সমুদ্রের তলায় লুকিয়ে আছে কতই না ঐশ্বর্য, আর কতই না রহস্য! এভাবে সমুদ্রের তলায় রহস্যের সন্ধান করতে গিয়েই বিজ্ঞানীরা এক চরম বিস্ময়ের খোঁজ পেলেন, যা ছিল এক কথায় অবিশ্বাস্য! পৃথিবীতে মহাদেশ সাতটি অনেকেই এটা জানেন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাঁরা এমন এক বিস্তৃত এলাকার সন্ধান পেয়েছেন, যেটি অষ্টম মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতিত পাওয়ার যোগ্য। প্রথম দিকে অনেকেই দ্বিধান্বিত ছিলেন এই ভেবে যে, সত্যিই কি তারা আবিষ্কার করতে চলেছেন কোটি কোটি বছর ধরে প্রশান্তমহাসাগরের নিচে লুকিয়ে থাকা নতুন এক মহাদেশ!
বিজ্ঞানীদের সন্ধান পাওয়া নতুন এই বিস্তৃত এলাকা লুকিয়ে আছে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে! নিউজিল্যান্ড এই মহাদেশের পানির ওপরে থাকা একমাত্র অংশ। বাকি সবটুকু পানির নিচে। এই মহাদেশের নাম দেয়া হয়েছে নিউজিল্যান্ড ও ইন্ডিয়া দুই দেশ মিলিয়ে। বিজ্ঞানীরা এই মহাদেশটির নাম দিয়েছেন জিল্যান্ডিয়া। আকারে এটি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সমান।
সাগরতলে মহাদেশ১৯৯৫ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ব্রুস লুয়েন্ডিক ‘জিল্যান্ডিয়া’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। ১৯৬০ সালে সমুদ্রের নিচে তেলের খনি অনুসন্ধানের সময় এই মহাদেশের অস্তিত্ব খুঁজে পান বিজ্ঞানীরা। তারপর জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আরো বিস্তৃত গবেষণাকার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। এ সময় বিজ্ঞানীদের হাতে এমন কিছু তথ্য আসে যার ওপর ভিত্তি করে তারা জিল্যান্ডিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হন। বিজ্ঞানীদের মতে, জিল্যান্ডিয়া দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের পানিতে তলিয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিউজিল্যান্ড আসলে এই মহাদেশেরই জেগে থাকা অংশ। বলা যেতে পারে, এই মহাদেশের পর্বতচূড়া।
সমুদ্রতলদেশ থেকে প্রায় ১২,২১৭ ফুট উচ্চতায় এই মহাদেশের অবস্থান। নিউজিল্যান্ডের জিএনএস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষকদের দীর্ঘ ছয় বছরের গবেষণায় উঠে আসে মহাদেশটি সম্পর্কে নানা অজানা তথ্য। মহাদেশটি খুবই সম্পদশালী। এর সমুদ্রের নিচে রয়েছে বিপুল পরিমাণের জীবাশ্ম জ্বালানি, যা পৃথিবীর ভবিষ্যতের দীর্ঘ সময়ের জ্বালানির চাহিদা মেটাতে সক্ষম। এর মূল্য হবে বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। বিজ্ঞানীদের দেয়া তথ্য মতে, ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে অস্ট্রেলিয়া এবং অ্যান্টার্কটিকার চেয়ে একেবারেই আলাদা হবে এই জিল্যান্ডিয়া মহাদেশ।
৬-৮.৫ কোটি বছর আগে এটি অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং ক্রমাগত পানির নিচে নিমজ্জিত হতে থাকে। পরবর্তীতে ৮.৫-১৩ কোটি বছর আগে জিল্যান্ডিয়া অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ ও অ্যান্টার্কটিকা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, ২৩ কোটি বছর আগে সম্ভবত মহাদেশটি সম্পূর্ণ নিমজ্জিত ছিল। বর্তমানে মহাদেশটির সিংহভাগই প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে নিমজ্জিত। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম মহাদেশীয় ভূখন্ডাংশ বা অনুমহাদেশ যার আয়তন প্রায় ৪৯,২০,০০০ কিলোমিটার।
