়ে কবি কবিতা ও ছড়া লিখেন অসাধারণ চিত্রকল্প, উপমা-উৎপ্রেক্ষা-রূপকের মাধ্যমে।
আল মাহমুদ দৈহিকভাবে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন; কিন্তু তাঁর অমর কীর্তি চিরন্তন বেঁচে থাকবে বিশ্বসাহিত্যে- বাংলাদেশের কবি হিসেবে।

Share.

মন্তব্য করুন