সাগরতলে মহাদেশজিওলজিক্যাল সোসাইটি অব আমেরিকায় প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে বিজ্ঞানীরা বলেন, জিল্যান্ডিয়ার আয়তন প্রায় ৫০ লাখ বর্গকিলোমিটার যা পার্শ্ববর্তী অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের সমান। কিন্তু জিল্যান্ডিয়ার প্রায় ৯৪ শতাংশই তলিয়ে আছে সাগরের পানিতে। মাত্র অল্প কিছু অঞ্চল পানির ওপর মাথা তুলে আছে, যেমন নিউজিল্যান্ডের নর্থ ও সাউথ আইল্যান্ড এবং নিউক্যালেডোনিয়া। আর মহাদেশের স্বীকৃতি পেতে যা যা দরকার, জিল্যান্ডিয়া তার সব ক’টিই পূরণ করেছে বলেও দাবি করছেন বিজ্ঞানীরা। এখন তারা চেষ্টা করছেন নব আবিষ্কৃত তলিয়ে যাওয়া ভূখণ্ডের জন্য মহাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের।
এটাকে মহাদেশ হিসেবে বিবেচনা করার জন্য গবেষকরা বলেন, একটি মহাদেশ হতে হলে যে ধরনের উপাদান থাকতে হয় এর মধ্যে সেগুলো রয়েছে। এখানে উচ্চ ভূমি, স্বতন্ত্র ভূতত্ত্ব, সীমানা এবং সমুদ্রের তলদেশ গতানুগতিকতার চেয়ে বেশি ঘন। এই আর্টিকেলের প্রধান লেখক নিউজিল্যান্ডের ভূতত্ত্ববিদ নিক মরটিমার বলেন, জিল্যান্ডিয়া নিয়ে বিজ্ঞানীরা দুই দশকের বেশি সময় নিয়ে গবেষণা করেছেন। গবেষকরা বলেন, একটি মহাদেশ হতে যা দরকার তার চেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব রয়েছে এই জিল্যান্ডিয়ার।
সাগরতলে মহাদেশজিল্যান্ডিয়ার কিছু মাটি ও পাথরের নমুনা নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন। এর মাটির সাথে মহাদেশ ভিত্তিক যে ভূখণ্ড রয়েছে তার আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে। কিন্তু সমুদ্রের তলদেশের গঠনের সাথে এই মাটির কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই জিল্যান্ডিয়াকে মহাদেশ হিসেবে বিবেচনা করার জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ১১ জন ভূতাত্ত্বিকের দীর্ঘ গবেষণার ফলাফল এই যে, একটি মহাদেশ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় চারটি বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান জিল্যান্ডিয়ার। এর মধ্যে আছে ভূখণ্ডের উচ্চতা, মহাসাগরীয় ভূত্বকের তুলনায় উচ্চ অবস্থান, বৈচিত্র্যময় ভূখণ্ডের আগ্নেয়গিরি, রূপান্তরিত ও পাললিক শিলার উপস্থিতি এবং সমুদ্রের তলদেশের ঘনত্ব গতানুগতিকতার চেয়ে বেশি- এসব বৈশিষ্ট্য। ফলে মহাদেশ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার জন্য অবস্থানে আছে জিল্যান্ডিয়া।
একদল গবেষক জানিয়েছেন আপাতদৃষ্টিতে জিল্যান্ডিয়াকে বৃহৎ এবং সমন্বিত এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। এর অর্থ দাঁড়ায়, জিল্যান্ডিয়াকে মহাদেশ হিসেবে দাবি করা যায় না। এমন যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন একদল গবেষক। কিন্তু সম্প্রতি স্যাটেলাইট প্রযুক্তি এবং সমুদ্র তলের মাধ্যাকর্ষণ মানচিত্র ব্যবহার করে জিল্যান্ডিয়াকে একটি সমন্বিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সমুদ্রের প্রায় ৩,২৮০ ফুট নিচে নতুন এই মহাদেশটির সীমারেখা দেখতে পাওয়ার পর থেকেই তার ওপর ভিত্তি করে ভূতাত্ত্বিকগণ জিল্যান্ডিয়াকে মহাদেশ হিসেবে মেনে নেয়া যায় বলে জোরালো অভিমত ব্যক্ত করেন।
সাগরতলে মহাদেশতবে জিল্যান্ডিয়াকে ৮ম মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। যদি ভবিষ্যৎ গবেষণায় এটিকে মহাদেশ হিসেবে স্বীকার করা হয়, তবে মহাদেশ সাতটি নয় হবে ৮টি।
এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অ্যান্টার্কটিকা, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়া- এই সাতটি মহাদেশের বাইরে অষ্টম মহাদেশ হিসেবে ‘জিল্যান্ডিয়া’কে তালিকাভুক্ত করার জন্য বিজ্ঞানীরা জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। যদি এটি মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তবে ৪.৯ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার আয়তনের জিল্যান্ডিয়া হবে পৃথিবীর অষ্টম এবং ক্ষুদ্রতম মহাদেশ। আশা করা যাচ্ছে এখন থেকে মানচিত্রে জিল্যান্ডিয়ার অবস্থান নতুন করে দেখানো হবে। সাতটি মহাদেশের সাথে যোগ হবে নতুন আরেকটি মহাদেশ।

Share.

মন্তব্য করুন